আমাদের পাড়ার কানাইদা ছিল স্টার ফুটবলার। তখন প্রখ্যাত ফুটবলার মেওয়ালাল সবে অবসর নিয়েছেন। কানাইদা দেখতে যেমন মেওয়ালালের মত ছিল, তেমনি ভাল ফুটবলও খেলত। মেওয়ালালের মতই খেলার সময় পরত লাল হাফ প্যান্ট, আর গায়ের রঙটাও ছিল তার কুচকুচে কালো। মাঠের রেলিঙে পা ঝুলিয়ে বসে আমরা স্কুল পড়ুয়া ছেলের দল খেলা দেখতাম। আমাদের কাছে কানাইদা ছিল সেদিনের মেওয়ালাল।
বল নিয়ে প্রতিপক্ষের গোল পোস্টের দিকেযখন কানাইদা পাঁই পাঁই করে ছুটে যেত, তখন আমরা উত্তেজনায় শরীর টানটান করে সম্ভাব্য গোলের জন্য চেঁচিয়ে উঠে উৎসাহ দিতাম, “গোওওওওওল, কানাইদা গোওওওল”। কানাইদা মানে গোল হতেই হবে।
খেলা শেষে কানাইদা যখন মাঠের কোনায় তার ঘামে ভেজা জার্সি খুলে ঘাম নিংরাতো, আমরা ছেলের দল কানাইদার পেশী ঝলকানো শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকতাম নির্নিমেষ। কানাইদা জেলা ভিত্তিক ফার্স্ট ডিভিশনে ফুটবল খেলত। কলকাতার বড় টিমগুলোতেও সুযোগ পেয়েছিল।
আমরা বড় হলাম। কলেজে উঠতে খেলার মাঠটা জীবন থেকে অনেক দূরে চলে গেল। কানাইদার খোঁজ আর রাখতাম না। বছর দশেক পর বাড়ি গেছি ছুটিতে। থলে হাতে ঝুলিয়ে রেল মাঠের পাশে, মুরগির দোকানে। যার দোকান, সে আমার একসময়ের খেলার সাথীও বটে। আমার সাথে এটা সেটা বাক্যালাপ করতে করতে সে ডিপ ফ্রিজ থেকে মুরগি বার করে ওজন করে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল, ‘বারো পিস কর’। যাকে পিস করতে বলা হল, সেই লুঙ্গি পরা খালি গা লোকটি একমনে কাঠের গুঁড়ির উপর মুরগি কেটে একটা পাত্রে রেখে থলে বন্দী করে আগে বাড়িয়ে দিচ্ছে। লোকটা ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। মনে করতে পারছি না কোথায় দেখেছি। জিজ্ঞাসা করল, ‘কি ভাল তো?’ ঘাড় নেড়ে তো দিলাম, তবু চিনি না। লোকটা মুরগি টুকরো করতে করতে বলল, “এখন থাকো না তো এখানে। শুনেছি দিল্লীতে……”।
বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল কানাইদা। হ্যাঁ সেই কানাইদা, যে একদিন রেল মাঠে বাতাসকে হেলায় উড়িয়ে ছুটে যেত প্রতিপক্ষের গোলপোস্ট লক্ষ করে আর আমরা ‘কানাইদা গোল, কানাইদা গোওওওওওল’ করে গলা ফাটাতাম। এখন তার গায়ে রক্তের ছিটেয় ফুটবল মাঠের কাদার দাগগুলো চাপা পড়ে গেছে।
Tags: অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়, গল্প, ফুটবলার
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।