18 Mar

পর্ব- মোহিনী

লিখেছেন:আত্মদীপ


আঁখিকোণে কাজলের রেখা কী কেঁপে গেল? ম্লান হয়ে আসা শেষ দিবসের আলোতে মুকূরের দিকে চেয়ে থাকেন কৃষ্ণ, একটু অস্থির লাগে, কেমন জানি অচেনা একটা সুখে বুক-মন শূন্য হয়ে আসে। গোধূলির শেষ আলোকে বাইরের ধুলিপ্রান্তর কেমন মায়াময় মনে হয়। কে বলবে,এই প্রান্তরে রক্ত প্রবাহ একদিন সিক্ত করে দেবে প্রতিটি ধুলিকণা, কে বলবে এ এক যুদ্ধক্ষেত্র, একমাত্র কৃষ্ণ জানেন ভারত যুদ্ধের কী গুরুতর পরিণতির সম্মুখীন হবে এই বিরাট নগ্ন প্রান্তর, কিন্তু হঠাৎই কেমন যেন অন্যরকম একটা লজ্জা এসে খেলা শুরু করে হৃদয়ে; এই গোধূলি বেলায়, মায়াবি আলোকে হঠাৎ মনে হয়ে যায় সেই পার্বত্য নব যুবকটির কথা। তার দেহ বর্ণ অবিকল এই আলোকের মতো, পর্বতের অজানা গন্ধ যেন নাকে এসে লাগে কৃষ্ণের; নগ্নতার কথাতে মনে পড়ে যায় তার বলিষ্ঠ বুক, ক্ষীণ কটির কথা, কী অদ্ভূত শক্তির প্রকাশে সর্বদা মত্ত তার দুই বাহু; উষ্ণ নিশ্বাস পড়ে, নিষ্পেষিত হতে মন চায়। কিন্তু হায়, চিন্তার স্রোত খন্ডিত হয়ে যাচ্ছে যে! ওগো কৃষ্ণ,  তুমি তো জানো,  আজ এই ধরাতলে তার শেষ রজনী!  এত রূপ, এত মায়া দিয়ে যে শরীর -মন তুমি প্রস্তুত করছো,  তা যে আগামী প্রভাতে একা হয়ে যাবে!

” তুমি তাকে খুব ভালোবাস তাই না সখা?” কৃষ্ণার এই প্রশ্নের কোনো উত্তর ভারতযুদ্ধের প্রাণপুরুষ দিতে পারেন না, ম্লান হাসেন!  তার মনে পড়ে যায় পার্থর মায়াময় চোখ, এ যুবক যেন অবিকল পার্থ, পিতার যোগ্য সন্তান….দেহবর্ণ খানি কেবল মাতৃরূপ; উলুপির দেহে নাগিনীর যে মায়া বহুবছর আগে প্রত্যক্ষ করেছিলেন তারা দুই সখা, এ যুবক যেন তারই পূর্ণ প্রকাশ, যদিও পৌরুষে! নাগবংশের একমাত্র বংশধর সে, তবু যখন যুদ্ধ জয়লাভ হেতু বলিদানের প্রশ্ন উঠল, সে পিছিয়ে যায় নি; কী বা চেয়েছিল সে, বিবাহ করতেই তো কেবল, কিন্তু কোন রমণী একরাত্রের স্মৃতি বহন করবে সারা জীবন? তাও এমন উজ্জ্বল পুরুষ,  তার স্মৃতিতে যে দেহ-মন নিঃশেষ হয়ে যাবে! কিন্তু ও কী সখা পার্থ, তুমি ঐ মুখ ম্লান করো না, আচ্ছা আমি, আমি শ্রীকৃষ্ণ তাকে গ্রহণ করবো।

তারপর আজ এখানে বসে গোপন সুখের ভিতিতে শিহরিত হচ্ছেন মাধব! আহা নাম খানি বড় সুন্দর তার, ইরাবান! যেন বার বার উচ্চারণ করতে মন চায়! ও কী পৌরুষ তোমার নাগরাজা, তোমার তরে শ্রেষ্ঠ পুরুষ মাধবেরও নারী হতে মন চায়! দেখো, আজ তার এ কী সাজ, কোমল দেহ জুড়ে আঁকা হয়ে আছে অঙ্গরাগ, কর্ণমূলে হীরকের কুন্ডল ঝকমক করে ওঠে, কন্ঠহার এ কোন গভীরতায় প্রবেশ করতে উদ্যত,  কেশ বন্ধনে বন্ধু হয়েছে অজানা পারিজাত, বিভ্রান্তি লাগে, এত কোমল, এত রমণীয় হে ঈশ্বর,  কেন এ নারী রূপ চিরস্থায়ী নয়, কেন স্তনভারে নুব্জ হতে পারছি না আমি! হঠাৎ চমক ভাঙে , দাসি আলো নিয়ে এসেছে, খেয়াল হয় রাত নেমে এসেছে যেন কখন, মুকূরে চেয়ে মনে হয় একী সখি কৃষ্ণা এমন করে সামনে বসে যে, ভ্রান্তি ভাঙে, মনে হয়, ঐ তো শয্যা প্রস্তুত; মসৃণ ফুলের শয্যা এ যে, সুখে বিহ্বল লাগে কৃষ্ণের, মনে মনে নিজের নাম গান করতে থাকেন তিনি, ” আজ হে মদনমোহন তবে তুমি মোহিনী,  এ রূপের মায়াতে আবৃত পূর্ণ রমণী, মোহিনী …মোহিনী! ”

তার আসার সময় হলো বুঝি,  ঐ পদশব্দ শোনা যায়, বুকে যেন হাজার শঙ্খ বেজে ওঠে, উলুধ্বনি দিয়ে ওঠে কারা! এসো ইরাবান, এসো আমায় বাহুপাশে বদ্ধ করো, আরো আরো নিবিড় হয়ে এসো, মোহিনীর সৃষ্টিকে তুমি রমণীয় করো!

কিন্তু হায় মোহিনী, এ যে কেবল একটি রাত সখি, কাল যে তুমি বিধবা হবে! কাল তুমি আবার প্রাজ্ঞ পুরুষ,  সেই চেনা জন, মোনমোহন পার্থসারথি! কিন্তু তাই কী এমন অনাবিল সুখের মুহূর্তেও তোমার চোখে জল, আঁকড়ে ধরো বার বার তার বলিষ্ঠ পিঠ, ঐ কোমল দেহ তার দেহতল থেকে বুঝি আকুতি করতে থাকে, যেতে নাহি দিব! রাত বড় অধৈর্য যে, কলঙ্কিনী সে শেষ হবার জন্য ছুটে চলেছে; হারাবার ভয় গাঢ় হয়ে আসে, মনে হয়, আহা যৌবনের কী বিভৎস অপচয়! যুবক তুমি কর্তব্যের দাস, মোহিনী দেহ ত্যাগ দাও, দ্যেখো ভোর হয়ে আসে, মৃত্যুর ভেড়ি বেজে ওঠে; আজ ভারত যুদ্ধের প্রথম রক্তপাত! এতখন যে দেহ উষ্ণতা দিয়েছে তোমায় হে মোহিনী,  সেই দেহের শীতলতাকে স্পর্শ করে শ্রী কৃষ্ণ ভারত যুদ্ধের সূচনা করবেন, আঁখির কাজল মুছে যুবকের তাজা রক্তের তিলকে অপাপবিদ্ধ হয়ে ওঠো তুমি আবার, আবার তুমি আদি পুরুষ,  একক, সম্পুর্ণ একা! মনের মধ্যে কেবল মোহিনী অবিরত বিলাপ করতে থাকে, হে ইরাবান ,শ পতি আমার শেষ যাত্রার অশেষ পথে এ অভাগিনী কে তুমি গ্রহণ করো!

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ