সন চোদ্দোশো পঁচিশের গ্রীষ্মসন্ধ্যা। পিয়ালী আর অনিন্দ্য নিমন্ত্রণরক্ষার জন্য প্রায় তৈরি। পিয়ালী আয়নার সামনে চুল আলতো জড়িয়ে ঘাড়ের ওপর তুলে ফ্রেঞ্চ নট বাঁধছে- দু এক গুছি রুপোলি রেখা সিঁথির পাশে। অনিন্দ্য রেডি অনেকক্ষণ – তাড়া দিচ্ছে।
পিয়ালী শাড়ি ঠিক করতে করতে বলল-‘এত কিসের তাড়া! যাচ্ছ তো হস্টেলের রুমমেটের বাড়ি, মানে আমাদের মতই বুড়ো আর বুড়ি।এক্স গার্লফ্রেন্ড-ট্রেন্ড হলেও বুঝতাম’। অনিন্দ্য ঘরের বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগ্রেট খাচ্ছিল। নিজে নিজেই হাসছিল পিয়ালী-শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে করতে। ওর হাসি মশকরায় অনিন্দ্য যোগ দেবে না- পিয়ালী জানে। অনিন্দ্যকে কোনদিন হাসতেই দেখে নি পিয়ালী, রসিকতা করতেও নয়। বস্তুত অনিন্দ্যর খুব খুশি খুশি একটা মুখ পিয়ালী মনেই করতে পারে না। অ্যালবামে ওদের যুগল ছবি, ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘার ব্যাকড্রপ অথবা সমুদ্রের বালিতে বসে ওরা দুজন, কিম্বা ঘোড়ায় চড়ে লাল নীল টুপি মাথায় বিট্টু পিট্টু। দুপাশে অনিন্দ্য পিয়ালী। কোনো ছবিতেই অনিন্দ্য হাসিমুখ নয়। একটু আড়ষ্ট যেন,হয়ত সামান্য নতমুখ কোথাও। অথচ সেই অর্থে অনিন্দ্যর অপ্রাপ্তি কিছু নেই। এই বয়সে ওর মতো ছেলের জাগতিক যা কিছু পাওয়ার সবই পেয়েছে। পিয়ালীর বা আত্মীয়স্বজনের অন্তত সেরকমই মনে হয়। পিয়ালীর বিয়ে হয়েছে প্রায় পঁচিশ বছর। বিট্টু পিট্টুও ছোটো থেকে বড় হয়ে কলেজ, ইউনিভার্সিটি পৌঁছে গেল। এত বছরে অনিন্দ্যকে হাসতে দেখল না পিয়ালী। সে যে অতীব গম্ভীর, দাঁত খিঁচোচ্ছে সর্বদা এমনও নয়। শান্ত শিষ্ট ভদ্র দায়িত্বশীল কিন্তু নিরুত্তাপ। খুব বেশি বন্ধুবান্ধবও নেই। ওই অফিসের সহকর্মী দু তিনজন। স্কুল কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই । উৎসব বা ঘরোয়া জমায়েতে অনিন্দ্য বরাবরই চুপচাপ-উপহার দিয়ে, ফার্স্ট ব্যাচে খেয়ে আচ্ছা আসি , নমস্কার- ব্যাস। এই পঁচিশ বছরে পিয়ালীর মনে হয়েছে, অনিন্দ্য যেন বর্মাবৃত অদৃশ্য এক বর্ম তাকে ঘিরে রয়েছে অনুক্ষণ আর সেই বর্ম ভেদের অস্ত্র পিয়ালীর তূণে নেই। কখনও আবার মনে হ’ত, যেন এক গভীর বনে প্রাচীন বৃক্ষরাজির তলায় অনিন্দ্য এক শ্যাওলা ধরা প্রাচীন পাথর-তার পাশ দিয়ে, কখনও উপর দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে হরিণ, কখনও বাঘ-পাথরের পিঠে রোদ পড়ে না, শ্যাওলা জমে জমে সবুজ। বস্তুত, বিয়ের পরেই পিয়ালী তার নতুন বরের আত্মমগ্নতা খেয়াল ক’রে নিজের কলেজ আর ইউনিভার্সিটির পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে তুলনায় বসে আশ্চর্য হয়। অনিন্দ্যর বাবা নীলমাধবকে এক বিকেলে চা দিতে গিয়ে সে সটান জিগ্যেস করে-‘ আচ্ছা, আপনার ছেলে কি বরাবরই এরকম?’
নীলমাধব পিয়ালীর চোখে চোখ রেখে বলেন, ‘কী রকম? বি স্পেসিফিক বৌমা।’
-‘না, এই চুপচাপ মত’
-‘ বাবু একটু ইন্ট্রোভার্ট। তাতে প্রবলেম কোথায়? তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার ট্যবহার করছে না কি?’
-‘তা নয়, মানে বলছিলাম, আপনাদের ছেলে কি বরাবরই এই রকম? ইন্ট্রোভার্ট নয়, ওকে একটু উদাসীন মনে হয় আমার, আসলে।’
-‘বরাবর আর দেখলাম কোথায় বৌমা? তোমার শাশুড়ি গত হলেন ওর সাত বছরে, তারপর থেকে মামাবাড়িতে আর হস্টেলে। এই তো কদিন বিয়ে হ’ল। একসঙ্গে থাকতে থাকতে সহজ হবে। একটু মানিয়ে গুছিয়ে নিও- সবাই কি একরকম হয়, বৌমা?’
পঁচিশ বছর মানিয়ে গুছিয়ে কেটে গেছে পিয়ালীর, বর্মভেদ করার চেষ্টা বহুদিন ছেড়ে দিয়েছিল সে ,বরং একটু ঝেড়েঝুড়ে ঘষে মেজে রাখত অনিন্দ্যর বর্ম-ওর মনে হ’ত ঐ বর্মই অনিন্দ্যর আসল বাড়ি।ওইখানেই যেন ভালো থাকে অনিন্দ্য।
আজ চোদ্দোশো পঁচিশের গ্রীষ্মসন্ধ্যায় এখন ওরা অঞ্জন আর স্নিগ্ধার বাড়ি যাচ্ছে। অঞ্জন হস্টেলে অনিন্দ্যর রুমমেট ছিল একথা নীলমাধবের থেকেই জেনেছিল পিয়ালী। বিয়ের বছরখানেক পরে ওরা পুরী যাবে কদিনের জন্য। গোছগাছ করছিল; নীলমাধব ওর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিয়েছিলেন ।
-‘কিছু বলবেন? এই তো চা দেব এক্ষুণি আর একটু গুছিয়ে নি,এই পাঁচ মিনিট’
– তাড়া দিতে আসি নাই বৌমা। একটা কথা বলি রে মা। পুরী যাচ্ছ, সমুদ্রে বেশি নেমো টেমো না।’
-‘কেন, ওমা কেন? এ বাবা, পুরীতে গিয়ে সমুদ্রে নামব না?
-‘ পা টা ভিজিও, বালিতে বসে থেকো-স্নান কোরো না। বাবুর জলে ফাঁড়া আছে বৌমা। তোমাকে কি ও বলেছে একবার ডুবে যাচ্ছিল দীঘায় গিয়ে?’
-‘ সে কি? কই না তো? কবে? ‘
-‘কলেজে পড়ার সময়। সেকন্ড ইয়ার। অঞ্জন বাঁচিয়েছিল ওকে। অঞ্জন ওকে তুলে না আনলে…ওর কপালের একটা কাটা দাগ আছে না? ওটা তো ঐখানেই-বোল্ডারে ঘা খেয়ে-‘
-‘অঞ্জন কে?’
-‘ বাবুর বন্ধু। ওরা পড়ত একসঙ্গে, হস্টেলে এক ঘরেই থাকত। আমাদের বাড়িতেও আসত খুব এক সময়ে।এদিক ওদিক খুব বেড়াত দুজনে। ভালো টি টি প্লেয়ার ছিল অঞ্জন। ন্যাশনাল খেলেছিল। বাবুও ভাল খেলত। অঞ্জনের থেকেই শিখেছিল।’
মাঝে মাঝে বর্ম থেকে বেরোতো অনিন্দ্য। কদাচিৎ। যেন শ্যাওলাধরা পাথরের পিঠে একফালি রোদ পড়ত কখনও কখনও। পুরী গিয়ে এইরকমই এক রাতে , বর্ম থেকে বেরিয়েছিল অনিন্দ্য। ঘনিষ্ঠ হয়েছিল বউ-এর। আর পিয়ালী ওকে আঁকড়ে ধরে দীঘার কথা তুলেছিল, বলেছিল-‘ডুবে গেলে কী হোতো?’
অনিন্দ্যর পিঠে পিয়ালীর নখ বসে যাচ্ছিল। সেই অবস্থাতেই অনিন্দ্য তার বর্ম পরে নেয়। পাশ ফিরে আলো জ্বালায় ও জল খায়।
পিয়ালী বলেছিল-‘কী হল?’
অনিন্দ্য উঠে ব্যালকনিতে গিয়েছিল। সিগারেট ধরিয়ে বলেছিল,’ জানি না।’
আজ এত বছর পরে ওরা অঞ্জনদের বাড়ি নিমন্ত্রণরক্ষায় যাচ্ছে।
দুদিন আগে অনিন্দ্য বাড়ি ফিরে বলেছিল-‘আমার সেই কলেজের বন্ধু অঞ্জন, মনে আছে?’
পিয়ালীর পুরী স্মৃতি ফিরে এসেছিল- বলেছিল, ‘মনে রাখার মত কোনো কথা হয়েছিল?’
-‘ও হয় নি! তাই তো। আচ্ছা ঐ ওরা মানে অঞ্জন আর স্নিগ্ধা ওদের বাড়ি যেতে বলেছে রোববার। যাবে তুমি?’
-‘ওরা কি বাইরে কোথাও ছিলেন এতদিন? মানে এতদিন যোগাযোগ ছিল না তাই বলছি…’
-‘ছিল তো-ছিল যোগাযোগ। এই নিয়ে কথা হয় নি আর কি। কাল ফোন করেছিল-বলল, স্নিগ্ধা খুব করে বলেছে তোমাকে নিয়ে যেতে। যাবে? যাবে তো?’
অঞ্জনদের বাড়ি মফস্সলে।ওরা ট্রেনে গেল অনেকখানি, তারপর স্টেশনে নেমে রিকশা। ছিমছাম দোতলা বাড়ি, বাগান-সবুজ রং করা কাঠের গেটে লতিয়ে উঠেছে মাধবীলতা। রিকশা থামতেই দুজনে বেরিয়ে এসেছিল। অঞ্জনের টানটান মেদহীন চেহারা, তুলনায় স্নিগ্ধার মুখে খানিক ক্লান্তি আর বয়স। ওরা দোতলায় বসেছিল- চা কাজু ডালমুট-টুকিটাকি কথা-
‘ বাড়ি চিনতে অসুবিধে হয় নি তো?’
– ‘সুন্দর সাজানো বাড়ি-দারুণ বাগান’
-‘কতক্ষণ লাগল শিয়ালদা থেকে? ভীড় ছিল?’
-‘ছুটির দিন তো-ফাঁকা ফাঁকা- ‘
-‘রেড মিট খাওতো? ‘
এই সব…
চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। পিয়ালী ভাবছিল হস্টেলের কথা জিগ্যেস করবে। জিগ্যেস করবে দীঘার কথা, অনিন্দ্যর ডুবে যাওয়ার কথা। তখনই অঞ্জন সামান্য হেসে – ‘তোমরা গল্প করো তবে’ বলে অনিন্দ্যর সঙ্গে নিচে নেমে গেল। সিগারেট- টিগারেট খাবে হয়ত-
স্নিগ্ধা ঘুরে ঘুরে বাড়ি দেখাচ্ছিল পিয়ালীকে- স্নিগ্ধার পুজোর ঘর, বারান্দায় একটা দোলনা, ছাদের বাগান- টবে গন্ধরাজ, সূর্যমুখী, ছোটো জুইঁ, লঙ্কা ফলেছে অজস্র, ছোটো টবে ঘৃত কুমারী, ঝুমকোলতা, ধনেপাতা-
আবার দোতলায় এসে বসেছিল ওরা। ‘টিভিটা চালাই? তুমি দেখো একটু-আমি রান্না শেষ করে নি? এই তো হয়েই গেছে।। ফ্রায়েড রাইসটা শুধু আর চপ গুলো ভাজব। আরে না না তুমি বোসো-এক্ষুণি হয়ে যাবে’- পিয়ালীকে তুমি -ই বলছিল স্নিগ্ধা-
পিয়ালী একলাই বসে পর পর দুটো সিরিয়াল দেখল, তারপর খবর।গুচ্ছের বিজ্ঞাপনে মাথা ধরে যাচ্ছিল। স্নিগ্ধা সামান্য চেঁচিয়ে টুকটাক কথা বলছিল। অনিন্দ্যরা নিচে গেছে অনেকক্ষণ। এবারে পিয়ালীর খিদে পাচ্ছিল। রাতও হয়েছে। কিচেন থেকে বেরিয়ে স্নিগ্ধা খাবার সাজাচ্ছিল- ফ্রায়েড রাইস,চাপ, পনীর, চাটনি, পায়েস সম্ভবত-
পিয়ালী বলল, ‘এবার ওদের ডাকা যাক। অনেক রাত হ’ল তো।’
স্নিগ্ধা ভাতের পাত্র টেবিলে রেখে শান্তভাবে বলল-‘চলে আসবে’।
পিয়ালী সামান্য বিরক্ত হ’ল বলল-‘এতক্ষণ হ’ল নিচে গেছে, কী করছে কি?’
স্নিগ্ধা আরও শান্তভাবে বলল-‘নিচে নয়, মেজেনাইনে আছে-থাক না, চলে আসবে’।
পিয়ালী কোমরে আঁচল জড়িয়ে তরতরিয়ে নামল। মেজেনাইনের দরজা খোলা। দোতলার টিভির আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে অন্য কোন আওয়াজ ঢুকছিল পিয়ালীর কানে-ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছিল পিয়ালী। অনিন্দ্য হাসছে- তুমুল হাসছে। মুখ বাড়িয়ে পিয়ালী দেখছিল, মেজেনাইনের পুরোটা জুড়ে পেল্লায় টেবিলটেনিস বোর্ড, তাতে পরিপাটি নেট। দেখছিল, ঘামে জবজবে অনিন্দ্য আর অঞ্জন। অনিন্দ্যর টপস্পিন ব্লক করছিল অঞ্জন। তারপরের ফ্লিপটা কে চপ করল, পরক্ষণেই অঞ্জনের একটা লবকে স্ম্যাশ করে হেসে উঠল অনিন্দ্য। কালো টি শার্ট ঘামে ভিজে পিঠে সেঁটে গেছে, কপালের ওপর চুলের গুছি- সাদা বল ড্রপ খাচ্ছে এদিক থেকে ওদিক, অনাবিল হাসছে অনিন্দ্য আর অঞ্জন। সমস্ত মেজেনাইন জুড়ে বল ড্রপ খাওয়ার আওয়াজ আর হা হা হাসি। অনিন্দ্যর মুখমন্ডল উদ্ভাসিত, সে হাসছে, চেঁচাচ্ছে, বাহবা দিচ্ছে অঞ্জনকে, কখনও নিজেকেই- দুই হাত আশ্চর্য মহিমময় ভঙ্গিতে কাছাকাছি এনে সার্ভ করছে। স্পিন করাচ্ছে। সামান্য সূচালো হয়ে যাচ্ছে মুখ তখন। কপালের কাটা দাগে ঘাম, তাতে আলো পড়ে তিলকের মত দেখাচ্ছে। এ কোন অনিন্দ্য? পিয়ালীর পা সরে না। বর্ম খুলে ফেললে অনিন্দ্য এইরকম সুন্দর?
স্নিগ্ধা কখন যেন ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল ল্যান্ডিংয়ে। পিয়ালীকে আলতো টানল। বলল-‘ওপরে এসো।’ পিয়ালী কথা বলল না, ভ্রূভঙ্গি করে বলল-‘কেন?’ স্নিগ্ধা আর পিয়ালীর মধ্যে সেই মুহূর্তে একটা বোঝাপড়া কাজ করছিল যেন-কেউ কথা বলছিল না-ঈশারা করছিল পরস্পরকে।
স্নিগ্ধা ঠোঁটে আঙুল রেখে ঈশারায় আবার বলল- ‘এসো।’
অবাক লাগল পিয়ালীর। এলো যদিও ওপরে। এসেই গলা তুলে বলল-‘কেন ও ঘরে ঢুকলে কি হ’ত? আমরা দেখব না খেলা?’
-‘যদি ওরা চাইত, আমরা দেখি -ডাকত। তাই না?’
-‘ হয়ত ভেবেছে, আমরা খেলা টেলা বুঝি না-ভালো লাগবে না, বোরড হ’ব-‘
-‘খেলুক না নিজেদের মত-এই সময়টুকুই তো-‘
-‘তুমি কিন্তু নিজে নিজে ভেবে নিচ্ছ’
পিয়ালীর চোখে চোখ রেখে ক্লান্ত হাসল স্নিগ্ধা-‘ না গো। জানি।’ ওর নখের কোণার, তর্জনীতে হলুদ লেগে ছিল, কপালে সামান্য স্বেদ। আঁচল নিয়ে মুখ মুছল স্নিগ্ধা।
-‘ জানো? কী ক’রে? অনিন্দ্য রেগুলার আসে এখানে? আসে? কবে থেকে?’
-‘কেন তুমি জানো না ?’
স্নিগ্ধা আর পিয়ালীর মাঝখানে এখন একটা বিশাল সবুজ টেবিল, ড্রপ খাচ্ছে সাদা বল, পিয়ালী লব করবে কি স্ম্যাশ বুঝতে পারছিল না।
Tags: ইন্দ্রাণী দত্ত, গল্প, পিং-পং
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।