এ গাথা তো আমার হৃদয়ের…….অপরূপ নির্জনে শরীরে শরীর ছুঁয়ে দেওয়া খিন্ন হৃদয়ের কথা….বিপন্ন বাসনার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা সুখ ও অসুখ…প্রসব যন্ত্রণার মতো গলাগলি হর্ষ ও বিষাদ…..
যখন মন আমার হারিয়ে ফেলে তার দুর্লভ সম্পদ…….নির্জনতার গভীরে দেহ এসে সাজায় শত কারাকক্ষ তার…..চারদিকে ঘিরে থাকে বাসনার দুর্গম পরিখা…যদিও শরীরের জন্য আমার সঞ্চিত থাকে ভয়…….শরীরের গর্ভদ্বারে জুড়ে থাকে শতেক সংশয়…..সেই সময়গুলোতে…গ্লেসিয়ারের ধ্বস নামা সেই নাক্ষত্রসময়ে…রাত্রির সেই দুর্বিষহ নির্জনতায়……তোমার স্মরণে জেগে ওঠে রজনীগন্ধার সুঘ্রাণ……সারা শরীরে সেই ঘ্রাণ জড়িয়ে নিয়ে তুমি দাঁড়িয়ে থাকো আমার বিহবল চোখের সামনে এক স্বপ্নের মতন……..যেন খেয়ালের খুশী দিয়ে ভরা এক ফাল্গুনের মন….ঠিক যেন এক ত্রিমাত্রিক ছবি…..
তোমার স্মৃতির সেই রাত্রিকে নিয়ে কতো……কতো রাত্রি আমি পার হয়ে যাই একা…কতো এঁকে যাই অন্ধকারে অন্ধকার রেখা…. তোমার সেই স্মৃতির শরীর……বুকের গভীরে তোমার স্পর্শের স্মৃতি ব্যাপ্ত হয়ে থাকে…সেই স্মৃতির স্বপ্নে আমি অসহায়……অসহায় আমি তোমাকে ডাকতে পারি না…আমার সমস্ত শরীর মন দিয়ে, তার অনু পরমাণু দিয়ে….এক গভীর আর্তির…..এক দীর্ঘ প্রলম্বিত ডাক…….ডাকতে চাই…..ডাকতে চাই….কিন্তু কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে থাকে……তবুও সেই রমনীয় স্বপ্ন জেগে থাকে আমার হৃদয় কন্দরে……সেই ইতস্ততঃ স্পর্শ গন্ধ আলাপ আলিঙ্গন…..চোখের পাতায় ভাসে তোমার শাড়ীর আঁচল, গ্রীবার উদ্ধত ভঙ্গী, কিছু চূর্ণ কুন্তল……নিঃশ্বাসে যেন তোমার দুরন্ত রাত্রিবাসের চিহ্ন খুঁজে পাই….
স্বপ্নের সেই খুশী নিয়ে আমি ছোট ছোট স্মৃতির পসরা সাজাই……পেতে চাই তোমার হৃদয়ের চাবি দুহাত ভরে….আমি বলি তুমি এসো……তুমি এসো….তুমি আশ্চর্য্য হও……যদি বলি এসোনা তুমি আঘাত পাও….অসহ্য ব্যথায় নীল হয়ে যাও তুমি……ঘর ও বাইরের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকো তুমি……দরজার চতুষ্কোণে তুমি ছবি হয়ে থাকো…….ত্রিমাত্রিক অস্তিত্ব তোমার দ্বিমাত্রিক হয়ে যায়…..অক্ষম আমি দেখতে থাকি….দেখতেই থাকি…..তোমার শ্রান্ত দৈর্ঘ্য তোমার অসহায় প্রস্থ বন্দী হয়ে ছটফট করে….আমি অক্ষম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি….. তোমার অনাঘ্রাত বেধ ধীরে ধীরে সকালবেলার শিউলির মতো ঝরে ঝরে যায়….আমারই বিহবল দৃষ্টির সামনে অদৃশ্য হয়ে যায়……..কিন্তু আমি তো তোমাকে দিতে চাই ফুল…….দিতে চাই অশ্রু আর যন্ত্রণা…..অতঃপর ভ্রূণবীজ……..
রুদ্ধ কণ্ঠ ভেদ করে আমি চিৎকার করে উঠি…..কেন নির্বাসন দাও তোমার পৃথিবী থেকে…আমার বুকের বাতাস কেন সরাও নির্মমভাবে……দেখো না তির্যক রোদে ঝিকিমিকি উড়ে চলে যায় আমার ভালোবাসা……বোঝোনা কেন অসহায় আমি বসে থাকি হাতে নিয়ে আমার রক্তকলম…..আমার মণিবন্ধে বাঁধা থাকে খঞ্জ সময়….আমার কর্ণকুহরে ফিসফিস করে কারা ভালোবাসা ভালোবাসা….
কিন্তু তুমি……অহংকারী তুমি…….তোমার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর বেধ, তোমার বৈভব, তোমার অভিমান, তোমার ক্ষুদ্রতা নিয়ে দুলতে থাকো আমার চোখের সামনে…..স্বচ্ছ মসলিনের মতো……ধীরে ধীরে দুলতে থাকো এক নিষ্পাপ অস্তিত্ব নিয়ে……চোখ আমার সন্মোহিত……আমি সন্মোহিত হয়ে যাই……উথালপাথাল খুঁজি রবীন্দ্রনাথকে তুমি কোথায় আছো…..কোন শ্যামলিম নীলিমায়…কোন খেজুর বীথিকায়….. অথবা জীবনানন্দের ধানসিড়ি নদীর তীরে…… হাজার বছর ভ্রমণের শেষে ব্যাবিলনের প্রাচীরতলে…….অথবা বিদিশার নিশায়…..সে এক আনন্দসময়…… সে আনন্দসময়ে তোমাকে খুঁজে পাওয়া…..দুরন্ত গ্লেসিয়ারের মতো ধ্বস নিয়ে নেমে আসা সেই নাক্ষত্রসময়….
অথচ সেই সময়গুলোই গুপ্তকায় ছুরির মতো নির্মম নাক্ষত্রসময়……সেই সময়–ই তোমাকে ত্রিমাত্রিক থেকে অকস্মাৎ দ্বিমাত্রিক করে…..তোমার ক্লান্ত দৈর্ঘ্য তোমার অনাস্বাদিত প্রস্থ সূর্য্যকিরণশুস্ক পাপড়ির মতো খসে যায় ঝরে যায়…..আমি তোমাকে সোনার ফ্রেমে বন্দী করি…..ফুলমালা ও অশ্রু দিই…..তুমি অপলক চেয়ে থাকো আমার দিকে….তারপর ক্লান্তিতে তোমার চোখ নিঃসীম তন্দ্রায় ঢুলে পড়ে….তোমার সেই বিরল অনুভূতি তোমাকে নিয়ে যায় এক দুর্গম পর্বত চূড়ায়, এক আনন্দশিখরে……যেখানে বর্ষার বাদল মেঘ আকাশ ছুঁতে পারে না…..চারিদিকে থাকে শরতের পেঁজা তুলোর মতো মেঘ……কালিদাসের মেঘ যেখানে অনিবার বিচরণ করে….রবীন্দ্রনাথের শরৎ আর জীবনানন্দের শঙ্খচিল…..
আর তখন–ই তোমাকে সাজাতে চাই আমি অপরূপা করে…..তুমি তো আমার হৃদয়–ভরানো আকাশ…….নম্র নীল প্রতিভাস…..তোমার পায়ে দিই স্বর্ণালী নুপুর……তোমার বাহুতে হলুদ কংকন….তোমার কণ্ঠে দোলে সাতনরী রত্নহার….তোমার মেখলায় থাকে চন্দ্রহার…..স্বর্ণাভ কাঁচুলীতে তুমি সেজে ওঠো অনন্যা……তুমি বলে ওঠো আমাকে আরও একটু সাজিয়ে দাও…..তখন তোমাকে পরাই এক আকাশ–নীল শাড়ী…..জ্যোৎস্নায়, আকাশে, তোমার চোখের তারায় আর প্রিয় পৃথিবীর তিনভাগ জলে অগাধ ভেসে যায় সেই নীল রং….আমার দুচোখ মেখে নেয় তোমার শরীরবর্ণ……এক টুকরো সুদূর আকাশ…..তুমি বলো আমাকে আরও একটু সাজিয়ে দাও…..
তখন তোমার মাথায় দিই কৃষ্ণচূড়ার বাহার…..কপালে এঁকে দিই শ্বেতচন্দনের তিলক…..তুমি বলতে থাকো আমাকে আরও একটু সাজিয়ে দাও….অসহায় আমি তখন খুলে দিই তোমার সমস্ত আভরণ……বিকেলের কনে–দেখা আলোয় ঝলসে ওঠে তোমার শরীরের চিকন সোনালী ইঙ্গিত……তুমি তবুও বলো আমাকে আরও একটু সাজিয়ে দাও….দুরন্ত তিলোত্তমা আমার……তুমি যে নিজেই হারিয়ে ফেলো তোমার লজ্জার দ্বীপ……আমি শুধু অসহায় নতজানু হয়ে পড়ি……..আমার বিপন্ন বিস্ময় গলে যায় ঝরে যায়……লক্ষ্যভেদী হতে পারিনা আমি……নতজানু আমার হাত থেকে গাণ্ডীব খসে পড়ে……শরীরে যে আমার ভয়….শরীরের গর্ভদ্বারে বেধে আছে শতেক সংশয়…….
তবুও তো আমি তোমাকে প্রাণপণ ডাকতে চাই……..কণ্ঠরুদ্ধ আমার প্রতীক্ষার ক্ষণ বাড়তেই থাকে…..মনে মনে বলি ঈশান কোণে একটা টালমাটাল ঝড় উঠুক…..সেই প্রলম্বিত ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে যাক তোমাকে…উড়ে যাক তোমার অহংকার…তোমার অভিমান…….কিন্তু তা তো হবার নয়……সময়ের গুপ্তকায় ছুরি তোমাকে ত্রিমাত্রিক থেকে দ্বিমাত্রিক করে……তোমার শ্রান্ত ক্লান্ত দৈর্ঘ্য তোমার অনাঘ্রাত প্রস্থ, তোমার অস্পৃষ্ট অনাস্বাদিত বেধ আমার অক্ষমতায় বন্দী হয়ে ছটফট করে….তোমাকে আমার স্মৃতির ফ্রেমে বেঁধে নিই….ফুল, অশ্রু ও যন্ত্রনা…..অতঃপর ভ্রূণবীজ দিই…..
তিলোত্তমা আমার…..তাই চলো চলে যাই……… এই আবহমান স্থবির সময় পেরিয়ে হেঁটে যাই দুজনে…দুজনেই হেঁটে যাই গোপনে…জ্যোৎস্নায় মাখামাখি পুড়ুক অরণ্য…….বিষন্ন রাতচিল বিদীর্ণ করুক নৈঃশব্দ…….এসো, বাতিল করে দিই সমস্ত সামাজিক উৎসব…..আর সেই থুরথুরে খঞ্জ সময়…………
Tags: আবহমান, গল্প, সিদ্ধার্থ সান্যাল
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।