‘খবরদার! আমার মাকে নিয়ে একটাও খারাপ কথা বলবেন না’ তেরো বছরের তিনুর মাথায় খুন চেপে গেলো, তার দুচোখে আগুন। এমনিতে তিনু খুব শান্ত, সাত চড়ে রা কাড়ে না। রোজ ভোরবেলায় উঠে সকালের লোকাল ধরে ডানকুনি থেকে চলে আসে শিয়ালদায়। এখানে এই ভাতের হোটেলে কাজ করছে একবছর হলো। মাইনে ছাড়াও সকালের জলখাবার আর দুপুরের খাওয়াটা ফ্রি। ছুটি পায় রাত আটটায়। মালিক খুব বদরাগী। একটু কিছু ভুল হলেই চিৎকার করে মারতে যায়। অশ্লীল গালাগাল দেয়। সেই সব সময় দুর্বিসহ কষ্টে আর অপমানে তিনুর চোখ ফেটে জল আসে। মন বিদ্রোহ করতে চায়, কিন্তু ঠিক তখনি তার মায়ের অসহায় মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠে সব গোলমাল করে দেয়। তিনু শান্ত হয়ে মুখ বন্ধ করে আবার কাজ করে।
কিন্তু সেদিন আর সহ্য করতে পারলো না। ভাত তরকারী সমেত একটা প্লেট তার হাত থেকে পড়ে ভেঙে যেতেই হোটেল মালিক একটা হুংকার দিয়ে খদ্দেরদের সামনেই চিৎকার করে উঠলো- ‘এর দামটা কে দেবে রে ঢ্যামনা। তোর পাঁচভাতারে মা?’
তিনু এই গালাগালটা আগেও শুনেছে। পাড়ার কিছু বখাটে ছেলে মাঝেমাঝে বলে। কিন্তু তিনু তার মাকে ভীষণ ভালবাসে। সে দেখেছে তার বাবা যেদিন রেলে কাটা পড়লো আর তিনজনের সংসারটা রাতারাতি ভেসে গেলো। সে দেখেছে সে আর তার মার প্রতিদিনের জীবনংসগ্রাম। ছ’টা বাড়িতে বাসন মাজার কাজ করে তাদের বেঁচে থাকার লড়াই। তাই এদিন আর সে সহ্য করতে পারলো না। মরিয়া হয়ে সে রুখে দাঁড়িয়েছে। উত্তেজনা আর রাগে সে বলে উঠলো, ‘খবরদার, আমার মাকে নিয়ে একটাও খারাপ কথা বলবেন না’। মালিককে তার দিকে তেড়ে আসতে দেখেই টেবিল থেকে একটা কাঁচের গেলাস সজোরে ছুঁড়লো তার কপাল লক্ষ্য করে। সব খদ্দেররা উঠে এলো। হৈ হৈ চিত্কারের মধ্যেই মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেলো তিনু। তারপর জনবহুল রাস্তা দিয়ে দৌড় আর দৌড়। জোরে আরও জোরে। কয়েক মিনিটেই মিশে গেলো জনারণ্যে।
ডানকুনি ষ্টেশনের কাছে চায়ের দোকানের মালিক গঙ্গাদা তাকে খুব ভালবাসে। সেদিন অসময়ে তিনুকে ফিরে আসতে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে রে? চোখ মুখ বসে গেছে। আমায় বল।’ ক্লান্ত, বিধ্বস্ত তিনু ধপ করে একটা টুলে বসে পড়লো। গঙ্গাদা পরম স্নেহে তার গায়ে মাথায় হাত বোলাতেই তিনু হাউ হাউ করে কেঁদে সব ঘটনাটা বললো। সেই সময় একটু দূরেই বসেছিলেন ঐ অঞ্চলের দাপুটে কাউন্সিলর রতনবাবু। তিনুকে কাছে ডেকে বললেন, ‘আহারে এর বাবা-মা কেমন মানুষ। একেবারে পাষণ্ড। কোথায় একে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করবে, না এই একরত্তি ছেলেকে বাইরে পাঠিয়েছে পয়সা রোজগার করতে’।
তিনু ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। সে চোখের ভাষা, তার চাপা বেদনা কাউন্সিলর বুঝবেন কী করে। কেমন করে জানবেন এক অসহায় মা আর ছেলের বেঁচে থাকার রোজনামচা। গঙ্গাদা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, উনি ইশারায় থামিয়ে দিলেন। তারপর তিনুর একটা হাত ধরে বললেন, ‘তোমাকে আমি কাছেই একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করে দিতে পারি। শুধু মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। কে বলতে পারে তুমিই হয়তো একদিন বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা আইএএস হবে। বলো কোনটা হতে চাও’।
তিনু বিস্ফারিত দুচোখে তাকিয়ে থাকলো। বুঝতে পারছে না কী ভাষায় কথা হচ্ছে। এবার গঙ্গাদা কাছে ডেকে নিল। বলল, ‘স্যার, জিজ্ঞেস করছেন, জবাব দে। কী হতে চাস? ডাক্তার না ইঞ্জিনিয়ার?’ তিনু অস্ফুটে কিছু বলতে চাইছিল। গঙ্গাদা বলল, ‘জোরে বল, উনি শুনতে চাইছেন’।
শরীরে সমস্ত শক্তি একত্র করে হাড় পাঁজরা ভেদ করে একটা চিৎকার শোনা গেলো – ‘গঙ্গাদা আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে। আমি ভাত খাবো। অনেক ভাত, অনেক অনেক ভাত, পেট ভরে’।
Tags: অনিলেশ গোস্বামী, গল্প, ভাত
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।