19 Apr

নো এন্ট্রি

লিখেছেন:দেবাশিস মজুমদার


নো এন্ট্রি – ১

 

“তাই  বলছিলাম, মানুষের  ভালোবাসায় আমাদের  দল চলে, কর্পোরেট এর টাকায় নয়,আজকের  এই সমাবেশে জনগণের উপস্থিতি  সেকথা  প্রমাণ  করছে, সবসময় আপনারা  এভাবেই আমাদের  পাশে  থাকবেন, আপনারাই পারেন আগামী নির্বাচনে  আমাদের দলের  মতামতকে সারা দেশের  মানুষের  সামনে  তুলে  ধরতে, —–, তাই  আজকের  মত আগমী নির্বাচন এর দিনগুলিতে  এভাবেই উপস্থিত থেকে  ভোট বাক্সে মতামতের  প্রতিফলন  ঘটান,আজ আরনয় ,এখানেই শেষ  করলাম, অনেক ই ফিরবেন  বহুদূর  ,অনেক মানুষ  দূরের রাস্তায়  দাঁড়িয়ে  আছেন, ভিতরে  পৌছতেই পারেননি, তাদেরকেও সংগ্রামী অভিনন্দন, সাধারন  মানুষের  জয় হবেই, জয়হিন্দ, ইনক্লাব  জিন্দাবাদ,  বন্দেমাতরম”–প্রবল  হাততালির  মধ্যে   হাত নাড়তে নাড়তে  মঞ্চের থেকে  নেমে  এলেন জননেতা  বিপ্লব  বোস । প্যারেড  গ্রাউন্ড  এর বিশাল  জমায়েতের  অন্যতম  স্টার বক্তা তিনি ।পাটভাঙা  সাদা পাঞ্জাবি  ঘামে জবজবে হয়ে সুঠাম শরীরের মজবুত  কাঠামোকে স্পষ্ট  করে  ষাটোত্তীর্ণ  বয়সকে যেন  বৈপ্লবিক- ব্যঙ্গ   করছে।

“নেতা হো তো অ্যায়সা”–মঞ্চের  ঠিক নীচে  নামতেই  উড়ে  আসা  টিপ্পনিকারের দিকে  দুহাত বাড়িয়ে  এগিয়ে  গেলেন– “আরে,ধীরাজদা যে– আপনাকেই  খুঁজছি, শোনেন,জেকব ফার্মাসিউটিক্যালস  তো আপনার এলাকায়, ওদের  একটু  বলে  দেবেন, ক্ষমতায় থাকার  সময়  আমাদের  সব সাহায্য  নিয়েছে, এখন ইলেকশন  ফান্ডে চাঁদার  ব্যাপারে  একটু  উদার হতে, আরে  দাদা  খরচ সামলানো যাচ্ছে  না,কর্পোরেটকে ওরা কিভাবে  চুষে নিচ্ছে, আমাদের  আগেও কর্পোরেট  অনেকটা  হেল্প  করত ,আপনি ধরুন  ওদের ।”

“সেটা  কি ভাল দেখাবে,তাছাড়া  আগের  রাজ্য  কমিটির  মিটিংয়ে  এনিয়ে বিস্তর  হইচই  হয়েছিল, তোমার  নিশ্চয়  মনে আছে ।”–ধীরাজ বাবু সামলাতে  চাইলেন—“আর তাছাড়া আজতো লোক ভালই হয়েছে, বিরোধীরা কর্পোরেট  মানির ব্যাপারটা  ঠিক  খবর  পাবে,মিডিয়াকে খাওয়ালে–ফালতু ব্যাপার  হবে ইলেকশন  এর আগে, ছেড়ে  দাওনা।”

“না,না—- ওসব নিয়ে ভাবলে  চলবে না ধীরাজদা,এই লোক আগের বারও এসেছিল, রেজাল্ট কি হল?,এদের  কোন  বিশ্বাস  আছে?আর বিরোধী দলগুলো যেভাবে টাকা  ছড়াচ্ছে, কোনো ঠিক আছে ? ধরুন  যদি আমরা  পারলাম না,  আই মিন,  ইলেকশন রেজাল্ট আমাদের বিপক্ষে  গেল ,তখন পার্টি  চালাবেনকি করে? তখন এই কর্পোরেটওয়ালারা কিন্তু আমাদের  চিনতে ই পারবে না,কেউ চিনবে  না দাদা,তার,চেয়ে  এখনই  ইলেকশন  ফান্ড এর নামে  টাকা  তুলে  রাখুন । বাকি  ওসব রাজ্য  কমিটি-ফমিটি আমি  বুঝে  নেব।”পকেটে র ভেতর  থেকে  সিগারেট  বের করে  ধরালেন প্রগতিশীল  দলের  “ইলেকশন -মেশিনারি – গুরু”বিপ্লব ।

“আমদের দলের অর্গানাইজেশনাল স্ট্র্যাটেজি  এবং  স্ট্রেন্থ খারাপ  মনে করছ কেন,ইলেকশন টা ফেয়ার হতে  দাওনা”—-নিজের  মতামতকে প্রতিষ্ঠা করার  শেষ  চেষ্টা  করলেন বর্ষীয়ান  নেতা  ধীরাজ গুপ্ত ।

“আরে রাখুন  আপনার ওই  দলীয় পাসওয়ার্ড ,ওসব বস্তাপচা  প্রাগৈতিহাসিক  তত্ত্ব  এই সাইবার  দুনিয়ায়  চলে  না,মাল বোঝেন  মাল,ওতেই চলছে  মালামাল  অফার,আর একটার পর একটা  ইলেকশন ওদের  হাতে বেরিয়ে  যাচ্ছে”–হাতের  তুড়িতেই ইলেকশনের পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট দেখিয়ে  সদ্য  ধরানো  সিগারেটটাতে পরপর লম্বা দুটো  টান  দিয়ে  দ্রুত নীচে  ফেলে পা দিয়ে  মাড়িয়ে  এগিয়ে  গেলেন  বিশ্বাসী  ভক্ত  বঙ্কার দিকে ।গত দুমাসের একটানা  নির্বাচনী প্রচার  এর শেষে আজ প্রগতিশীল  দলের সর্বশেষ  জনমোহিনী  সভা।খবরে প্রকাশ জনমতে জোয়ার  তুলতে  চললেছে প্রগতিশীল দের এই সভা।ফলে সর্বস্তরের  সব নেতা  মঞ্চের  আশেপাশে  আশ্রয়ের  আশায়।গোটা কতক চেনা মুখের সাবধানী হাসির শুকনো  প্রত্যুত্তর  ছুঁড়ে  আর তথাকথিত  কয়েকজন  দলীয়  দলিতের অপ্রয়োজনীয় কথা বলে  দলে নিজদের ওজন বাড়ানোর চেষ্টাকে  আপন ইমেজে উড়িয়ে দেওয়ার  চেষ্টায় গম্ভীর  কণ্ঠে  “বঙ্কা ,ফোন টা দে”—হাঁক দিয়ে দ্রুত এক্সিট এর দিকে  পা বাড়ালেন প্রগতিশীল  দলের হেভিওয়েট  ইলেকশন মাস্টার মাইন্ড বিপ্লব বোস ।

পড়িমড়ি  করে পেছনে ছুটতে  ছুটতে  বঙ্কা বলল-” কোন ফোনটা ,দাদা?”

দাদা প্রায়  ছুটছে-“-এস নাইনটা।” কে কে ফোন করেছিল রে?”

বঙ্কা  ছুটতে ছুটতে  সাবধান  করল– ওদিকের থেকে গাড়ি  পার্কিং  সরিয়ে  দিয়ে   নো এন্ট্রি  করে দিয়েছে, ওদিকে যাবেন না,—–বৌদি সেন্ট্রাল  এভিনিউ তে আটকে আছে  একঘন্টার ওপরে আর বৌদিই বলল–টুকুন কলেজ  থেকে  বান্ধবী র বাড়ি গিয়ে  ফেরার  পথে উল্টোডাঙ্গা  হাডকোর  মুখে  ফিরতি  মিছিলের  জ্যাম এ পড়েছে । আজহেভি ভিড় হয়েছে  দাদা,তাইনা?

“আরে,শালা ,কতটা  হাঁটতে  হবে রে?”বিরক্ত বিপ্লব এর জিজ্ঞাসা ।

“ওদিকের সব রাস্তা  নো এন্ট্রি  করে দিয়েছে,দাদা  ।সেই প্ল্যানেটোরিয়ামের দিকে  একটা বেরোনোর  রাস্তা  রেখেছে, আরএকটা কথা  বলতে  ভুল  গেছি তোমার ঐ আপেল ফোনটাতে বিশাখা দি ফোন  করেছিল  ,বলল ‘-দাদাকে  বলে দিবি  ওরা টাকা  দিয়ে  গেছে অফিসে ।  ,উনি  বাড়ি ফেরার  পথে,অফিসের থেকে বেরিয়ে  গাড়িতে আটকে আছেন মিছিলের  জ্যামে, বালিগেঞ্জর  কাছে, কখন ফিরবেন  ,জানেন  না,রাতে গিয়েদেখা করে টাকটা  নিয়ে  নিতে বলেছেন কারণ কাল ভোরে ফ্লাইট, দুবাই  চলে  যাচ্ছেন ।

ঘড়িতে  চোখ  বোলালেন বিপ্লব, ঠিক  সাতটা ।কাকে কিভাবে  ধরবেন, সব তালগোল  পাকিয়ে  গেল ।অবশেষে  নো এন্ট্রি র সীমানা য় পৌঁছে নিজের  সাদা বি এম ডব্লিউ  তে নিজেকেই গুঁজে  বললেন –‘ এসিটা বাড়িয়ে  দে।”

বঙ্কা  নির্দেশ  মতন কাজ করে  ড্রাইভার  এর কাছ  থেকে  জলের বোতল  নিয়ে এগিয়ে  দিয়ে  বলল- “এখনো  একঘন্টা,মল্লিক বাজারের  ক্রসিংয়ে  পৌছতে । তারপর  তো কোনদিকে  যাব ঠিক  করা,এখানে  আগের  গাড়ির যা লাইন আছে না,সত্যদার গাড়ি  ঠিক পঞ্চাশ মিনিট  আগে  বেরিয়ে এখনও  মল্লিক  বাজারের  মুখে  যেতে  পারে নি,লখা ফোনে  বলল,জানেন দাদা, বাপরে সব রাস্তাই কি নো এন্ট্রি?,হেভি  লোক  হয়েছে  মিটিংয়ে, তাই না দাদা?”

“শালা  শুয়োরের  বাচ্চার দল”–ক্ষিপ্ত বিপ্লবের জবাবে  চমকে  উঠল বঙ্কা ।

তারপর  থতমত খেয়ে  বলল –কারা দাদা?

বিপ্লবী  উত্তরও পেল–ঐ শালার পাবলিক ।

 

নো এন্ট্রি – ২

 

“–আমরা  এই  নির্বাচনী পদ্ধতির মাধ্যমে  সমাজ ব্যবস্থা  বদলাবে বিশ্বাস  করি  না ঠিকই  কিন্তু আমাদের  কোন  না কোন ভাবে গণতান্ত্রিক  পরিকাঠামোর  মধ্যে থেকেও  তার  ক্ষমতা করায়ত্ত  করার প্রচেষ্টা  চালিয়ে  যেতে হবে  তবেই একদিন  সমাজ বদলের স্বপ্নটা সার্থক  করতে পারব।এই নির্বাচনী কান্ড গুলো  তারই অংশ মাত্র” —–আসন্ন  নির্বাচন  উপলক্ষে প্রগতিশীল  দল আয়োজিত  রাজনৈতিক  চিন্তন শিবিরে নিজের  বক্তব্য  পেশ  করলেন  প্রগতিশীল  দলের  তরুণ  তুর্কী  চিন্ময়  দাশগুপ্ত ।

” হ্যাঁ,  এবার  আপনারা আপনাদের  প্রশ্ন গুলো করতে পারেন  চিন্ময় দাকে”—–সঞ্চালকের প্রস্তাব ।

দলের  ছটফটে  কর্মী  বীরু হাত  তুলল–দাদা, একটু  যে কথাটা  বললেন, তাতে  পাওয়ার =পলিটিক্স  এর তত্ত্ব টাই ঘুরিয়ে  চলে  এল না।

” আমি  বলছি—শোন——–”

বীরুকে মাঝখানে  থামিয়ে  তরুণ তুর্কী  বলতে  শুরু  করলেন—“তোর মাথায়  না কিস্যুটি  নেই,  এইজন্য  বলি একটু  পড়াশুনো কর।কোনদিন ই পার্টি – লিটারেচার গুলো  পড়লি না,হঠাৎ  সব প্রশ্ন  ছুঁড়ে  নিজেদের  জাহির  করার  বুদ্ধি  কে যে শেখায় বুঝতে  পারি না।”

এবার চকিতে  দলীয়  কর্মী  সুনন্দর দিকে  ঘুরে  বললেন–“শোন,ওকে  আমার লেখা ” ক্ষমতার বিশ্বায়ন ” বইটা দিয়ে  দাও।”

এরপর  বীরুর দিকে  চোখ  ফিরিয়ে বললেন  —“ওটা  পড়। না বুঝলে  বলিস।আমাদের  এখানে  ওভাবে  প্রশ্ন  করে নেতাদের  চোখে পড়া যায় না,প্রকৃত এবং যুক্তিনির্ভর আলোচনাকে আমরা কদর করি,জামাই ঠকানো  প্রশ্নে  আলোচককে বোকা  বানিয়ে  সমাজ  বদলের  মতন কঠিন  বিষয়  কিস্যুটি  বুঝবি না, বুঝলি?”

ছটফটে  কর্মী  বীরু  থতমত খেয়ে  বসে পড়ল।

এরপর  মাসছয়েক কেটে  গেছে ।ভোটও মিটে গেছে, সেই তরুণ তুর্কী  তখন  ক্ষমতার কুর্সিতে।কৃষ্টিচক্র ক্লাবের  মাঠের রক্তদান শিবিরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে  সেই  নেতা  আসছে  শুনে  সেই  ক্ষমতার বিশ্বায়ন  বইটাকে বগলদাবা  করে উপস্থিত হল বীরু।আজ নিজেই নিজেকে  সাজিয়ে  এনেছে   বেশকিছু  অকাট্য  যুক্তি  আর প্রশ্নে।ক্ষমতার পুলিশী ঘেরাটোপে  পরিচিতকে দেখলে  মানুষ  যেমন  অকারণেই    মানসিকভাবে  ক্ষমতা করায়ত্ত  হয়ে  যাবার  বিশ্বাসে বৃত্তের  মধ্যে  থাকা  লোকটার  সঙ্গে  সবার  সামনে ব্যক্তিগত  প্রসঙ্গ  তুলে কথা বলে নিজেকে  গুরুত্বপূর্ণ  করে তুলতে  চায়, ঠিক  সেভাবেই বীরু  এগিয়ে  গিয়ে  গলাটা  ভারি করে  ব্যাগ  বইটা বের করে বলল–চিন্ময়দা পড়ে ফেললাম, একটু  কথা আছে  তোমার  সাথে।”

একটু  থমকে  নিজেকে  সামলে  নিয়ে  তুর্কী  বললেন  “-আরে, ভালো তো?এখন তো পরিস্থিতি  আলাদা, এখানে   ওসব আলোচনা র জায়গাও না,ফোন  করে  অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে  ঘড়ি  ধরে  এস।কথা হবে।সবটাই  প্রোটোকল,বুঝলে”–বলতে  বলতে লাল আলো জ্বলা গাড়ি  এগিয়ে  আসতেই লাফিয়ে উঠে  পড়লেন  আর সতর্কবাণী  জারি  রেখে হুস  করে বেরিয়ে  গেল  লম্বা  কনভয় ।

বীরুর  সাজানো  কথাগুলো  ,প্রশ্ন গুলো  যেন বীরুকে  ঠাট্টা  করে উঠল একসাথে।, বোকা বোকা  ভাবে  হাতে ধরা বইটার  ওপর  হাত বোলালো একবার ।ক্ষমতার রাজনীতির  বিপরীতমুখী  শিবিরের  দাদা র ক্ষমতা র সুযোগের সদ্ব্যবহার  প্রক্রিয়টা পরখ করে থতমত ভাবটা কাটিয়ে  বইটা  আর কখনও  লাগবে  না বুঝতে পেরে   শেষ পরীক্ষা -র পরীক্ষার্থীদের  মত ব্যাগে  ঢুকিয়ে  সোজা  তাকাতেই  উল্টো দিকের  দেওয়ালে  ওদের  দলের  একটা  দেওয়াল লিখনে চোখ  আটকে  গেল–ক্ষমতা  দখল  নয়,যাবতীয় শোষণ,বঞ্চনার বিরুদ্ধে  লড়াই  চালিয়ে  যাওয়াই আমাদের  একমাত্র  লক্ষ্য ।

ফিক করে  হেসে  ফেলল  বীরু ।

 

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ