আনন্দ নিকেতনে আজ খুশির হাওয়া সকাল থেকেই। প্রতিদিনের তুলনায় আজ সবার মনে একটু বেশি খুশি। আর এক সপ্তাহ বাদেই পুজো। অন্যদিন অনেকেই পাঁচটার সময়ে উঠে মাঠে মর্নিং ওয়াক করে। কিন্তু আজ সবাই মহালয়া শোনার তাগিদে ঘড়ি ধরে চারটে বাজতেই উঠে পড়েছে। প্রতিবার এই দিনটাতে জলখাবার খেতে খেতে হলঘরে বসে সবাই প্রি পুজো বৈঠক করে পুজোর কটাদিন কিভাবে কাটানো হবে সেই নিয়ে।
আজও যথারীতি আনন্দ নিকেতন বৃদ্ধাশ্রমের হলঘরে সবাই এসে জড়ো হয়েছে। যদিও নামেই বৃদ্ধাশ্রম, মানসিকতায় সবাই এখনও চিরনবীন। প্রত্যেকের বাড়ির ছেলেমেয়েরাই যে এখানে বাবা বা মাকে দিয়ে গেছে তা নয়, কেউ কেউ স্ব ইচ্ছায়ও এসেছেন। এই যেমন দত্তবাবুরা। দত্তবাবু ও তাঁর স্ত্রীর চার ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে যদিও বাবা মাকে অনেকবার নিজের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছে, কিন্তু দাদা ও ভাইরা দেয়নি। বলেছে, নিজের বাড়ি, ছেলেরা থাকতে বাবা মা কেনো মেয়ের বাড়ি গিয়ে থাকবে! আসলে ব্যাপারটা অন্য। বাবা মা মেয়ের বাড়ি গিয়ে থাকলে পাড়া প্রতিবেশির কাছে নিজেরা মুখ দেখাবে কি করে। এদিকে চারজনের একে ওপরের সাথে ঝগড়ায় মুখ দেখাদেখি বন্ধ হবার জোগাড়। প্রতিদিন চার বউয়ের ঝগড়ায় মিসেস দত্ত একেবারে নাজেহাল হয়ে যেতেন, যদিও তাঁর কথায় কেউ কোনো গুরুত্বই দিতনা। আবার সন্ধ্যের পর বাড়ি এসে বউদের হয়ে সাফাই গাইতে গিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে ঝামেলা শুরু। হাতাহাতি শুরুর আগে দত্তবাবু ভাগ্যিস চার ভাইকে জমি ভাগ করে দিয়েছিলেন। বোন ও তার নিজের প্রাপ্য ছেড়ে দিয়েছিল যাতে দাদারা সুখী হয়, কিন্তু তাতেও ঝামেলা মিটলো না। এবার ঝামেলা শুরু হলো বাবা মা কার কাছে থাকবে সেই নিয়ে। বড় আর মেজ’র অবস্থা ভালো , ওরা দায়িত্ব নেবে ভাবলো। কিন্তু একা কেন দুজনের বোঝা একজনে নেবে। তাই ঠিক হলো, বাবা বড়জনের কাছে , আর মা মেজজনের কাছে থাকবে। শেষ বয়সে কোথায় দুজনে একসঙ্গে ভালো সময় কাটাবে তা নয়, দুজনকে আলাদা হয়ে যেতে হবে! মিস্টার ও মিসেস দত্ত তাই নিজেরাই ওদের থেকে আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। আর চলে এলেন আনন্দ নিকেতনে। এসে দেখলেন তাঁরা নিজেরাই শুধু এই সমস্যার ভুক্তভোগী নন, আরো অনেকেই আছেন এই দলে। আবার মিস্টার ও মিসেস রায় তাঁদের ক্ষেত্রে ঠিক হয়েছিল তাঁরা একমাস বড় ছেলে ও একমাস ছোট ছেলের ফ্ল্যাটে থাকবে। এই বুড়োবয়সে প্রত্যেক মাসে এতো দৌড়াদৌড়ি ভালো লাগে। তাই তাদের ও ঠিকানা এখন আনন্দ নিকেতন। আরো দুই তিন দম্পত্তি আছেন যাঁরা আবার ছেলে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে নিজেরাই চলে এসেছেন বৃদ্ধাশ্রমে। টাকা আছে, ব্যাস ডবল কামরা ভাড়া করে আরো অনেক বন্ধুদের সাথে সময় কাটাচ্ছেন। এঁরা উন্নত চিন্তাধারার মানুষ। এই যেমন সোমবাবুর মত, একটি মেয়ে যখন বিয়ে করে বাবা মাকে ছেড়ে আসছে তখন তাঁদের ছেলেই বা তাঁদের সাথে থাকবে কেন? তার চাইতে ওরা ওদের মতো থাকুক, আমরা অন্যত্র চলে যাই। দিব্যি ভালো সম্পর্ক আছে। প্রত্যেক সপ্তাহে ছেলে, বৌমা, নাতনি সবাই আসে দেখা করতে।আর একসাথে থাকলে নির্ঘাত এখন বৌমার সাথে ওনার মিসেসের চুলোচুলি হতো।
আবার মিস্টার ও মিসেস সেনের মতে, ছেলে মেয়েদের মানুষ করেছেন, স্বনির্ভর করেছেন। এখন ওরা ওদের মতো থাকুক, আর ওনারা ওনাদের মতো। আরো দুজন সস্ত্রীক এখানে থাকেন, তাদের ধারণা বাড়িতে থাকলে এখন রান্না করতে হতো, বাজার করতে হতো, নাতি পুতির দেখভাল করতে হতো, যাকে বলে আয়ার কাজ, আর নয়তো নিজেরা আয়ার দেখভালে বিছানায় পরে থাকতেন। তার থেকে এই বেশ ভালো আছেন। নিঃসন্তান অনেকেও থাকেন এখানে। যাঁরা সঙ্গী বিহীন তাঁরাও এখানে বন্ধুদের সাহচর্যে অনেকটা দুঃখ ভোলে। ফ্ল্যাটে বা নিজের বাড়িতেও এই বয়সে বড় একাকিত্ব ভুগতে হয়, কিন্তু এখানে সবাই একটা পরিবার। প্লাস ডাক্তার দেখানো ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধাতো আছেই। সবচেয়ে ভালো ব্যাপার এখানকার যিনি মালিক মালকিন তাঁরাও এখানেই থাকেন। তাঁদেরও এক ছেলে স্থায়ীভাবে বাইরে । তাই তাঁরা ছেলের নামে যে জমি কিনে রেখেছিলেন সেখানে বানিয়ে ফেললেন এই আনন্দ নিকেতন। এখানে অনুষ্ঠান ও হয়, হলঘরে বসে আড্ডা বৈঠক, সিনেমা দেখা, পিকনিক সবই হয়। এমনকি প্রতি সপ্তাহে পুরুষ সদস্যদের একজন বাজার আর মহিলা সদস্যদের একজন রান্নাঘরের দায়িত্ব নেন। তাঁরাই বাকিদের পছন্দ তালিকানুযায়ী বাজার ও রান্না করায়। রান্নার লোক থাকলে ও অনেকে হাতও লাগায়। ওরা খুব আনন্দে আছে। তাই আনন্দ নিকেতনের সবার মুখে একটাই কথা, যদি পকেটে মানি থাকে তো চলে এসো এখানে, শেষ বয়সটা মজা করে কাটিয়ে যাও।
আজ মহলায়ায় পুজোর তোড়জোড়। পুজোয় কে কিরকম কাটাবে, কি খাবে তার আড্ডা হচ্ছে….। সোমবাবু সস্ত্রীক ঢুকলেন। চেয়ারে বসতে বসতে বললেন বন্ধুগণ আমারতো পুজোয় এখানে থাকা হচ্ছে না। জানোইতো গতবারের মতো এবারেও ছেলে বাড়ি নিয়ে যাবে। রীনাদেবী গলা মেলালেন, আমারো এবারে তোমাদের সাথে পুজো কাটানো হচ্ছেনা। রীনাদেবী আগে স্কুল শিক্ষক ছিলেন। পাঁচ বছর হলো অবসর নিয়েছেন। পেনশনের টাকায় আনন্দ নিকেতনে আনন্দে আছেন। ছেলে, বউ, নাতি অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। মাঝে মাঝে যখন কলকাতায় ফ্ল্যাটে আসে তখন মাকেও নিয়ে যায়। তবে শেষ তিনবছর আসতে পারিনি। এবারে পুজোয় আসবে ঠিক ছিল, কিন্তু হুট করে আজই যে এসে পড়বে তা জানত না রীনাদেবী। এইমাত্র ছেলে ফোন করেছিল । সকালেই চলে এসেছে ওরা। ফ্লাইটের ধকল একটু কাটিয়ে নিয়ে বিকালে নিতে আসবে মাকে।
সোমবাবু আর রীনাদেবীর কথা শুনে সকলেরই একটু মন খারাপ হলো। যারা সারাবছর ছেলের আসার অপেক্ষা করে থাকে তাদের কাছে মনে হলো রীনাদেবী যেন হাতে চাঁদ পেয়েছেন। অধিকাংশের আবার মনে হলো ছেলে যখন থাকেনা মায়ের সাথে তখন এবারে পুজোয় এসে কদিনের জন্য মাকে তাঁদের থেকে বঞ্চিত করে নিয়ে যাবার কি দরকার!
রীনাদেবী নিজে অবশ্য একটু উচ্ছসিত প্রায় তিন বছর পর নাতিকে দেখবেন বলে। এর আগে সেই কোন ছোট্টবেলায় দেখেছিলেন, তখন বয়স ছিল চার। অবশ্য এখানকার বন্ধুদের জন্যও মন কেমন করবে। তা আর কি করা যাবে । মাত্র দু সপ্তাহের ব্যাপার। পুজোর পর ওরাও চলে যাবে , আর উনিও আবার চলে আসবেন।
বিকালে মার্সিডিজে করে এলেন রীনাদেবীর একমাত্র সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার ছেলে রৌনক। আশ্রমের সবার সাথে হালকা আলাপচারিতার পর মাকে নিয়ে গাড়িতে উঠবে যখন সবাই তখন নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। হুইল চেয়ারে বসা পার্থবাবুও হাজির তাঁর ভালো বন্ধুকে টাটা করতে।
বেশ মজা লাগলো রৌনকের। ঠিক ছোটবেলায় দেশের বাড়ি থেকে কলকাতায় ফেরার সময়ে সবাই এরকম একসাথে হাজির হতো। বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন রিনাদেবী। সোমবাবুর ছেলে, বউ ও নাতনি ও ঢুকলো। এবার ওঁদের যাবার পালা। বাকিরা মনখারাপ করে যে যার ঘরের দিকে এগোলো। কেউ বা হলঘরে, কেউ বাগানের দিকে।
আজ ষষ্ঠী, মায়ের বোধন। মহালয়ার দিন খুব আনন্দ করে রীনাদেবী এসেছিলেন। কিন্তু আসার পর থেকেই মনে কোনো স্বস্তি নেই। নাতিকে পুরো বিদেশিদের মতো দেখতে হয়েছে, বয়স মাত্র সাত হলে কি হবে লাল লাল গাল দুটো টিপে আদর করতে গেলেই রেগে যায়। ভাবলেন ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী আর লালকমল নীলকমলের গল্প শোনাবেন। ও হরি, উল্টে তাকেই সে বলে, what is bangoma bangomi? Please tell me the story of harry potter.
ওইসব তো আর জানেন না তিনি। আদর করে যে খাওয়াবেন তাও উপায় নেই। তাকেই উল্টে ছেলে চামচে করে ভাত খাওয়া শিখিয়ে দিলো। চামচে ভাত খেয়ে যে কোনো সুখই নেই এটা আর কি করে বোঝান তাকে। ও দেশে যে সবাই এরকমটাই করে। আজ বরাবর নিরামিষ খান রীনাদেবী। লুচি, তরকারি সব নিজেই করলেন, ওরা কিসব Swiggy থেকে খাবার আনালো। এবার ওদের সাথে ঠাকুর দেখতে যাবার কথা। যদিও ইচ্ছা নেই, তবুও বেরোলেন। কিন্তু এত ভিড়ে ঠাকুর দেখা পোষায়! অগত্যা ওরা গেল আর রীনাদেবী পার্কিংএ গাড়ির মধ্যে বসে রইলেন। না আর ভালো লাগছেনা, মনটা বড় খারাপ করছে বাড়ির জন্য। আনন্দ নিকেতনই যে এখন আসল বাড়ি ওনার। সারারাত ঠাকুর দেখে যখন ফেরা হলো, তখন প্রায় পরিষ্কার হতে চলেছে আকাশ। কলাবউ স্নানের ঢাক বাজছে। ওরা হাতমুখ ধুয়ে শুতে যাবার তোড়জোড় করছে, রীনাদেবী বললেন, বাবু একটু শুনবি, তোর সাথে দুটো কথা ছিল।
– হ্যাঁ মা বলো।
– বলছিলাম কি আমি ওখানে ফিরে যেতে চাই যদি তোদের না কোনো আপত্তি থাকে। দেখ আসলে….
-ঠিক আছে মা, তোমায় এত কিছু বলতে হবে না। আমি বুঝে গেছি তোমার মন কি চাইছে। আসলে তুমি আনন্দ করেই এসেছিলে, আবার এখন নিজেই যেতে চাইছো। আমি একটু ঘুমিয়ে নি তারপর তোমায় দিয়ে আসবো।
স্বস্তির নিঃস্বাস ফেললেন রীনাদেবী।
সপ্তমীর বেলায় হলঘরের বৈঠক যথারীতি চুটিয়ে চলছে। সোমবাবুরাও গতকালই ফিরে এসেছেন। এখনকার সবাইকে ছেড়ে থাকা মুশকিল। উল্টে এখন ছেলে বউ আর নাতনি বিকালে এসে বাবা মাকে নিয়ে ঠাকুর দেখতে বেরোচ্ছে। মজাদার আড্ডার মধ্যে হঠাৎ গেটের সামনে হর্নের আওয়াজে চমকে উঠলো সবাই। আনন্দ নিকেতনের মালিক সুমন্ত ঘোষ ও তাঁর স্ত্রী একটু বোঝার চেষ্টা করলেন এখন কে আসতে পারে এই অসময়ে। হটাৎ মিস্টার দত্ত চেঁচালেন, আরে এটাতো মনে হচ্ছে রৌনকের গাড়ি।
সিকিউরিটি গেট খুলতেই গাড়ি থেকে নামলেন রীনাদেবী। ততক্ষনে সবাই গেটের সামনে হাজির। রৌনক গাড়ি থেকে নেমে বললো, না..মাকে আর রাখা গেলোনা। আপনাদের এখানে আসার জন্য মন খারাপ। তাই দিয়ে গেলাম। আমরা বরং যাবার দিন দেখা করে যাবো।
বলেই গাড়িতে উঠে সাঁ করে বেরিয়ে গেল। আর এদিকে সবাই বাচ্চা ছেলে মেয়েদের মতো হাততালি দিয়ে বলে উঠলো, কি মজা, এবার জমবে পুজো। সবাই মিলে আবার হলঘরে জমায়েত হলো। আনন্দ নিকেতনে সপ্তমীর সকাল আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো।
Tags: আনন্দ নিকেতন, গল্প, সায়ন্বিতা সরকার
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।