11 Jun

সব জানালা যখন বন্ধ হয়ে যায়

লিখেছেন:জীম হামযাহ


আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। পুলিশের প্রাথমিক সন্দেহ আমাকে ঘিরে। আমি তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কি করবো না করবো কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না। মূহুর্তের মধ্যে সবকিছু ঘোলাটে দেখতে পেলাম। আশপাশের ফ্ল্যাটের মানুষজন এসে ভীড় জমিয়েছে আমাকে ঘিরে রেখে। নানাজনের নানা প্রশ্ন। যাকে বলে পাবলিক জিজ্ঞাসাবাদ। আমি ঠিক মত কিছুই বলতে পারছিলাম না। ঠোঁট শুকিয়ে আটালো হয়ে আটকে যাচ্ছে। আমি জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ঢুকের পর ঢুক গিলি। একটি তীরের জবাব দিতে না দিতে তীরের পর তীর এসে আমাকে বিদ্ধ করছে। তারপর আমি ঘিরে থাকা লোকদের প্রতি হাত জোড় করে মাথা নাড়ি আর বলি- আমি মারিনি, আমি মারিনি! এমতাবস্থায় পুলিশ এসে আটক করে আমাকে গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে আসে।

বলতে গেলে, সে আচমকা এসেছিল । কালের দুর্বিপাকে বিপর্যস্ত হয়ে যখন সব জানালা বন্ধ হয়ে গেল, তখন নিঃশ্বাস ছাড়ার জন্য হলেও একটা জানালা সে খোঁজছিলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম- আর কোন পথ কি খোলা আছে? সে চোখের জল ফেলে আর মাথা নাড়ে। না, না।

আমার যতটুকু মনে পড়ে, যে ছিল আমার জীবনে প্রথম চাওয়া, তার নাম সুজানা। দীর্ঘ খরা আর চৌচির দিন শেষে বর্ষার অজোড় ধারায় সে এনেছিল আমার জীবনে নতুনতর উচ্ছ্বাস। শতরূপার মুগ্ধতায় আমার থই থই বুকে ফুটিয়েছিল শতদল। কল কল-ছল ছল বুকে নৃত্য-ছন্দে আমি আলোড়নের তটে বসে আনন্দে কাঁপতাম। আর তাকিয়ে রইতাম খরতর নদীর বুকে দোলায়িত ছোটো তরীর দিকে। আমি আশায় আশায় দিন পার করতাম, তরী ভিড়বে আমার ঘাটে। বেলা কাটতো সুজানার হাতের বৈঠার সহ সঙ্গী হতে। আমার বেলা যায় অপেক্ষায় অপেক্ষায় । কিন্তু তরী ভিড়েও ভিড়ে না। ছলছল স্রোতে ছলনার খেলা খেলে। তারপরও বেলা যায় আর যায়। দেখতে দেখতে একসময় আমি লজ্জ্বা কিংবা ধর্য্য হারাই। সময়ক্ষেপন না করে নিজেই এগিয়ে গেলাম দুপায়ে। শতদল নিয়ে হাত বাড়ালাম আকুল আবেদনে। নদীর কুলকুল স্রোতে সে প্রসন্ন হাসির উতরোল ছড়িয়ে দু হাতের বৈঠা ছেড়ে দিল। তার দু হাত নাড়িয়ে কাঁকনের রিনিঝিনি ঝঙ্কার তুলে বললো- ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোটো এ তরী’!

আমি বিস্ময়ে লক্ষ করলাম তার দুহাতের বৈঠা ধরে রয়েছে অন্য একটি ছেলের হাত!

সুজানার কাছে আমি যদিও প্রথম ছিলাম না কিন্তু সে ছিল আমার প্রথম চাওয়া। ভুলতে ভুলতেও আমি তাকে ভুলতে পারি না। সে মনে রয়ে যায় ভুলে ভুলেও। একদিন সুজানাকে জিজ্ঞেসও করে ফেলি- তুমি তাকে কতটা ভালবাস? সে বলেছিলো- সংজ্ঞাহীন। প্রশ্ন করেছিলাম – সে তুমাকে কতটুকু ভালবাসে? সুজানা আমাকে আকাশের বিশালতার প্রতি ইঙ্গিত করে। তখনও পথের মোড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি চলে আসি।

প্রায় দেখতাম তারা ঘুরছে আর ছুটছে। ছুটছে আর ঘুরছে। উড়ছে আর দোলছে। কখনও তীব্র হর্ণ বাজিয়ে তারা চলে যেত আমার পাশ দিয়ে। আমি কখনো তাকাতাম আবার কখনো তাকাতামও না। নিজেকে বলতাম-যাচ্ছে যাক!

তারপর ক্যালেণ্ডারের কতো পৃষ্ঠা উল্টে গেলো।আড়ালে-আবডালে কখনো আড়চোখে অনিচ্ছায় সম্মুখে-পিছনে দিনে দিনে কতো দিন ভেসে গেলো অতীতের ধারায়। এরি মধ্যে আকাশ কতোবার রোদে হাসলো, কতোবার মেঘে ছেয়ে বৃষ্টিতে কাঁদলো, বিজলী চাবুকের আঘাতে বজ্রপাত হলো সে অনেক কিছু আমার অগোচরে পড়ে রইলেও টানাপোড়ন, সঙ্কোচনের সঙ্গিন খবর যে একটু একটু করে আসে না তা নয়। আমি নিশ্চুপ খেকে গেলাম। নিরবতা ছাড়া আমার কী করার ছিলো? আমি আমার মুক্ত আকাশের অসীম বিশালতার দুয়ার খোলে হাত বাড়িয়ে ছিলাম, কিন্তু সে এলো না।ভেবেছিলাম সে আসবে তার অতীত ঝেড়ে তার মনে আমার জন্য জায়গা তৈরি করে বলবে- করবা তুমার জীবনতরীর সঙ্গিনী! আর নাই বলুক  অন্তত তার ব্যথাগুলো আমাকে জানাবে।

কিন্তু এ ছিল আমার নিছক কল্পনা।আমার ধারণাকে অতিক্রম করে সে হোস্টেল ছেড়ে, শহর ছেড়ে চলে গেলো একেবারে নাগালের বাইরে।আমি এমন কোন মওকা পেলাম না, তার সাথে যোগাযোগ রাখি।

একটা সময় এমন আসে, আমাদের চারপাশের সবকিছু লাগে বর্ণালি। শিল্পীর চেয়েও মহান শিল্পীর কারুকার্যতা ডানায় নিয়ে উড়ে বেড়ানো প্রজাপতি,রং বেরংয়ের ফুলের রূপ আর সৌরভ এবং চারপাশের বহু বর্ণের বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মি চোখে তৈরি করে মোহনীয় মায়া। কল্পনার রঙ্গালো ভূগোলে বসে বসে জীবনের ছক আঁকি। কিন্তু ছকানুযায়ি জীবন এগোয় না। কখনও জীবনের গতি আর সময়ের গতির মাঝে নেমে আসে বিস্তর ফারাক। জীবনকে পিছনে ফেলে সময় চলে যায় বহু দূরে। এমনও হয়, ঝড় ঝাপটা সব উল্টে পাল্টে দেয়। তারপরও বসে থাকা যায় না।জীবনের প্রয়োজনে আবার ঘুরে দাঁড়াতে হয়। আবার নতুন সময়ের সাথে সঙ্গতি রেখে হিসেব কষতে হয়। কেউ কেউ আবার ঘুরপাক খায় অদৃষ্টের ছকে।

সুজানার বিয়ে হয়েছে এ খবর আমি জানতে পারি অনেক দিন পর। ঢাক ঢোল ছাড়া তড়িঘড়ি করে বোধ হয় অনাড়ম্বর বিয়েটা হয়েছে। আপন স্বপ্ন-ইচ্ছের কাছে পরাজিত হয়ে শেষে  সে পরিবারের ইচ্ছে ও পছন্দের কাছে নিজেকে সোপর্দ করে দেয়। ছেলেটিও তাকে দেখে পছন্দ করে বিয়ে করেছে। অবস্থাপন্ন পরিবার। স্বনির্ভর স্বামী তার। শুনেছি সুখে আছে।

তারপর কেমনে কেমনে একদিন সুজানার সাথে আমার যোগাযোগ স্থাপিত হয় আন্তর্জালে।এবং তা ছিলো আকস্মিক বটে।আমি নিজ থেকে তার করিডোরে নক করি। টুকটাক কথা হতো।  প্রথমে তার কথা থেকে কিছুই আন্দাজ করতে পারি নি। যদিও সে নিজেকে ঢেতে রাখতে চেয়েছিলো, কিন্তু একটা সময়  তার ভারি দীর্ঘশ্বাসের ধাক্কায়  সে পর্দাটা উড়ে যায়! তারপর সে নিজ থেকে একটু একটু  করে ঝাঁপি খোললো।

‘যতটা ভাবছো তা মোটেও না। ভদ্র লোকেরা হাত দিয়ে মারে না, ইশারায় মারে। নিরাসক্ত সে।  আমার থেকে থাকে এখন অনেক দূরে।’

স্বামীর সাথে টানাপোড়নের অনেক কথা আমার সাথে শেয়ার করলো।

বলেছিলাম ম্যানেজ করে নে দেখবে-ধীরে ধীরে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

সে হয়তো ম্যানেজ করার চেষ্টায় নিজের মেধা-শক্তি যা আছে সব ব্যয় করছিলো। হয়তো সব স্বাভাবিক হয়ে যেত। কিন্তু টানাপোড়ন ব্যাপ্ত এই সময়ে একটি  “ভিডিও স্ক্যান্ডা” ভারাইল হয়ে সে সম্ভাবনাও ডুবিয়ে দিলো  । হঠাৎ কোন কাঁচের গ্লাস মতো হাত থেকে  পড়ে চুরমার হয়ে গেলো!

আমার মোবাইলে তখন শুধু ছোট একটা এসএমএস এসেছিল-লম্পটটা রেহাই দিলো না, আমার সব শেষ করে দিলো!

ছোট একটি লাইনের আড়ালে সুজানার অসহায় কান্না আর যন্ত্রণার কী ব্যথা আমি অনুভব করতে পারছিলাম।  হয়তো সুজানার সবচেয়ে বড় দূর্বলতা ছিল সে মেয়ে। এজন্যই হয়তো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিয়মে প্রকৃত অপরাধীর কথা বিবেচনায় না এনে সবার লক্ষবস্তুতে পরিণত হল একা শুধু সুজানা।  একটা ‘ভিডিও স্ক্যান্ডাল’ মুহুর্তের মধ্যে তাকে তার বিশাল পৃথিবীটাকে সংকীর্ণ করে আশ্রয়হীন করে দিলো। শুধু স্বামীর ঘর হারালো না, আপন পরিবারে এসেও স্বস্তি থাকলো না তার। ঘরের বাইরে পরিবারের সদস্যদের ওপর পরিহাসের যতো কাঁটা আর তীর বিঁধতো , ঘরে এসে তারা সব ছুড়ে দিতো সুজানার ওপর। ঘৃণা আর অপমানের দুর্বিপাকের ঘূর্ণি থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেয়ার মতো তার নেই নিরাপদ স্থানটুকু । নারীর রূপ যৌবন নিয়ে যখন খোলা আকাশের নিচে অসহায়, তার চারদিকে থাকে শুধু অশুভ দৃষ্টি। নিসঙ্গ দূর্যোগে তার ডাঙ্গায় যেমন বাঘের ভয়, পানিতে রয়েছে কুমিরের ভয়!  ভাবনার তেপান্তরে ঘুরপাক খেয়ে খেয়ে শেষে হয়তো সে একটা পথ খোঁজে পেয়ে ইতস্তত নিরুপায় পদে পা বাড়িয়েছিলো ।

সুজানাকে  নিয়ে আমার দিন আন্তরিক চলছিলো ঠিক কিন্তু সমস্যা হচ্ছিল ব্যাচলর জীবনে তাকে নিয়ে এক ছাদের নিচে বসবাস। যে সুজানাকে একদিন মনেপ্রাণে চেয়েও নিজের করতে পারি নি আজ তাকে কাছে পেয়েও পারছি না জীবনের সাথে জড়িয়ে নিতে। কী বাস্তবতা! কী বিচিত্র এ জীবন! না পাবার আক্ষেপ হয়তো জীবনে বহু থাকে। কিন্তু না পাবার আক্ষেপ নিয়ে জীবন শুধু শুধু আফসোসের বন্দরে পড়ে থাকে না। জীবন চলে জীবনের নিয়মে। তবে নিজেকে থাকতে হয় দক্ষ চালকের  ভূমিকায়। সেই ছেলেটির সাথে যখন সম্পর্ক ছিলো, সুজানা তাকে ভালবাসতো অন্ধের মতো। সে ছাড়া তার মনে আর কারও যেমন ঠাঁই ছিলো না। ঠিক আমার ক্ষেত্রে অর্পারও হয়েছে একই অবস্থা। আমার প্রতি তার ভালবাসা সংজ্ঞাহীন। তার বিশাল আকাশ জুড়ে যেমন আমার অস্তিত্ব তেমনি আমারও সমগ্র সত্ত্বা জুড়ে দখল করে আছে অর্পা।

সুজানার কাছে এসব কিছুই অজানা ছিলো না। পরিস্থিতি অনুভব করতে পারছিলো সে। একদিন  জানালো, একটা বাসা পেয়েছে। অফিসেরও কাছাকাছি। রিক্সা ভাড়ার অনেক টাকা বাঁচবে।  দু একদিনের মধ্যে তথায় গিয়ে সে উঠবে। আমি ইতস্তত করে হলেও তার কথায় সায় দেই। সুজানা তার তিন দিন পরে আমার বাসা ছেড়ে নিজের বাসায় চলে গিয়েছিল।

অর্পা আর আমার ব্যাপারটি আর ব্যক্তিগত না রেখে পারিবারিক ভাবে এগিয়ে নেবার জোর প্রস্তুতি চলছিলো।

অর্পা আগে যদিও কয়েকবার অনেকটা প্রায় ধারনাপ্রসূত জিজ্ঞেস করেছিলো, আমি কৌশলে এড়িয়ে যাই। ভুলবুঝাবুঝি হতে পারে ভেবে এখনই তাকে জানাতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু সে এবার সরাসরি জিজ্ঞেস করে বসে- সুজানা কে হয়, তার সাথে তুমার কী সম্পর্ক?

নিজেকে সন্দেহমুক্ত রাখতে তখন সুজানার সাথে দেখা সাক্ষাত অনেকটা কমিয়ে দিয়েছিলাম।

কালো মেঘে কেটে কেটে দিনে দিনে রোদ্রজ্জ্বল যে আভা সুজানার মধ্যে বিকশিত হয়েছিল তা পূর্ণতায় যেতে না যেতে সহসা দেখতে পেলাম কোন অন্ধকার ছায়া আবারও মলিনতা নিয়ে এসেছে। হঠাৎ করে চাকুরি ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে আমাকে কিছুই জানায় নি। আমি যখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম হঠাৎ কী এমন হল? সে জানালো- এটা তার আকস্মিক কোন সিদ্ধান্ত ছিল না। ভিডিওটি এখন অফিসের প্রায় প্রত্যেকের হাতে হাতে এসে পৌঁছেছে। দেখে লালা ফেলছে। অনেকে সুযোগ নিতে চায়। সহ্যর সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বসও জানে। চাকুরিও টিকিয়ে রাখা অসম্ভব তাই বের করে দেয়ার আগে নিজেই কেটে পড়লাম।

কয়েকদিন অপেক্ষা করো কিছু একটা হয়ে যাবে। একটি প্রাইভেট হসপিটালে লোক নিবে সেখানে চেষ্টা করে দেখছি। আমি  তাকে অভয় দেই।

সুজানা দিনদিন আরও বিমর্ষ হয়ে যাচ্ছে।  অনেকদিন থেকে তার মামলারও কোন খোঁজ নিচ্ছে না। নিজ থেকে একদিন সুজানাকে বললাম কোর্টে চল, মামলার একটু খোঁজ নেই। সে তাতে কোন আগ্রহ দেখালো না।

মামলায় কি আমার অতীত ফিরে পাবো?

এভাবে কি হাল ছেড়ে দিবে, এটার উচিৎ শাস্তি হবে না?

আসামী দেশের বাইরে, ফিরবে কিনা কে জানে।

আমি দেখতাম সুজানা মাঝে মধ্যে আত্মমগ্নতায় ডুবে যায়।  হয়তো কিছুক্ষণের জন্য ফিরে যায় তার পেছনের দিনেও । একদিন অনেক সময় চুপচাপ পার করে  সে বলেছিলো তার বাচ্চাটির কথা। ওর কথা খুব মনে পড়ে,ওরে যে ভুলতে পারি না। আমি না ওকে…

আমি সেদিন ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়েছিলাম। তুই কি এসব ভুলতে পারিস না?

পারিপার্শিকতা আমাকে অনেক সময় শ্লথ করে দেয়। এটা সুজানার প্রতি আমার মোটেও অবহেলা ছিলো না। সুজানার আত্মবিশ্বাস ফিরাতে, তাকে আবার ঘুরে দাঁড় করাতে আমি জোর চেষ্টা চালাই। শুধুমাত্র একটি বিষয় ছাড়া তার জন্য আমি সব করতে পারি।

সুজানা আর আমার এই ছবি অর্পার কাছে কেমনে পৌঁছলো ভেবে কিনার করতে পারলাম না।   অর্পা আমার মোবাইলে  ছবি সেন্ড করে ব্যাখ্যা চাইলো। যদিও সুজানার সাথে আমার আজকাল খুব একটা যোগাযোগও হচ্ছে না। কানকথা আর ধারণা অর্পার ভেতরে হয়তো বিশ্বাস অবিশ্বাসের একটা দ্বন্ধ তৈরি হয়ে তাকে ভুলবুঝাবুঝির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এবার বুঝলাম ব্যাপারটা নিয়ে তার সাথে লুকুচুরি খেললে সমস্যা আরও প্রকট হতে পারে। তার কাছে পুরো বিষয়টি আরও আগেই আমার ক্লিয়ার করা দরকার ছিল। ধরতে পারলাম যে এটা আমার ভুল হয়েছে। ভাবলাম ট্রেনিংটা শেষ করে ঢাকা থেকে ফিরে গিয়ে সুজানার সাথে তাকে দেখা করিয়ে পরিচয় করিয়ে সব খোলাসা করবো।

ঢাকা থেকে ফিরে কয়েক দিন চলে গেলো অর্পার সাথে দেখা হলো না। জানতে পারলাম এবারও সুজানা চাকুরিটা ছেড়ে দিয়েছে।  আমাকে কিছুই জানায় নি। এই ভিডিও ক্লিপ কি শুধু একমাত্র তাকেই তাড়া করতে থাকবে, এটা কি তাকে নিস্তার দিবে না?

সুজানার নাম্বারে ফোন দিলে মোবাইল বন্ধ পেয়ে তার বাসার পথে চললাম দেখা করার জন্য। দরজায় টোকা দিলাম। ভেতর থেকে খোলা পেলাম। আমি গিয়ে তার পিছনে দাঁড়ালাম। সে তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনী টানছিলো। আয়নায় আমাকে দেখেও সে সাজগুজ নিয়ে ব্যস্ত থাকলো। কোন কথা বললো না। যেমন ফিরেও তাকালো না। তার লম্বা লিকলিকে দেহে খুব কায়দা করে শাড়ি জড়িয়ে পিঠের একপাশে আঁচল ছেড়ে দিয়েছে। ঠোঁটে কড়া লিপিস্টিক, মেচিং ব্লাউজ আর টানা টানা চোখ, ধনুক বাঁকা ভ্রু সব মিলিয়ে সহসা আমার মনে পড়লো আরব্য কবি ইমরুল কায়েসের কবিতার দুটি লাইন-

‘ অপরূপা সুন্দরী ঝিনুকের মোতি,

পূর্ণিমার চাঁদ সে তো সন্যাসীর জ্যোতি।’

এমন সাজগোজ! কোথাও যাবে নাকি?

সুজানা তার ঠোঁটে হাসির খানিকটা আভা তুলে একটি টিপ হাতে নিয়ে খুব সযত্নে তার কপালে বসিয়ে দেয়। কোন উত্তর দিলো না।

আমি বিছানায় বসতে বসতে দেখলাম তার খাটের পাশে দেয়ালে  পুত্র শিশুদের বেশ কয়েকটি টানানো ছবি।

বাচ্চাদের এতো ছবি কেন টানিয়ে রেখেছিস?

আমি পিঠে বালিশ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে বসেছিলাম। সুজানা ধীরে ধীরে এসে আমার পাশে বসলো। ছবির ওপর শান্ত দৃষ্টি রেখে বললো-আমার ছেলের ছবি!

দু চোখে বিস্ময় আর প্রশ্ন রেখে সুজানার চোখে তাকাই।

আমার ছেলেটা এখন এতো বড় হয়েছে। প্রায় আমার কাছে আসে। গত রাতেও এসেছিল। সে বলে তাকে কেন ঐ জায়গায় ফেলে দিয়েছিলাম?  সে খুব ভয় পাচ্ছে। একা থাকতে পারছে না। সে আমাকে আমাকে ডাকছে…! সুজানা একটু একটু কাঁপছে!

সুজানা তোর কী শরীর খারাপ, কী হয়েছে ক্লান্তি লাগছে?

সে একদৃষ্টিতে আমার বুকের দিকে তাকিয়ে রইলো। বললো- তুমার বুকে একটু মাথা রাখতে দিবে?

আমি হাত দুটি বাড়িয়ে তাকে আমার বুকে টেনে নিলাম। দীর্ঘপথ হাঁটার পর কোন ক্লান্ত পথিক গাছের ঠাণ্ডা ছায়ায় বিশ্রাম নিয়ে যেভাবে ক্লান্তি ঝাড়ার নিঃশ্বাস ফেলে, সুজানাও ঠিক সেভাবে নিঃশ্বাস ফেলছে। আমি তার মাথায় হাত বুলাই। সুজানা আমার হাতের আলতো পরশ পেতে পেতে  চোখ বুজে শুয়ে থাকলো।

তখন আমার ভাবালুতায় ছেদ পড়লো। মোবাইলের রিংটোন আবারও বাজছে। অর্পা ফোন দিয়েছে।

তুমি এখন কোথায়?

বাসায় আছি।

কার বাসায়?

কেন, আমার বাসায়।

মিথ্যা বলছো কেন, আমি তুমার দরজার সামনে দাড়িয়ে কথা বলছি!

অর্পা, আমরা আগামীকাল কোথাও দেখা করি। তুমার সাথে বিস্তারিত… অর্পা ফোন কেটে দেয়।

কতোক্ষণ পর আমি আমার বুকের দিকে তাকালাম। সুজানা ঘুমিয়ে আছে,নড়ছে না। তারপর আমি তাকাতে তাকাতে দেখলাম আমার বুকটাতো একটা কবর! আর সেই কবরে সুজানা শুয়ে আছে নিঝ্ঝুম নিরালায়!

ময়না তদন্তের রিপোর্ট এখনও আসে নি। আমাকে আবারও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে আনা হয়েছে। আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি- সুজানাকে আমি মারি নি। সুজানাকে অনেক আগেই মেরে ফেলা হয়েছিলো।  সেদিন সে আমার বুকে শুতে চেয়েছিল। আমারও মনে হচ্ছিল তার বিশ্রামের খুব প্রয়োজন। কিন্তু সে যে এক ঘুমে দুনিয়া পার করে দিবে তা কে জানতো?

[ বানানবিধি ও  ভাষার ব্যবহার লেখকের নিজস্ব]

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ