এলাকাটা এখনও তেমন জমে ওঠেনি। এদিকটায় সারি দিয়ে বেশ কিছু ফ্ল্যাট তৈরি হলেও সুমন্তবাবুদের পিছনের দিকটা এখনও বস্তি টাইপের রয়ে গেছে। অফিসের সুজয়বাবুর পরামর্শে বিশাল টাকা ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে মাত্র এক বছর আগে এই ফ্ল্যাটটা কিনেছেন নিঃসন্তান সুমন্ত ও রাধিকা। দুজনেই ভাল চাকরি করে, ফলে কোনও সমস্যাই নেই। সুজয়বাবু বলেছিলেন এলাকাটা এখনও গ্রাম্য গ্রাম্য আছে, টাটকা মাছ, সব্জি, কাজের লোক কিছুরই অভাব হবে না। এরপর একটু থেমে বলেছিলেন,আসলে এলাকার মানুষগুলো এখনও শহুরেদের মত সেয়ানা হয়ে যায় নি।
কথাগুলো সত্যিই মিলে গেছে। বাসন্তির মা সত্যিই খুব ভাল মানুষ। একটু দূরে ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা টালির বাড়িগুলোতে থাকে। স্বামী নেই, জামাই পরিত্যক্ত মেয়ে আর নাতি – নাতনিদের নিয়ে সংসার। লকডাউন ঘোষণা হতেই করোনা আতঙ্কে প্রথম প্রথম বাসন্তির মাকে ছুটি দিয়ে দিয়েছিল রাধিকা। বলেছিল করোনা মিটে গেলে এসো। পুরোটা নয়, কিছু টাকা পাবে। শুনে মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল তার। মেয়ে আর নাতি – নাতনিদের খাই খরচ চলবে কী করে তা নিয়েই চিন্তায় পড়েছিল সে। মেয়ে সিঁদুর কারখানায় প্যাকিংয়ের কাজ করে, করোনার জন্য তাও বন্ধ। তবে এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই সংসারের কাজকর্মের বিপুল অসুবিধের কথা ভেবে বাসন্তির মাকে ফের ডেকে পাঠিয়েছে সুমন্ত ও রাধিকা। বাজার-দোকান ওই এখন সব করে দেয়। করোনা আতঙ্কে এলাকায় সুমন্ত বা রাধিকা কেউই বেরোয় না। যা অবস্থা কিছু একটা হয়ে গেলে কে সামলাবে ? দুজনেরই অফিস থেকে বলে দিয়েছে বাড়িতে থাকুন, সেফ থাকুন। মাইনে ব্যাঙ্কে যেমন ঢোকে তেমনই ঠিক ঢুকে যাবে।
ফলে করোনার ছোবল এড়িয়ে বেঁচে থাকাটাই এখন প্রতিদিনের লড়াই। দোকান বাজার করে আনার পর বাসন্তির মা যখন ফেরে তখন রাধিকার মনে হয় গোটা এলাকার করোনা ভাইরাস নিয়ে সে ফিরেছে। ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকেই একগুচ্ছ নির্দেশ দেয় রাধিকা। নির্দেশ মেনে প্রথমে রাস্তার কলে সাবান দিয়ে হাত-পা ধুয়ে নিতে হয়। তারপর হাত স্যানিটাইজ করতে হয় বাসন্তীর মাকে। তারপর আনাজগুলোকে সাবানজলে ভাল করে ধুতে হয়। এরপর ফ্ল্যাটের নিরাপত্তাকর্মীদের জন্য নির্দিষ্ট বাথরুমে জামাকাপড় কেচে অন্য শাড়ি পরে তবেই বাসন্তির মাকে ঘরে ঢোকার অনুমতি দেয় রাধিকা। বাবুবাড়ির জন্য লাইন দিয়ে দোকান বাজার, বাড়ির কাজ করতে সারাদিনের প্রায় সব সময়টাই বেরিয়ে যায়। তবে তার কাজটা যায়নি। লকডাউনের বাজারে পুরো মাইনেটাই পায় বাসন্তীর মা – মাসে হাজার টাকা।
প্রায় প্রতিদিনই আসছে ত্রানের গাড়ি। এক একটা ক্লাব পালা করে নিয়েছে। কাল সত্যবালা স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন থেকে এসেছিল। একটা ব্যাগে চাল,ডাল,আলু আর ১০টা করে ডিম বাড়ি বাড়ি দিচ্ছিল। আজ এসেছে নবজীবন সংঘ থেকে। ওরা এনেছে মুড়ি,চানাচুড়,বিস্কুট,পাউরুটি,কেকের প্যাকেট। সুব্রতবাবু দোতলা থেকে নেমে চুপিচুপি একটা প্যাকেট নিয়ে নিলেন। গত চারদিন ধরে এভাবেই বিনে পয়সায় বেশ কটা প্যাকেট কব্জা করে ফেলেছেন তিনি। তার মুখে বেশ তৃপ্তির হাসি।
ব্যাপারটা দেখে খুব অবাক হল বটা। লকডাউনে রিকশা চালানো বন্ধ। কিভাবে দিন চলবে সেই ভেবে চুল ছেঁড়ার জোগার। গাড়িটাকে সাইডে তালা মেরে প্রতিদিন সকালে এই মোড়ের মাথায় বসে থাকে। কদিন ধরেই বটাদের মত মানুষদের কথা ভেবে বিভিন্ন ক্লাব থেকে প্যাকেটে করে জিনিষ দিয়ে যাচ্ছে। দুপুরে-রাত্রে স্টেশনের ধারে লঙ্গরখানাও খুলেছে পার্টি থেকে। কিন্তু তা বলে এই লোকটাও প্যাকেট নেবে? ভাল চাকরি করে মাইরি। মাঝে মাঝেই বটার রিকশা চড়ে ষ্টেশন যায়। স্টেশন বাজারে বিউটি পার্লারে গেলে ওর বউ-মেয়ের বটার রিকশা বাঁধা।
ব্যাপারটা দেখে বটার খুব রাগ হল। পকেট থাকা বিড়ির প্যাকেট থেকে একটা বিড়ি ধরাল। তারপর কী মনে হল ফিক করে হেসে ফেলল। ভাবল ব্যাপারটা বউকে গিয়ে বলতে হবে।
Tags: গল্প, বাসন্তীর মা ও অন্য গল্প, সমীর ঘোষ
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।