|| ১ ||
কদিন ধরেই বড় বিরক্ত হয়ে উঠেছে অর্ক । একে তো পাঁচ মাস হয়ে গেল, ঘরবন্দি । কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না কবে সবকিছু আগের মতো হবে? স্কুল, মাঠ, বন্ধুবান্ধব সব যেন কেউ এক তুড়িতে হাজার মাইল দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিল । প্রথম প্রথম খুব মজা পেয়েছিল সে, সাতদিন স্কুল বন্ধ ; কিন্তু কে জানতো এই মজা টা ‘সাজা’য় পরিণত হতে চলেছে?
দুপুরবেলা ঘুম আসে না অর্কর । ঠাকুমার ঘরে জানালার ধারে চুপ করে বসে মানুষের আনাগোনা দেখতে থাকে ।কিন্তু কদিন ধরে অর্ক লক্ষ্য করছে রাস্তার ধারের বটগাছটার নিচে কোত্থেকে একটা পাগল এসে জুটেছে । কখনো মরার মতো পরে থাকে, কখনো আবার অতি উল্লাসে গান গেয়ে ওঠে । পৃথিবী জুড়ে ঘটে চলা মৃত্যুমিছিলের আওয়াজ কি তার কান অবধি পৌঁছচ্ছে না? ছোটবেলার অভ্যাসবশত আর পাঁচটা ছোটোখাটো জিজ্ঞাসার মতোই অর্ক ঠাকুমাকে প্রশ্ন করে ওঠে এই কথা । উত্তরে ঠাকুমা বললেন – “পাগলে কি আর এসব মহামারী বোঝে?”
|| ২ ||
তখন এপ্রিল মাস হবে । অর্কর জীবনে শুরু হল এক নতুন অত্যাচার । অনলাইন ক্লাস । এখন আর দুপুরগুলো ঠাকুমার ঘরে নয়, নিজের পড়ার ঘরের কানে হেডফোন গুঁজে কাটছে । আর সেই ক্লাসের অর্ধেক সময় তো – “স্যার শুনতে পাচ্ছি না !”, “স্যার নেটওয়ার্ক নেই, আরেকবার বলুন ।”, “স্যার অমুকে জয়েন করতে পারছে না ” – শুনতে শুনতে কেটে যেত অর্কর । প্রযুক্তি দূরের মানুষকে কাছে তো এনে দিতে পারে কিন্তু কাছের মানুষকে দূরে করে দিতেও এর জুড়ি মেলা ভার । ক্লাসের শেষে ঠাকুমাকে এসে অর্ক অভিযোগ করতো – “কোথায় বন্ধুদের সঙ্গে এক বেঞ্চে পাশাপাশি বসে ক্লাসের মাঝে হ্যান্ড ক্রিকেট খেলতে গিয়ে ধরা পরে স্যারের বকা খাওয়ার মজা, আর কোথায় এই মাথামুণ্ডুর অনলাইন ক্লাস? ”
|| ৩ ||
বড় রাস্তার ধার ঘেঁষে বাজার বসতো । এখন বাজার আসে বাড়ি অবধি । এমনই কোনো এক মে মাসের সকালবেলা প্রবল বাকবিতন্ডা শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে অর্ক দেখে মাছওয়ালার সঙ্গে সপ্তম সুরে কথোপকথন চলছে বাবার ।
– আরে ভাই, বিপদটা তোমার আমার একার না, সবার । মাস্ক না কানে ঝুলিয়ে রেখে নাকে লাগাও ।
– কি হবে ওসব করে দাদা? পেটের দায় বড় দায় ! আপনি বলুন কোনটা ওজন করবো?
– আগে মাস্ক লাগাও !
অগত্যা নাছোড়বান্দা বাবার কথা মাছওয়ালাকে শুনতেই হল । পাশের বাড়ির ভবানী মুখুজ্যে এলাকার নামকরা ডাকাবুকো লোক। অর্কর বাবার ছেলেবেলার বন্ধু। এত কোলাহল শুনে বাড়ির দোরগোড়ায় এসে উপস্থিত হলেন ।মাঝে মাঝেই ক্ষণিক গল্প করতে আসেন।
– কি সনাতন? এত চেঁচাচ্ছ কেন?
– চেঁচাচ্ছি কি আর সাধে ভবানীদা? – মাছওয়ালাকে পয়সা মিটিয়ে দিয়ে বললো অর্কর বাবা ।
– আর কি বলি ভাই সনাতন, কদিন ধরে মা আবার অসুস্থ । জ্বরে পড়েছে । ভয়ে আমার হাত-পা শুকিয়ে আসছে । কি দুর্যোগ এলো ভাই বল !
– তো আপনিই বলুন । এর মধ্যে কেউ কথা না শুনলে তাদের বোঝাতে হবে না বলুন? কেউ বলুক না বলুক আমি বলতে ছাড়ি না দাদা !
– ঠিকই তো ।
– ভবানী দা, আজ পেপারওয়ালা এসেছিলো? আপনাদের কাগজ দিয়ে গেছে? আমাদের দেয় নি ।
– না রে ভাই । আর দেবে কেমন করে? কাগজ নেওয়া, খবর দেখা বন্ধ করে দিয়েছি । ভালো লাগে না আর । রোজ রোজ এক খবর । তোতাপাখির মতো আওড়ে যাচ্ছে – আজ সংক্রমণের রেকর্ড ছাড়ালো,আজ মৃত্যু বাড়ল! উফ !
অর্কর মনে হল একজন ডাকাবুকো সাহসী মানুষও কিভাবে একটা অদৃশ্য শত্রুর হুঙ্কারে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দিন কাটাতে পারে। ঠাকুমা মাঝে মাঝে বলেন – “প্রাণের ভয় বড় ভয় !”
|| ৪ ||
জুন – জুলাই মাস নাগাদ সমাজের ছবিটা অদ্ভুতরকম ভাবে বদলে যেতে লাগল অর্কর কাছে । ভবানী মুখুজ্যের মা আজ আর নেই । পৌরসভা থেকে লোক এসে বাড়ি ঘিরে দিয়ে গিয়েছে তার । চৌদ্দদিন বাইরে বেরোনো মানা । অথচ, জানালা দিয়ে অর্ক দেখতো আর ভাবতো – ইদানিং যেন মানুষ এই অদৃশ্য শত্রুকেও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জীব হওয়ার অহংকারে উপহাস করা শুরু করেছে ! কারো মাস্ক কানে ঝুলছে, কারো থুতনিতে, কারো আবার মাস্ক বেপাত্তা ! অর্কর মনে যখন হাজারটা প্রশ্ন ভীড় করে আসে, কথা বন্ধ হয়ে যায়, কেমন করে যেন ঠাকুমা মনের ভাবটা ঠিক ধরে ফেলেন ।
– কি ভাবছো দাদুভাই?
– কিছু না ।
– আচ্ছা ওই পাগলটা আছে দেখ তো?
অর্ক তাকালো বটগাছটার দিকে । হ্যা আছে । মরার মতো পরে আছে । ঠাকুমা বললেন – বাবু যা তো, এই খাবারটা ওকে একটু দিয়ে আয় তো, আজ মিনতি কাজে আসে নি, নইলে ওর ফেরার সময় ওকেই বলে দিতাম ।
অর্কর বুঝতে দেরি হল না মাঝে মাঝে একটা থার্মোকলের বাটি করে যে খাবারটা পাগলটা খেত, সেটা তার বাড়ি থেকেই ঠাকুমা পাঠাতেন । ঠাকুমা বরাবরই এরকম ভালো মানুষ ! পাগলটার প্রায় অচৈতন্য দশা দেখে অর্করও মায়া লাগল । বললো – দাও আমি দিয়ে আসি ।
জলদি বেরোবার চক্করে মাস্ক পরতে ভুলে গেছে খেয়াল হয়নি অর্কর । পাগলটার কাছে গিয়ে অর্ক দেখে কেমন যেন ভয়ে কুঁকড়ে পরে আছে সে । কোথা থেকে এনে নাকে একটা কাপড়ও পেঁচিয়ে রেখেছে । অথচ আর পাঁচটা সুস্থ লোকের সে হুঁশ নেই। ভাবতে ভাবতে হাত চারেক দূরে খাবারের বাটি টা রেখে দিয়ে ডাক পারল অর্ক –
মানুষের গলা পেয়ে চমকে উঠে বসলো পাগলটা । খানিকক্ষণ ভয়ার্ত চোখে অর্কর দিকে তাকিয়ে থাকলো, তারপর বিড়বিড় করে ভয়ে ভয়ে বললো – ও কি হ্যা? একটা কাপড় – চোপড় কিছু নাকে দাও। তারপর ঝপ করে খাবারটা নিয়ে খেতে শুরু করল ।
অর্কর খেয়াল পড়তেই দৌড় লাগলো বাড়ির দিকে । মা দেখতে পেলে আর রক্ষা নেই । তাড়াতাড়ি হাত-পা-মুখ ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ে ঠাকুমার ঘরে এসে অর্ক জানালো সবটা । শুনে ঠাকুমা বললেন – “বুঝলে দাদুভাই, পাগলেও নিজের বুঝ বোঝে !”
ঠাকুমার উত্তরটা অর্কর মনে জমে ওঠা বিরক্তিপূর্ণ প্রশ্নগুলোর মধ্যে অন্তত একটার উত্তর হয়ে দেখা দিল ।
Tags: উত্তর, গল্প, দেবাশিস সাহা
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।