সূর্যটা গড়িয়ে গড়িয়ে তালগাছের কাছাকাছি নেমে আসতে আসতে বিকেলটা আরো কোমল হয়ে আসছে ততক্ষণে। নদীর স্রোতে সূর্য়ের জলকেলির দিকে ব্রিজের রেলিং ধরে তখনও সে নিরবে তাকিয়ে আছে।তার লম্বা চুল পিছলে পিছলে পড়ছে বৈকালিক রোদ ।আর তার বিচ্ছুরিত সমস্ত কেশাগ্র কাঁপছে তিরতির করে।নরম রোদের জেল্লায় তাকে দেখাচ্ছে আরো রমনীয় এবং মোহনীয় । মাথার ওপরে একঝাঁক পাখি উড়ে গেলেও সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নাই তার। এসব ছাড়িয়ে এখন আরো দূরে পড়ে আছে তার দৃষ্টি। কতটা দূরে সে দৃষ্টি তা বোধগম্যের বাইরে। হয়তো সে নিজেও জানে না তার দৃষ্টির খবর। হতে পারে এতোটা দূরে, যেখানে মেঘ আর কুয়াশা ছাড়া অন্যকিছুর অস্তিত্ব খোজেঁ পাওয়া দুষ্কর।যেখানে ভাবনাও খোজেঁ পায় না কোন পথ ।
নি:শ্চুপ সময় যাচ্ছে।
আমরা কেউ কারো সাথে কোন কথা বলছি না।
আমি পূর্বাপর সব জানার পরও এভাবে তার ব্যথাটা নতুন করে জাগিয়ে দিলাম কেন? আসলে আমিতো এতোকিছু সামনে আনতে চাই নি। কিন্তু কথায় কথায় সেও নিজেকে হালকা করতে লাগলো।আর আমিও চাচ্ছিলাম যে, তার মধ্যে অুধাবন সৃষ্টি করতে। পূর্বাপর সবকিছু সামনে রেখে নিজেকে বিচার করে একটা উপলব্ধির জায়গায় যাতে সে ফিরে আসতে পারে। যেখান থেকে সে নিজ থেকে তার সিদ্ধান্তটা নিতে পারে। আর আমার নিজের অবস্থানটাও তার কাছে তুলে ধরা জরুরী মনে করছিলাম। যা আটকে যাচ্ছিলো সঙ্কুচের প্রাচিরে।যা টপকাতে যেয়েও আমাকে কেন জানি ফিরে আসতে হয় বারবার।আর মূলত আমি এটা এমন ভাবে চাচ্ছি যে, সেটা তার প্রতি নিছক করুণা কিংবা অন্যকিছু ভেবে না বসে।আমার ঈপ্সা তাকে কি বুঝাতে ব্যর্থ নাকি সে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ, নাকি সে বুঝেও এড়িয়ে যাচ্ছে?
আমার কালক্ষেপ সহ্য হচ্ছিলো না। ঝরা পাতার স্তুপে হারিয়ে যাওয়া স্বর্ণখণ্ডকে খোজে পেতে আমি সহসা তাতে আগুন ধরিয়ে দেই। যাতে সব পুড়ে ছাই হয়ে বাতাসের ঝাঁপটায় আসল স্বর্ণটা বের হয়ে আসে।সে আমার চোখের সামনে পোড়তে থাকলো।এবং কাঁদতে থাকলো।এবং ধীরে ধীরে তীব্রতা হ্রাস পেতে পেতে ধোঁয়া হয়ে বাতাসে মিশে যেতে থাকে।বারবার সে তার চোখ মুছে।
তখনও কোন কথা বলছিলো না সে।অনেক্ষণ বাক্যহীন সময় পার করার পর শেষে আমিই নিরবতা ভাঙ্গলাম।তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। সেও আমার চোখে চোখ ফিরালো। এবং আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো। বললাম- তোমার মনের অবস্থা আমি গভীর ভাবে অনুভব করতে পারি। কিন্তু তোমার কাছে যা আছে তাতো কেবল স্মৃতি। আর স্মৃতি দিয়ে বাস্তবতার সাথে লড়াই করা যায় না।
আমার কথায় সে কোন জবাব দিলো না, নিরুত্তর দাড়িয়েঁ থাকলো কেবল। এবং তার দৃষ্টি আবারো নদীতে ফিরিয়ে নিলো।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ঠিক করে বলো-এভাবে কি জীবন চলবে?
নদীর জলধারার দিকে তাকাতে তাকাতে সহসা তার ঠোঁট নড়ে ওঠলো-
‘চলছেইতো।’
‘যেমন তুমি কী বুঝাতে চাচ্ছো?’ আমি প্রশ্ন করলাম।
‘দেখতে পাচ্ছো না, আমি জটলার মধ্যমণি।আমাকে ঘিরে যে আমোদ তা নিয়েই পার করে দিবো। যে ভাবে চলছে খারাপ কি…।’
আমি তার দিকে লক্ষ্য করলাম। এ উত্তরে তার মধ্যে কোন আত্মতৃপ্তি খোঁজে পেলাম না। হতাশা আর অসহায়ত্বের স্পষ্টছাপ। বললাম- আমার কথা তুমি লক্ষ্য করো। তুমি নিজেও একথা অস্বীকার করতে পারবেনা নিশ্চয়- জীবনের পথে মানুষ নির্ভরশীল। সঙ্গি ছাড়া জীবন অচল প্রায়। জীবনের প্রয়োজনেই একে অন্যকে খুজেঁ নিতে হয়। এবং মানুষকে জীবনে স্বার্থকতা খোঁজে পেতে, যেতে হয় সংসারের কাছে, সমাজের কাছে। এবং সেখানেই জীবনের প্রকৃত সুন্দর্য্য। ঝড় আসতে পারে। উড়িয়ে দিতে পারে,বিধ্বস্ত করে দিতে পারে সব, তাই বলে জীবন থেমে থাকে না। জীবনের প্রয়োজনে জীবনকে সেখান থেকে উঠে দাঁড়াতে হয়। ঘুরে দাঁড়াতে হয়। তাই বলে পতঙ্গের মতো আলো দেখে আগুনে ঝাঁপ দেয়ার নাম ঘুরে দাঁড়ানো নয়। এটা আত্মহত্যার নামান্তর!হ্যাঁ-আমি বিশ্বাস করি তুমার এখন অনেকজন আছে। যতোই থাকুক, তাদের নিয়ে এভাবে যতোই ভাল থাকো কিন্তু সেটা কি প্রকৃত ভালো থাকা বলা যায়? নিজেকে জটলার মধ্যমণি করে তুমি কি পারছো তুমার চোখে মুখের সীমাহীন হাহাকার আড়াল করতে? হতাশার ছায়া দূর করতে? শোন, সময় মার্বেলের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যায়। অথবা বলা হয় নদীর স্রোতের মতো। পরিবর্তনশীল সময়ের স্রোতে জীবনেরও রং বদলায়। অনেক বিচ্ছুরণ তার দ্যেুতি হারায়। ম্লান হয়ে আসে। মানুষ বেঁচে থাকে বিশ্বাস এবং ভালোবাসার জোরে। জীবনের প্রয়োজনে বিশ্বাস এবং ভালবাসাকে প্রবলভাবে জাগিয়ে রাখতে হয়। একটা আস্থার জায়গায় নিয়ে আসতে হয় নিজেকে। জীবনটা কোন পণ্য নয়। না কোন খেলনাও। তুমার আমার প্রতিটা বর্তমানও অতীতে পিছলে পড়ে। অতীতও ডুবে যায় তারও অতীতে। সামনে ভবিষ্যৎ আরও দূরে আছে ভবিষ্যতেরও ভবিষ্যৎ। তুমি নিশ্চয় এও জানো- দুধের মাছি মানে সু সময়ের বন্ধু। এরা উড়ে আসে আবার উড়ে চলে যায়। এরা কারো আপন হয় না। একসময় দেখলে তুমার সামনে-পেছনে, ডানে-বামে কেউ নেই, সবাই উড়ে গেছে।ভিড় জমিয়েছে অন্য কোথাও।আর তুমি দাড়িয়েঁ আছো একা ঐ তালগাছটার মতো। একটু আগে তারও মাথার ওপর ছিলো সূর্যের বিচ্ছুরণ।শাখায় শাখায় ছিলো দ্যুতি আর ছন্দ। পাতা ছিলো চকচকে আলোকজ্জ্বল। কিন্তু এখন তাকিয়ে দেখো তার শাখায়, পাতায় কেমন ম্লানতা আর অন্ধকার নেমে আসছে। আর দেখো তার বর্তমান করুণ নি:সঙ্গতা। তুমি সেই বাস্তবতাকে কিভাবে…।
‘স্টপ! স্টপ! স্টপ…!দয়া করে তুমি চুপ থাকো। এতো কথা বলছো কেন, আমাকে কেন তুমি এতো প্রশ্ন করছো! তুমি কেন আমাকে নিয়ে এতো নাক গলাচ্ছো? তুমি চুপ থাকো প্লিজ!’
তার কথায় আমি খানিক নিরব থেকে আবারো মুখ খোল্লাম-তোমাকে নিয়ে ভাবি বলেই এসব বলছি। তুমি কেন বুঝতে পারছো না নাকি জেনে বুঝেও এড়িয়ে যাচ্ছো?
‘প্লিজ, তুমি আমাকে বিরক্ত করো না। আমাকে আমার মতো বাঁচতে দাও।’
এটার নাম বেঁচে থাকা হলে স্বস্তি পেতাম। এভাবে নিজেকে নিঃশেষ করে দিচ্ছো। তুমি নিজেকে খুব বাজে ভাবে শেষ করে দিচ্ছো। তুমি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো-সবকিছু ভুলে যেয়ে তোমার কি নতুন করে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে না। সব কিছু পেছনে রেখে নিজেকে নতুনতরো সাজাতে পারো না?
সে আমার থেকে ঘুরে যায়। সে আমাকে পিছ দিয়ে সরে যায়। সে সূর্যাস্তের দিকে মুখ করে শক্ত নিশ্চুপ দাড়িয়েঁ থাকে ঠোঁটে কামড় বসিয়ে। সে কোন কথা বলছে না। তার দু চোখ সিক্ত!
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার দিকে নিরবে তাকিয়ে রই। সে আগের মতোই নিরব। কোন ভাবান্তর দেখা যাচ্ছে না তার মধ্যে। তার এ নিরবতা আমাকে পীড়া দেয়। আমাকে ব্যথিত করে। আমাকে উত্তেজিত করে। সহসা আমি ধর্য্যহারা হয়ে পেছন থেকে গিয়ে তার হাত ধরে সজোরে আমার দিকে ঘুরিয়ে আনি। এবং তার দু কাধে হাত রেখে ঝাঁকুনি দিয়ে বলি-কথা বলছো না কেন, হ্যাঁ আমি আমার কথা বলছি, তোমার মনে কি এখনো আমার জন্য একটুও স্থান নেই! তুমি এতো পাষাণ কেন?
আমার চোখে দৃষ্টি রেখে প্রিয়তির চোখের পাতা নড়ে ওঠলো।তার ঝিলিক প্রোজ্জ্বল ছলছলে চোখ থেকে আমার ঘাড় বেয়ে টুপটুপ অশ্রু গড়িয়ে পড়লো!
Tags: গল্প, জীম হামযাহ, নতুন চর
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।