ঝাঁ-চকচকে পিচরাস্তাটা ধরে যেতে যেতে কুড়ানী ভাবল,সত্যিই দেশটার কি উন্নয়ন! আর মানুষ গুলোর কোনো ভাবনা নেই।বর্ষাতে আর ছ্যাপ-ছ্যাপে কাদা মাড়িয়ে,লুঙি-কাপড় গুটিয়ে খালি পায়ে হাঁটতে হবে না কাউকে।গ্রামের ছেলে-মেয়ে গুলোকে আর ঠেলে-ঠেলে সাইকেল পার করে স্কুলে যেতে হবে না—এখন পাকা রাস্তা!লোকের কথা চিন্তা করলে কি হবে,কুড়ানী নিজে কখনও জুতো পরে না।জুতো থাকবে কি করে ওর পায়ে?খালি পায়ে চলে চলে পা গুলো যে শক্ত ইঁট হয়ে গেছে!সেই ইঁট-পা যদি একবার ঠেলে-গুঁজে জুতোর ভেতর ঢুকোয় তাহলে ফটাং করে ফিতে-মিতে ছিঁড়ে কোনদিকে উড়ে যাবে।তখন জুতো পরার শখ মিটে যাবে কুড়ানীর।পাকা রাস্তা ধরেই মাথায় ভারি ঝুড়ি নিয়ে খালি পায়ে লদর-পদর করে ঘরমুখো কুড়ানী।
খাল-বিল,পুকুর,মাঠ-ঘাট দেখে বাগ্দীরা ঘর বেঁধেছে।সেই বাগ্দী পাড়ার মাঠের ধারে অনাদীকে নিয়ে ঘর বেঁধেছিল কুড়ানী।একদমে এতটা রাস্তা ভারি ঝুড়িটা বইতে পারে না।থপাস করে নামিয়ে বটতলায় বসে পড়ে।আর মাঠকুড়া-বিলকুড়ার পরনের যে শাড়িটা হাঁটু অবধি সাঁটা,গাঁয়ে ঢোকার আগে সেটা ঠিক করতে হবে না?
বটগাছের এখন কোনো চিহ্ন নেই,খালি নামটাই রয়ে গেছে।পিচরাস্তাটা করার সময় কাটা পড়েছে।কয়েকদিন কারও চোখে ঘুম থাকেনি।রাত নেই,দিন নেই—শুধুই ঘষর-ঘষ,ঘষর-ঘষ।তিনদিনের দিন ভোরের দিকে মড়-মড়,চড়-চড় ধপাস করে একটা শব্দ উঠেছিল মাত্র।সেই শব্দ শুনে তড়াক করে জেগে উঠল গাঁয়ের মানুষ।কি হল,কি হল?এসে দেখল রাস্তা বন্ধ।রাস্তা বন্ধ হবে না কেন?সেই বুড়ো বটটা যে ঠ্যাং-ম্যাং উপর দিকে তুলে আড়া-আড়ি ভাবে শুয়ে পড়েছে।নাও এবার বোঝো ঠেলা!গুড়ি,ডাল-পালা পিস পিস করে কাটতে আবার তিনদিন।বুড়ো বটগাছটা কি আর এক-দু’শো বছরের বুড়ো?কয়েক শো বছরের ইতিহাসের সাক্ষী।
কুড়ানী শাড়িটা ঠিক করে ঝুড়িটা মাথায় তুলে নিল।তারপর একদমে রায়পাড়া পেরিয়ে বাগ্দীপাড়া।সারাদিন কম পরিশ্রম হয়েছে! ঘটিংডাঙার বিল,জিওলনালার পাড়,ভাড়ালগোড়ের পোড়ো জমিতে ঘাস জন্মেছে বিস্তর।ঘোষপাড়ার বাগালরা পাল-পাল গোরু-মোষ চরায়।ঘাস খেয়ে খেয়ে পেটগুলো যখন ডিগডিগে হয়ে যায়,তখন পেছন দিকে বেরিয়ে যায়—সারা মাঠময় শুধু থপাস-থস,থপাস-থস শব্দ উঠে।আর কুড়ানীর মতো বিলকুড়া-মাঠকুড়া মেয়েমানুষরা পেছন-পেছন ঝুড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।এখন কিছু ঘুটে করে রাখলে সামনের বর্ষাটা নিশ্চিত।
তালপাতার সড়ক দেওয়া রান্নাশালের চালার ছেঁচাকোলে ঝুড়িটা নামিয়ে রাখল কুড়ানী।বর্ষাকালে ঝিট ঢুকে পড়ে।থাকার ঘরটাও খুব একটা ভালো নয়।ঝিটেবেড়া খড়ের ছাওনি দেওয়া মাটির একখান ঘর।এখন তিনটি প্রাণী মাথা গুঁজে কোনরকমে থাকে।
পাড়ার মধ্যে অনাদীর দাদা শ্যামাচরণের অবস্থা বিশাল।ওর ছেলেটা বাইরে কাজ করে,মাস গেলে থোক থোক টাকা পাঠায়।এবছর ইন্দিরা আবাসের ঘর পেয়েছে;কিছু টাকা যোগ করে একতলা দালানবাড়ি তুলেছে।আর দেওর মদন পিক-আপ ভ্যান চালায়,প্রতিদিন রোজগার।কুড়ানীদেরও আয়-উন্নতি হয়ে যেত,যদি অনাদী না খ্যাপা হয়ে যেত।আগে ভালোই ছিল মানুষটা।মাস গেলে বাঁকুড়ার হাসপাতালে দেখিয়ে আনত।শেষের দিকে কি যে হয়ে গেল…।
(২)
কুড়ানীর মেয়ে ফুলকি একদিন বলল, ‘বাবা মুনে হয় একেবারে খ্যাপা হয়ে গেইচে,তার লিগে মুনে করে ঘর আসতে লারচে লই মা?’
কুড়ানী বলল, ‘মিনষেটার কথা বাদ দে তো- যেখানে আছে থাকুক গে,পঁচে মরুক গে।’
ছেলেমেয়ের সামনে যাই বলুক মানুষটার উদ্দেশ্যে,অবসর সময়ে ওকে নিয়ে চিন্তা হয়।আগে ও যেখানেই থাকুক,একমাস-দু’মাস পর ঠিক চলে আসত;কিন্তু এবারে একবছর পেরিয়ে গেল তবুও আসার নাম নেই।গালে হাত দিয়ে ভাবে,বুকের ভেতরটা খাঁ-খাঁ করে উঠে।
ফুলকিকে স্কুলে ভর্ত্তি করেছে কুড়ানী।ছেলে লখাটার মতো যেন বোকা না হয়।লখাটা যদি পড়াশোনা করত তাহলে কি আজ এই অবস্থা থাকত!কথায় বলে, ‘মাথার উপর ছাতা নাই/জলের কোনো বাধা নাই।’ সেই হয়েছে কুড়ানীর অবস্থা। সেদিন মল্লিকপাড়ার ছমিরের ব্যাটা বলল যে – কুড়ানীর চালা ঘরটার লুকিয়ে-লুকিয়ে ছবি তুলেছে মদন।ছবিগুলো দরখাস্তের সঙ্গে ব্লকে জমা দিয়েছে,এবারে ওর ঘর কে আটকায়।
কুড়ানী বলেছিল, ‘তা বাপ আমার,আমি কি ঘর-দুয়োর পাব নাই?ভোট দিই না কি?’
‘সব লটের পর লট আসছে তো।’ একটু ঢোক গিলে বলেছিল, ‘সামনের ভোটটা পেরক,তারপর দেখছি।’
কুড়ানী জানাশোনা কয়েকজনকে বলে রেখেছে।তারা দেখছি-দেখছি করে বছরের পর বছর পার করে দিল।কবে ঘর পাবে কে জানে!তাছাড়া সরকার তো আর মাটির ঘর রাখছে না,কুড়ানীও পাবে নিশ্চই।
লখাটার কোনোদিকে ‘হেলদোল'(খেয়াল)নেই।যা রোজগার করে তার অর্ধেক মদ খেয়েই শেষ করে দেয়।বাপের মতো হয়নি ছেলেটা।শাসন করতে গেলে পাল্টা জবাব দেয়, ‘ছেলে হয়েচি কিত্তে,আমদ-ফূর্তি করব নাই?’ এখন বড় হয়ে ‘পোজ-পাজ’ দারুণ!হাতে সুতো বেঁধেছে,পেছনে বড়-বড় চুল,মাঝে টেরি কাটে।মেয়েদের মতো কান ফুঁড়িয়েছে ছোকরা।ক্লাবের ছেলেগুলোর সঙ্গে মিশে-মিশে যত্তসব বদ অভ্যাস ধরেছে।ছেলেগুলোও যেমন হয়েছে।পুকুরপাড়ে কিংবা ফাঁকা মাঠে যদি কারও হাঁস-মুরগী পেয়েছে,তবে তাকে আর প্যাঁক-প্যাঁক করারও সময় দেয় না,তার ‘লেতার’ চুকিয়ে ছাড়ে।ক্লাবে তখন ফিস্টি হয়।চুল্লু মালের সাথে জমে উঠে সেদিনটা।
কুড়ানীর শ্বশুর বেঁচে থাকতে অনাদীকে পাঁচ কাঠা জমি দিয়েছিল।সেই থেকেই সবাই মুখ ঘুরিয়ে থাকে।ভাসুর শ্যামাচরণের সঙ্গে তো ‘রা-সা’ নেই।দেওর মদন তাহলেও সাড়া দেয়,তবে কুড়ানী বুঝতে পারে তাকে একনজর দেখতে পারে না।ওদের কলে জল নেয় কুড়ানী। সেদিন কলতলায় রক্তের মতো লাল ‘একল্যাদা’ তামুক ফেলেছিল থু করে। মদনের চোখে পড়তেই কথার কি ঝাঁঝ!দপ করে জ্বলে উঠে। ‘তুকে কতবার মানা করব বলদিনি বৌদি,কলতলায় থুতু ফেলিস না,ফেলিস না।দেখে গা ঘিন-ঘিন করে আমার।’
মদন চলে যেতে মুচকি হেসে মদনের বউ খরখরি বলেছিল,ওর কথায় কিছু মনে কর না দিদি।উ ওরকমই মানুষ,কথার ছিরি নাই।’ মদনের বউ খরখরিই একটু অন্যরকম।কুড়ানীকে ভালবাসে,সময় পেলে উঁকুন বেছে দেয়।
(৩)
পালদের বড় পুকুরের পাড়ে তেঁতুল গাছটার তলায় একদিন একটা লোক এসে বসল। মলিন ছিন্নবিচ্ছিন্ন জামা,বড়-বড় চুল,গোঁফ-দাড়ি ভর্তি মুখ।লোকটা জোরে-জোরে প্রলাপোক্তি করে চলেছে।মদনের বউ খরখরি পুকুরের গাবায়-গাবায়,মানে খালধারের রসালো মাটিতে কলমি শাক তুলছিল পেঁছে নিয়ে।পুকুরের পাড়ে-পাড়ে হাঁটছিল ছোট মেয়ে পুঁটি।লোকটার বিভৎস ভঙ্গি দেখে পুঁটি ভয়ে-ময়ে প্যাঁ করে কেঁদে ফেলল।খরখরি মাথা তুলে দেখল লোকটাকে।তারপর নিজের মনেই বলল, ‘হেই লো খ্যাপাটা আবার এইচে,সবার চোখের ঘুম কেড়ে নিবেক লো!’ পুঁটির কান্না দেখে তাড়াতাড়ি কোলে তুলে নেয়। ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে মেয়েটা।খরখরি আদর করে, ‘না মা কাঁদিস না,কাঁদিস না….ও তুর অনাদী জ্যাঠা,কিছুই করবেক নাই।’
খ্যাপাটা আপন মনেই বকতে বকতে কি মনে করে উঠে পড়ে।পাশ কাটিয়ে যাবার সময় পুঁটির দিকে কট-মট করে চেয়ে দাঁত গুলো ফেঁড়ে হি-হি করে হেসে চলে গেল।
রায়পাড়ায় ঢুকেই বংশির গুমটিটার সামনে দাঁড়াল। বংশি ভ্রু কুচকে তাকাল ওর দিকে। ঝলংপটং সুট প্যান্ট,ছেঁড়া জামা,মুখ ভর্তি দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। পকেটে কাগজ,পোয়াল,পলিথিন যত পেরেছে গুঁজে রেখেছে।সামনে ঝোলানো বাচ্চাদের খাবার-দাবার। সেগুলোর দিকে লালসার দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর দাঁত ফেঁড়ে হি-হি করে হেসে বলল, ‘কই দে,বিস্কুট দে দিনি।’
কতক গুলো ন্যাংটো-পোংটা ছেলে মারবেল খেলছিল।ওরা খেলা থামিয়ে লোকটাকে দেখল। একজন বলল, ‘হায় দেক ফুলকির বাবা এইচে।’
বংশি বলল, ‘কুথায় ছিলিস এতদিন?’ খ্যাপাটা কোন জবাব দেয় না। আবার বলে, ‘দে না খুড়ো,খুব খিদে পেইচে।’ বংশি কাচের বয়েন থেকে বিস্কুট বের করে ওর হাতে দেয়।খেতে খেতে চলে গেল।
স্কুল থেকে এসে ফুলকি উঠোনের এক কোণে বেতের মোড়াতে বসে শেষ বিকালের রোদটাকে গায়ে মাখছিল।কুড়ানী তালাই পেতে শুয়েছিল।সারাদিন খাটুনির পর একটু ‘আলিশ’ এসেছিল চোখে।ঠিক সেই সময় খ্যাপাটা উঠানের একটু দূরে শিরীষ গাছটার তলায় দাঁড়াল।ফুলকি প্রথমে চমকে উঠেছিল,তারপর ভাল করে চেয়ে দেখল লোকটাকে। চিনতে পারল। বাবা!কতদিন দেখেনি বাবাকে…কতদিন! মুখটা দাড়ি-গোঁফে বুজে গেছে,তেল না পড়ে পড়ে মাথার চুলে জটাধরা ভাব।কতদিন স্নান করেনি কে জানে!ফুলকি মা কে হাতের ঠেলায় নাড়াল, ‘এই মা,মা,মাগো।’
কুড়ানী ঘুমের ঘোরের মধ্যেই বলে, ‘কি হয়েচে কি?’
ফুলকি আঙুল বাড়িয়ে দেখায়, ‘হউ দেক মা,বাবা এইচে।’
কুড়ানী খিদিবিদি করে উঠে পড়ল। চেয়ে দেখল,শিরীষ গাছের নিচে খ্যাপা মানুষটা বসে আছে।কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল কুড়ানী আর ফুলকি।শুধু শুধু চাওয়া নয়,এই চাহনি আদিম মানুষটার ভেতর থেকে একজন কে খুঁজে নেওয়ার। অনাদীও ফ্যাল-ফ্যাল করে চেয়ে আছে। যে মানুষটাকে নিয়ে জীবনের এতগুলো বছর কাটাল,তার এমন দুর্দশা! আর চেনায় যাচ্ছে না। চুল-দাড়ি ভর্তি মুখ,কোটরস্থ চোখ,না খেয়ে-খেয়ে একেবারে ক্যাংলাস হয়ে গেছে শরীরটা।
ইতিমধ্যেই অনেকে খবর পেয়ে গেছে অনাদী বাড়ি ফিরেছে।ছাদের উপর দাঁড়িয়ে শ্যামাচরণের বউ মঙ্গলী এবং তার ছেলের বউ ফুলটুসি এক ঝলক তাকিয়ে দেখল অনাদীকে।কুড়ানীর চোখে চোখ পড়তেই সট করে সরে পড়ল। উঠানের পাশ দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছিল কাঙালের মা।অনাদীকে দেখে সেও কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়াল। কাছে এসে বলে, ‘কুতায় ছিলিস বাপ অ্যাতদিন?’ অনাদী কোন কথা বলল না। সে এখন মৌনব্রত পালন করছে।তা দেখে কাঙালের মা বলল, ‘কই লো কুড়ানী,কিছু খেতে দিলি?’
__ধুপোটার জন্যে ভাত রেঁদে রেখে দিইচি নাকি?’
__সে কি লো হতচ্ছারি! কুতায় খেইচে,না খেইচে__দুটি দে।যতই হোক তুর…
__তুমি যুথা যাচ্চ যাও দিকিন মাসি,মেলা বক-বক কর না কানের গুড়ায়।’
মাগীর ঢং!__বলে হাত নেড়ে নেড়ে কয়েকটা অশালীন শব্দ প্রয়োগ করে হন-হন করে চলে গেল কাঙালের মা।কিছুক্ষণ পর কুড়ানী বলল, ‘ফুলকি থালা করে ভাত-তরকারি বেড়ে দিয়ে আয় তুর বাবাকে।’
ফুলকি মায়ের কথা শুনে বাবাকে খেতে দিল।একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকে।শিরীষ গাছের তলায় বসে গব-গব করে ভাত খাচ্ছে অনাদী।ভাত তো খাচ্ছে না,যেন গোটা থালা সমেত খেয়ে নিবে। ফুলকি চেয়ে-চেয়ে বাবার খাওয়া দেখছে। কতদিন পেটপুরে খেতে পায়নি বাবা কে জানে!
(৪)
শীতকালের ছোট দিন,ঝুপ করে সন্ধে নেমে এল। লখা সাইকেল নিয়ে কোথায় গিয়েছিল। ফিরে এসে সাইকেলটা চালাঘরের দেওয়ালে ঠেসিয়ে রাখল। ফুলকি বলল, ‘বাবা এইচে দেকলি?’
‘কই না তো।’
কিছুক্ষণ পর ফুলকি বলল, ‘মা আমি খুঁজে দেকব?’ কুড়ানী রান্নাশাল থেকেই জবাব দেয়, ‘এত জাড়ে কুতায় বেরুবি,বুজে মারাকগো,খাবার সময় হলে ভেবিয়ে ঘর আসবেক।’
মায়ের কথা শুনে লখা মুখ ভ্যাংচালো।বলল, ‘আসবেক- না দেকগা আবার চলে গেল।’ দাদার কথা শুনে ফুলকি ফিক-ফিক করে হাসল।বলল, ‘দাদা জানিস,বাবা এইবার সুট প্যান্ট করে এইচে।’
– আর বারে তো কাদের একটা লুঙি পরে চলে এইল।রাতে আমার চাদরটা জুত করে বিছিয়ে শুতে দিইলি- সকালে উঠে দেখি পাখি ফুড়ুৎ!’ একটু ঢোক গিলে বলে, ‘আজ কুতায় শুতে দিবি বাবাকে?’
ফুলকি দাদাকে রাগাবার জন্যে বলে, ‘ক্যানে তুর কাচে।’
‘হুঁউ,বললিই হল।’
কুড়ানী বলে, ‘আজ রান্নাশালের চালাটায় শুবেক,কাল তিনু নাপিতকে ডেকে চুল-দাড়ি মুছিয়ে কাটা করাব।’
ঘরের ভেতর বি.পি.এল তালিকাভুক্ত ইলেক্ট্রিক মিটার বসেছে।তারই একখানা বাল্ব মিট-মিট করে জ্বলছে। সেই আলোতে বসে চপ মেখে মুড়ি খাচ্ছে লখা আর ফুলকি। ঘরের থেকে কিছুটা আলো দরজা দিয়ে বেরিয়ে উঠানের জমাট অন্ধকারটাকে ওই দূরের মাঠের দিকে তাড়িয়ে দিয়েছে,যেখানে ঝিঁ-ঝিঁ পোকারা গান ধরেছে। ঠিক এমন সময় উঠানের আলো-আঁধারিতে একটা ছায়া পড়ল।লখা চিনতে পারল না।ফুলকি মুখ ঘুরিয়ে দেখল- বাবা দাঁড়িয়ে।
– হা দেক দাদা,বাবা এইচে।
লখা মুখে মুড়ি পুরেই দেখল বাবাকে। কুড়ানী রান্নাশালের ভেতর ছিল। তা দেখে ‘বাঁকিটায়’ ঠেস দিয়ে দাঁড়াল অনাদী।একটা পাতলা ফির-ফিরে জামা পরে আছে গায়ে।ভাবল,ওকে কি জাড় লাগে না!
– বসো ভাত খেয়ে লিবে।
ঘরের ভেতর লন্ঠনটা জ্বালল।লন্ঠনের হলুদ শিখায় চামচে করে বোরলিন গরম করছে কুড়ানী। শীতে হাত-পা,ঠোঁট-মুখ সব ফেটে চৌচির। লন্ঠনটা ঘিরে তিনজন মানুষ।ফাটা জায়গা গুলোতে গরম গরম বোরলিন লাগায়।
রান্নাশালের ভেতর খেয়ে-দেয়ে একটা বস্তার উপর শুয়ে পড়েছে অনাদী।কুড়ানী বলে, ‘যা জাড় পড়েচে- তুর বাবাকে একটা কাঁথা দিলে হত।’
লখা বলল, ‘চান-টান করে নাই,আজ আর ময়লা করতে দিন্না দিনি…’
ফুলকি বিছানায় শুয়ে শুয়েই বলে, ‘ঠিক বলেচিস দাদা।’
লখা কি যেন ভাবল।বেশ কিছুক্ষণ পর বলে, ‘বাবাকে আর একবার বাঁকুড়ায় দেখিয়ে আনলে হয় না মা?’
কুড়ানী বলল, ‘শুদু দেখিয়ে আনলেই হবেক?ঔষুদ কিনার পইসা কই?’ একটু শ্বাস ছেড়ে আবার বলে, ‘ঠিক সময়ে-সময়ে ঔষুদটা না পেয়েই তো মানুষটা…’
(৫)
এখন কত রাত কে জানে,ঘুমটা ভেঙে গেল কুড়ানীর।এই ক’মাস নানারকম দুশ্চিন্তায় চোখে একদম ঘুম নেই।আগে এক ঘুমে সকাল করে দিত,এখন আর তা হয় না।বিছানায় উঠে বসল কুড়ানী।ছেলে-মেয়ে দুটো বেঘরে ঘুমচ্ছে।ফুলকি যে করোটে শোয় সকালে সেই ভাবেই ঘুম ভাঙে। লখাটার স্বভাব খারাপ,বালিশে মাথা থাকে না-গড়িয়ে গড়িয়ে বিছানার বাইরে চলে যায়।কোনোদিন আবার ফুলকির গায়ের উপর ঠ্যাং-ম্যাং চাপিয়ে দেয়।কুড়ানীর ফুলকির চিৎকারে চেতন হয়।দু’জনকে ঠেলে ঠিক করে দেয়।লখাকে গালি পাড়ে,আ মরণ!স্বভাব দেখ ধুমসো মোষটার,ঘুমে দিশে হুস নাই!
ঘরের ‘বাঁকিটা’ খুলে বাইরে বেরোয় কুড়ানী।শিরীষ গাছের মাথায় একফালি চাঁদ উঠেছে। প্রচন্ড শীত!কুয়াশায় অস্পষ্ট উঠান।শিশির পড়ছে টিপ-টিপ করে।পায়ে-পায়ে এগিয়ে শিরীষ গাছের পাশের নালাটায় প্রাথমিক কাজ সারল কুড়ানী।বুকের দপদপানিটা বাড়িয়ে দিয়ে দূরের মাঠে অন্ধকারের বুক চিরে একদল শেয়াল ডেকে উঠল।
শুতে যাওয়ার আগে রান্নাশালের ‘বাঁকিটা’ খুলে একবার কি মনে করে অনাদীকে দেখল।শীতে থর-থর করে কাঁপছে মানুষটা;একেবারে কুঁকড়ে গেছে।যে বস্তাটা বিছিয়ে শুয়েছিল,সেটাই টেনে পা গুলো ঢাকা নিয়েছে।দেখে খুব মায়া হল কুড়ানীর।হৃদয়ে সগৌরবে সহানুভূতি বিরাজ করল।
চুপি চুপি,নিঃশব্দে ঘরের ভেতর ঢুকে একটা কাঁথা বের করে আনল।ছেলে-মেয়ে দুটোর দিকে চোখ বুলিয়ে দেখল ঘুমে কাদা।কাঁথাটা সযত্নে অনাদীর গায়ে ঢাকা দিয়ে দিল।
মানুষটার মুখটা খুব অসহায়! কুড়ানী পাশে বসে কপালে হাত বুলিয়ে দিল।এবারে এসে তেমন চিল্লায়নি।আগে সবার চোখের ঘুম কেড়ে নিত।খ্যাপায় হোক আর যাই হোক মানুষটা বেঁচে আছে বলেই তো মাথায় লাল টক-টকে সিঁদুরটা পরতে পাই!কতদিন মানুষটার স্পর্শ পাইনি তার হিসাব নেই। অনাদী চোখ খুলল।এই কনকনে শীতের রাতে হঠাৎ উষ্ণতার স্পর্শ পেয়ে জেগে উঠেছে।হিংস্র ও ক্ষুধার্ত বনবেড়ালের মতো চোখগুলো জ্বল-জ্বল করে জ্বলছে।কুড়ানী বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না।ভয় পেয়ে গেল।খ্যাপা মানুষের মন যদি চিৎকার চেঁচামেচি আরম্ভ করে দেয়!সেই ভেবে উঠতে গেল,অমনি খপ করে একটা হাত চেপে ধরল অনাদী।বুকটা ধক-ধক করে উঠল কুড়ানীর।সঙ্গে-সঙ্গে সারা শরীরে শিহরণ।
চাঁদের আলো তালপাতার সড়ক এর ফাঁক দিয়ে চুরি করে ঢুকে পড়ছে।একটা আলো-আঁধারী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।এই হাত ধরার ইঙ্গিত কুড়ানী বোঝে।নির্জন পরিবেশে প্রাকৃতিক সুখ ভর করল শরীরে। ভেতর থেকে ‘বাঁকিটা’ লাগিয়ে দিল কুড়ানী।চাঁদের আলো-আঁধারিতে প্রকৃতি আর শরীরের এক অসীম অনন্ত লীলা রহস্যের যুগপৎ খেলায় মেতে উঠল দুটি প্রাণী।ততক্ষণে শিরীষ গাছের মাথা থেকে চাঁদটা লজ্জা পেয়ে অনেকটা সরে পড়েছে।
Tags: গল্প, প্রত্যাবর্তন, হামিরউদ্দিন মিদ্যা
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।