18 Apr

স্বর্গসন্ধানী

লিখেছেন:মৃন্ময় চক্রবর্তী


চাঁদিফাটা রোদে ধানের নাড়াগুলো যেন এবার ঝলসে উঠবে– এমন এক প্রখর বেলায় একজন পথিকের ক্লান্ত ঘোড়া মাঠের উপর দিয়ে যেতে যেতে প্রাচীন একটি অশথ গাছের নিচে থামতে বাধ্য হল। সে শুনেছে কুরুক্ষেত্রের কাছাকাছি কোথাও একজন সাধুপুরুষ থাকেন, যিনি সেবাপরায়ণ। সেই ঠিকানা এখন খুব দরকার। ক্ষুধায় তৃষ্ণায় তিনি ও তাঁর বাহন ভয়ানক অবসন্ন।

অশথের ডাল ধরে দোল খাচ্ছিল কিছু গোপালবালক, পথিক তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, খোকারা তোমরা সেই মহাপুরুষের ঠিকানা বলতে পারো? ছেলেরা বলল, ঋষি মুদগলের কথা বলছেন কি মান্যবর? তিনি কাছেই থাকেন, ওই যে মাঠের শেষে তালবৃক্ষ দেখছেন, ওখানেই তাঁর কুটির। পথিক দূরে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সূর্যরেখার অন্তরালে তাঁর দৃষ্টি প্রতিহত হল। ছেলেরা বলল, মান্যবর মাঠের ওই দিকে তাকান, দেখতে পাচ্ছেন কিছু? পথিক কিছুই না দেখতে পেয়ে ঘাড় নাড়েন। ছেলেরা বলে, ভালো করে দেখুন। পথিক হাত দিয়ে সূর্যালোক রোধ করে দূরে তাকালেন, তারপর তাঁর অশ্বপৃষ্ঠে লাফিয়ে উঠে পড়লেন।

দূরে মাঠের ভেতর একটা কালো অবয়ব লক্ষ করে তাঁর ঘোড়া ছুটছিল। ধীরে ধীরে অবয়বটি ঘনীভূত হলে দেখা গেল একজন সাধুপুরুষ মাটির উপর থেকে নিবিড়ভাবে কি যেন সংগ্রহ করছেন। তাঁর চতুর্পাশে পাখিরা চক্কর কাটছে। উড়ছে, নামছে, চরছে, আবার উড়ছে।

ঘোড়ার পায়ের শব্দে ঋষিজনের সংগ্রহতন্ময়তা নষ্ট হওয়ায় তিনি ঘুরে তাকালেন। পথিক দেখলেন একজন দীর্ঘদেহী শ্মশ্রুগুম্ফমন্ডিত শ্যামল পুরুষ মলিন বসনের প্রান্তঝুলিতে ঝরে পড়া ধান সংগ্রহ করছেন। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে করজোড়ে দাঁড়ালেন পথিক, বললেন, হে ঋষিশ্রেষ্ঠ আমি বহুদূর থেকে আসছি, যাব আরো বহুদূরে। এখন পথশ্রমে ক্লান্ত, আমি শুনেছি আপনার কাছে আশ্রয় পেয়ে বহু মানুষ ধন্য হয়, আমি তাই আপনার আশ্রয়প্রার্থী। ঋষি বললেন, হে পথিকবর, আপনি রাক্ষস, দানব, দস্যু, ব্রাহ্মণ যে-ই হন না কেন ঋষি মুদগলের আশ্রয়লাভে বঞ্চিত হবেন না। আমার সঙ্গে আসুন।

পথিক মুদগলের আশ্রমে অন্ন ও আশ্রয় পেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম ভাঙলে দেখলেন তখনও অন্নগ্রহণেচ্ছু শেষ সেবাপ্রার্থীটিকে পাখার বাতাস করছেন ঋষি। বেলা পড়ে গেছে কিন্তু তখনও তাঁরা দুটি ভাতও মুখে দেননি। পথিক অবাক হয়ে ভাবলেন, মাত্র দিন পনেরোর সংগ্রহে এত মানুষের সেবা কেমন করে করেন মুদগল, নিজেরাই বা কী খান? তাঁর হৃদয় ভিজে উঠল এই মহাপ্রাণের সেবাপরায়ণ মন দেখে। তিনি ভেবেছিলেন আজ রাতটুকু থাকবেন, কিন্তু একজন রাজপুরুষের এমন একজন দীন সেবকের অন্নধ্বংস করা শোভনীয় নয় ভেবে দ্রুত উঠে পড়লেন শয্যা ত্যাগ করে।

ঘোড়াটি বাঁধা ছিল শেফালি গাছের নীচে। সূর্যাস্ত সমাসন্ন। পথিক যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। ঋষি তাঁকে অনুরোধ করায় পথিক বললেন যে তাঁকে আগামীকাল ভোরের মধ্যেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছোতে হবে, তাই এই গোধূলি সময়েই তাকে যাত্রা করতে হচ্ছে।

মুদগল তাকিয়ে রইলেন, পথিকের ঘোড়া লাল ধূলো উড়িয়ে আসন্ন ধুসর সন্ধ্যার সীমান্তে মিলিয়ে গেল। ঋষিজায়ার শঙ্খ বেজে উঠল তুলসীতলায়। মুদগল ফিরে এলেন কুটিরে। এবেলায় তাঁদের উপবাস গেল। জলগ্রহণ করে আসন পেতে বসলেন পুঁথির আশ্রয়ে। সামান্য প্রদীপের আলো তাঁর মাটির কুটিরে জ্যোতির্ময় হয়ে উঠল।

মুদগলের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল দেশময়। তাঁর দীন কুটির কখনো অতিথিহীন থাকত না। মানুষ তো বটেই, এমনকি দেবরাজ ইন্দ্র অবধি সময়ে সময়ে তাঁর কুটিরে এসে উপস্থিত হতেন।

একদিন এক প্রখর দুপুরবেলায় এক ব্যক্তি অকথ্য গালিগালাজ করতে করতে তাঁর কুটিরের আঙিনায় এসে প্রবেশ করল। সেই সময় সবে তিনি খেতে বসেছেন, ঋষিজায়া সামান্য ব্যঞ্জন এগিয়ে রাখছেন থালার পাশে। চমকে উঠলেন মুদগল। এত নীচ ভাষায় তাঁকে গালিগালাজ করছে কে? তিনি পাত ছেড়ে উঠে পড়লেন। বাইরে এসে দেখলেন তাঁর পরিচ্ছন্ন উঠোনে পুরুষাঙ্গ ঘুরিয়ে মূত্রত্যাগ করছে এক নগ্ন ব্যক্তি। তার মাথা ন্যাড়া, সর্বাঙ্গে ধুলো। তাঁকে দেখেই সেই ব্যক্তি আবারো উপর্যুপরি গালিগালাজ করতে করতে বলতে লাগল সে ক্ষুধার্ত। তাকে খেতে দেওয়া হোক। ঋষি মুদগল বিচলিত না হয়ে তাঁকে ঘরে ডাকলেন এবং তাঁর নিজের জন্য বেড়ে রাখা অন্ন তাঁর দিকে বাড়িয়ে ধরে তাকে তালপাতার বাতাস করতে লাগলেন। এমন রাক্ষুসে পেট তিনি আগে দেখেন নি। সেদিনের সমস্ত আয়োজন ফুরিয়ে গেল। পাগল বৃদ্ধটি শেষ পাতের ভাত অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে সর্বাঙ্গে মেখে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে গেল কুটির পরিত্যাগ করে। মহর্ষি তাঁর গন্তব্য পথের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, কে এই ব্যক্তি?

একটি পক্ষ পেরিয়ে যাবার পর আবার সেই পাগল বৃদ্ধ হাজির হয়ে মুদগলের সমস্ত সঞ্চয় খেয়ে ফেলল। এমন করে প্রায় ছবার কষ্টার্জিত অন্ন ফুরিয়ে গেল তাঁর। পরিবার সহ অভুক্ত রইলেন। কষ্ট পেলেও তাঁর মুখের একটি রেখাও টলে উঠল না।

ষষ্ঠ বারে হার মানল সেই বৃদ্ধ পাগল। সে বলল, আমি দুর্বাসা, আমি অবাক হয়েছি মুদগল তোমার সেবাপরায়ণতায়। তুমি ধন্য। তুমি নিদারুণ কষ্ট পাওয়া সত্বেও একটিবারের জন্য তা প্রকাশ করনি মুখে। তুমি পুণ্যবান, তুমি সশরীরে স্বর্গারোহণ করবে খুব শীঘ্রই। এই বলে ঋষি প্রস্থান করলেন। করজোড়ে তাঁর গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইলেন মুগ্ধ মুদগল।

তখন প্রায় বিকেল গড়িয়ে এসেছে। গ্রীষ্মঋতুর প্রকৃতি কিছুটা রুক্ষ। আকাশে উত্তাপ। আচমকা মুদগল লক্ষ করলেন গাছে গাছে ফুল ফুটেছে, পাখির কূজনে অকস্মাৎ বনরাজি মুখরিত। উত্তাপ কমে আসছে, মনোরম লাগছে আকাশ। কোনো উৎস থেকে অত্যন্ত মন্থর গতিতে নেমে আসছে এক অপার্থিব আলো।

হঠাৎই তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে গেল, ধীরে ধীরে তা ধাতস্থ হয়ে এলে তিনি দেখলেন একটি হংস-সারস টানা পুষ্পক রথ তাঁর অতি নিকটে ভাসমান। সেই রথে উপবিষ্ট একজন তরুণ দেবদূত তাঁকে সম্বোধন করছেন। ঋষি তাঁর উদ্দেশ্যে হাত জোড় করে নমস্কার জানাতে দেবদূত বললেন, মহর্ষি আপনি সিদ্ধ হয়েছেন, আসুন এই রথে আরোহণ করুন, আপনাকে স্বর্গে নিয়ে যাই। মুদগল মৃদু হাসলেন, তারপর বললেন, স্বর্গ, সে কেমন, আমি তো তার কিছুই জানিনা দেবদূত! আপনি কি স্বর্গবাসের ভালো এবং মন্দ নিয়ে কিছু বলতে পারেন? দেবদূত বললেন, নিশ্চই পারি ঋষিশ্রেষ্ঠ। মুদগল বললেন, তবে বলুন আমি শুনি, তারপর নয় ভেবে দেখব।

দেবদূত বললেন, স্বর্গ এখান থেকে অনেক উপরে, উচ্চ আকাশে অবস্থিত। দেবতারা সেখানে রথে চড়ে ঘুরে বেড়ান। সেখানে অনন্ত যৌবন। মেরু নামে তেত্রিশ যোজন বিস্তৃত এক সোনার পাহাড়ের উপরে এক আশ্চর্য এবং সুন্দর দেবোদ্যান আছে। পুণ্যবানেরা স্বর্গে গিয়ে সেই উদ্যানে ঘুরে বেড়ান। এখানকার বাতাস অত্যন্ত নির্মল, সুগন্ধময়। এখানে নানারকম অপার্থিব সুরশব্দ মনপ্রাণ মোহিত রাখে। এখানে জরা নেই, ক্ষুধা ও পিপাসা নেই, অসুখ নেই, দুঃখ নেই, ভয় নেই, তাপ নেই, ক্লান্তি নেই। যারা ধর্মকে অবহেলা করে, যারা মিথ্যুক এবং নাস্তিক তারা স্বর্গে যেতে পারে না। এই হল স্বর্গবাসের গুণ মহর্ষি। আর এর দোষ এই যে এখানে কর্ম এবং ধর্ম করার কোনো সুযোগ নেই। অর্জিত পুণ্যসমষ্টি ফুরিয়ে গেলেই আবার পৃথিবীতে ফেরত আসতে হয়, নতুন করে পুণ্যসঞ্চয়ের জন্য।

মুদগল হাসলেন, বললেন, ধন্যবাদ দেবদূত, আপনি ফিরে যান। যেখানে কর্ম এবং ধর্মের সুযোগ নেই সেই অতিলৌকিক প্রদেশে আমার যাবার কোনো বাসনা নেই। আমি দীনের সেবায় দিনাতিপাত করতেই আনন্দ পাই। এখানেই আমার অনন্ত স্বর্গ।

দেবদূত ফিরে গেলে, মুদগল কুটিরাভিমূখী হলেন। দেখলেন তাঁর অপর্যাপ্ত আঙিনায় কাঙালেরা ভিড় করে আছে।

Tags: , , , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ