লা ইওরোনা ( গুয়াতেমালা)
[‘লা ইওরোনা’ একটি পৃথিবী বিখ্যাত জনপ্রিয় লাতিন আমেরিকান ভৌতিক লেজেন্ড। পৃথিবীতে একটি ভৌতিক লেজেন্ড নিয়ে এত সংখ্যক প্রচলিত গল্পের নজির পৃথিবীতে বিরল। স্প্যানিশে ‘llorona’ শব্দের অর্থ হল- ‘ক্রন্দনরতা মহিলা। ]
মারিয়া নামে একটি মেয়ে ছিল। তার স্বামী কিছুদিনের জন্য যখন বাইরে যায়, সেই সুযোগে তার সাথে একজন যুবকের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সে তাদের খামারের দেখাশুনো করতো। কিন্তু একটি সমস্যার সৃষ্টি হয়- তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ফল স্বরূপ মেয়েটি সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে। তাদের একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয় এবং জন্মানোর সাথে সাথেই মেয়েটি তাকে নদীর জলে ডুবিয়ে মেরে ফেলে।
শোনা যায় এই ‘ইওরোনা’-ই হল মারিয়ার বেদনার্ত আত্মা- সাদা বা কালো রঙের পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায়। সাধারণত নির্জন রাস্তায়, নদী, লেক, ঝরনার ধারে তাকে দেখা যায়। তবে তার মুখটি পুরোপুরি চুলে ঢাকা থাকে। আবার কেউ কেউ বলে তার মুখটি একটি ঘোড়ার মুখের মত। কেউ তার চোখের দিকে তাকালে বা তার সাথে কথা বললে তার মৃত্যু নিশ্চিত।
আরও একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। যখন কেউ ভাবে যে ইওরোনা তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে, আসলে সে তখন তার থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে, আবার যখন কেউ দেখে যে ইওরোনা অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে, আসলে সে তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
ইওরোনা তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত আত্মা হিসেবে রাত্রিবেলা ঘুরে বেড়ায় আর ‘আমার ছেলে কোথায়?’ বলে কাঁদতে থাকে।
কথিত আছে, ইওরোনা যখন চিৎকার করে কাঁদে, সাথে সাথে তুষার ঝড় ওঠে। এই ভয়ঙ্কর কান্না শুনলেই খুব সাহসী লোকেরও ভয়ে হাত পা অবশ হয়ে যাবে। একবার এই ভয়ার্ত কান্না শুনলেই সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়া উচিত। কারণ দু বারে না হলেও তৃতীয়বার ইওরোনা জিতবেই। কারণ তৃতীয় বার তার কান্না শুনলেই ভয়ে তার রক্ত সাথে সাথে জমাট বেঁধে বরফে পরিণত হয়ে যায়। এমন বহু মানুষ আছেন যারা এই ইওরোনাকে দেখেছে বা তার ভয়ার্ত কান্না শুনেছে।
সেইবো ফুলের গল্প (আর্জেন্টিনা)
প্রাচীন লোকগাথা অনুযায়ী পারানার তীরে আনাই নামে একটি মেয়ে বাস করতো। মেয়েটি দেখতে ছিল খুব কুৎসিত ও কঠোর স্বভাবের। তবে মেয়েটি খুব সুন্দর গান গাইতো। গরমকালের বিকেলবেলায় যখন সে দেশাত্মবোধক বা ঠাকুর দেবতার গান গাইতো, গুয়ারানী সম্প্রদায়ের লোকেরা মুগ্ধ হয়ে তার গান শুনতো। গানের মধ্যে দিয়েই তার স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পেত।
একদিন হঠাৎ স্পেনীয় সাদা চামড়ার লোকেরা তাদের দেশে অনুপ্রবেশ করে, সেখানকার সব কিছু ধ্বংস করে দেয়, স্থানীয় লোকেদের মেরে ফেলে। তাদের জমি, জায়গা স্বাধীনতা সব কেড়ে নেয়।
একদিন স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে তাকেও তারা বন্দী করে নিয়ে যায়। সারা রাত সে ঘুমতো না, শুধু কাঁদতো। একদিন এক রক্ষী রাতে ঘুমিয়ে পড়লে সে সেখান থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই রক্ষী জেগে উঠে তাকে যখন বাধা দিতে যায়, তখন সেই রক্ষীর বুকে ছোরা বসিয়ে দিয়ে সে জঙ্গলে পালিয়ে যায়। সেই মৃত্যুপথযাত্রী রক্ষীর চিৎকারে অন্যান্য স্পেনীয়রাও জেগে যায় এবং আনাইকে ধরার জন্য তারা বেড়িয়ে পড়ে। অবশেষে আনাই তাদের হাতে ধরা পড়ে যায়। মৃত রক্ষীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার জন্য তাকে পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আনাইকে তারা একটি গাছের সাথে বেঁধে আগুন লাগিয়ে দেয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সেই আগুনের শিখাটি যেন তার কাছে পৌঁছুতেই চাইছিল না। আনাই কোনও কথা বলল না, চুপ করে দাঁড়িয়ে সব সহ্য করলো। তার মাথাটি একদিকে হেলে গেল। এরপর একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটলো- আগুনের শিখাটি যখন ওপর দিকে উঠতে লাগলো, আনাই একটি গাছে রুপান্তরিত হয়ে গেল।
পরের দিন ভোরবেলা সেই সাদা চামড়ার সৈনিকেরা একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল- সেখানে একটি অতীব সুন্দর গাছ তার উজ্জ্বল সবুজ বর্ণের পাতা আর ভেলভেটের মত লাল ফুলে সজ্জিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং চারিদিকে সে তার অপরূপ শোভা ছড়িয়ে দিচ্ছে। যেন দুঃখের মাঝে সাহস ও শক্তির মূর্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
[ডিসেম্বর, ১৯৪২-এ এই ‘সেইবো’ (Erythrina crista-galli) ফুলকে আর্জেন্টিনার জাতীয় ফুলের মর্যাদা দেওয়া হয়। এই টকটকে লাল বর্ণ হল সমৃদ্ধির প্রতীক।]
Tags: কৌশিক দাশ, গল্প, দুটি বিদেশি গল্প
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।