অফিস বেরোনোর ঠিক আগে ওইরকম অশান্তি করা কখনোই পছন্দ করে না আশিস। তাও আবার বাবা-মার সাথে। সারাদিনের মত মেজাজটা খিটখিটে হয়ে যায়। একে কাজের চাপ, তার উপর সংসারের দায়-দায়িত্ব – সব মিলিয়ে নিজের জন্য নিঃশ্বাস ফেলার সময়টুকু যখন পায় না, তখনই এমনটা ঘটিয়ে ফেলে সে।
“বাবা পুজো তো চলে এল, ফেরার পথে সরস্বতী ঠাকুর টা নিয়ে ফিরিস।“- বলার মধ্যে এইটুকুই বলেছিল আশিসের মা।
“আমি পারব না। বাবাকে বল। সবসময় সব দায়িত্ব যেন আমারই! আমার কাঁধ থেকে বোঝাটা একটু হাল্কা কর তো। সবসময় এটা কর, ওটা কর – আর ভাল লাগে না! নিজেরা করতে পারলে কর, নইলে ওইসব পুজো-টুজো তুলে দাও।”
ব্যাস। পুজো তুলে দাওয়ার কথা বলেই আশিস বাড়ি থেকে বেরিয়ে তো পরল, আর তার সাথে সাথে তার মা ওই কথা শুনে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। পিছু ফিরে দেখে নি আশিস, দৌড়ে এসে অটো ধরল।
-“ দাদা আপনি সামনে এসে বসুন, ওনারা পেশেন্ট আছেন।“ – অটো ড্রাইভার বলল। অগত্যা তাই করতে হল। আশিস দেখল পিছনের সিটে এক বৃদ্ধ দম্পতি বসে আছে। ভদ্রলোকের বয়স আশির কাছাকাছি হবে, আর ভদ্রমহিলাও খুবই বয়স্ক। লোকটির পায়ে ব্যান্ডেজ করা, খুব সম্ভবত হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
অটো চলতে শুরু করল। শীতের সকালে রোদ না উঠলে ঠাণ্ডাটা যেন দ্বিগুণ হয়ে যায়। চাবুকের মত সপাৎ সপাৎ করে গায়ে ঠাণ্ডা হাওয়ার প্রহার খেতে হচ্ছিল। কিন্তু সেদিকে মন নেই আশিসের। মনে যেন কেমন একটা ঝর শুরু হয়েছে সকাল থেকে। মার সাথে ওইভাবে ব্যাবহার করাটা বোধ হয় ঠিক হয় নি। কিন্তু করবে টা কি? মাথায় চিন্তার তো শেষ নেই; ফ্ল্যাটের ই.এম.আই ভরতে হবে, মায়ের চোখের ছানিটা কাটাতে হবে, বাবার পায়ে ব্যাথাটা আবার বেড়েছে, এ মাসে দুটো প্রিমিয়াম দেওয়ার আছে, কম্পিউটারটা অনেকদিন হল খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে; বন্ধুর ল্যাপটপ আটকে রেখে আর কতদিন চলবে? এবার নতুন একটা নিতে পারলে ভাল হয়, নিজের ফোনটাও অনেকদিন হল সমস্যা করছে, একটা নতুন কেনার কথা ভাবছিল সে; কিন্তু সখের আগে বারবার দায়িত্ব এসে হাজির হয়। তাই আর নিজের দিকটা দেখা হয় না। তার উপর যদি সবসময় ওইরকম অসহায় মুখ নিয়ে কেউ এটা করিস, ওটা করিস করে যায়; কতক্ষন মাথার ঠিক থাকে?
এসব চিন্তাই করছিল সে যখন অটোটা একটা হাসপাতালের সামনে এসে দাঁড়াল। পিছনে বসে থাকা যাত্রীর উদ্দেশ্যে ড্রাইভার বলল-
‘’ও মাসিমা , হাসপাতাল এসে গেছে, নামুন।‘’
‘’আচ্ছা বাবা, নামছি” – কাঁপা কাঁপা স্বরে ভদ্রমহিলা বললেন।
আশিস নেমে এল। পিছনের সিটটা দখল করবে বলে। ওদের নামার সঙ্গে সঙ্গে যেই না সে অটোতে উঠতে যাবে, অমনি ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন –
“বাবা একটু সাহায্য করবে? এনাকে একটু ভেতরে নিয়ে যাবে? আমার একার পক্ষে হবে না।“
“হ্যাঁ মাসিমা নিশ্চয়ই। “ বলে আশিস নেমে পরল আর ভদ্রলোককে ধরে ধরে হাসপাতালের ভিতরে এক জায়গায় বসিয়ে দিয়ে এল। ভদ্রমহিলা ড্রাইভারের হাত ধরে আসছিলেন। বোধ হয় পায়ে ব্যাথায় কষ্ট পাচ্ছেন।
আশিসকে ফিরতে দেখে তিনি বললেন – “বেঁচে থাক বাবা! ভগবান তোমার মঙ্গল করুন। আশীর্বাদ করি বাবা, ভাল থেকো। “
“না মাসিমা কোনও ব্যাপার না’’ – হাসিমুখে বলল সে। তারপর অটোয় উঠে গিয়ে বসল।
রাস্তাটার এপারে হাসপাতাল, অন্যপারে স্কুল। এতক্ষন লক্ষ্য করে নি আশিস। ভিড় দেখে মনে হল পরীক্ষা চলছে। সে দেখল – কি সুন্দর ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা বাবা কিংবা মায়ের হাত ধরে স্কুলে আসছে, আর তাদের ব্যাগ গুলো সব তাদের বাবা –মার কাঁধে। রাস্তা থেকে স্কুল প্রাঙ্গনটা অনেকটাই দেখা যায়। কোথাও কোন মা তার ছেলের জুতোর ফিতেটা বেঁধে দিচ্ছে, একটি ছোট্ট মেয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে, আজকে প্রথমদিন হয়ত। কেউ কেউ মায়ের কোলে করে, কেউ কেউ বাবার স্কুটারে করে আসছে। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে একটা জিনিস সমান লক্ষ্য করল আশিস। প্রত্যেক বাবা-মাই তার সন্তানকে ছেরে যাওয়ার আগে স্নেহের চুম্বন এঁকে দিচ্ছে তার কপালে। যেন কয়েক ঘণ্টার বিচ্ছেদেও তাদের সন্তান সুরক্ষিত থাকে, ভাল থাকে, তারই আশীর্বাদ স্বরূপ শেষ মুহূর্তের আদরটা করে দিয়ে যাচ্ছে। দেখে মনের জগতে নিজের ছোটবেলায় ফিরে গেল আশিস। নিমেষের মধ্যে একটা আবছা লবনাক্ত কুয়াশা তার চোখের কোনাটা ঘিরে ফেলল।
ইতিমধ্যে ড্রাইভার এসে অটো স্টার্ট দিল। আর জিজ্ঞেস করল –
“ কি দেখছেন দাদা?’’
“ওই যে। সব স্কুলে আসছে। “
“হ্যাঁ। “ হেসে উঠল ড্রাইভার। “ আজ নিজেদের বোঝাটা মা-বাপকে দিয়ে বওয়াচ্ছে, কাল যখন সময় আসবে, তখন মা-বাপ কেই বোঝা মনে করবে। এই যে দেখলেন না?”
‘’মানে?”
“মানে ওই যে ভদ্রলক-ভদ্রমহিলা কে ভিতরে পৌঁছে দিয়ে এলেন। কি অবস্থা দেখলেন?”
“হ্যাঁ তাই তো, এই অবস্থায় ওনারা একা রাস্তাঘাটে বেরচ্ছেন কি করে? এত গাড়িঘোড়া চলছে, যেকোনো মুহূর্তে একটা বিপদ হয়ে যেতে পারে। ওনাদের ছেলে বা কেউ নেই?”
“ আছে। বিদেশে আছে। ভদ্রমহিলা বলেছিলেন একবার।“
“তা বিদেশে আছে তো রোজগার নিশ্চয়ই ভাল হবে। বাবা-মার এরকম হাল কেন? পয়সা-কড়ি ঠিকঠাক পাঠায় না নাকি?”
“কি জানি? ওই টাকাটাই বোধ হয় না পাঠানোর মত করেই পাঠায়। ওখানেই সব দায়িত্ব শেষ।“
“হুম।”
“আসলে জানেন কি দাদা, দোষটা কিছুটা বাবা-মায়েরই।“
“কেন?”
“কেন আর কি? আজকাল দেখেন না, স্কুল-টিউশন, টিউশন-স্কুল করতে করতে বাবা-মায়েরা নিজেরাই যেন ছেলেমেয়েদের সাথে আরেকবার পড়াশোনা করে ফেলে। খেলাধুলা সব লাটে ওঠে, বাচ্চার ভবিষ্যৎ তৈরি করার দৌড়ে ওদের শৈশবটাই নষ্ট করে দেয়। আর তার সাথে সাথে মনুষ্যত্ব টাও হয়ত। ছেলে বেলায় কি ঠিক কি বেঠিক না শিখিয়েই কাঁধে অঙ্ক বই, ইংরাজি বই, বাংলা বই চাপিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দিল পরতে। ব্যাস। ছেলেপেলে শিখে গেল মানুষ হওয়া !”
অবাক হয়ে কথাগুলো শুনে চলছিল আশিস। কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। খালি বলল – “হ্যাঁ, সে তো বটেই। “
ড্রাইভার বলে যেতে থাকল –
‘‘আসলে কি বলুন তো, ওই সকালে টিউশন, দুপুরে স্কুল, বিকেলে আঁকা, নাচ, গান, সাঁতার এসব না করে দিনে একবেলা রুটিন করে এদের যদি ‘মানুষ’ হওয়াটা শেখানো যেত, তাহলে বড় হয়ে বাপ-মার এই অবস্থা করত না। আসলে জানেন কি, আজ-কালকার বাবা-মায়েরা ছেলে মেয়েদের মানুষ করতে গিয়ে তাড়াহুড়োয় এক একটা ‘টাকা কামানোর মেশিন’ বানিয়ে ফেলছে।‘’
ইতিমধ্যে অটোটা আশিসের অফিসের সামনে এসে দাঁড়াল। ড্রাইভার কে ভাড়া মিটিয়ে যেই না এক পা বাড়িয়েছে, অমনি ফোনটা বেজে উঠল। রিসিভ করতেই ওপারে মায়ের উদ্বেগপূর্ণ কণ্ঠস্বর-
“ কি রে বাবাই; খাবারটা না খেয়েই বেরিয়ে গেলি! আর এদিকে রাগের মাথায় টিফিনটাও নিতে ভুলে গেলি? রাস্তাঘাটে বেরোনোর আগে এত রাগারাগি করতে আছে? চিন্তা হয় না?”
আশিসের মনে এতক্ষন যে মেঘ জমেছিল সেটা যেন প্লাবন হয়ে নেমে এল ওর চোখ দিয়ে! ভাঙা ভাঙা গলায় সে বলল – “ Sorry মা। ভুল হয়ে গেছে । তুমি চিন্তা কোর না, আমি পৌঁছে গেছি।“
“আচ্ছা। আর তোর বাবাকে পাঠাচ্ছি ঠাকুর আনতে। তুই সাবধানে ফিরিস বাবা, কেমন?”
‘’ না মা। বাবাকে পাঠিও না। আমিই ফেরার পথে মা সরস্বতী- কে নিয়ে ফিরব। আর পুজো হবেই! এখনও ‘মানুষ’ হওয়া শেখাটা বাকি আছে গো।“
Tags: Debasis Saha, story, গল্প, টাকা কামানোর মেশিন, দেবাশিস সাহা
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।