পাখী, বহুদিন তোমার কোন সংবাদ নেই। উড়ানে বিভোর তুমি, হয়তো সময় নেই অথবা সময় তুমি খুঁজবে না – এ তোমার সিদ্ধান্ত।
আমি এখন দরিয়ার পানসি নৌকায় বসে নির্জনতা অনুভব করি। চারিদিকে নদীর কলরোল একই ভাবে উচ্চারিত, একই ভাবে বহমান। কেন জানি না আমার মনে হয় এই বিস্তীর্ন জলরাশি আমাকে বিদ্রুপ করছে। তুমি বোধহয় আমাকে আর ভালোবাসো না, নচেৎ তুমি একটা তাগিদ অনুভব করতে। তাহলে তুমি বুঝতে অসীম শূন্যতার একাকী নাগরিক কল-কল্লোলের মধ্যেও তোমার ডানার আওয়াজ খুঁজে বেরাই। রাত্রে চাঁদ ওঠে, আমার শুধু নিদ্রাহীন প্রতিক্ষা।
‘ভালোবাসা’ শব্দটা খুবই ব্যাপ্ত। স্থান-কাল-পাত্র কিছুরই তোয়াক্কা করেনা। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
প্রভাত কি রাত্রি অবসানে?
যখনই চিত্ত জেগেছে
তখনই হয়েছে প্রভাত
সব ভালোবাসার অর্থ পিঞ্জরে আবদ্ধ থাকা নয়, এ এক মানসিক স্বর্গীয় বন্ধন।
মনে পড়ে সেই দিন, পূর্নিমার চাঁদের তলায় যখন আমি একা দিকভ্রান্ত মান্দাস, যখন অসীম শূন্যতা আমাকে গ্রাস করে ঠিক তখনই সংপৃক্ত চেতনায় ভরপুর হয়ে পাখনার ভালোবাসায় আলোক বর্তিকার মতো তুমি আমার পাশে এলে। আমি আশ্রয় পেলাম। তোমার পালক-এ আমি হাত রাখলাম। কী মসৃন, মায়াবী, শীতল ছিল তোমার পালক। তুমি প্রতিশ্রুতি দিলে কাছে থাকার। আমাদের কথা হল, তুমি বারবার আসবে উড়ানের বিরতিতে – আমি স্পর্শ করব মসৃন, শীতল, মায়াবি পালক। তুমি বাতাস করবে বিলাসি মাতাল ডানায়। অকুল পাথরে আমি পেলাম পবিত্র দ্বীপের ঠিকানা।
তোমাকে আমি আলিঙ্গন করলাম, মনন জুড়ে। তোমার উপস্থিতি আমাকে সুরের সন্ধান দিল, তোমার অনুপস্থিতি আমাকে হতাশায় নিমজ্জিত করতে লাগলো।
আমার চেতনায় তুমি সব-মহিমায় পদাচারন শুরু করলে। তোমার মঙ্গলাচিন্তায় আমি প্রসাদী ফুল সঞ্চয় করেছি, তোমার অসুস্থতার খবরে আমি কাতর হয়েছি তোমার উড়ান প্রতিযোগিতার প্রতিটা দিন আমি উদগ্রীব ছিলাম – তোমার এক টুকরো বার্তা না এলে রাত্রে আমি নিদ্রাহীন।
সেই তুমি, কতদিন নিরুদ্দেশ। মেঘ আর বাতাসের সখ্যতায় তুমি আজ কত উদাসীন আর নিষ্ঠুর। অকুল সমুদ্রে উত্তাল ঢেউ-এ অসীম শূন্যতায় বৈঠা হাতে আকাশের দিকে চেয়ে থাকা ক্লান্ত মাঝি বাচঁলো কি বাচঁলো না, ভালো আছে কি নেই – এ সংবাদ তোমার কাছে অর্থহীন বন্ধন। তাই তুমি অনায়াস দক্ষতায় কৌশলে, আপন স্বাতন্ত্রে এগিয়ে চলেছো মেঘের বুকে, অন্তরঙ্গ বাতাসের অনুষঙ্গে – পবিত্র ভালোবাসা পরোয়া না করে। অথচ দেখো, আমার চাহিদা কত সামান্য। একটু সখ্যতা , একটু গান, একটু আলাপচারিতা, একটু আদর, একটু আশ্রয়। কি আর হবে! অবহেলা এটাই তো এক প্রাপ্তি। বিশেষ করে তা যখন তোমার থেকেই নিঃসৃত হয়, তখন তা আমার সম্পদ। নিঃশব্দে শিশিরে পারে হিমেল অশ্রুকনায় আমি স্নাত হই। রাত্রে চাঁদ ওঠে, আমি শুধু নিদ্রাহীন এক ভালোবাসা।
আমি ক্রোধান্বিত নই, কেননা ক্রোধ দেখাবার একটাই অধিকার থাকে, আমি বোধহয় সেটা অর্জন করিনি । তোমার যাত্রা সফল হোক। তোমার উড়ান সন্ধান দিক নতুন নতুন সবুজ দ্বীপের। তুমি সাফল্যে উদ্ভাসিত হবেই। অফুরান জলরাশির মধ্যে তোমার ঠোঁটে থাকবে সবুজ পাতা – নতুন দ্বীপের খবর। আমি প্রায়শঃই বলতাম, আমার পাখী সবার সেরা। এ শুধু কথার কথা নয়, এ আমার হৃদয়ের উৎসারিত চিরন্তন কামনা। জানো পাখি, আরও কয়েকটা কবিতা লিখেছি। ইচ্ছা হয় তোমাকে শোনাতে। কিন্তু তুমি বন্ধনহীন গ্রন্থি, উড়ানেই মশগুল, উড়ানেই মুক্তি।।
এ চিঠি তোমার কাছে পৌছবে কিনা জানিনা, এর জবাব দেওয়ার দায় তোমার নেই। আকাশের নীচে, তামিস্র আঁধারে, বৈঠা হাতে হালকা দোলায় ভাবনার শব্দগুলো কেমন করে যেন গ্রন্থিত হয়ে গেল। যে দিন আমি থাকবো না, অশ্রুপাতে তোমার উড়ান যেন সিক্ত না হয়। নজরুলের ভাষায় বলি।
‘মোরে মনে পড়ে
একদা নিশীথে যদি প্রিয়
ঘুমায়ে কাহারও বুকে অকারনে বুক ব্যথা করে
মনে করো ,মরিয়াছে, গিয়াছে আপদে।
আর কভু আসিবে না
উগ্রসুখে কেহ তব চুমিতে ও-পদ-কোকনদ,
মরিয়াছে, অশান্ত – অতৃপ্ত – চির স্বার্থপর লোভী
অমর হইয়া আছে, র’বে চিরদিন
তব প্রেমে মৃত্যুঞ্জয়ী
ব্যথা বিষে, নীলকণ্ঠ কবি।
ভালোবাসা নিও
মাঝ দরিয়ার ক্লান্ত মাঝি
Tags: গল্প, পাখি তোমাকে, প্রবন পালন চট্যোপাধ্যায়
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।