অনেক শতাব্দী পূর্বকার কথা। তখন বৌদ্ধযুগ। বঙ্গ দেশে মহারাজ সিংহবিক্রম দর্পদলন রাজত্ব করিতেছেন। তিনি যে কেবলমাত্র প্রজাদরদী সুশাসকই ছিলেন এমত নহে। শিল্প এবং সাহিত্যের অকুণ্ঠ পৃষ্ঠপোষণও করিতেন। প্রাচীন ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের পরবর্তীতে তাঁহার রাজত্বকালকেই সুবর্ণযুগ বলিয়া উল্লেখ করা হইয়া থাকে।
কবি, চিত্রকর, গায়কদের জন্য মহারাজ কালিদাস সদন, ভরত ভবন ও নারদ মহল নামে তিনটি বিশালাকার সভাগৃহ তৈরি করিয়া জনগণের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করিলেন। এতাবৎকাল যেমন কৃষক, মজুর, সেনানী, রক্ষাকর্মী, মোসাহেব প্রমুখেরা শ্রমের বিনিময়ে অর্থোপার্জন করিত, এক্ষণে কবি, গায়ক ও অন্যান্য শিল্পীগণেরও বৌদ্ধিক শ্রমের বিনিময়ে কিঞ্চিত রোজগারপাতি করিবার স্থায়ী বন্দোবস্ত হইল। চতুর্দিকে মহারাজ সিংহবিক্রম দর্পদলনের নামে ধন্য ধন্য পড়িল।
শিল্প সাহিত্যের চর্চা অকস্মাৎ ভয়াবহ রকম বাড়িয়া গেল। সম্বৎসর চাষ করিয়া কৃষক যেখানে দশটি স্বর্ণমুদ্রা আয় করিতে গলদঘর্ম, একজন সি – গ্রেড কবিও সেখানে কালিদাস সদনে একটি অর্ধপৃষ্ঠার কবিতা পাঠ করিয়া অন্যূন পঞ্চাশ স্বর্ণমুদ্রা আয় করিতে লাগিল। অন্যূন বলিবার উদ্দেশ্য ইহাই যে কবি শিল্পীদের মধ্যে মহারাজ গ্রেডেশন প্রথা চালু করিয়াছিলেন। মান, বয়স ও রাজভক্তির সূচক নির্ধারণ করিয়া গ্রেড স্থিরীকৃত হইত। সি-গ্রেড শিল্পীর বরাদ্দ পঞ্চাশ স্বর্ণমুদ্রা (সর্বনিম্ন) এবং এ-প্লাস গ্রেড শিল্পীর বরাদ্দ তিনশত স্বর্ণমুদ্রা (সর্বাধিক) নির্ধারিত ছিল।
নিতাই গুছাইত নামক জনৈক দোকানী হিসাব করিয়া দেখিলেন প্রভূত পরিশ্রম করিয়া মাসান্তে পাঁচ-সাত স্বর্ণমুদ্রা লভ্যাংশ হিসাবে আয় হইতেছে। এই যৎসামান্য উপার্জনে স্ত্রী পুত্র কন্যা লইয়া সংসার অতিবাহিত করা ক্রমশ দুঃসাধ্য হইয়া উঠিতেছে। তাঁহার মনে একটি পরিকল্পনা আসিল। আচ্ছা! দোকানদারি ছাড়িয়া কাব্যচর্চা করিলে কেমন হয়! না, বেশ হয়। পুঁজি ভাঙিবার প্রয়োজন হয় না অথচ আয় নেহাৎ মন্দ নহে। উপরন্তু বিস্তর খাতির। মহারাজ সিংহবিক্রমের রাজত্বে কবি শিল্পীদের তুল্য সুখীজীবন আর কাহার আছে!
গুছাইত মহাশয় আর বিলম্ব করিলেন না। নিজের মুদিখানাতেই কালি কলম আর সাদা কাগজ ছিল। সন্ধ্যাবেলায় স্নানপর্ব সারিয়া শুদ্ধচিত্তে শুদ্ধবস্ত্রে মহারাজ সিংহবিক্রমকে স্মরণ করিয়া বসিয়া পড়িলেন। ছোটবেলায় কিছু পদ্য লিখিয়া ছিলেন। বিদ্যালয়ের বার্ষিক পত্রিকায় একটি দুটি মুদ্রিতও হইয়াছিল। এক্ষণে এই পঞ্চাশোর্ধ বয়সে আর একটিবার চেষ্টা করিয়া দেখিলে ক্ষতি কী!
গুণীজনেরা বলিয়া থাকেন প্রতিভার কখনও মৃত্যু হয় না। বাস্তবিক তাহাই হইল। নিতান্তই তিনদিনের চেষ্টায় মহারাজের গুণকীর্তন করিয়া একখানি আস্ত কবিতা লিখিয়া ফেলিলেন নিতাইবাবু। অতঃপর মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকিয়া এবং প্রকাশ্যে মহারাজের নামে জয়ধ্বনি দিয়া কবিতাখানি জমাদারের করকমলে অর্পন করিলেন। জমাদার যথারীতি গোমস্তাকে দিলেন। গোমস্তা প্রথম দুই লাইন কাটিয়া মুহুরিকে দিলেন। মুহুরি শেষে চারি লাইন যোগ করিয়া সেরেস্তাদারকে দিলেন। সেরেস্তাদার প্রথমে বিযুক্ত দুই লাইনের উপর চারিলাইন যোগ এবং শেষে যুক্ত চারিলাইন হইতে দুই লাইন বিয়োগ করিয়া নায়েব মহাশয়ের দপ্তরে পাঠাইলেন। নায়েব মহাশয় অগ্র এবং পশ্চাতে দুই দুই লাইন ছাঁটাই করিয়া মোহর লাগাইয়া দিলেন।
ব্যাস! নিতাই গুছাইতের হিল্লে হইয়া গেল। সি-গ্রেড কবি হিসাবে প্রথমবার কালিদাস সদনে কবিতা পাঠ করিয়া খাজাঞ্চির নিকট হইতে ঝকঝকে পঞ্চাশটি স্বর্ণমুদ্রা পকেটস্থ করিয়া ফুল্লহৃদয়ে গৃহে ফিরিলেন।
সেই শুরু। তাহার পর আর পশ্চাতে তাকাইবার প্রয়োজন কিংবা ফুরসৎ কোনোটাই রহিল না। সি-তে শুরু করিয়া বর্তমানে তিনি বি-প্লাস গ্রেডে উন্নীত হইয়া কবিশ্রী উপাধিতে ভূষিত হইয়াছেন। তাঁহার শুভনাম হইয়াছে কবিশ্রী নিত্যানন্দ। রাজকৃপা দেড়শত স্বর্ণমুদ্রা। আগে লুঙ্গি ফতুয়ায় দিন কাটিত। এক্ষণে ফিনফিনে শান্তিপুরী ধুতি আর গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি ছাড়া অন্য কিছুই পরিধান করেন না। আগে দিনে দুই খিলি পান বরাদ্দ ছিল এখন দুই পাত্র পান নিতান্তই আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে। চেহারাতেও যথেষ্ট জেল্লা আসিয়াছে। আর মাত্র সিঁড়ির দুইটি ধাপ ভাঙিতে পারিলেই তাঁহার মনোবাসনার ষোলো আনা পূর্ণ হয়। পরেরটি কবিকূলভূষণ এবং সর্বশেষে কবিরাজচক্রবর্তী এই দুইটি এখনো অধরা রহিয়া গেল। কিছুদিন যৎসামান্য উদ্বেগে কাটাইবার পর গোমস্তার মাধ্যমে পাকা সংবাদ পাইলেন যে সামনের কবিপক্ষের সূচনায় তাঁহার এ-গ্রেড প্রোমোশন এবং তৎসহ কবিকূলভূষণ উপাধি প্রাপ্তি প্রায় নিশ্চিত।
মনে অতিরিক্ত ফুর্তি লইয়া তিনি বিদ্যাভবন সরণীস্থ সুরা হাউসের দিকে যাইতেছিলেন। অকস্মাৎ পথিমধ্যে ছোটবেলার বন্ধু হরেন মল্লিকের সহিত কবিশ্রী তথা আসন্নসম্ভবা কবিকূলভূষণ নিত্যানন্দের সাক্ষাৎ হইয়া গেল। হরেনকে দেখিয়া তাঁহার মনে প্রভূত সহানুভূতির উদ্রেক হইল। তালিমারা ফুলপ্যান্ট, কলারফাঁসা হাওয়াই শার্ট এবং পেরেকমারা চপ্পল পরিহিত হরেনকে যথার্থই দুঃস্থ বলিয়া বোধ হইল।
রাজধানী হইতে সুদূরবর্তী মফঃস্বলে হরেন মল্লিক দীর্ঘ দিন যাবৎ একখানি ক্ষুদ্র সাহিত্য পত্রিকা (তৎকালীন বঙ্গদেশে যাহাকে লোকে লিটল ম্যাগ বলে) সম্পাদনা করিয়া আসিতেছেন। পত্রিকালব্ধ আয় অপেক্ষা তৎসংক্রান্ত ব্যয় অধিকতর হওয়ায় হরেনের সাংসারিক ভাণ্ডারে টান পড়িয়াছে। তথাপি প্রতিবেশীদের নিরন্তর উপহাস ও স্ত্রী পুত্রকন্যার অশেষ গঞ্জনা নীরবে সহ্য করিয়া হরেন পত্রিকা প্রকাশ বিষয়ে অদম্য এবং অক্লান্ত।
সব শুনিয়া নিত্যানন্দ অনেক সহানুভূতি ও সমবেদনা জ্ঞাপন করিয়া বলিল, তুমি আমার সহিত আইস। আজ মাসের দ্বিতীয় শনিবার। কালিদাস সদনে সি-গ্রেড কবিদের কবিতা পড়িবার দিবস। গোমস্তাকে বলিয়া কহিয়া লিস্টে তোমার নামটি ঢুকাইয়া দিতে পারিব বলিয়া বোধ হইতেছে। প্রথমে সি-গ্রেড দিয়াই শুরু হউক, পরে মুহুরি মহাশয়কে হাত করিয়া সি-প্লাস করা অসম্ভব কিছু হইবে না। আপাতত পঞ্চাশ স্বর্ণমুদ্রা মন্দ কী!
হরেন মনে মনে ভাবিলেন মন্দ কী! একটি কি দুইটি কবিতা পাঠান্তে পঞ্চাশ স্বর্ণমুদ্রা উপার্জন তাঁহার কাছে প্রায় হস্তে চন্দ্র ধারণ বলা যাইতে পারে। এতাবৎকাল পত্রিকা সম্পাদনা করিয়া কদাপি পঞ্চাশ স্বর্ণমুদ্রা চর্মচক্ষে দেখেন নাই। পুলকিত চিত্তে তিনি তৎক্ষণাৎ বন্ধুর সহিত কালিদাস সদন অভিমুখে রওনা হইলেন।
বসন্তকাল। শিমূল পলাশ কৃষ্ণচুড়ায় প্রকৃতি অপরূপা। সুপবন বহিতেছে। প্রফুল্ল চিত্তে হরেন বন্ধুর সহিত গল্প করিতে করিতে চলিয়াছেন। অকস্মাৎ বসন্তের মাতাল সমীরণে কবিশ্রীর ফিনফিনে শান্তিপুরী ধুতি বেসামাল হইয়া হাঁটুর উপর কিঞ্চিৎ উঠিয়া গেল। হরেন সবিস্ময়ে লক্ষ করিলেন নিত্যানন্দের দুই হাঁটুতে অদ্ভূত ক্ষতচিহ্ন। লালিমাযুক্ত নধর শরীরের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ দুই হাঁটুর কুৎসিত ক্ষত হরেন মল্লিকের অস্বস্তির কারণ হইয়া দাঁড়াইল।
ভাই, ও কীসের ক্ষতচিহ্ন? হরেন দাঁড়াইয়া পড়িলেন।
কিছু নহে, বলিয়া নিত্যানন্দ ধুতি টানিয়া হাঁটু ঢাকিলেন।
হরনে তবু দাঁড়াইয়া রহিলেন। নিত্যানন্দ তাড়া লাগাইলেন, ইত্যবসরে যথেষ্ট বিলম্ব হইয়াছে। দ্রুত পদচারণা আবশ্যক। ভিড়ের মধ্যে গোমস্তাকে খুঁজিয়া বাহির করিতে সময় লাগিতে পারে।
হরেন ঠাঁই দাঁড়াইয়া পুনর্বার বলিলেন, কীসের ক্ষতচিহ্ন বলিলে না তো ভাই!
নিত্যানন্দ বলিলেন, বলিলাম তো উহা এমন কিছু নহে। প্রতিবার কবিতা পাঠের আরম্ভে ও সমাপ্তিতে মহারাজের সম্মুখে নতজানু হইয়া অভিবাদন করিতে হয় কিনা। দীর্ঘকালব্যাপী এবম্বিধ ক্রিয়ায় ঘর্ষণজনিত ক্ষত হইয়াছে মাত্র।
এই কথা শ্রবণ করিয়া হরেন পশ্চাদগামী হইবামাত্র নিত্যানন্দ বিস্মিত হইয়া বলিলেন, ওকি! তুমি কোথায় চলিলে ভাই!
কবিকে কখনও কাহারও সম্মুখে নতজানু হইতে নাই। নতজানু হইলে কবি বাঁচেন না। তাঁহার মৃত্যু হয়।
নিত্যানন্দ আরো বিস্মিত হইয়া বলিলেন, কিন্তু আমি তো দিব্যি বাঁচিয়া আছি!
তুমি কবি নহ তাই বাঁচিয়া আছো। তুমি আসলে নিতাই মুদি। দাঁড়িপাল্লার ওজন এবং মুদ্রা গণনায় তুমি ওস্তাদ কারিগর। তুমি দীর্ঘজীবী হও।
এই বলিয়া হরেন চলিয়া গেলেন।
(ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত ‘ব্যাঘ্র ও পালিত কুকুর’ গল্প অবলম্বনে)
Tags: গল্প, বিষ্ণু বিশ্বাস, ব্যাঘ্র ও পালিত কুকুর
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।