দিনে ঘুমোলে রাতে ঘুম আসতে চায় না । এপাশ ওপাশ বড় যন্ত্রনা দায়ক ! আবার সারাটা দুপুর জেগে থাকাটাও প্রাণান্তকর অবস্থা ! রোজকার মতো দুটো কাগজ নিয়ে সমন্বয় আজ বিছনায় না শুয়ে চেয়ারে গিয়ে বসল । মনে মনে ঠিক করেছে যে সে আজ কিছুতেই ঘুমোবে না । দেখি ঘুমটা কোথা দিয়ে আসে ।
বড় পত্রিকাটা পড়তে পড়তেই আড় চোখে একবার দেয়াল ঘড়িটা দেখে নিল । দু বার বাথরুম গেল । অথচ ঘড়ির কাঁটা যেন কিছুতেই নড়ে না ! সব কিছু খুঁটিয়ে পড়েও মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিটেই পড়া শেষ । সমন্বয় একটা হাই তোলে । চোখের পাতা দুটো সামান্য ভারী মনে হওয়ায় সে ঘরের মধ্যেই বার কয়েক পায়চারি করে ঘুম তাড়ানোর চেষ্টা করে । তারপর ছোট পত্রিকাটা নিয়ে আবার চেয়ারে বসে । এই পত্রিকাটা বড়টার একটি ছোট সংস্করণ । সামান্য দু একটি খবর ছাড়া বাকি সব একই । শুধু পরিবেশনের ধরনটা আলাদা । কিন্তু এই পত্রিকার দ্বিতীয় পাতার শেষে যে চার-ছয় লাইনের ছড়া থাকে তা শুধু অসাধারণই নয় , শব্দ-ছন্দের উপর সাংঘাতিক দখল না থাকলে এমনটা লেখা যায় না । আর সেই সাথে চাই প্রতিদিনের ঘটনার উপর কড়া নজর । সমন্বয় রোজ ছড়াটি দুবার করে পড়ে ।
বেশ কয়েক বছর হল কোমরটা আর জুতসই নেই ! বিশেষ করে অপারেশনের পর বেশিক্ষণ এক জায়গায় বসলে সমন্বয়ের বেশ কষ্ট হয় । ভীষণ টাটায় । তাই কোমরটাকে একটু টানটান করার জন্য সে বিছানার আশ্রয় নেয় । কাগজ পড়া শেষ করে সিলিং ফ্যানের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে সমন্বয় ফ্যানের ঘুরন্ত বিয়ারিংয়ে নিজের মুখের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায় । এক সময় মুখটা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে কোথায় যেন হারিয়ে যায় ! সমন্বয় ঘুমিয়ে পড়ে ।
রোজ সকাল-সন্ধার চাটা সমন্বয়-পরী তাদের ব্যালকনিতে বসেই খায় । এটা দীর্ঘদিনের অভ্যাস । সামনের রাস্তায় প্রায় সব সময় লোকের চলাচল থাকে । চেনা অচেনা লোক দেখতে দেখতে কখন যে চা শেষ হয়ে যায় তা ওরা বুঝতেই পারে না ।
দক্ষিণ কলকাতার এই বাড়িতে সমন্বয়-পরী তাদের দুই ছেলেকে নিয়ে প্রায় কুড়ি বছর হল আছে । রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে সমন্বয় কলকাতার একটা অফিসে এসে অবসর নেয় । যদিও বাড়িটা কেনা হয়েছিল তারও প্রায় পনের বছর আগে । তাই ছেলে দুটো এখান থেকেই তাদের পড়াশুনো শেষ করেছে । আর পরীও একেবারে ঝঞ্ঝাট মুক্ত হয়ে এ বছরেই অবসর নিয়েছে ।
-হ্যাঁ , তুমি কী যেন জানতে চাইছিলে ? হঠাৎ সমন্বয়ের মনে হল পরী যেন কী একটা বলল ।
সামনের টি টেবলে চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে পরী বলল – সে তো প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেল ! তোমার এতক্ষণে মনে পড়ল !
সমন্বয় স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে – কি যে বলনা তুমি । আমি এমন কিছু ভাবিনি যে তুমি কিছু বললে আমি শুনতে পাব না ।
“ইদানীং তোমাকে সব কথাই দুবার করে বলতে হয় । এটা তোমার ইচ্ছাকৃত কিনা বুঝতে পারছি না !”
“জানিনা কানটা শত্রুতা করছে কিনা ! তুমি তো একটা কাজ করতে পার । ধর তোমার দ্বিতীয় ডাকে যদি আমি সাড়া দিয়ে থাকি তাহলে বরং প্রথমে অতটা উচ্চ গ্রামেই বলবে । এবার বল কী জানতে চাইছিলে ?”
পরী একটু চুপ করে থেকে বলল ,” এতদিন সবকিছু দিব্বি চলছিল । হাঁটু ব্যথা ছিল কিন্তু এমনটা নয় । এখানে ওখানে ছোটাছুটি করেই তো সব কাজ করেছি । অথচ যেই না চাকরী জীবনে অবসর এল আর অমনি শারীরিক অসুবিধাগুলো সিন্দাবাদের মতো আমার ঘাড়ে চেপে বসল । মাত্র বছর খানেকের মধ্যেই একটা অবসাদ র্যাপারের মতো সারা শরীরে জড়িয়ে গেল !তোমার এমনটা মনে হয় না ?”
“ একেবারেই না । বরং এই পাঁচটা বছর যে কি শান্তিতে রয়েছি তা শুধু আমিই জানি । এখন সবটাই আমার ইচ্ছেতে হয় , অফিসের নিয়মে নয় । শুধু এই সময় ছেলে দুটো যদি কাছে থাকত তাহলে একেবারে সোনায় সোহাগা হত । কারোর নাতিকে দেখলে খুব পুটুসকে মিস করি ।“ সমন্বয় একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ।
কিছুটা সময় দুজনেই চুপচাপ হয়ে যায় । নিজেদের ভিতরে ডুব দিয়ে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে কিযে খোঁজে কে জানে ! এক সময় আবার উপরে ভেসে ওঠে । সমন্বয় পরীর দিকে তাকিয়ে দেখে সে গলির শেষ মাথায় বা হয়তো আরো দূরে তাকিয়ে রয়েছে । সমন্বয় আলতো করে পরীর নাম ধরে ডাক দেয় । পরী চমকে ওঠে । সমন্বয় বলে, “তুমি যে অবসাদের কথা বলছিলে তার মূল কারণ হচ্ছে একটা হিসেব তুমি একেবারেই বাদ দিয়ে দিয়েছ । আর তা হল ,যে সময়টা তুমি কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে , সেই সময়টাই এখন তোমার কাছে বাড়ন্ত হয়ে গেছে । একটু লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবে যে তুমি আগে মোটামুটি বাড়িতে যা করতে এখনও প্রায় তাই কর । কাজেই বাড়ন্ত সময়টাই এখন তোমার কাছে অবসাদ ডেকে এনেছে ।“
“দেখ ,ব্যাপারটা যে আমি একেবারেই বুঝিনা , তা নয় । আসলে ভেবেছিলাম জীবনের এই অধ্যায়টা বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করব । কিন্তু তা আর হল না ।বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বোধ হয় বড় বেশি বুড়িয়ে গেলাম । একাকিত্ব বা অবসাদ যাই বলি না কেন এরা যেন ওৎ পেতে বসেছিল ! আর এটা বেশি করে টের পাই যখন তুমি বাড়িতে থাক না । এত বড় বাড়িতে শুধু আমি একা ! নিজের পায়ের শব্দই তখন একান্ত বল ভরসা বলে মনে হয় । যাক গে , এখন তাড়াতাড়ি কম্পিউটরটা ওপেন কর । হয়তো ছেলেটা স্কাইপে বসে পড়েছে । আমাদের সময় মতো না পেলে ভাববে হয়তো শরীর খারাপ হয়েছে ।
“ হ্যাঁ, তুমি যাও । আমি আসছি ।“ সমন্বয় উদাস গলায় বলে ।
“ কী ব্যাপার বলত ! তুমি ইদানীং জিসানের মুখোমুখি হতে চাও না ! ও স্কাইপে এলে তুমি আমার আড়ালে দাঁড়িয়ে কথা বল ! আমি লক্ষ্য করছি এটা কিন্তু ওয়ান আইড ডিয়ারের মতো ব্যবহার হচ্ছে । বাপ-ব্যাটার কোন ঝগড়া হয়েছে কি ?” পরীর গলায় একরাশ বিস্ময় ঝরে পড়ে ।
সমন্বয় মাথা নেড়ে মৃদু হেসে বলে , “আরে না ,না, ঝগড়া হবে কেন ! আসলে সারা গালে তো পাকা দাড়ি ,তাই ও হয়তো ভাববে যে আমি অসুস্থ । তোমার মনে আছে পর্ ,আগে ওরা বলত , বাবা
কিন্তু কোনদিন বুড়ো হবে না । আর আমিও ওদের বলতাম , হ্যাঁ , আমার মৃত্যুর পর তোমরা আমার দাড়ি কাটিয়ে তবে দাহ করবে । সারা গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আমার মোটেই ভাল লাগেনা ।“
“কিন্তু তুমিও তো ইদানীং রোজ ক্লিন সেভ কর না ।“ পরী অবাক হয়ে বলে
“আসলে আমাকেও বোধ হয় একটা অলসতা পেয়ে বসেছে । অনেক দিন এমনও হয়েছে যে হাতে ব্রাশ-রেজার নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাল করে মুখ দর্শন করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, থাক আজ আর দাড়ি কাটব না । কেন এমনটা হয় বুঝিনা । ঠিক আছে চল, এবার কম্পিউটারটা খুলে দেই । ওদিকে জিসানও হয়তো স্কাইপে বসে পড়েছে ।“
সমন্বয় কম্পিউটারটা খুলে দিয়ে নিজের এবং পরীর ওষুধ কিনতে বেরিয়ে যায় । জিসান এখনও স্কাইপে আসনি । পরী জানে এত তাড়াতাড়ি ওষুধ কিনতে যাওয়াটা সমন্বয়ের একটা অছিলা মাত্র । জিসান ও যিশু এরা দুজনেই এখন হাতের বাইরে । একজন স্টেটে আর একজন রয়েছে ব্যাঙ্গালুরুতে । ওদের এত দূরে চলে যাওয়াটাকে সমন্বয় মন থেকে মেনে নিতে পারেনি । মুখে কিছু না বললেও পরী বুঝতে পারে যে ছেলেদের এবং নাতির জন্য সব সময় সমন্বয়ের একটা দুশ্চিন্তা হয় । হয়তো এ জন্যই ওদের ছাড়তে চায়নি । প্রথমেতো ঠিক ছিল জিসানকে মাত্র এক বছরের জন্য পাঠান হচ্ছে । কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা যে বাড়তে বাড়তে আট বছরে গিয়ে ঠেকবে তা তো জানা ছিল না । তাই বাধ্য হয়েই ওরা পুটুসকে ওখানেই ভর্ত্তি করে দিয়েছে । ব্যস, ওদের ফিরে আসার যতটুকু আশা ছিল তা এভাবে শেষ হয়ে যাওয়ায় সমন্বয় ব্যাপারটাকে ভাল মনে মেনে নিতে পারেনি । তাই মনে মনে গুমরে মরে ! পরী একদিন বলেছিল ,”দেখ ছেলেদের যখন ভাল করে লেখাপড়া শেখান হয়েছে তখন তো আমরা ভেবেছি যে ওরা নিজেদের জগতে প্রতিষ্ঠিত হোক । এজন্য তো তাদের বাড়িতে বসিয়ে রাখলে চলবে না । সন্তানের প্রতি স্নেহ-মায়া অবশ্যই থাকবে । কিন্তু তা যেন ওদের বেড়ে ওঠার পথে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে , সেটাও দেখতে হবে । যেন কখনও পরে না বলতে পারে যে তোমাদের জন্য আমাদের কিছুই হল না । তাছাড়া আজ যদি আমাদের মেয়ে থাকত ,তাহলে কী করতে ? ওকেও তো লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করে চাকরী এবং বিয়ে দিতে হত । তখন সেও তো চোখের আড়ালেই চলে যেত ।“ অবশ্য এ ব্যাপারে পরী নিজে অনেকটা খোলামেলা । ছেলেরা বাইরে আছে এটা অন্যের কাছে বলতেও তো বেশ গর্ব হয় । যতই সমন্বয় হ্যাংলা শব্দ ব্যবহার করুক না কেন কখনও কখনও হ্যাংলামো করতে নেহাত মন্দ লাগে না । তারিয়ে তারিয়ে আচার খাওয়ার মতো মনে হয় । সেই সাথে নিজেকে রত্ন গর্ভা ভাবতে ভালই লাগে । তবে ইদানীং এমন রত্ন গর্ভার সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না । প্রায় সবার বাড়িতেই কেউ না কেউ বিদেশে রয়েছে । বিশেষ করে আইটিতে যাদের ছেলে-মেয়েরা কাজ করে ।এ রাজ্যে আর চাকরী কোথায় যে ছেলে-মেয়েরা দেশেই থাকবে ।
আজ জিসানের সাথে বেশিক্ষণ কথা হয়নি । ওর ঠান্ডা লেগে গলা ব্যথা করছে । অবশ্য ও অনেক কথাই বলেছে । কিন্তু পরীই চায়নি যে জিসান বেশি কথা বলুক । কথা বলতে নিশ্চয়ই ওর কষ্ট হচ্ছিল । এদিকে এখনও শঙ্করী এল না । দুপুরে এই আসছি বলে বাড়ি গেছে । অথচ সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল আসার নামটি নেই । ও না এলে হাঁটু দুটোর ম্যাসাজ হবে না । তাহলে সকালে আর মাটিতে পা ফেলাও সম্ভব হবে না । ওকে নিয়ে এই হয়েছে এক জ্বালা । পরী মনে মনে গজগজ করতে করতে ব্যালকনিতে গিয়ে বসে ।
।। দুই ।।
এখন সমন্বয় ও পরীর ব্যালকনি সর্বস্য জীবন । বাড়িতে যতটুকু সময় ওরা জেগে থাকে এই এক চিলতে ঝুল বারান্দাকেই ওরা আঁকড়ে থাকতে চায় । পথ চলতি লোকদের দেখা বা পরিচিত লোকদের ভাল-মন্দ জিজ্ঞাসা করেই ওদের সময় কাটে । ইদানীং সমন্বয়ের ডান কানটা বেশ দুর্বল হয়ে গেছে । অন্যকে সামান্য কথাও একটু জোরেই বলতে হয় । সেই সাথে হাতে অফুরন্ত সময় থাকায় পরিচিত লোক দেখলে আর যেন ছাড়তে ইচ্ছা করে না । কিন্তু মাঝে মাঝে সমন্বয়ের মনে হয় ওরা বুঝি তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে ! কেউ কেউ আবার রোদ বিহীন রাস্তাতেও ছাতার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায় ! তাহলে কি সে সবার কাছে অবাঞ্ছিত হয়ে গেছে ! ভীষণ কষ্ট হয় সমন্বয়ের ।
সমন্বয় সান্ধ চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে এসে বসল । রাস্তার সবকটি আলো আজ জ্বলেনি ! তাই রাস্তার কিছুটা আলো-আঁধারি । সমন্বয় সেদিকে তাকিয়ে বলল, “বুঝলে পরী , আজ যেন আমাদের এই গলির দু চোখ জুড়ে ঘুম নেমেছে ! ভাল করে তাকাতে পারছে না !”
পরী সে দিকেই তাকিয়ে ছিল । বার কয়েক কাপে সিপ্ দিয়ে সে ঐ প্রসঙ্গে না গিয়ে বলল, “কই তুমি বললে না তো ডাক্তার বাবু তোমাকে কী বললেন ।“
সমন্বয় এতক্ষণ গলির আলো আঁধারিতে ডুবে ছিল । পরীর কথায় তার ঘোর কেটে যায় । সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলে, “কী আবার বলবেন । সেই একই কথা । ঘাম ঝরিয়ে হাঁটুন, ঘাম ঝরিয়ে হাঁটুন । আরে বাবা পারলে কি আর হাঁটতাম না । কে চায় সুগার নিয়ে বেঁচে থাকতে । যত সব ডিসগাস্টিং ব্যাপার ।“
“আর প্রেসারের কথা কিছু বলেন নি ?” পরী আবার খুঁটিয়ে জানতে চায় ।
“সেতো মেপেই দেখা গেল । সবই প্রায় নরমাল । একশ ষাট বাই একশ । চিন্তার কোন কারণ নেই ।“ সমন্বয় হাসে ।
“ এটা মোটেই ঠিক নেই । তুমি ওষুধের ব্যাপারে কিছু বলনি ?”
“প্রয়োজন হলে তো উনি নিশ্চয়ই দিতেন ।আমি কেন সাধ করে চাইতে যাব । তাছাড়া একবার প্রেসারের ওষুধ খাওয়া শুরু করলে আজীবন খেয়ে যেতে হবে । এখন ছাড় ওসব কথা । তোমাকে তো আসল গল্পটাই বলতে ভুলে গেছি । তুমি তো বাইপাসের দিকে অতটা যাওনি । গেলে দেখতে কত বিশাল বিশাল কমপ্লেক্স হয়েছে । তারই একটার নাম “ নিহারিকা হাউজিং “ । ওরই দশ তলায় থাকতেন মিঃ এবং মিসেস বোস । তাঁদের একই ছেলে । সে বছর দশেক ধরে বিদেশেই থাকে । তাই প্রত্যেক বছর বাড়ি এসে কিছু দিন বাবা-মায়ের সাথে কাটিয়ে যায় । কিন্তু ছেলের পড়াশুনোর জন্য বছর দুয়েক ধরে আর আসতে পারেনি । এদিকে আমাদের মতো ওদেরও স্কাইপ আর হোয়াটস অ্যাপ নির্ভর জীবনটা ক্রমশই দুর্বিষহ হয়ে উঠছিল । তাই গত সপ্তাহে ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীর বুকে গুলি করে নিজে আত্মঘাতী হয়েছেন । কিন্তু নিজের মাথায় গুলিটা ঠিক মতো লাগেনি । তাই চারদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর তিনিও শেষে মারা গেছেন । ওদের ড্রয়িং রুমে একটা স্টেটমেন্ট পাওয়া গিয়েছে । তাতে তারা যৌথভাবে লিখেছেন যে এই মৃত্যুটা একান্তই
তাঁদের যৌথ সিদ্ধান্তের ফসল । সব শেষে রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন –‘ মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সমান ‘।“
“কী সাংঘাতিক লোক তো ! একেবারে ঠান্ডা মাথায় স্ত্রীকে মেরে তারপর নিজে – উঃ ! আমি তো ভাবতেই পারছি না !” পরীর গলা দিয়ে একটা গোঙানীর মতো আওয়াজ বেরিয়ে আসে ।
“কেন এমন কথা বলছ ? ওরা তো নিজেদের একাকিত্বের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল । কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা । ব্যাপারটা আরো সাংঘাতিক হত যদি ভদ্রলোক
বেঁচে থাকতেন । ভাবতে পারছ , তাহলে উনি একটা গূঢ় অপরাধ বোধে বাকি জীবনটা শুধু দগ্ধে মরতেন না, একটা ট্রমার মধ্যে দিয়ে বাঁচতেন ! সেটা হত বেঁচে থেকেও মরার সামিল । এ যন্ত্রনাটা হত কাটা জায়গায় নুন ছিটিয়ে দেওয়ার মতো মর্মান্তিক !” সমন্বয় চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ।
।। তিন ।।
বাজারের ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে ফ্রিজের সামনে রেখে সমন্বয় মাছের ছোট ব্যাগটা রান্না ঘরের সিঙ্কে উপুড় করে দেয় । মাছের পুঁটলি দুটো সিঙ্কে পড়ে যায় । এবার ব্যাগটা ধুয়ে বাইরের গ্রিলে ঝুলিয়ে রাখে । প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট থেকে মাছগুলো জলের নীচে ঢেলে দিয়ে ভাল করে কচলে ধুয়ে নেয় । তারপর ডিপ ফ্রিজ থেকে মাছের বাস্কেট এনে তাতে গুছিয়ে রাখে । এবার সবজিগুলো বড় বাস্কেটে রেখে ভাল করে হাত-মুখ ধুয়ে শরীরের সাথে এঁটে যাওয়া জামাটা চেয়ারের পিছনে রেখে ফুল স্পিডে ফ্যানটা চালিয়ে দেয় । কে বলবে যে ফেব্রুয়ারির শেষ ! আবহাওয়া দপ্তরের ঘোষনা এবার নাকি সাংঘাতিক গরম পড়বে ! এটা হয়তো তারই আভাস । শরীরটা সোফায় এলিয়ে দিয়ে সমন্বয় কাগজটা টেনে নেয় । এমন সময় শঙ্করী পরীর ঘর থেকে বাইরে এসে বলে , “দাদাবাবু , চা দেব ?”
সমন্বয় ঘাড় কাৎ করে বলে, “ হ্যাঁ, দাও । তোমার বৌদির হাঁটু মালিশ হয়েছে ?”
“হ্যাঁ, এবেলার মতো হয়েছে ।“ শঙ্করী চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে বলে ।
“বেশ-বেশ । তাহলে বৌদির চাটাও এখানেই দাও ।“
“বৌদি এখন খাবে না বলেছে । একেবারে চান করে খাবে ।“ শঙ্করী রান্না ঘর থেকে বলে ।
সমন্বয় চায়ের কাপটা নিয়ে উঠে দাঁড়ায় । ঘরের ফ্যানটা অফ করে দিয়ে ব্যালকনিতে এসে বসে । এখানেও ফ্যান আছে । কিন্তু এই মুহূর্তে একটা সিরসিরে বাতাস বইছে ! এই ব্যালকনিতে ওরা দুজনে যে সারাদিনে কতবার বসে তার কোন হিসেব নেই । বিছানায় চোখ মেলে চাইলেই আর শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না । আসলে এই বয়সে এসে কর্মহীন জীবনের যে একাকিত্ব তা ইদানীং বড় বেশি করে মানুষের সান্নিধ্য টানে । তা সে পরিচিত হোক বা অপরিচিতই হোক অথবা কথা হোক বা না হোক । শুধু মানুষের চলাচলের দিকে তাকিয়ে থাকা । পরিচিতদের সাথে যে কথা হয় না , তা নয় । কিন্তু তাদের সময়ের দাম আছে । তারা তো আর তার মতো কর্মহীন বৃদ্ধ নয় । তবে তার সম বয়সি অনেক প্রবীণ আছেন যাঁরা তার মতো একাকিত্বে ভোগেন না । দিব্বি নাতি-নাতনিদের নিয়ে হৈ-হৈ করে মজায় দিন কাটান । তবে হ্যাঁ, ছেলের সংসারে তাঁরা কতটা বাঞ্ছিত তা হলফ করে বলা যাচ্ছে না ।
পরী তার ছোট গ্রীবার উপর কাঁচা-পাকা চুলগুলো ছড়িয়ে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে ব্যালকনিতে এসে
বসে । চুল যে ভাল করে মোছা হয়নি তা বোঝা যায় । চুলের আগায় এখনও টলটল করছে বেশ কিছু জল বিন্দু । সেদিকে তাকিয়ে সমন্বয়ের একটা পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে যায় ।তখন সদ্য ওদের বিয়ে হয়েছে
। রোজ সকালে ওঠা এবং স্নানটা সেরে ফেলা পরীর চিরকালের স্বভাব । সমন্বয় একটু দেরি করে উঠত । তাই সকালে চায়ের কাপ হাতে পরী যখন তাকে ডেকে তুলতো তখনও সে এমনই এক পিঠ ছড়ানো কালো চুলের আগায় অনেক মুক্তো ঝুলতে দেখেছে । আজ সেই কালো চুল আর নেই কিন্তু মুক্তোগুলো রয়ে গেছে ! সমন্বয় সামান্য গলা খাঁকারি দিয়ে বলল ,” এই কিছুক্ষণ আগে ননীগোপালের সাথে কথা হল । আমাকে বসে থাকতে দেখে ও এগিয়ে এসে বলল- “ প্রায় ছয় মাস আর দেখা হবে না দাদা । বড় খোকার ওখানে যাব । ফিরতে ফিরতে প্রায় পুজো চলে আসবে । আমি জানতে চাইলাম,’ নয়ন এখন কোথায় ?’ ননীগোপাল বলল ,’ ফিলাডেলফিয়ায় ।‘ যাই বল ওরা কিন্তু দিব্বি আছে । ছয় মাস বিদেশে তো বাকি ছয় মাস স্বদেশে । একেই বলে প্রশস্ত কপাল ।“ সমন্বয় হয়তো নিজের ভাগ্যের সাথে ননীগোপালের সৌভাগ্যের তুলনা করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল ।
পরী এ ব্যাপারে কোন আগ্রহ না দেখিয়ে বলল’ “ বাজার থেকে কী মাছ এনেছ ?”
“ঐ তো দুশ গ্রাম বাগদা আর আড়াইশ গ্রাম কাটা পোনা । সাথে একটা হাফ নারকোল এনেছি । কিছুটা দিয়ে মালাইকারি করতে বলবে আর বাকিটা যেন মোচায় দেয় ।“ সমন্বয় নিঃশব্দে একটা তৃপ্তির ঢোক গিলে নেয় ।
“ না, হবে না ।“ পরীর গলায় একরাশ ঝাঁঝ ঝরে পড়ে ।
“ কেন হবে না শুনতে পারি কি ?”
“ হবে না যখন বলেছি , তখন হবে না । তোমার লজ্জা করে না । যার কোলেস্টেরল বেশির দিকে তার লজ্জা করেনা নারকোল কিনে আনতে । আমি তো আগেই বলেছি যে জিসান-যিশু এরা চিংড়ির মালাইকারি খেতে কতই না ভালবাসতো । তাই আমি আজো ওদের কথা ভেবে মুখে তুলতে পারিনা । অথচ তুমি কিনা – “
সমন্বয় তাড়াতাড়ি বলে , “ তাহলে কি ঐ মাছ ফেলে দেবে ? “
“আমি কি ফেলে দেব বলেছি । কেন কালজিরা-কাঁচা লংকা তাতে মিষ্টি কুমড়ো দিয়ে কোনদিন খাওনি ? সেটাও তো বেশ সুস্বাদু হয় । তোমার বয়স যত বাড়ছে নোলাটাও কিন্তু বেড়ে চলেছে । এই বয়সে লোকে সব ব্যাপারেই সংযমি হয় । কিন্তু তোমার সে বালাই নেই !”
“ওরা দু ভাই তো আরো অনেক কিছুই খেতে ভালবাসত । তা বলে কি আমরা সব কিছু বাদ দিতে পেরেছি ! নাকি নিজেরা খাই না ! ওদের জন্য শুধু শুধু মানসিক কষ্ট পাওয়ার কোন যুক্তি নেই !” সমন্বয় একটু রাগত গলায় বলে ।
“কই আমিতো সব খাবারের কথা বলিনি । শুধু চিংড়ির মালাইকারি,ইলিশের ভাপা আর খেজুর পাটালি দিয়ে পায়েস । ব্যস, এই তো মাত্র তিনটে জিনিস । এগুলো ওদের ছাড়া আমি মুখে দিতে পারিনা । আর এটা তুমি খুব ভাল ভাবেই জান ।“
সমন্বয় হাসতে হাসতে বলে, “দেখ , যারা হোমমেকার এসব কথা তাদের মুখে মানায় । কারণ তাদের জীবনের পুরোটাই আবর্তিত থাকে তাদের সন্তানকে ঘিরে । অথচ তোমার তো তা নয় । তুমি তো
সারা জীবনই চাকরী করলে । এক কথায় কাজের লোকের কাছেই ওরা মানুষ । ছুটির দিন ছাড়া ওরা তো সম্পূর্ণভাবে আমাদের পায়নি । জানি এতে হয়তো ওদের একটা মানসিক খেদ থেকে গেছে । কিন্তু আমরা
যতটুকু পেরেছি তা পূরণ করার চেষ্টা করেছি । কোন কিছুর ব্যাপারে আমরা সামান্যতম কার্পন্য করেছি এটা ওরা বলতে পারবে না । তাই ওসব ঠুনকো সেন্টিমেন্ট নিয়ে বসে থেকে লাভ নেই । ওরা যখন
নিজেদের মতো করে বেঁচে আছে তখন আমরাই বা থাকব না কেন ! তাছাড়া তুমি তো বউদের দু চারটি ভাল রেসিপি বলেও দিতে পার । ওরা অন্তত চেষ্টা করুক । স্বামীদের খাওয়াক ।“
“ওদের রেসিপি বলিনা কে বলল । আজই তো বললাম । জিসান নাকি দিন দুয়েক আগে লোভে পড়ে দুটো কচি চিচিংগা নিয়ে এসেছে । তাই মনিদীপা জানতে চাইছিল কীভাবে রান্না করব । তিনটি পদ্ধতি বলে দিলুম ।“
“একে চিচিংগা, তায় আবার তিনটি ফর্মূলা ! বাড়িতে করেছ বলে তো মনে পড়ে না ।“
“তা এখন মনে পড়বে কেন ! অকৃতজ্ঞ তো গাছে ফলে না । কেন তুমি কালজিরা-শুকনো লংকা ফোড়ন দিয়ে চিচিংগা খাও নি ? আবার পেঁয়াজ কুচি দিয়ে নামানোর সময় পোস্ত বাটা । বল খাও নি ? আবার কুঁচো চিংড়ি ছড়িয়েও তো করেছি । জানি এখন তোমার কিছুই মনে পড়বে না । আসলে ওসব তুমি ইচ্ছে করেই মনে রাখ না ।“
সমন্বয় আবার হাসতে হাসতে বলে, “দেশটা সাহেব সুবোদের হলেও ওখানে প্রচুর হাবাইতা বা আদেখলা ভারতীয় থাকায় সবই পাওয়া যায় । কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে এত ভাল ভাল রেসিপি থাকতে শেষে কিনা তুমি চিচিংগার রেসিপি শেখালে ! কেন মালাইকারি বা ইলিশ ভাপা কি বউয়েরা করতে পারবে না নাকি ! মাঝখান থেকে শুধু –“
সমন্বয় তার কথাটা শেষ না করলেও পরীর বুঝতে বাকি রইল না যে সে ঐ চিংড়ি ভাপার শোক এখনও ভুলতে পারেনি । কিন্তু কথা বাড়িয়ে লাভ নেই । উত্তর দিলেই এক কথা থেকে আর এক কথা হবে । আর শেষ হবে ঝগড়ায় । তারচেয়ে বাবা বোবা-কালার অভিনয় করাই ভাল । তাই পরী তাড়াতাড়ি চায়ের কাপদুটো নিয়ে উঠে পড়ে ।
।। চার ।।
যে লোকটি এত বড় বাড়ির মধ্যে ঐ ব্যালকনি ছাড়া আর কিছুই চেনে না তাকে ব্যালকনিতে না দেখতে পেয়ে পরী সমন্বয়ের ঘরে উঁকি দেয় । সমন্বয় তখন এক মনে কি যেন লিখছিল । পরী অবাক হয়ে ভাবে শেষে কি এই বয়সে এসে সমন্বয়ের কবিতা পেয়েছে ! সে পা টিপে টিপে পিছনে গিয়ে দাঁড়ায় । উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে । কিন্তু কিছুই বুঝতে পারে না ।
এক সময় সমন্বয় টের পেয়ে হেসে বলে, “কি লিখছি জান ?”
পরী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে মাথা নেড়ে বলে, “না “।
সমন্বয় বেশ গর্বের সাথে বলে , “জানতাম তুমি বলতে পারবে না । এই কাগজটার মূল্য কোন অংশেই অর্থের চেয়ে কম নয় । তোমার হয়তো প্রচুর অর্থ থাকতে পারে । কিন্তু আপদে-বিপদে তা কীভাবে খরচ করবে তখন তা মনে পড়বে না । তখন তোমার চারদিকে অসৎ লোকদের ভিড় জমে যাবে । সেই
সময় মাথাটাও দেখবে ঠিক ভাবে কাজ করছে না ! যেমন ধর, ওষুধ এনে দেওয়া । কাকে দিয়ে আনাবে লোক পাচ্ছ না । বাজার করে দেওয়ার লোক পাচ্ছ না । ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার লোক পাচ্ছ না ।
এমন কি ব্যাংকে নিয়ে যাওয়ারও কাউকে হাতের কাছে পাচ্ছ না ! অথবা কোথাও বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করছে , সেটাও বিশ্বস্ত লোকের অভাবে সম্ভব হচ্ছে না । তখন কী করবে !”
“কেন , তুমি কি দীর্ঘদিনের জন্য কোথাও যাচ্ছ ? নাকি একেবারেই বিবাগী হয়ে যাবে ? তোমার মতলবটা কী বলত ?” পরী ভূরু কুঁচকে জানতে চায় ।
“আরে বাবা আমি কি আমার জন্য ভাবছি নাকি ! আমি তো ভাবছি তোমার জন্য ।“
“আমার জন্য মানে !” পরী অবাক হয়ে জানতে চায় ।
“আরে বাবা আমার অবর্তমানে তোমার এটা ভীষণ কাজে লাগবে । যত্ন করে হাতের কাছে রেখ । এই কাগজটাকে আবার লকারে রেখ না । শেষে কাজের সময় দেখবে এটাকে আর খুঁজে পাচ্ছ না ।“
“আচ্ছা একটা কথা বলত । তোমার শরীর খারাপ হয়নি তো ? রাতে ভাল ঘুম হয়েছে তো ? কোন রকম পেট গরম হয়নি তো ?” পরী অবাক হয়ে জানতে চায় ।
“কেন , ওসব হতে যাবে কেন ! আমি তো দিব্বি ভালই আছি । অন্তত ফার বেটার দ্যান ইউ ।“ সমন্বয়ের ঠোঁটে সামান্য হাসির ঝলক খেলে যায় ।
“কে আগে যাবে, আর কে থাকবে তার কোন হিসেব নেই । অথচ সাত সকালেই যত আজে বাজে কাজ । কে বলেছে যে তুমি আগে ড্যাং ড্যাং করে চলে যাবে আর আমি এত বড় বাড়ি আগলে একা পড়ে থাকব ।“
“আচ্ছা পরী , এটা কি কেউ বলতে পারে ! নাকি বলা যায় । আমি এমনও দেখেছি প্রায় চার বছর শয্যাশায়ি ছিল আমার ন পিসি । কিন্তু সুস্থ সবল পিসেমশাই হঠাৎ একদিন আগে চলে গেলেন । তাই বলছি আগে থাকতে এসব বলা যায় না । তোমারও কাজে লাগতে পারে বা আমারও ।“
“ তা কী আছে ঐ কাগজে ? “পরী এতক্ষণে জানতে চাইল ।
“ এখানে দুটো সংস্থার নাম ও ঠিকানা আছে যারা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় । এঁরা বিশ্বস্তও বটে । এদের অন্ধের যষ্টিও বলা যেতে পারে । ইদানীং তেমন বিশ্বস্ত লোক পাওয়া মুশকিল । তাই ঐ সংস্থার নামগুলো টুকে রেখেছি ।“ এবার সমন্বয় একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ।
“ঠিক আছে , আমি না হয় তোমার যুক্তি মেনে নিলাম । কিন্তু জানতো ইদানীং আমি মাঝে মাঝেই খুব একাকিত্ব বোধ করছি । বিশেষ করে বাড়িতে একা থাকার সময় । মনে হয় আমি বুঝি একেবারে ফুরিয়ে গেছি । আমাদের করার মতো কি কোন কাজই নেই ! নাকি আমি মানসিক দিক দিয়ে ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ছি ! বিশেষ করে হাঁটু দুটো ব্যথা করলে এ সব কথা বেশি করে মনে হয় ।“
সমন্বয় হাসলে ওর চোখ দিয়ে অনেকের মতোই জল গড়ায় । পরীর কথায় হাসতে গিয়ে এখন ঠিক তাই হল । হাতের চেটো দিয়ে তা মুছতে মুছতে সে বলে,” যাকগে , এতদিনে তাহলে একটা সঠিক কথা ভাবতে পেরেছ । দেখ , তোমার দুই ছেলে । ওদের ওখানে তুমি ইচ্ছে করলেই যেতে পার । অথচ এই বাড়ি ছেড়ে তুমি যাবেনা । আবার একাকিত্বও তোমাকে ছাড়বে না । তাহলে নিজেকে একটা কাজের মধ্যে আটকে রাখ । তখন আবার বলবে ,আমার হাঁটু ব্যথা । একেবারেই দৌড় ঝাঁপ করতে পারব না ।“
“এই শোন, আমি ইচ্ছে করলেই ওদের কাছে চলে যেতে পারি । কিন্তু কেন যেতে পারছি না জান ? শুধু তোমার জন্য । আমি যাই আর তুমি শরীরের উপর অত্যাচার করে একটা বিপদ ঘটাও আর কি ! শেষে হ্যাপাটাতো আমাকেই সামলাতে হবে নাকি ! তা না হলে কবে চলে যেতাম । “
এবার আর সমন্বয় হো-হো করে না হেসে মৃদু মাথা দুলিয়ে মুচকি হেসে বলল, “এতদিনে তাহলে ছেলেদের কাছে না যাওয়ার পক্ষে একটা বেশ যুতসই যুক্তি বানাতে পেরেছ । শুনেও ভাল লাগল যে আমি অন্তত সহায়হীন নই । আমার জন্য ভাববার কেউ আছে । সেতো আমিও বলতে পারি যে তোমার হাঁটু ব্যথার কথা ভেবে আমিও কোথাও যেতে পারলাম না । অবসরের আট বছর পার করেও একই জায়গায় আটকে রয়েছি ।“
“ একেবারে ফালতু কথা বলবে না বলে দিলাম । যেন উনি রোজ আমার হাঁটু মালিশ করে দিচ্ছেন । যত্ত সব আদিখ্যেতার কথা । ব্যথায় কঁকিয়ে মরলেও যে সামান্য সহানুভূতি দেখায় না সে কিনা হাঁটু ব্যথার কথা বলে ! তোমার কথা শুনলে ঘোড়াতেও হাসবে । আমার হাঁটু নিয়ে না ভেবে বরং কাজের কথা বল । টাইম কিলিং এর কথা ভাব । কারণ তুমি যদি আগে চলে যাও তাহলে আমি কিন্তু গোটা চারেক বেড়াল আর গোটা দুয়েক কুকুর নিয়ে একাকিত্ব দূর করতে পারব না ।“ পরী এক নাগাড়ে কথা বলে এবার যেন দম নেওয়ার জন্য থামল ।
সমন্বয় অবাক হয়ে বলে,” হঠাৎ কেন কুকুর –বেড়ালের প্রসঙ্গ উঠল ! কোন কালেই তো আমাদের বেড়াল ছিল না । বরং বহু আগে আমরা কুকুর পুষতাম বটে ।“
“কেন সেদিন তো মদন এসে ঘটনাটা বলল । তোমার মনে নেই !”
“কোন গল্পটা বলেছিল ঠিক মনে পড়ছে না ।“ সমন্বয় মনে করতে পারে না ।
“আরে বাবা,সেই যে একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে এক বৃদ্ধ দম্পতি থাকতেন । হঠাৎ এক রাতে ভদ্রলোকের সামান্য বুক ব্যথা হল । স্ত্রী দিশেহারা হয়ে বোস্টনে ছেলের কাছে ফোন করলেন ।অথচ লাইন পেলেন না । শেষে নিজেই স্বামীর বুকে হাত বুলিয়ে যেতে লাগলেন । উনি বুঝতেই পারেন নি স্বামী কখন মারা গেছেন । অত রাতে ডাক্তারের ফোন বন্ধ থাকায় একেবারে অসহায়ের মতো চোখের সামনে স্বামীকে চলে যেতে দেখে তিনি কেমন যেন পাথর হয়ে গেলেন । এখন তিনি একাকিত্ব দূর করার জন্য একগাদা বেড়াল-কুকুর পুষ্যির সাথে সংসার করেন আর ডাব্বাওয়ালার খাবার খান ।ওনার কপালটা একবার ভাব । ছেলে থেকেও নেই ! সে নাকি ছুটি পায়নি বলে আসতে পারেনি । এটা কোন কাজের কথা হল ! তাই আমি যেমন কারোর অনুগ্রহও চাইনা , তেমনি পুষ্যিদের নিয়ে থাকতেও চাই না ।“
সমন্বয় এতক্ষণ পরীর কথা শুনছিল । অথচ খুব গভীর ভাবে কিছু শুনছিল না ! কারণ তার মাথার মধ্যে প্রথম থেকেই একটা নতুন ভাবনা ঠুকঠুক ঠুকঠুক করে একটা কিছু নির্মাণ করে চলছিল । আর তা যতই একটা অবয়ব পাচ্ছিল ততই সেই নির্মাণের চারদিক থেকে একটা নরম আলোর বিচ্ছুরণ মাথার ভিতরটা ভাসিয়ে দিচ্ছিল ! এক সময় সেই নতুন ভাবনাটার একটা পূর্ণাবয়ব হয়ে যেতেই সমন্বয় ‘ইউরেকা – ইউরেকা’ বলে চীৎকার করে ওঠে !
পরী এতক্ষণ মনে মনে চাইছিল সমন্বয় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একটা কিছু বলুক । কিন্তু সমন্বয়কে চুপ করে থাকতে দেখে সে বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায় । এমন সময় সমন্বয়ের অমন বেমক্কা চীৎকারে ভয় পেয়ে সে আবার থপ করে বসে পড়ে এবং স্বামীর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে! যে কোনদিন উচ্চগ্রামে কথা
বলেনি সে হঠাৎ অমন ভাবে চেঁচিয়ে ওঠায় পরী ভাবে এটা কি সেই বৃদ্ধ দম্পতির ঘটনার কোন এফেক্ট ! নাকি ওরও বুকে ব্যথা করছে !
সমন্বয় পরীর হাত দুটো নিজের করতলে আবদ্ধ করে হাসতে হাসতে বলে, “পেয়ে গেছি পরী , আমি পেয়ে গেছি । যা ক’দিন ধরেই ভাবছিলাম আজ তার ওষুধ পেয়ে গেছি ।“
পরী হতবাক হয়ে সমন্বয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে !
সমন্বয়ের চোখ দুটো আনন্দে চকচক করে ওঠে ! সে দুই ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলে,”আমি যে কতটা বোকা আজ তা বুঝতে পারলাম । এতদিন পর্যন্ত নিজের বুদ্ধির উপর একটা আস্থা ছিল । কিন্তু সেটায় যে এতটা মোর্চে পড়ে গেছে তা ভাবিনি । তাই পথ খুঁজতে এতটা বছর চলে গেল !”
এবার পরী অধৈর্য হয়ে বলে,” কি তখন থেকে শুধু একই কথা বলে চলেছ , যার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না ! একবার ব্যাপারটা খোলসা করে বলবে তো । “
“আসলে আমাদের নিচের ঘরগুলোর কথা ভুলেই গেছিলাম ! অযত্নে ঘরগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । বরং ঐ ঘরগুলোয় একটা কোচিং সেন্টার খুললে কেমন হয় ?” সমন্বয় প্রশ্নটা করে পরীর মুখের অভিব্যক্তি লক্ষ করে ।
পরী কিছুটা সময় নিয়ে ভাবে । তারপর প্রায় স্বগতোক্তির মতো করে বলে, “ করলে একেবারে মন্দ হয় না । তবে পড়াবেটা কে ? আর ছাত্রই বা পাবে কোথায় ? “ পরী বুঝতে পারে ব্যাপারটা তার মনে এক চিলতে জায়গা করে নিয়েছে ।
সমন্বয় দ্বিগুন উৎসাহে বলে, “আরে সে সব নিয়ে তোমাকে বিন্দু মাত্র ভাবতে হবে না । একটা বড় করে ফ্লেক্স লাগিয়ে দিলে ছাত্র-ছাত্রী পেয়ে যাব । তার সাথে শিক্ষকও পেয়ে যাব । আমার পরিচিত অনেকেই আছেন যাঁরা ভালবেসে এমন কাজ করতে উৎসাহী হবেন । শুধু তাঁদের জন্য সামান্য চা-বিস্কুটের একটা ব্যবস্থা করতে হবে । কি পারবে না ?”
“সে না হয় হয়ে যাবে । কিন্তু হু উইল বেল দ্যা ক্যাট ?” পরী জানতে চায় ।
“তুমি থাকতে এ দায়িত্ব আর কে নেবে বল । ইউ উড বি অন দ্যা স্টিয়ারিং । আর বাকিটা আমি সামলে নেব । দাতব্য চিকিৎসালয়ের মতো এর নাম হবে “অবৈতনিক শিক্ষা নিকেতন ” । অথবা ‘ পরীদির ফ্রি কোচিং সেন্টার ‘ ।“
“আরে না-না । এ যেন মিলনদার কোচিং সেন্টারের মতো শোনাচ্ছে । এ নাম চলবে না । তবে প্রথমটা খুব একটা মন্দ নয় । আমি কিন্তু কোন অনিয়ম সহ্য করব না ।এ কথা আগেই বলে দিলাম ।“ পরীর কথা শুনে মনে হচ্ছে সে যেন এখনই স্কুলের হেড দিদিমনি হয়ে গেছে !
“আরে ঠিক আছে ,ঠিক আছে । অবৈতনিক বলে কি কোন ডিসিপ্লিন থাকবে না , তা আবার হয় নাকি ! সে ব্যাপারে পুরো কড়া নিয়ম থাকবে । এরপরে দেখবে আমাদের জীবনের অভিধানে ‘একাকিত্ব’ বলে আর কোন শব্দই খুঁজে পাওয়া যাবে না ।“
বহুদিন পরে সমন্বয় আর পরী দুজনেই হোহো করে হাসতে লাগল । ব্যালকনির সামনে দিয়ে যেতে যেতে পরিচিত লোকেরা থমকে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে ব্যাপারটা জানতে চাইলে সমন্বয় হাসতে হাসতেই কোনমতে বলল ,” বলব মশাই , পরে সবই বলব । আগে আমাদের একটু প্রাণ খুলে হাসতে দিন ।“
Tags: Anjan Sengupta, story, অঞ্জন সেনগুপ্ত, এই তো বেশ আছি, গল্প
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।