শ্রীরামপুর বাগবাজার রুটের একটা তিন নম্বর বাস শ্রীরামপুর স্টেশন সংলগ্ন স্ট্যান্ড থেকে ছেড়ে নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলেছে। সামনের দিকে ড্রাইভারের সিটের পিঠোপিঠি লেডিস সিটের এক কোণে বসেছেন এক বৃদ্ধা মহিলা। মহিলার পরনে কিছুটা মলিন সাদা থান, হাতে একটি মানানসই পুঁটুলি। বোঝা যায় কোন নিম্নবিত্ত প্রান্তিক পরিবারের প্রবীণ সদস্যা। আমাদের মধ্যে যারা স্ট্যান্ড থেকেই বাসে উঠেছে তাদের অনেকেই খেয়াল করছে এক যুবক এসে মহিলাকে বাসে তুলে দিয়ে গিয়েছিল, যে সম্ভবত ওঁর পুত্র।
বাস ছাড়ার সময়েই উনি কন্ডাক্টারকে বলে দিয়েছিলেন ‘মাসীর বাড়ি’ স্টপেজ এলেই যেন ওঁকে বলে দেওয়া হয়। এর পরমুহূর্ত থেকে যখনই বাস কোথাও দাঁড়াচ্ছে তিনি প্রশ্ন করছেন –‘হ্যাঁ বাবা, মাসীর বাড়ি আইলো’?
প্রায় বার দশেক প্রশ্নটি করবার পর কন্ডাক্টার বলল –‘মাসীর বাড়ি দেরি আছে ঠাকমা, এখনো বটতলাই আসে নি, আপনি চুপ করে বসুন, ঠিক সময়ে বলে দেবো’।
এই উত্তরে একটু সময় চুপ করে থাকলেন বটে কিন্তু তারপরেই আবার তিনি আগের মত শুরু করলেন –‘হ্যাঁ বাবা, মাসীর বাড়ি আইলো’?
বাসের অন্য প্যাসেঞ্জাররা তখন মজা পেয়ে মিটিমিটি হাসছে।
কন্ডাক্টার চটে গিয়ে খেঁকিয়ে উঠে বলল –‘অত বকবক না করে চুপ করে বসুন তো ঠাকমা, একদম কথা বলবেন না। সময় হলে ঠিক নামিয়ে দেব’।
কন্ডাক্টারের এই মেজাজ দেখে থতমত খেয়ে একেবারে চুপ করে গেলেন সেই বৃদ্ধা। বাস চলতে থাকলো নিজস্ব গতিতে। কিন্তু কন্ডাক্টার ভুলে গেল ওই মহিলার কথা। বাস যখন মাসীর বাড়ি স্টপেজ ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে তখন আমরা হইহই করে বাস থামালাম। এতবার বলার পরেও বৃদ্ধাকে ঠিক যায়গায় না নামানোর জন্য প্রচুর তিরস্কার করলাম। কন্ডাক্টার মহিলাকে ওইখানেই নামিয়ে দেওয়ার তাল করছিল। আমরা সবাই গলা তুলে বললাম ‘তা হবে না। বাস ঘুরিয়ে আবার এক স্টপ পিছনে নিয়ে যেতে হবে এবং ওই মাসীর বাড়িতেই মহিলাকে নামিয়ে দিতে হবে’। জনতার মেজাজ দেখে ঘাবড়ে গিয়ে ড্রাইভার গাড়ি ঘোরালো। নির্দিষ্ট যায়গায় এসে দাঁড়াবার পর কন্ডাক্টার বলল –
‘মাসীর বাড়ি এসে গেছে ঠাকমা, নামুন’।
ঠাকমার মধ্যে নামার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। তিনি পুঁটুলি থেকে একটি হোমিওপ্যাথি ওষুধের শিশি বের করে কয়েকটি গুলি মুখে ফেলে গ্যাঁট হয়ে বসে রইলেন।
‘কি হল নামুন, মাসীর বাড়ি তো এসে গেছে’।
ঠাকমা বললেন – ‘আমি তো বিশালক্ষী সড়কে নামবো, কোন্নগরে। আমার ছেলে বলেছিল মাসীর বাড়ি আইলে এই হোমিপ্যাথি ওষুধের চারটে দানা খেয়ে নিতে। তাইজন্যে জিগ্যেস করছিলুম বারবার’!
Tags: গল্প, দেবরাজ গোস্বামী, বাস
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।