‘ মধু, এতো তাড়া করছো কেন, বোসো ? আজ রবিবার, এই তো এলে ! এসো, একত্রে চা পান করতে করতে প্যারাডাইজ লস্ট পড়া যাক !’
গৌরদাস আলমারী হইতে একটি চামড়ার বাঁধাই ক্ষুদ্র বহি বাহির করিতে করিতে কহিলেন !
যাহাকে বলা হইলো, তিনি শ্যামবর্ণ, অতি উজ্জ্বল চক্ষুবিশিষ্ট, ইউরোপিয়ান পোশাকে সুসজ্জিত এক বয়োত্তীর্ণ কিশোর, গুচ্ছ গুচ্ছ ঘনকেশ তাহার মস্তকের উপর হইতে স্কন্ধদেশ পর্যন্ত নামিয়া আসিয়াছে !
খিদিরপুর নিবাসী কলিকাতা হাইকোর্টের ব্যারিস্টার রাজনারায়ণ দত্তের এই অতি মেধাবী পুত্র মধুসূদন এই মুহূর্তে প্রিয় বন্ধু গৌরদাস বসাকের বৈঠকখানা কক্ষে অস্থির ভাবে পায়চারী করিতেছেন !
মধু কোটের ঘড়ি-পকেট হইতে সুদৃশ্য সোনার ঘড়ি বাহির করিয়া সময় দেখিলেন, তারপর বলিলেন,
-‘গৌর, তুমি বুঝছো না ! রবিবারের ‘মাস’ শেষ হবে বেলা এগারোটায় ! এখন বেরিয়ে পড়তে না পারলে এগারোটার আগে সার্কুলার রোডের জোড়া গির্জার সামনে পৌঁছতে পারবো না ! তুমি তো জানো, সপ্তাহে একবার অন্তত কমলমণি-র দর্শন না পেলে আমার চিত্ত শান্ত থাকে না ! আমি পুরো সপ্তাহে এক ছত্রও লিখতে পারি না !’
-‘মধু, তুমি যা ভেবে রেখেছো তা হবার নয় ! এই বিধর্মের বিবাহ হিন্দু সমাজ মানবে না কিছুতেই ! তোমার বাবা, মা জাহ্নবী দেবী মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়বেন !’
-‘ গৌর, তোমাকে এখন পুরোটা জানানোর সময় এসেছে ! কারণ তুমিই আমার বিবাহপ্রস্তাব নিয়ে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহনবাবুর গৃহে যাবে ! আমি বিবাহব্যবস্থার সমস্ত রীতি ভাঙতে চাই ! আর ভালো করে শোনো, কমলমণিকে বিবাহের উদ্দেশ্যে আমি ক্রীশ্চান হবো স্থির করেছি ! কৃষ্ণমোহনবাবু সম্মত আছেন, ধর্মান্তরিত হলেই বিবাহ হবে !’ মধু ঘরের বাহিরে যাইতে উদ্যত হইলেন !
গৌরদাস প্রিয়বন্ধুর মানসিক দৃঢ়তা সম্পর্কে সম্যক অবহিত, তাই তিনি স্তব্ধ হইয়া বসিয়া থাকিলেন !
রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহনের বৈঠকখানা কক্ষ !
গুরুতর আলোচনা চলিবার হেতু রেভারেন্ড-পত্নী বিন্ধ্যবাসিনী দেবী-ও কক্ষে উপস্থিত !
গত পরশ্ব কৃষ্ণমোহনের ব্যবস্থাপনায় মধুসূদন খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হইয়াছেন !
এখন কলিকাতার বিশিষ্ট হিন্দুসমাজ যৎপরোনাস্তি বিচলিত হইয়া এই দুর্ঘটনার অন্তর্নিহিত গূঢ় কারণ খুঁজিয়া বাহির করিবার চেষ্টা করিতেছেন !
এই মুহূর্তে গৌরদাস প্রায় নতমস্তকে বন্দ্যোপাধ্যায় দম্পতির সামনে দন্ডায়মান !
ক্ষণকাল পূর্বে তিনি প্রিয় বন্ধু মধুসূদনের সঙ্গে কৃষ্ণমোহন-তনয়া কমলমণির বিবাহপ্রস্তাব উভয়ের সামনে রাখিয়াছেন !
কৃষ্ণমোহন এবিষয়ে প্রথমেই পত্নীর মতামত জানিতে চাহিলেন !
কক্ষে ক্ষণকালের জন্য সম্পূর্ণ নীরবতা !
নীরবতা ভাঙিয়া বিন্ধ্যবাসিনী কহিলেন, ‘মধু খুব ভালো ছেলে, আমি তাকে পছন্দ করি, তোমার কাছে শুনেছি সে অত্যন্ত মেধাবীও বটে ! ধর্মের বাধা-ও এখন আর নেই ! কিন্তু..’ বিন্ধ্যবাসিনী থামিয়া গেলেন !
গৌরদাস মাথা তুলিয়া রেভারেন্ড-পত্নীর দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিলেন, সে দৃষ্টি অতীব উদগ্রীব !
কৃষ্ণমোহন কহিলেন, ‘ কিন্তু…?’
বিন্ধ্যবাসিনী থামিয়া থামিয়া কহিলেন, ‘ কিন্তু, হাজার হোক, মধু তো কায়েতের ব্যাটা, তাই….তাই এ বিয়েতে আমার মত নেই ! তুমি বাছা একথাটা তাকে জানিয়ে দিও !’
এই অভাবিত যুক্তিতে সম্পূর্ণ বিমূঢ় হইয়া গৌরদাস কৃষ্ণমোহনের প্রতি আকুলনয়নে চাহিলেন !
জবাবে কৃষ্ণমোহন মস্তক সঞ্চালন ও দৃষ্টি দ্বারা যে শতাব্দীপ্রাচীন ইঙ্গিত করিলেন, তাহার মর্ম হইতেছে পত্নীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাইবার কোনো অভিপ্রায় বা ক্ষমতা তাঁহার নাই !
গৌরদাসের বৈঠকখানা কক্ষে মধুসূদন অধীরভাবে প্রতীক্ষা করিতেছেন, সুসংবাদ লইয়া যে কোনো মুহূর্তে গৌর আসিয়া পড়িতে পারে !
এমনসময় বিষাদাচ্ছন্ন মুখ লইয়া গৌরদাস প্রবেশ করিলেন !
মধুসূদন অত্যন্ত উদগ্রীবভাবে প্রশ্ন করিতে গিয়া বন্ধুর ভাবগতিক দেখিয়া থামিয়া গেলেন !
ক্ষণপরে গৌর ক্লীষ্টস্বরে কহিলেন, ‘এ বিবাহে কৃষ্ণমোহন-জায়ার সম্মতি নেই !’
মধুসূদন শুনিয়া চেয়ারে বসিয়া পড়িয়া মৌন রহিলেন, তাঁহার ললাটে ঘর্ম দেখা দিলো !
গৌর আবার বলিতে গেলেন , ‘অমতের কারণ হিসাবে তিনি….’ মধুসূদন হাত তুলিয়া তাঁহাকে থামিতে বললেন !
বিশাল গ্রান্ডফাদার ঘড়ির টিকটিক শব্দ ভিন্ন কক্ষে অস্বস্তিকর নীরবতা বিরাজ করিতেছে !
গৌর বলিল, ‘ মধু, আমি কি ঈশ্বরচন্দ্র মশায়ের সঙ্গে বিধান নিয়ে কথা বলবো, তোমার পুনর্ধর্মান্তরের ব্যাপারে…’
গৌরদাসের কথা শেষ হইলো না, মধুসূদন উঠিয়া দাঁড়াইলেন,
-‘না গৌর ! অনেক হয়েছে ! এই মুহূর্তে প্রতিজ্ঞা করলাম ভবিষ্যতে যদি কখনও বিবাহ করি, বাঙালী তথা ভারতীয় রমণীকে বিবাহ করব না !
মধুসূদন দ্রুতপদে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেলেন !
ঘোড়ার গাড়ীর শব্দ ধীরে ধীরে দূরে মিলাইয়া গেলো !
Tags: গল্প, নিছক গল্পকথা, সিদ্ধার্থ সান্যাল
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।