দোতলার দুনম্বর কোর্টে বেলা দুটো নাগাদ বাণীব্রতর একটা কেস আছে ! সেটা ওঠার সময় প্রায় হয়ে এলো !
কালো গাউনটা পরতে পরতে বাণীব্রত হেসে বললো,
‘শুক্লা, তুই এবার একটা স্মার্টফোন কিনে ফেল…আর কিপ্টেমি করিস না মা !
শুনলাম তো কয়েক মাসের মধ্যেই কজ লিস্ট হোয়াটস-আপ-এ দেওয়া শুরু করবে ! তখন কি করবি ? বাড়ী ফিরে ডেস্কটপে কখন ওয়েবসাইট দেখবি আর কখনই বা ক্লায়েন্টকে খবর দিবি !’
শুক্লা বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে ওর পুরোনো নোকিয়া ফোনে টুপটাপ করে কাউকে বোধহয় এস এম এস করছিলো, মুখ তুলে কিছু জবাব দেওয়ার আগেই বার লাইব্রেরীর লম্বা টেবিলের শেষ প্রান্ত থেকে সিনিয়র উকিল নরহরি সামন্ত খবরের কাগজটা পাশে টেবিলে রেখে বললেন,
‘ওই তো ! বাড়ীর সকলের কথায় আমাকেও কিনতে হলো একমাস আগে….এই যে, স্যামসুং। বারো হাজার বেরিয়ে গেলো ! তবে হ্যাঁ, ছবি তুলছি খুব আর পাঠাচ্ছি…ছবি এখন আমার কাছে আসছেও খুব….ব্যাপারটা ভালো হে !’
বাণীব্রত হেসে বললো, ‘সব শিখে গেছেন দাদা ?’
নরহরি বললেন, ‘কিছু কিছু শিখে ফেলেছি ভাইপোটার কাছ থেকে ! হোয়াটস আপটা, ছবিটা তুলতে পাঠাতে পারি ! তবে অনেক ফিচার আছে তো ! আস্তে আস্তে সড়গড় হবে ! আরে আমাকে শেখাবে কে…বাড়ীতে তো কারুর সময় নেই !’
শুক্লার বোধহয় এসএমএস পাঠানো হয়ে গিয়েছে…এবার বললো,
‘কিনবো কিনবো…এবার তো কিনতেই হবে ! এই ফোনটার ওপর এতো মায়া পড়ে গেছে পাঁচ বছরে, কলেজ লাইফে কেনা তো, তাই আর বাতিল করতে পারছি না !’
বাণীব্রতর কেস ওঠার তাড়া, বারান্দায় বেরিয়ে যেতে যেতে বললো, ‘পাঁচ বছর এনাফ টাইম ! নতুন কিনে ফেল, কিনে ফেল ! আমাকে বলিস, দোকানে সঙ্গে যাবো, সিলেকশনে হেল্প করবো !’
নরহরি শুক্লাকে বললেন, ‘তোমরা সব ইয়ং জেনারেশন ! তুমি-ই বোধহয় একমাত্র এই কোর্টে সাবেকী ফোন নিয়ে চলো ! আর সবাইয়ের হাতেই তো ঢাউস সব মোবাইল আর কানে সর্বক্ষণ ইয়ারফোন…দূর থেকে দেখি সব পাগলের মতো বিড়বিড় করতে করতে আসছে !
শুক্লার খিদে খিদে পাচ্ছে, ক্যান্টিনে যাবে, উঠতে উঠতে বললো, ‘ হ্যাঁ, ওই হ্যান্ডস অফ-এ কথা বলারও খুব সুবিধে ! আমার তো এই ফোনে বেশ কাজ চলে যাচ্ছে ! তবে ওই যে বাণী বললো কজ লিস্টের কথা ! দেখি, এ মাসটা যাক, সামনের মাসে কিনে ফেলবো ! একটু টিফিন করে আসি দাদা !’
শুক্লা বড়ো কাঁচের দরজাটা ঠেলে বারান্দায় বেরিয়ে এলো !
শুক্লা আর বাণীব্রত এরা দুজনে চুঁচড়ো সদর কোর্টে একেবারে সংখ্যালঘু নয় !
বেশ কিছুদিন হলো একসঙ্গে পাঁচ ছজন বিভিন্ন কলেজ থেকে সদ্য পাস-করা অ্যাডভোকেট এখানে প্র্যাকটিস শুরু করেছে ! পাবলিক প্রসিকিউটর সিনিয়র এডভোকেট গৌরমোহন ব্যানার্জী একটু স্নেহের সঙ্গেই এদের বলেন অর্বাচীনের দল !
বার লাইব্রেরীর ঘরটা কখনো কখনো তাদের সকলের উচ্চকিত কথাবার্তায় ল কলেজের ক্যান্টিন বলে মনে হয় ! সিনিয়ররা ব্যাপারটা উপভোগ করেন, বোধহয় নিজেদের তরুণ বয়স মনে পড়ে যায় !
এদের মধ্যে বাণীব্রত আর শুক্লা কিছুটা সিনিয়র, দুজনে একসঙ্গে হুগলী মহসীন কলেজ থেকে ল পাস করে চুঁচড়ো কোর্টে প্র্যাকটিস করছে চার বছর হলো !
সদর কোর্টে দেওয়ানি আর ফৌজদারি কেসের তো কমতি নেই তাই পসার একটু একটু করে জমছে দুজনেরই !
তবে কলেজ জীবন থেকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেও দুজনের প্র্যাকটিসের ধরণধারণ বেশ আলাদা !
বাণীব্রত একটু বেছে বেছে কেস নেয়, ফৌজদারি কেস নিতে চায় না !
সেরকম যদি কিছু এসেও যায় তাহলে ক্লায়েন্টকে শুক্লার নাম রেকমেন্ড করে দেয় !
শুক্লার আবার ডিফেন্স করতে ভালো লাগে, প্রতিবাদী বা আসামীর জন্য আর্গুমেন্ট করবার সময় মনের মধ্যে একটা আলাদা উত্তেজনা অনুভব করে !
আর বধূনির্যাতন বা ওই জাতীয় কেস থাকলে তো কথাই নেই, ও একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ে, পারলে আদ্ধেক ফিজ নিয়েই নির্যাতিতার পক্ষ নিয়ে লড়বার জন্য তৈরী হয়ে যায় !
শুক্লার এই দুটো ব্যাপার নিয়ে বাণীব্রত সুযোগ পেলেই তাকে হালকা খেপায় !
প্রথমটা হচ্ছে এই মেয়েদের ওপর অত্যাচারের কেস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া !
আর দ্বিতীয় ব্যাপারটা হচ্ছে শুক্লার আদ্যিকালের মোবাইল !
আর একটা ইন্টারেস্টিং তর্ক চলে দুজনের মধ্যে প্রায়ই, সেই কলেজ লাইফ থেকেই, অপরাধীদের সংশোধন করা নিয়ে !
শুক্লার উত্তেজিত বক্তব্য, ‘জেলের পারপাস যদি বদলে যেতে পারে, জেলের নাম যদি সংশোধনাগার হয়ে যায় তাহলে সেই সংশোধনের প্রসেসটা আমাদের থেকেই শুরু হবে না কেন ?
দ্যাখ বাণী, যারা অপরাধ করে তাদের পক্ষের উকিল হয়ে আমরা তাদের মনের, তাদের ভাবনার সব থেকে কাছাকাছি চলে আসি ! সুতরাং আমরাই তাদের কাজের ভুলটা বোঝানোর জন্য সব থেকে বেশী কোয়ালিফায়েড, নয় কি ?’
শুক্লার উত্তেজনায় বাণীব্রত হাসতে হাসতে ঠান্ডা জল ঢেলে দেয়,
‘আরে ক্রিমিনালরা যদি সব রিফর্মড হয়ে যায়, মানুষ যদি লোভী না হয়ে, বাড়ী জমির মিথ্যে মামলা করা বন্ধ করে দেয় তাহলে খাবি কি ? কোর্ট কি মাছি তাড়াবে ?’
তার একটা গুরুভার প্রস্তাবের এরকম লঘুকরণে শুক্লা ভেতরে ভেতরে বেশ ক্ষুব্ধ হয় ! সে কিছু বলার আগেই বাণীব্রত আবার বলে, এবার একটু সিরিয়াস গলায়,
‘শোন, আমার বিশ্বাস অপরাধ প্রমান হওয়ার আগে পর্যন্ত অপরাধী তার করা অপরাধের গুরুত্ব, তার নিজের জীবনের বা সমাজের ওপরে সেই অপরাধের প্রভাব এসব ব্যাপারে বেশী ভাবে না ! শাস্তি পাওয়ার পরে, জেলের চৌহদ্দিতে একা থাকার সময় তার ভাবনা চিন্তাগুলো ঐদিকে যায় ! তাই জেলের মেয়াদ খাটার সময় অপরাধীর সংশোধন হওয়ার চান্সটা অনেক বেশী থাকে ! তুই তার আগে বুঝিয়ে বিশেষ ফল পাবি না, বুঝলি !’
শুক্লা দমে যায় না…তার ফৌজদারী কেসগুলো আসতে থাকে…আসামী সংশোধনের তার নিজস্ব প্রক্রিয়াও জারী থাকে !
আর অপরাধ-তত্ত্ব ও আসামীদের মানসিকতার ওপর দুজনের তর্কও সমানে চলতে থাকে !
সদর কোর্টের মেন চারতলা বিল্ডিংটা থেকে বেরিয়ে ক্যাম্পাসের ঠিক উল্টোদিকে ক্যান্টিন, মাঝখানের মাঠটা পেরিয়ে যেতে হয় !
কোর্ট চত্বরে নিয়মমাফিক ভিড়, একদিকে টিনের অস্থায়ী ছাউনির নীচে সারি সারি কম্পিউটারের সামনে ব্যস্ত নতুন যুগের কোর্ট-মুহুরীরা !
আর অন্যদিকে কম্পিউটার স্ক্রিনের দুপাশে ঝুঁকে পড়ে আছে বাদী বিবাদীর দল !
ছাউনির ঘেরা থেকে বেরোতেই মাঝমাঠে শুক্লা ছোট দলটাকে দেখতে পেলো…দুটো রোগা পাতলা ছেলে, ময়লা জামা প্যান্ট, উস্কোখুস্কো চুল, দেখলে তো বস্তির ছেলে মনে হয়, দুজনের কোমরের দড়ি ধরে আছে এক কনস্টেবল, সঙ্গে আর একজন পুলিশ, নিশ্চয়ই এ এস আই, তার পেছনে বোধহয় বাবা, কাঁচাপাকা চুল, হাঁটু অবধি কাপড়, ময়লা হাফশার্ট, পুলিশ দুজনকে কিছু একটা অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলতে বলতে এই বিল্ডিং-এর দিকেই আসছে !
কিন্তু আইনরক্ষক দুজন সেকথায় বিশেষ কান দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না, ওদের দুজনের ভাবলেশহীন মুখ এখান থেকেই শুক্লা দেখতে পাচ্ছে !
শুক্লার কাছাকাছি আসতেই বুড়ো মানুষটা ওকে, বা বিশেষ করে ওর কালো গাউনটাকে লক্ষ্য করলো বোধহয় ! তাড়াতাড়ি সারির পেছন থেকে দৌড়ে এসে হুড়মুড় করে ওকে বলতে লাগলো,
‘আমার মা-মরা ছেলেদুটোকে বাঁচাও দিদি…মিথ্যে মিথ্যে ওদের ধরে নিয়ে এসেছে…ওরা চুরি করেনি দিদি !’
শুক্লা হাত তুলে বুড়োকে থামিয়ে চোখের ইশারায় পুলিশের দুজনকে থামালো !
কাছ থেকে দেখে তার মনে হলো দুটো ছেলেই বোধহয় আঠারো পেরিয়ে গেছে…তবে কুড়ির নীচে তো হবেই !
তাড়াতাড়ি ভেবে নিলো ও, ‘জুভেনাইল না হলেও রিফর্ম এক্সপেরিমেন্টের জন্য কেসটা হতে পারে একেবারে আইডিয়াল…বাণীকে একবার হাতেনাতে দেখিয়ে দেওয়া যায় তাহলে…’
এ এস আই কে শুক্লা জিজ্ঞেস করলো,
‘কি কেস ?’
এ এস আইটি বয়সে তরুণ, বোধহয় তিরিশ একতিরিশ বয়েস !
‘নিশ্চয়ই পরীক্ষা দিয়ে ডাইরেক্ট রিক্রুট হবে’… শুক্লা ভাবলো !
‘আমি অনিল পাল, এ এস আই ! ল্যাপটপ চুরির কেস ম্যাডাম ! কাল দুপুরে বাড়ী থেকেই ধরেছি ! ব্যাটারা কিছুতেই মানছে না ! কিন্তু আমরা একেবারে শিওর ! এফ আই আর, একদফা ইনভেস্টিগেশন হয়ে গেছে ! আজ কাস্টডি চাইবো ! চোরাই মাল রিকভারি করতে হবে !’
শুক্লা ছেলে দুটোর দিকে ভালো করে তাকালো আবার, একটার আবার বাঁকানে মাকড়ি পরা…দুটোই গোঁজ হয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে !
মন স্থির করে ও বাপের দিকে ফিরলো,
‘কোর্টের তো কিছু খরচ আছে ! তার ওপর আমারও…’
‘দেব দিদি কোর্টের খরচ সব ! গরীব মানুষ আমরা, আমি ঘরামীর কাজ করি…আপনি যদি বাচ্চাদুটোর মুখ চেয়ে আপনারটা একটু কম করে…’
শুক্লা কথার মাঝখানেই বললো, ‘সেসব হয়ে যাবে ! তুমি এখন বলো তো এদের বয়েস কত…জানো ঠিক করে ?’
অনিল পাল চুপ করে শুনছিলো, এবার বললো,
‘ওটা চেক করেছি ম্যাডাম কালই ! দুটোই স্কুল ছেড়ে দিয়েছে পাঁচ-ছ বছর আগে ! স্কুলে গিয়ে দেখে এসেছি, পিঠোপিঠি, উনিশ বিশ ! এই যে কানে মাকড়ি, এটা মান্তু, ছোট, উনিশ বছর, আর ওটার বয়েস বিশ, শান্তু !’
শুক্লা মনে মনে প্রশংসা না করে পারলোনা…’ বাঃ ! এ অনিল পুলিশ তো কাজের আছে ! ওই ইয়ং বয়সটাই আসল রাজা’, ভাবলো ও !
মুখে বললো, ‘তাহলে তো ঠিকই আছে ! কখন এদের পেশ করবেন আপনি ?’
‘চারটেয়, ঘন্টাখানেক সময় আছে, তিন নম্বরে !’ অনিল পাল ঘড়ি দেখে বললো !
‘ঠিক আছে ! শোনো তুমি, আমি টিফিন খেয়ে আসছি ! এখন দোতলায় তিন নম্বর ঘরের বাইরে বারান্দায় বেঞ্চিতে বোসো ! আমি ফিরে এসে তোমায় ডেকে নেবো ! কিছু কাগজে ওদের দুজনের সই বা টিপছাপ নিতে হবে ! আজকে জামিন চাইবো, দেখি জজসাহেব কি করেন !’
কথাগুলো শুক্লা ছেলে দুটোর বাবার দিকে তাকিয়ে বললো ! বুড়ো তাড়াতাড়ি ময়লা জামার পকেট থেকে ততোধিক ময়লা একটা থলি বার করে তার থেকে দোমড়ানো মোচড়ানো কতকগুলো একশো টাকার নোট বার করে শুক্লার দিকে এগিয়ে ধরলো,’ এই যে দিদি…’
শুক্লা দুটো নোট তুলে নিয়ে বললো, ‘এতেই এখন হয়ে যাবে, আর লাগবে না ! তুমি এখন যাও, দোতলায় গিয়ে বোসো ! কাগজে তোমার ছেলেদের সই নিয়ে আমি ওদের সঙ্গে একটু কথাও বলবো আলাদা করে…তোমার সামনে নয় !’
তরুণ এ এস আই অনিল পাল মুচকি হেসে বাপকে বললো, এই তো…তুমি ঘ্যান ঘ্যান করছিলে, এখন উকিল ঠিক হয়ে গেলো তো ! এবার ম্যাডাম তোমার ছেলেদের ছাড়িয়ে আনবেন ! তুমি শুধু ওদের বলে দিতে বলো ল্যাপটপটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে ! শাস্তি কম হয়ে যাবে !’
শুক্লা অনিল পালের দিকে তাকালো…’বেশ বুদ্ধি ধরে তো ছেলেটা…এ তো তাড়াতাড়ি এস আই হয়ে যাবে !’
বললো, ‘কদিনের কাস্টডি চাইছেন ?’
এ এস আই অনিল সদ্যনিযুক্ত আসামী উকিলের দিকে তাকালো, বললো, ‘দেখি’ !
তার সঙ্গে ঠোঁটের কোণায় একচিলতে হাসি ঝুলিয়ে দিলো !
চারটের কিছু আগে শুক্লা দুভাই শান্তু আর মান্তু বারিকের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেলো, আলাদা করে তিন চার মিনিট, দোতলার বারান্দার এক কোণায় !
একটু দূরে চোখের কোণ থেকে তাদের লক্ষ্য করতে লাগলো অনিল পাল !
শুক্লা প্রথমেই জিজ্ঞেস করলো, ‘কি রে, এর আগে কখনো কেস হয়েছে তোদের…কোনোদিন ধরে এনেছে পুলিশ ?’
দুজনেই জোরে জোরে ঘাড় নেড়ে বললো, ‘না না, দিদি !’
চারদিকটা দেখে নিয়ে শুক্লা গলা নামিয়ে বললো, ‘সত্যি কথা বল ! জানিস তো উকিল আর ডাক্তারের কাছে কোনো কথা লুকোতে নেই ! এই প্রথম তোরা কিছু চুরি করেছিস তো ?’
শান্তু মান্তু দুজনে একঝলক নিজেদের মধ্যে চোখ চাওয়াচাওয়ি করে একসঙ্গে বলে উঠলো, ‘আমরা ল্যাপটপ চুরি করিনি দিদি, আগে কোনো দিন আমাদের পুলিশ ধরেনি !’
ও দুভাইয়ের দিকে ভালো করে আপাদমস্তক দেখলো আবার, বললো, ‘চুরি তো তোরা করেছিস বলেই আমার মনে হচ্ছে ! যদি বলে দিস তাহলে ভালো ! প্রথম অপরাধ বলে শাস্তি কম করার জন্য বলবো ! পুলিশ কিন্তু ঠিক বলেছে তখন ! চুরির কথা স্বীকার করে যদি ল্যাপটপ ফেরত দিস তাহলে কিন্তু শাস্তি কম হতে পারে ! নইলে…’
মাকড়ি-হীন শান্তু একটু নীচু গলায় বললো, ‘থানার লক আপে খুব মারে ওরা দিদি ! একজনকে দোষ স্বীকার করানোর জন্য খুব মারছিলো ! দিদি আপনি একটু বলবেন যেন আমাদের না মারে !’
শুক্লা এখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেলো চুরিটা ওরা করেছে, তবে প্রথম অপরাধ হতে পারে, পাকা চোর নয় !
তাই ওর নিজস্ব রিফর্ম প্রসেস চালু করার জন্য গম্ভীর গলায় বললো,
‘সেটা না হয় পুলিশকে রিকোয়েস্ট করবো ! তারা কি শুনবে আমার কথা ! ওরা ভীষণ মারে কিন্তু কথা বার করার জন্য ! তবে তোরা যদি চুরি স্বীকার করিস, জিনিস ফেরত দিস, তাহলে মারধর কম করতে পারে ! কত ছোট তোরা ! এই বয়সে কোথায় খেটে টাকা রোজগার করবি, বাবার পাশে দাঁড়াবি ! জেলে যাওয়ার পর তো সহজে কোথাও চাকরি পাবি না ! জেলখাটা চোরকে কেউ কাজ দেয়…বল তোরা ? আমি তোদের শাস্তি কম করার জন্য চেষ্টা করবো ! তবে তোদের কথা দিতে হবে আর কোনোদিন চুরি করবি না, ভালো হয়ে রোজগার করার চেষ্টা করবি ! কি রে বল…আমার কথা শুনবি ?’
দুই ভাই চুপ করে শুনছে ! শুক্লার মনে হলো দুজনে যেন হালকা করে ঘাড়ও নাড়লো ! উৎসাহের সাথে ও রিফর্ম প্রসেসের দ্বিতীয় চ্যাপ্টারে যাবার উদ্যোগ করছে এমন সময় অনিল এ এস আই ডেকে বললো, ‘এবার আমার ডাক পড়বে ম্যাডাম, ওদের ছেড়ে দিন ! ভেতরে যাবো আমরা !’
শুনে ব্যাগ থেকে ওকালতনামার কাগজটা বার করে নিলো ও ! একটু আগে তার ওপর ও শান্তু মান্তু বারিকের আঁকাবাঁকা সই নিয়ে নিয়েছে !
ল্যাপটপ চুরির কেস চললো পনেরো মিনিটের মতো !
শুক্লা দেখলো অভিযোগকারী লোকটিকে !
মধ্যবয়সী, চোখে চশমা, সরকারী উকিলের ঠিক পেছনে বসে মাঝে মাঝে আসামী দুই ভাইয়ের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি দিচ্ছেন !
ও মনে মনে বললো, ‘ আপনার চিন্তার কিছু নেই মশাই …আমার সিক্সথ সেন্স তো বলছে আপনার জিনিস ঠিকই ফেরত পেয়ে যাবেন…আমি এখন ভাবছি বাচ্চা ছেলে দুটোকে দাগী হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পারবো কিনা…হালকা শাস্তি খেটে তারপর সৎপথে ফিরে আসতে পারবে কি !’
সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অভিযোগকারী বললেন, উনি নিশ্চিত ওনার ল্যাপটপ পাশের বস্তির শান্তু মান্তু দুভাই-ই চুরি করেছে ! কারণ ওরা জানলার বাইরে থেকে প্রায়ই ওঁকে সাবধান করতো যে ল্যাপটপটা ঐরকম জানলার পাশের টেবিলে রাখলে চুরি হয়ে যেতে পারে ! সেজন্য উনি ওদের দুজনের নাম দিয়েই এফ আই আর করেছেন ! এখন পুলিশ ওনার ল্যাপটপ উদ্ধার করে দিক ও ওরা উপযুক্ত শাস্তি পাক !
ইনভেস্টিগেটিং অফিসার এ এস আই অনিল পাল বললো, গতকাল দুপুরে ওদের ধরে আনার পর কম বয়েস দেখে প্রথমে ওদের পুরোনো স্কুলে গিয়ে ওদের বয়সটা নিশ্চিত করেছে…দুজনের বয়েসই আঠারোর বেশী ! গতকাল ও আজ জেরা করার জন্য কোনো সময় পাওয়া যায়নি, এখন ঠিক করে ওদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে…যাতে চুরির মাল রিকভারি করা যেতে পারে ! সেজন্য তিনদিনের পুলিশ কাস্টডি চাই, ইত্যাদি ইত্যাদি !
শুক্লা শেষে বললো, অভিযুক্তদের বয়েস কম, পুলিশের খাতায় কোনো ক্রাইম রেকর্ড নেই, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিনদিন কাস্টডি অনেক বেশী সময়, আজ বৃহস্পতিবার, মাঝখানে মাসের সেকেন্ড শনিবার আর রবিবার পড়ে যাওয়ায় একদিন কাস্টডির অর্ডার হলে পুলিশ হরেদরে তিনদিন পেয়ে যাবে, বেলের জন্য তো আবেদন নেই, তাই মহামান্য আদালত যদি সবদিক বিবেচনা করে আগামী সোমবার পরের শুনানির দিন ধার্য্য করেন…ইত্যাদি ইত্যাদি !
মহামান্য জজসাহেব এই পেটি চুরির কেসটাও বেশ মন দিয়ে শুনলেন, মাঝে মাঝে কি সব খুচখাচ করে নোট করলেন তারপর হাতুড়ি ঠুকে উঠে যাবার সময় বললেন, অভিযুক্তেরা পুলিশ কাস্টডিতে থাকবে, পরের শুনানি আগামী সোমবার বেলা চারটের সময় !
শুক্লা এক নজরে দেখলো এ এস আই অনিল পাল সোজা কোর্টরুমের পেছনের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে !
তিন নম্বর ঘরের বাইরে অপেক্ষা করছিলো শুক্লা !
কোর্ট মুহুরীর কাছ থেকে কাস্টডির কাগজপত্র নিয়ে একটু পরেই বেরিয়ে এলো অনিল পাল ! সঙ্গে কনস্টেবল, তার হাতে শান্তু মান্তুর জিম্মাদারির দড়ি !
ও এগিয়ে গেলো অনিলের দিকে !
অনিল ওকে দেখে হেসে বললো, ‘আজকে তো প্রথম রাউন্ডে জিত আপনারই ম্যাডাম !’
কথাটা না শুনতে পাওয়ার ভান করে শুক্লা বললো, ‘আপনার কাছে একটা অনুরোধ আছে !’
অনিল পাল বোধহয় সদর কোর্টের এডভোকেটের কাছ থেকে হঠাৎ অনুরোধ শব্দটা আসবে আশা করেনি !
একটু হকচকিয়ে গিয়ে বললো,’বলুন না ম্যাডাম !’
শুক্লা অনিলকে একটু আলাদা করে দূরে নিয়ে গিয়ে বললো, ’মনে হচ্ছে আমার ক্লায়েন্টের এটা প্রথম অপরাধ। তাই ঘাবড়ে গিয়ে জজসাহেবের সামনে ওরা স্বীকার করলো না। আপনারা প্লিজ ওদের মারধর করবেন না । যদি ভাল করে বুঝিয়ে…’
অনিল বললো, ‘আপনি ওদের বুঝিয়ে বলুন, যদি ল্যাপটপের হদিশ পেয়ে যাই, রিকভারি হয়ে যায়, তাহলে মারধোর হবে কেন ! চুরি ওরাই করেছে, ওদের বডি ল্যাঙ্গোয়েজ তাই বলছে।’
শুক্লা আবার চমৎকৃত হল…বললো,
‘আমি তো যা বলার বলেছি। মার খাওয়ার ভয় আছে বেশ। এখন দেখুন কি হয়।’
অনিল পাল ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
‘সোমবার বেল চাইবেন ?’
শুক্লার একঘন্টা আগের কথা মনে পড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে । ও বললো, ‘দেখি’ ।
অনিল হাসলো, বললো, ’রিকভারি হয়ে গেলে বেল অপোজ করবো না।’
বার লাইব্রেরিতে ঢুকলো শুক্লা । দিনের শেষ চায়ের রাউন্ড চলছে । ওকে দেখে নরহরি সামন্ত বললেন,
‘তিন নম্বরে কি কেস করছিলে শুক্লা ? কাঠগড়ায় দেখলাম দুটো বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।’
শুক্লা ডিসপেনসার থেকে চা নিতে নিতে বললো, ‘জুভেনাইল নয়, আঠারোর বেশী ! ওই পেটি চুরির কেস…ল্যাপটপ । আজকে দুপুরেরই ওয়াক-ইন ক্লায়েণ্ট…আপনাদের ভাষায় মাঠের খদ্দের !’
পিপি গৌরমোহন বোধহয় ব্রিফ পড়ছিলেন, কিন্তু কানটা ছিলো এদিকে।
কাগজ থেকে চোখ না তুলেই হেসে বললেন, ‘অর্বাচীন উকিলদিদির অর্বাচীন ক্লায়েন্ট, বুঝলে না নরহরি।’
ওঁর বলার ভঙ্গিতে সবাই হেসে উঠলো।
শুক্লা টেবিলে বসে বললো, ‘সে আপনি যাই বলুন না দাদা। গরীব ঘরের বাচ্চা দুটো ছেলে…জেলে গিয়ে দাগী চোর না হয়ে যদি শুধরে যায়….’
গৌরমোহন ব্রিফটা বন্ধ করে বললেন, ‘শুধরোন খুবই মুশকিল শুক্লাদেবী। এইসব ছোটোখাটো চুরি না করলে সিগারেট, পানমশলা আর স্টাইলে চুলছাঁটার টাকা আসবে কোথা থেকে ! ওটাই এসব পেটি ক্রাইমের মূল কারণ । আরও কয়েক বছর যাক, তুমিও বুঝবে । তবে তোমার ওই সংশোধনের মিশনকে আমি সাপোর্ট করি । চেষ্টা তো করতে হবে আমাদের ।’
গৌরমোহন উঠে পড়লেন ।
ঘডিতে প্রায় পাঁচটা বাজে। বাণীব্রতকে ঘরের মধ্যে দেখলো না শুক্লা…’আজকের এক্সপেরিমেন্টটার শুরুটা ওকে যদি বলতে পারতাম’
শুক্লাও বেরিয়ে পড়লো ।
সোমবার লান্চের ঠিক আগেই একটা হিয়ারিং শেষ করে ও সবে বার লাইব্রেরিতে এসে বসেছে, পিওন এসে বললো যে বাইরে তাকে কেউ খুঁজছে ।
বাইরে এসে দেখে হারান বারিক, কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।
ওকে দেখে শুক্লা ঘড়ি দেখলো, তারপর বললো, ‘কেস উঠতে এখনও তো দুঘণ্টা সময় আছে। যাক তুমি এসে পড়েছো, ভালই হয়েছে । সঙ্গে টাকা আছে ? আজ আমি বেল প্লী করবো ।’
হারান বারিক বললো, ‘আজ্ঞে, দিদি ?’
শুক্লা বললো, ‘ও: ! বলছি যে তোমার ছেলে দুটোকে পুলিশের লক-আপ থেকে জামিনে বাড়িতে আনার চেষ্টা করব । বিনা বন্ডের কথা বলবো তবে জজসাহেব টাকা জমা রাখতে বলতে পারেন। টাকা আছে তোমার কাছে ?’
হারান বারিক বললো, আজ্ঞে, সাতশ তিরিশ টাকা জোগাড় করে এনেছি । এতে যদি আপনার…’
‘আরে আমার জন্য নয় ! জামিনের জন্য কোর্টে টাকা জমা রাখতে হতে পারে । এখন পঞ্চাশ টাকা দাও…কোর্টে দিতে লাগবে । আর তুমি এখানে বসে থাকো ! আমাকে কাগজ তৈরী করতে হবে…ছেলেগুলো এসে গেলে সই নিতে হবে ।’
শুক্লা টাকা নিয়ে লাইব্রেরিতে ঢুকে গেল । বাণীব্রত বসে কিছু পড়ছিল ।
মুখটা তুলে বললো, ‘কি রে, তোর সেই ডবল রিফর্ম কেস তো আজকেই ?’
‘হ্যাঁ, চারটের সময়, তিন নম্বরে । বেচারা বাবাটা এখনই এসে গেছে ! দেখি আজ বেল-এর জন্য পিটিশন মুভ করবো । কি জানি থানার কাস্টডিতে কি হোল ! চুরি তো ওরা করেছে বলেই আমার মনে হয়েছে…স্বীকার তো করলো না, না আমার কাছে, না কোর্টে ! এদিকে মার খাওয়ার ভয় আছে, জানিস ! আমাকে বললো, পুলিশকে একটু বলে দিন দিদি যেন না মারে…বোঝো !’
-‘তুই বললি নাকি ?’
-‘বললাম ! সে এক ইনটারেস্টিং এ এস আই কোর্টে এনেছিল ওদের, কি যেন নাম…হ্যাঁ, অনিল, অনিল পাল ! তার ভাবভঙ্গী একেবারে ইন্সপেক্টারের মতো…তাই রিকোয়েস্ট করলাম । সে আবার কি বলে জানিস ?
বলে চোরাই ল্যাপটপ রিকভারি তো করতে হবে আমাকে, কোথায় রেখেছে বলে দিতে বলুন, মারধোর হবে না, বেল-ও অপোজ করবোনা।’
-‘বাব্বা ! এ তো দেখছি প্রহ্লাদ পুলিশ !’
সাড়ে তিনটে নাগাদ পুরো দলটা দেখা দিল দোতালার সিঁড়ির কোণায় ।
শুক্লা বারান্দায় লাইব্রেরির দরজার পাশে হারান বারিকের সাথে অপরাধী সংশোধনে বাবা-মার আবশ্যিক ভূমিকার কথাটা সবে জমিয়ে বলতে শুরু করেছে…হারান বেচারা শুনে ঘাড় নাড়ছে আর মাঝে মাঝে মাথাটা চুলকোচ্ছে…এমন সময় ‘ওই যে, এয়েছে’ বলে সে ছিটকে সিঁড়ির দিকে প্রায় দৌড় লাগালো ।
শুক্লা ঘুরে দেখে এ এস আই প্রথমে, বেশ রিল্যাক্সড ভঙ্গীতে আসছে, পেছনে একজন কনস্টেবল, তার হাতে-ধরা দড়ির প্রান্তে শান্তু মান্তুর জোড়ি !
হারান তো গিয়ে প্রথমেই তার ছেলেদের গায়ে হাত-টাত বুলিয়ে হুড়মুড় করে অনেক কিছু লাগলো, দূর থেকে শুক্লা কিছু শুনতেও পাচ্ছে না !
ছেলে দুটোর মুখ দুটোও তো বেশ চকচকে, কোনো চাপ আছে বলে তো মনে হলো না ওর…
‘ব্যাপারটা কি ! মারধর হয়তো খায়নি ! তাহলে…এই আপাত প্রশান্তির কারণ কি ? আসামী দুজন আর এ এস আই, তিনজনের বডি ল্যাংগুয়েঞ্জই ( অনিল পালের বৃহস্পতিবারের কথাটা মনে পড়ে গেলো ওর ) তো প্রায় একই রকম !’ শুক্লা ভেতরে ভেতরে হঠাৎ উত্তেজনা অনুভব করতে লাগলো !
বেশীক্ষণ অধীর ভাবে থাকতে হলো না ওকে !
অনিল পাল কাছে এসে হেসে বললো, ‘ম্যাডাম, থ্যাঙ্ক ইউ ! মাল রিকভারি হয়ে গেছে ! ঘরের চালিতে লেপের মধ্যে ল্যাপটপটা লুকিয়ে রেখেছিলো ! কনফেশন স্টেটমেন্ট নিয়ে নিয়েছি ! আপনার কথায় বেশ কাজ হয়েছে !’
শুক্লা গম্ভীর থাকার চেষ্টা করলো, ‘খুব ভালো কথা ! আপনার অফিসার নিশ্চয়ই খুশী ?’
অনিল বললো, ‘হ্যাঁ, ম্যাডাম ! পারমিশন নিয়ে এসেছি পিপিকে বলার জন্য…আপনি বেল চাইলে পুলিশ অপোজ করবেনা !’
ও ফিরলো শান্তু মান্তুর দিকে, ‘কি ব্যাপার রে ! আমি তোদের উকিল…সেদিন অতোবার জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে বললি চুরি করিসনি ! আর লক-আপে পিটুনি খেয়ে…’
দুজনে প্রায় একসাথে বলে উঠলো, ‘না দিদি না !’
তারপর মাকড়ি-পরা মান্তু চারদিকে তাকিয়ে দাদার সঙ্গে একবার চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে নীচু গলায় বললো, ‘আপনার কথা শুনেছি দিদি ! আমরা দোষ স্বীকার করে নিয়েছি…একদম মারধর করেনি পুলিশ ! তারপর ওদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ল্যাপটপটাও বার করে দিয়েছি ! আমরা আর কক্ষনো কিছু চুরি করবো না । এবার শাস্তি হবে না, না দিদি ?’ বলেই মান্তু একবার অনিল পালের দিকে তাকিয়ে নিলো !
শুক্লা ভাবলো…’বা:, ভালোই প্রগ্রেস হচ্ছে…বাণীটা যদি এখানে থাকতো’
একবার পুলিশ দুজনের দিকে দেখে নিয়ে গম্ভীরভাবে বললো ও, ‘শাস্তি তো তোমাদের হবেই…তবে কম করার চেষ্টা করবো। তবে তোমাদের দুজনকে কথা দিতে হবে তোমরা আর কখনো চুরি চামারির মধ্যে…’
শুক্লার কথা শেষ হতে না হতেই দুজনে ওই হাতে দড়ি বাঁধা অবস্থায়ই হুমডি খেয়ে ওর পা ছোঁয়ার চেষ্টা করলো, ‘এই আপনার পা ছুঁয়ে বলছি আর কক্ষনো…’
ও পিছিয়ে গিয়ে বললো, ‘এই এই, কি করছিস কি কোর্টের মধ্যে । সুবুদ্ধি হয়েছে যখন, আমায় না বলে কাঠগড়ায় গিয়ে এই কথাটা দয়া করে জজসাহেবকে বোলো, তাহলে যদি কোনো কাজ হয়।’
দুজনে ঘাড় নাড়ে বাধ্য ছেলের মতো।
অনিল পাল আর কনস্টেবলটা এতক্ষণ পুরো ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিলো।
তাদের দিকে ফিরে শুক্লা বললো, ‘বেল-এর জন্য পিটিশন জমা করে দিয়েছি । একটু আগে যা বললেন, আশা করি কোন অসুবিধা হবে না ?’
অনিল যেভাবে ঘাড় নাড়লো তাতে বোঝা গেল কোনো অসুবিধা নেই ।
সবকিছু শুক্লা যেমন ভেবে রেখেছিলো প্রায় সেই রকমই ঘটলো।
পুলিশ আসামীদের স্বীকারাক্তির ডক্যুমেন্টের সাথে সাথে চুরি-যাওয়া ল্যাপটপটা পেশ করলো, ফরিয়াদী ভদ্রলোক সেটি সনাক্ত করলেন এবং পুলিশের বিনা বিরোধিতায় শান্তু মান্তুর পাঁচশ টাকার বন্ডে জামিন মঞ্জুর হয়ে গেল।
মহামান্য আদালত দশদিন বাদে পরের শুনানির দিন ধার্য্য করলেন ।
কোর্টরুম থেকে বেরোবার সময় এবার হারান বারিক শুক্লার পা ছোঁয়ার একটা বিফল চেষ্টা করলো !
শুক্লা ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো, বলে দিলো শান্তু মান্তু পরে বাড়ী যাবে, জামিন পাওয়া দুই আসামীর সঙ্গে ওর বিশেষ কথা আছে !
ক্যান্টিন প্রায় খালি !
শুক্লা প্রায় জবরদস্তি বাণীব্রতকে ধরে এনেছে !
এক্সপেরিমেন্টের বাকি অংশটা ও বাণীর উপস্থিতিতেই করতে চায় !
চারটে চা আর সিঙ্গাড়ার অর্ডার দিয়ে শুক্লা আর বাণীব্রত টেবিলে এসে বসলো !
শান্তু আর মান্তু কিছুতেই এক টেবিলে বসবে না !
যতই জামিন পাক হাজার হলেও আসামী তো বটে !
একটু আগেই কোর্টের কাঠগড়ায় গীতা ছুঁয়ে প্রথম অপরাধ কবুল করে এসেছে !
অবশ্য এটাও বলেছে যে ভবিষ্যতে এই রকম ভুল আর করবে না !
শুক্লার তখন মনে হয়েছিল জজসাহেব মুচকি হেসে বোধহয় সেটাও নোট করলেন !
যাই হোক, দু তিন বার বলার পর দুজনে টেবিলে একটু দূরত্ব রেখে পাশাপাশি বসলো !
টেবিলে চা সিঙ্গাড়া দিয়ে গেলো !
চা খেতে খেতে এবার শুক্লা তার ইনভেস্টিগেশনটা শুরু করলো !
‘নে তোরা খা ! খেতে খেতে এবার আমাকে বলতো তোরা ল্যাপটপটা চুরি করেছিলি কেন ? এবার সত্যি কথাটা বল ! টাকার দরকার ছিল…নেশা করিস ?’
হাতে সিঙ্গাড়া নিয়ে দুজনেই জোরে জোরে মাথা নাড়লো !
‘ঠিক আছে, নেশা না করার কথাটা নাহয় বিশ্বাস করলাম ! অবশ্য টাকার দরকার থাকলে তো একেবারে সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি করে দিতিস…লুকিয়ে রাখতিস না ! তাহলে ? কেন করেছিলি বল ?’
বাণীব্রত ওদের দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, ওদের প্রতিটা ভাবভঙ্গি লক্ষ্য করছে !
দুজনে নিজেদের মধ্যে চোখ চাওয়া চাওয়ি করছে, ভাবখানা এই সত্যি কথাটা বলবে কি বলবে না !
শেষে মান্তু বলে উঠলো, ‘আমরা ওই বুড়োকে একটু টাইট দিতে চাইলাম তো…আমাদের দেখলেই বস্তির ছেলে, বস্তির ছেলে, বলে গালাগাল দেয়…আগে সাবধান করেছি দু তিনবার…’দাদু, জানলার ধারের টেবিলে ওরকম ভাবে ল্যাপটপ রাখবেন না, আপনার একতলা বাড়ী…কখন কি হয়’…সে পাত্তাই দেয় নি…তাই সেদিন ভোরবেলায় জানলাটা খোলা পেয়ে …’
শান্তু তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, ‘আবার রেখে দিতাম দিদি, মাইরি বলছি, মা কালীর দিব্যি…সেদিনই মাঝরাতে গিয়ে জানলা দিয়ে ঢুকিয়ে দিতাম…কিন্তু বুড়ো ব্যাটা সময় দিলো না, সঙ্গে সঙ্গে থানায় গিয়ে আমাদের নামে কেস দিয়ে দিলো…’
মান্তু বলে উঠলো, ‘হ্যাঁ দিদি…আমরা ল্যাপটপ চুরি করি না…আমরা তো মোবাইল…’, বলেই দাদার দিকে তাকিয়ে থেমে গেলো !
শুক্লা প্রায় আকাশ থেকে পড়লো, ‘কি…কি ? মোবাইল কি ? বল…বল ?’
দুজনেই চোখ নামিয়ে নিয়েছে ! বাণীব্রত বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠেছে !
শুক্লা আবার বললো, ‘বল, মান্তু, কি বলছিলি, মোবাইল কি ? আমাকে একদম সত্যি কথা বল !’
এবার শান্তু থেমে থেমে বললো, ‘মিথ্যে বলেছিলাম দিদি, আর বলবোনা ! আমরা বেশ কটা মোবাইল চুরি করেছি আগে ! ধরা পড়িনি কখনো ! একটা লোক আছে, এক একটা মোবাইল দেড়শো টাকা করে দেয় ! কিন্তু আর কোনোদিন করবোনা দিদি ! তিন সত্যি দিদি !’ কথাটা শেষ করেই শান্তু চোখটা নামিয়ে নিলো !
বাণীব্রত বোধহয় জোরে হেসে উঠতে যাচ্ছিলো, শুক্লার স্তব্ধ মুখটার দিকে তাকিয়ে থেমে গেলো !
প্রবল মানসিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠে শুক্লা বললো, ‘ ছি ছি ছি, তোরা এতোগুলো মিথ্যে কথা বলেছিস আমাকে ! আমি কোর্টে তোদের প্রথম অপরাধ বলে আর্গুমেন্ট করে জামিন করালাম, আর তোরা কিনা…’
শুক্লার কথা শেষ না হতেই শান্তু মান্তু দুই ভাই এক সঙ্গে কাতরভাবে বলে উঠলো,’আর কোনোদিন চুরি করবো না দিদি ! মা কালীর দিব্যি !’
শুক্লা কিছু বলতে যাবার আগেই ওর মোবাইলটা বেজে উঠলো !
ও ব্যাগ থেকে ওর নোকিয়া ফোনটা বের করে দেখলো মা ফোন করেছে !
ফোনটা নিয়ে শুক্লা উঠে কথা বলতে বলতে ক্যান্টিনের দরজার দিকে এগিয়ে গেলো !
বাণীব্রত কি আর বলবে ওদের দুজনকে, ও চুপ করেই থাকলো !
আর ওরা দুভাই তাকিয়ে থাকলো শুক্লার দিকে !
মার সঙ্গে কথা শেষ করে এসে শুক্লা বেশ বিধ্বস্ত গলায় বললো, ‘তোরা এখন বাড়ি যা ! পরশু কোর্টে এসে আমার সঙ্গে দেখা করিস ! বাণী, চাটা ঠান্ডা হয়ে গেছে ! আর একবার চা বল প্লিজ ! ও:, মাথাটা আমার ধরে গেলো এসব শুনে !’
এই বলে শুক্লা চেয়ারে বসতে যাচ্ছে বাণীব্রত চোখের ইশারা করে দেখালো দরজার দিকে ! শুক্লা ঘুরে দেখলো দুভাই ক্যান্টিনের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কিছু আলোচনা করছে !
শুক্লা একটু উঁচুগলায় বললো, ‘কি রে, বাড়ি চলে যেতে বললাম না ! কি হলো আবার ? কিছু বলবি, না কি ?’
দুজনেই পায়ে পায়ে শুক্লার দিকে এগিয়ে এলো ! খুবই কিন্তু কিন্তু ভাব, বলবে কি বলবে না ঠিক করতে পারছে না যেন !
শুক্লা একটু নিরুত্তাপ গলায় বললো, ‘বল কি বলবি !’
দুজনে চোখ চাওয়া-চাওয়ি করতে করতে মান্তু বলে উঠলো, দিদি, আপনি আমাদের জন্য এতো করলেন, পুলিশের হাতে মার খেতে হলো না, জামিনও হয়ে গেলো, তাই আমরা ভাবছিলাম…’ মান্তু বলতে বলতে থেমে গেলো !
শুক্লা একটু তেতো গলায় বললো, ‘তো ? কি ভাবছিলি তোরা..ব-অ-ল ?’
এবার শান্তু বললো, ‘না ভাবছিলাম দিদি…মানে…কেবল আর একবার যদি, একদম লাস্ট, পরে আর করবো না দিদি, মাইরি মা কালির দিব্যি, যদি আপনার জন্যে …’ শান্তু ভাইয়ের দিকে তাকালো !
শুক্লা মান্তুর দিকে তাকাতেই মান্তু হড়বড় করে বলে উঠলো,
‘না আমরা ভাবছিলাম যদি আপনার জন্যে একটা স্মার্ট ফোন…এই শেষবারের মতো…যদি আনি দিদি…মানে ভালো ফোন, বড়ো স্ক্রিন…সামসুং…’
বাণীব্রত এতো জোরে হো হো করে হেসে উঠলো যে ক্যান্টিনের জানলার ধাপিতে বসা দুটো পায়রা ঝটপট করে উড়ে গেলো ! আর শুক্লা ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো…তার মনে হলো ডাক ছেড়ে কেঁদে ওঠে !
Tags: অর্বাচীন, গল্প, সিদ্ধার্থ সান্যাল
email:galpersamay@gmail.com
সুদীপ বসু on March 24, 2020
দারুণ ভালো লেগেছে … গল্পের উৎসাহ ব্যাঞ্জক ও উদ্রেক কারী ভাবনাটা আমাকে উৎসাহিত করলো … আনন্দ পেলাম … সুবসু
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।