ফোনটা আসতই এক দিন।এক দিন না একদিন আসতই ফোনটা।নিশ্চিত জানত ঋভু।আঠাশ বছর ধরে।
আমি সুমনা – চিনবে না হয়তো।আমি…
বুঝতে পেরেছি।যদিও বুঝতে পারাটা অদ্ভুত।কিম্বা হয়তো খুব স্বাভাবিক।
নতুবা ঋভুর এই নিশ্চিত অপেক্ষা কার্যকারণহীন সাট্টার নম্বর ধরার মতো খেলো হয়ে যেত। সম্পর্ক আছে কিছু ? থাকলেও অত্যন্ত জটিল।কিম্বা হয়তো একদম সোজা সরল।মণিকা স্বামী, ছেলেকে ছেড়ে পালিয়েছিল পার্থজিতের সঙ্গে।কিম্বা পার্থজিত মেয়ে আর বউকে ছেড়ে পালিয়েছিল মণিকার সঙ্গে।পুরোন ঘটনা।বহু যোগ বিয়োগ, ভুল উত্তর , না মেলা ভাগশেষ…. সুমনার এই ফোনটাও উত্তরমালায় ছিলনা।তথাপি সুমনা ফোন করেছিল। যখন আঠাশ বছর পার।আঠাশ বছর পার তবু ঋভু জানতো এই অনিবার্য ফোনের কথা। কোন প্রস্তুতি নেয়নি যদিও।উত্তর প্রতি -উত্তরের কোন ক্রম তৈরি করেনি সে মনে মনে কদাপি। কিছু ঘটনা, কোন স্মৃতি, কোন অপেক্ষা সতত সজীব থেকে যায়। আজীবন। আর এখন তো মাত্রই আঠাশ বছর।
– আঠাশ বছর আগে তোমার বয়স কত ছিল? সুমনার প্রশ্ন কি প্রস্তুতিবিহীন? জানেনা ঋভু।এই প্রথম আটকে রাখা স্রোতমুখ খুলে যায়। এতটুকু সতর্ক হবার সময় পায়না
– শনিবার ছিল ছ’ বছরের জন্মদিন। স্কুলের বন্ধুরা এসেছিল। ওদের মা বাবা,পাড়ার বন্ধু, পিসিমণি, জেঠুমণিরা… ।সোমবার সকালে চলে গিয়েছিল।অফিস ট্যুর বলে বেরিয়ে গিয়েছিল। আমাকে আর বাবাকে। ফেরেনি আর। কোথায় গিয়েছিল তুমি জান।
– তোমার ক্ষেত্রে সাডন শক ছিল।আমরা জানতাম।আমি আর মা।জানতাম বাবা থাকবেনা আর আমাদের সঙ্গে। কলকাতা যেত।ঠাম্মির বাড়ি যাবার কথা বলে।অথচ ঠাম্মি ফোন করে বাবাকে চাইত।আমি মাকে বলতে পারতাম না সেকথা।মা’ও হয়তো অনেক কিছু লুকিয়ে রাখতে চাইত আমার থেকে।মণিকা নামটা হাওয়ায় ভাসত। চলতে ফিরতে ধাক্কা খেতাম আমরা। আমি আর মা। ছোট্ট ওয়ান রুম ফ্ল্যাট।পার্টিশন করে কোনক্রমে দুটো খুপরি। কিছু আড়াল করার উপায় ছিল না। মণিকা, মণিকা , মণিকা – একটা বেলুনের মতো ফুলে উঠছিল ক্রমশ।ঘরের মাঝখানটা জুড়ে ফুলে উঠছিল।আমাদের- আমাকে আর মা’কে ঠেলে দিচ্ছিল।দেওয়ালের সঙ্গে পিষে চেপ্টে দিচ্ছিল।বাবা ঢুকে পড়েছিল বেলুনটার ভেতর। পুরোটা ঢুকতেই ফেটে গেল। বম্ব ব্লাস্ট। আমাদের নাকে মুখে বিষাক্ত গ্যাস ।দম আটকে মরে গিয়েছিলাম যেন।স্প্লিন্টারে ছিন্নভিন্ন হয়ে ছিটকে পড়েছিলাম।অথচ এরকম , ঠিক এরকমই ঘটবে আমি জানতাম ।ভোরে কতবার দেখেছি এই স্বপ্নটা। ঘুম ভেঙে ভেবেছি আজই হয়তো। স্কুল থেকে ফিরে ভাবতাম আজই হয়তো।টেনশনে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম আমরা । মা আর আমি। পার্থজিত মিত্র’র স্ত্রী আর মেয়ে।
– বাবাকে ঢিল মারতো পাড়ার ছেলেরা। অফিস যাবার পথে।ফেরার পথে গলির মোড়ের জটলা থেকে বেড়ালের ডাক, গাধার ডাক। সব চুল উঠে গেল বাবার, জানো? দু তিন মাসের মধ্যে পুরো টাক ।টাকলু বাবু টাকলু বাবু করতো।ছড়া কাটতো… টাকলু গেল মাছ ধরতে কোন সে নদীর কূলে, চুল নিয়ে গেল কোলাব্যাং আর বউ নিয়ে গেল কে রে? স্কুলের বন্ধুর মা’রা আমার জন্যে আলাদা করে টিফিন পাঠাতো। সেই সঙ্গে আবার সাবধানও করে দিত – ঋভুর সঙ্গে বেশি কথা বলার দরকার নেই। কোন ম্যাম আমাকে বকতোনা।অন্য ছেলেদের শাস্তি দিত । আমাকে বলতো – ঋভু তুমি পরের দিন হোম – ওয়ার্কটা সাবমিট করে দিও।সেশনের মাঝপথেই স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম। পরের বছর নতুন স্কুল।বাংলা মিডিয়াম।হস্টেল।স্কুলের পর কলেজ।হস্টেল। মা মরা ছেলে। সকলকে বলতে বলতে – সেই ছ বছর থেকে সমানে বলতে বলতে… বাবা অফিস থেকে সাইটে ট্রান্সফার নিয়ে নিল। এই সাইট, ঐ সাইট… দেড় বছর, কোথাও দু বছর।
– দেখা হয়নি আর কখনও?
– ডিভোর্সের কেস চলছিল যখন, আমাকে যেতে হয়েছিল একবার বাবার সঙ্গে।লাথি দেখিয়েছিলাম কোর্টরুমেই।
– মা তোমার কথা বলতো।মানে মণিকার ছেলের কথা। বলতো বাচ্চাটা একা বড় হবে। মা তোমার কথা বললে আমি রেগে উঠতাম। অথচ পরে আমিও ভাবতাম। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে বাচ্চা ছেলে একটা। অন্ধকার অন্ধকার বাড়ি। অপছন্দের খাবার ।
– বাবা দারুণ রান্না করে। আমিও। হস্টেলের ছুটিতে বাবার সাইটে চলে যেতাম।ঐ কদিন কিচেনে বাবা কাউকে ঢুকতেই দিত না।
– মিস করনি কখনও?
– লালু বলে একটা মেয়ে কুকুর ছিল।রাস্তার। সকালে দু চারটে বিস্কুট, রাতে রুটি। মাংস হলে হাড় গোড়। ছিল তিন চার বছর। একবার ভাদ্র মাসে মেটিং এর সময়ে কোথায় চলে গেল। আর আসেনি। ফাঁকা লেগেছিল কয়েকটা দিন। সকালে ঘুম থেকে উঠে, যেদিন মাংস হত…. । বাবা বলতো কখনও রাস্তায় দেখলে চিনতেই পারবোনা দেখবি। রোগা হয়েছে হয়তো … কি মরেই গেছে না খেতে পেয়ে, রোগে কি গাড়ি চাপায়। মানে লালু কুকুরটা। আমরা – বাবা, আমি ঝামেলা মিটিয়ে দিয়েছিলাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। উড়ো কথা এসেছিল কানে পার্থজিতের বউ ডিভোর্স দেয়নি।
– মণিকা আমাদের কাছে গিয়েছিল।বোম্বে।মা’র পা ধরেছিল। লাথি মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম আমরা। – কি আটকাচ্ছে তোমাদের? বর বউ এর মতই তো… ঋভু, সত্যি বলতে, আসলে আমরা, আমি আর মা ভয় পেয়েছিলাম। কি ভয় তখন স্পষ্ট বুঝিনি।মনের এত গভীরে ছিল যে ভয়ের চেহারাটার সঠিক আন্দাজ পাই নি।
– সিডনি না নিউজিল্যাণ্ড কোথায় যেন। মণিকা আর পার্থজিত। শুধু একটা নারী পুরুষের পেয়ার। মণিকা কারও মা নয়। পার্থজিত … আই কান্ট সে। তুমি বলতে পারো সুমনা, সে তোমার বাবার জায়গায় ছিল কিনা।
– বর বউ এর মতো হয়েই কাটিয়েছে।আইনতঃ মা বরাবর পার্থজিতের স্ত্রী। বাড়ি টাড়ি … যদিও ইউজলেস এই সবই। যাক গে – বাবা ফিরেছে ।
– জানি আমরা।পার্থজিত ফের তার পুরোন সংসারে।বাবা বলছিল…. বাদ দাও।
– একটা খবর দেবার ছিল…. গত মাসের চব্বিশে…। বাবা ফোনেই জানিয়ে দিতে বলেছিল।মা বলেছিল আসবেনা তুমি । আমার সঙ্গে দেখা করবেনা।কিন্তু আমি চেয়েছিলাম ।ভীষণ চেয়েছিলাম।
কি ? কি চেয়েছিলে ? পার্থজিত ফিরে আসুক ? ফিরে পেয়েছ তো।
– তোমাকে দেখতে চেয়েছিলাম একবার ।একবার দেখতে চেয়েছিলাম তোমাকে। কেন জানিনা। সম্পর্কে তুমি আমার …..
– চুপ।একদম চুপ।পার্থজিতের মেয়ের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই আমার। আমাদের। থাকা সম্ভব নয়। – দু হাতে মাথাটা চেপে বসে থাকে কিছুক্ষণ ঋভু।মুখ তুলে বলে ওকে প্লীজ কন্টিনিউ…
– না কিছুনা ঋভু।জাস্ট একটা খবর দেবার ছিল মণিকা আর নেই। তোমার জন্মদাত্রী…
-দেখা করতে বললে কেন? আমার রিঅ্যাকশন দেখতে চেয়েছিলে? কি ভেবেছিলে? কান্নাকাটি করবো? দিদি বলে তোমাকে ….? যার থেকে আঠাশ বছর আগের ঘটনাটার আন্দাজ তাইতো? লিসন সুমনা ,একটা মানুষ একবারই মরে ।একবার মরে গেলে আর মরেনা।ঋভুর মা মরে গেছে আঠাশ বছর আগে। যে বেঁচেছিল তাকে আমি কি মনে করতাম সেটা বলছিনা – মাইট বী টূ হার্শ ফর আ সফ্ট লেডী লাইক ইউ। সেই আঠাশ বছরের পুরোন মৃত্যু সংবাদ দিতে এলে তুমি আজ। হাঃ। একটা প্রশ্ন আমারও ছিল…. বাট লীভ ইট।
সুমনা জানে প্রশ্নটা।শুধু প্রশ্নটাই। উত্তরটা জানেনা ।
কফি শপের বাইরে বৃষ্টি।তুমুল বৃষ্টিতেই বেরিয়ে পড়ছে ও।ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
Tags: অনিকেত, গল্প, শ্রেয়া ঘোষ
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।