পান্তা ভাতে ছোট পিঁয়াজ আর লঙ্কা চিবিয়ে চাড্ডি ভাত খেয়ে, একটা বিড়ি ধরিয়েছিলো মোহন। তারপর যাঁতি দিয়ে খোসা শুদ্ধ সুপারিটায় চাপ দিতেই বুঝতে পারলো সুপারিটা ভোয়া।
কিন্তু একি ? ঘরের মধ্যে মাটির মেঝেতে হাঁটুর মধ্যে মাথা রেখে বসে আছে কালো পাথরের একটি মেয়ে। মেয়েটাকে দেখে ভয় পেয়ে পালাতে গিয়ে দেখলো দোর আটকেছে সে। বললো এই যে ব্রহ্মচারী বাবাজী – বলি কোন আশ্রমে যাওয়া হচ্ছে ? আমাকে নিয়ে যাবেনা ? দেখো গায়ে ছেঁকা লাগলো নাতো ? কোনখানটা দেখাও। আমি ফুঁ দিয়ে ফুঁ দিয়ে ঠান্ডা করি।
মোহন কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, আশ্রম নয়, হাসপাতালে যাচ্ছি।
মেয়েটি বললো, তোমায় ফল দুধ ঘি মাছ-মাংস-ডিম মন্ডা-মিঠাই খাইয়ে এমন চাঙ্গা করে দোব, তখন আমায় আর কাছছাড়া করবে না। এরপর মেয়েটি বললো, তোমার এই ছোট্ট ঘরে কি সুন্দর আলো হাওয়া। বাইরে কতো রোদ্দুর। আমি চুলগুলো রোদে শুকোই।
এরপর ঘর থেকে গামছাটা হাতে নিয়ে বললো চুলটা ঝাড়ি। তারপর বললো, মাগো ছেঁড়া গামছা, দাড়াভাঙা চিরুনি, ফাটা আয়না আমার দু’চক্ষের বিষ। দেখলেই গা পিত্তি জ্বালা করে।
মোহন বললো, আমার ঘরে তিনটেই ওই রকম। তারপর মশারিটাও ছেঁড়া।
মেয়েটি বললো, তুমি ঘুমোও কি করে ?
মোহন বললো কেন ? প্রথমে আমি মশারির মধ্যে শুয়ে থাকি। তারপর সব মশা এক এক ঢুকে পড়ে। তারপর আমি মশারি থেকে বেরিয়ে ছেঁড়া জায়গাগুলো বেঁধে দিই। এরপর সে দুঃখের মুখ করে বললো, জানো সকালে আমি যখন ঘরের মেঝে থেকে মশারিটা খুলে দিই, তখন দেখি কতোক মশা উড়ে যাচ্ছে। আর কতোক না খেতে পেয়ে মরে পড়ে আছে বিছানায়।
মেয়েটি বললো, তুমি কি ভেবেছো – এসব বলে আমায় ভাগিয়ে দেবে ? এখন আমি সাজবো তারপর নাচবো। আইলাইনারস- মাসকারা।
মোহন বললো. সে আবার কি ?
মেয়েটি বললো, আইলাইনার দিয়ে চোখ আঁকা হয়। মাসকারা চোখের পালকে দেয়। তারপর গালের মেকআপ, ঠোঁটের মেকআপ। লিপ গ্রস – ন্যাচারাল ম্যাজেন্ডা রেড, বেস প্রাইমা – ব্রাসার।
মোহন বললো, আমার মা এসবের নাম শোনেনি। তুমি আমায় ছাড়ো।
কোথায় যাবে ?
পাড়ার কুকুরদের জামা পরাতে।
কুকুরের জামা কি দিয়ে কাচো ?
মুগুর দিয়ে।
মেয়েটি মাথায় ঘোমটা দিয়ে বললো বলোতো আমি তোমার কি ?
মোহন পেত্নি বলতে গিয়ে বলে ফেললো পত্নি।
মেয়েটি লাফিয়ে তিনপাক ডিগবাজি খেয়ে বললো তুমি পতি আমি পত্নি। আমরা দু’জন কপোত কপোতি। ভাবতেই বুক ধড়ফড় করছে। বললো আমাদের বাসর হলোনা ফুলশয্যা হলোনা – বিয়েটা –কবে হোল ?
মোহন পড়লো ফাঁপড়ে। মেয়েটি বললো, হ্যাঁগো আমাদের বিয়েটা প্রেম করে হয়েছিলো না দেখশোনা করে?
মেয়েটির কথায় কাঁপ ধরলো মোহনের শরীরে। একটা সোমত্থ মেয়ে তার ঘরে। কেউ যদি দেখে ফেলে বলবে কি রে মোহন ভেতরে ভেতরে এতদূর? অনেকটা বিরক্তি নিয়ে মোহন বললো আমার জীবনে তখন খুব অন্ধকার। আমি হাঁটছি। যতো হাঁটছি ততই অন্ধকার। তারপর ঘুট ঘুটে অন্ধকার। যমের বাড়ির কাঠাকাছি। উল্টোদিক থেকে তুমি আসছিলে। জোরসে ধাক্কা লাগলো তোমার সঙ্গে।
মেয়েটি বললো ওমা তুমি হয়ত জানোনা আমার খুব দয়া মায়ার শরীর। কেউ কাঁদলে আমি সহ্য করতে পারিনা। আমার দোর গোড়ায় কেউ যদি কিছু চায় তাকে আমি চাল আলু দিয়ে দিই। হাঁড়িতে ভাত থাকলে বলি বোসো। একসঙ্গে খাবো। কতোজনকে তো দেখি তারা বলে মাপ করো। দু’বাড়ি এগিয়ে দেখো।
মোহন বললো তুমি তোমার গুনগান গাও। পারলে চিত্পুর থেকে বাজনা নিয়ে এসো। তাতে তোমার নামটা ছড়াবো। এখন রাস্তা ছাড়ো। অভিমান ঝরে পড়লো মেয়েটির গলায়। বললো আমি কি তোমার গলা ধরে ঝুলে আছি?
মোহনের পায়ের রক্ত দপ করে উঠে গেলো মাথায়। বললো ঝুলে দেখোনা। আমার ছেঁড়া গামছা দিয়ে তোমাকে উঠনের নিমগাছে বেঁধে ফেলবো। এরপর খুব আক্ষেপের সুরে বলে উঠলো – সেদিন যদি তোমার সঙ্গে দেখা না হয়ে সাপের ঘাড়ে পা দিতুম ভালো হতো।
মোহনের কথায় কেঁদে উঠলো মেয়ে। চোখ মুছতে মুছতে বললো আমি সবার কাছে একটা আপদ।
মোহন বললো তুমি আপদ নয়, বিপদ।
মেয়েটি চোখ তুললো মোহনের দিকে। মোহন বললো, তুমি আপদ নও। তুমি হলে সর্টসার্কিট। মানে লম্ফ।
মেয়েটি বলল লম্ফ মানে আগুন? সেকথা যদি বলো আগুন আমার যৌবন, শ্বাসে প্রশ্বাসবাসে।
মোহন বললো সেকথা আর বলতে – সাপের চেরা জিব। লকলকে অথৈজল, ডুবে গেলে টানাজালে তুলতে হবে। বললো দেখা হতে না হতে – কেন এলে রঙ দিতে? বললো ওগো শ্রীমতি প্রজাপতি আজ মনে হয় আমার খতম হবার দিন। এবার গান ধরলো সে; আবার যদি পাঠাও দয়াল – এ ভব সংসারে / একজন কৃষ্ণভক্ত মায়ের গর্ভে জন্ম দিয়ো মোরে।
মোহনের কথায় মেয়েটি কেঁদে উঠলো। বললো, তুমি এমন কথা বললে আমি কোথায় যাই। সারাটা জীবন কাঁটায় গিঁথে থাকতে হবে। এমন কপাল করে জন্মেছি। মোহন বললো আবার সোহাগ করে কান্না হচ্ছে? আমার ঘরে কিন্তু বেহালা নেই যে কাঁধে ফেলে বাজাবো।
মেয়েটি বললো ছেলেরা সব অমনই হয়। মেয়েদের ভালবাসা তুমি কি বুঝবে?
মোহনের গোঁফের ফাঁকে ফুটে উঠলো হাসি। এখন একটু একটু করে কথা বলার সাহস বাড়ছে। ভয় ভাবটা প্রায় নেই বললেই চলে। মেয়েটা মাথার ওপর উঠে নাচতে চায়। অত সহজে তোমায় মাথায় উঠতে দোবনা। যা বলার দরজার বাইরে থেকে বলো। বেটাছেলে নরম হলে মেয়েটা তক্তপোষে উঠে পা দোলাবে। আচ্ছা মেয়েটা কি সত্যিসত্যি ঘাসের মধ্যে ডুবে থাকা সাপ! কখন সোঁ সোঁ করে জামলা দিয়ে ঢুকে পড়েছে ঘরে! এবার কথা বলে উঠলো সে। বললো তোমার ভালবাসা? চিনিকে পুড়িয়ে কালো করে ঝোলাগুড়ে পাইল।
মেয়েটি বললো ভেজাল আছে বলে পাচ্ছো। কোটি কোটি মানুষের খাঁটি দুধের বাটির গরু কোথায়?
মোহন বললো গরু নয়, বলো গাইগরু।
মেয়েটি বললো গাইগরু বাচ্চা দিলে তখন তার বাঁটে দুধ আসে বলো?
মোহন বললো তুমি খেজুর গাছের রস না তাড়ি?
মেয়েটি বললো তুমি যেমন খাবে। টাটকা খেলে রস। রেখে দিলে গেবে গিয়ে তাড়ি।
মোহন বললো তোমার ইয়ারকি মারা কথা শুনে আমার গা শিরশির করছে। ভালো হবেনা কিন্তু?
মেয়েটি বললো একটা যোয়ান ছেলে আর একটা যোয়ান মেয়ে গা ঘেঁসাঘেঁসি করে বসে থাকলে ভালো হয়না। ভাতের হাঁড়ির ফ্যান গড়াতে কাঠের উনুন নিভে যায়।
মোহন বললো তুমি গর্ত করে উনুন তৈরি করে হাঁড়ি বসাও। আমি ততক্ষণে পগার পার হয়ে যাই।
মেয়েটির চোখের তারায় ঠিকরে ওঠা আগুন। বললো সিটা কতোদূরে?
নিরুদ্দেশ। যাকে বলে অসস্তাযাত্রা।
মেয়েটি চোখ নাচিয়ে বললো খুব যে সাহস। ঘর থেকে একবার পা বাড়াও দেখি। হাত পা গুলোকে দুমড়ে মুচড়ে রেখে দোব। বললো আমি খুব ভালো বলে তাই, অন্য কোন মেয়ের পাল্লায় পড়লে তোমার হালকে কামারশালে পুড়িয়ে লাঙলের ফাল করে ফেলতো।
মোহন বললো তুমি অন্য কাউকে না দেখিয়ে নিজের ঝালটা মিটিয়ে নাও। তাতে আমি বাঁচি আর মরি। তোমার তো দুঃখ মিটবে।
মেয়েটি বললো আই বাপ – খুব দেখছি ফুটফুট কথা ……
মোহন বললো তুমি কি ভাবো? ঝগড়ুটে মেয়ে কোথাকার? বলে কিনা আমায় লাঙলের ফাল করবে।
এই আমকে ঝগড়ুটে বলবে না।
মোহন বললো বলবো – বলবো – বলবো।
তুমি তিনবার বললে?
ঠিক বলেছি
মেয়েটি বললো ওঃ ……..
তারপর দেখলো মেয়েটি নেই। ঘরের মধ্যে একটা শালিখ। তারপর শালিখটি হেঁটে হেঁটে ঘর থেকে দুয়ার। – হেঁটে হেঁটে উঠোন, ওখান থেকে নিমগাছ। তারপর উড়ে গেলো আকাশে।
Tags: গল্প, পঙ্কজ চক্রবর্তী, পাথরের মেয়ে
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।