ধিনিকিস্টকে পাড়ার সবাই খুব সমীহ করে চলে । সমীহ মানে ভয়মিশ্রিত সমীহ বললেই বোধহয় ঠিকঠাক হয় । তার অনেক কারণও আছে । একটা টাইট গেঞ্জি আর বারমুডা পরা লোকটা যখন পাড়ার মধ্য দিয়ে দুলকি চালে ডিগডিক আওয়াজ তুলে বুলেট চালিয়ে যায় তখন পাঁচটা লোক দূর থেকে হাঁ করে দেখে । হ্যাঁ , দেখার মতোই বটে চেহারাখানা । বাইসেপ আঠারো , কাফ কুড়ি , ছাতি ছাপান্ন হয়তো নয় , তবে ওই কাছাকাছি কিছু একটা হবে । বাদবাকি সব প্রমাণ সাইজের । ঘাড়ে গর্দানে মাঝারি সাইজের একখানা গণ্ডার বললে অত্যুক্তি হয় না বোধহয় । শুধু বাইসেপে তো আর কাজ হয় না । তাহলে মাকালতলার হারু পালোয়ানেরও হত । অতবড়ো পহেনবান । গোটা রাজ্য জয় করে এসেছে । হলে হবে কী ! সবসময় মাথা নীচু করেই আছে । যেন চেহারা বানিয়ে কতবড়ো অপরাধ করে ফেলেছে । আর বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলোর কাছে যাকে বলে বিকশিত দন্ত কৌমুদি । আসলে ক্যালি থাকা চায় । ধিনিকিস্টর তা যথেষ্টই আছে । হয়তো একটু বেশি বেশিই । টুকটাক এটাসেটা দিয়ে পাড়ার বেশ কিছু উঠতি ছোকরাকে হাত করে রেখেছে । বেকার ছেলে – না যজ্ঞে না সেলাই-এ । অগত্যা ধিনিকিস্টং শরণং । যা দু-চার পয়সা আসে । তাদের কাজই হচ্ছে গুরুর হয়ে টাকা তোলা । – এই যে মেছোমোছাই , তিনমাছ ধরে পাওনা বাকি রেকেচেন । এরপর উল্টোপাল্টা কিচু হয়ে গেলে দোছ দিতে পারবেন না কিন্তু ।-হ্যাঁ হ্যাঁ বাবারা – একটু চাপে আছি তো তাই আর কী । ধিনিকে একটু বুঝিয়ে বোলো বাবারা । – বোজানোর কিচু নেই মেছোমোছাই । গুনে গুনে সাতদিন সময় দিচ্ছি । এর মধ্যেই যা করার করে ফেলুন । না হলে কিন্তুক ক্যাচাল হয়ে যাবে ।
ধিনিকিস্টর নিজস্ব ট্যাক্স কালেকশন ম্যানেজমেন্ট খুব এফেকটিভ । বাড়ি বা জমিজায়গা বিক্রি করলে ক্যাপিটাল গেন বাবদ বারো পারসেন্ট । কিনলে ওয়েল্থ ট্যাক্স দশ । তারসঙ্গে দরিদ্র নারায়ণ সেবা বাবদ সারচার্জ তিন পারসেন্ট । তাছাড়া দোকান বা গুমটির আকার আয়তন ও পজিশন অনুযায়ী সিকিউরিটি চার্জের প্রভিশন তো আছেই । আর হাতের পাঁচ ইট বালি সিমেন্ট পাথর সাপ্লাই-এর কারবার । আরো নানান হ্যানা ত্যানা – সেসব বিস্তারিত বলার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না । এই যৎসামান্য পরিচয়েই আশা করা যায় পাঠকগণ ধিনিকিস্টর এলেমদারির সম্যক পরিচয় পেয়ে গেছেন । মোটের উপর ধিনিকিস্ট ভালোই আছে , তার দলের ছেলে ছোকরারাও মন্দ নেই আর পাড়ার লোকজন অগত্যা যাকে বলে মোটামুটি থাকা তাই আছে ।
সবাই জানে বেকায়দায় ঠাপ আছে আর বাপেরও বাপ আছে । ধিনিকিস্টও জানে না এমন নয় । কিন্তু সে বাপ যে এমন খ্যাঁচাকলের হবে কল্পনাতেও আসেনি । আসার কথাও নয় । সুমন চাটুজ্যের সেই একমুখ দাড়িগোঁফ অনেককালের কালো ছোপ ছোপ- বুকের হাড় কখানা আঙুল দিয়ে এক দুই তিন চার করে গোনা যায় এমনই সেই বাপ । তিনরাস্তার মোড়ে একটা শিরিষগাছের তলায় সারাদিন বিধাতার সাথে সাপলুডো খেলে আর থেকে থেকে বিকট চিৎকারে ব্যোম কালি বলে গাঁজায় দম দেয় । পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অনেকদিনই গাঁজার গন্ধ পেয়েছে ধিনিকিস্ট । গা করেনি । আ হা ! হাড়হাভাতে মানুষ ! খাক না এট্টু । তার মতো জনি ওয়াকার বা সিভাস রিগ্যাল আর কোথায় পাবে !
সেদিন সন্ধের পর ধিনিকিস্ট একটু বেরিয়েছে । সুন্দর হাওয়া ছেড়েছে । আকাশে পূর্ণ চাঁদ । বুলেট নেয়নি । একটু হাত-পা খেলানোও হবে আর খুচরো একটা কাজও সেরে নেবে । কাজ মানে একটা ত্যাঁদর গাঁটকে একটু কড়কাতে হবে । এইসব ছোটোখাটো ব্যাপারে খুব একটা নাক গলাতে চায় না । দরকারও বিশেষ হয় না । কিন্তু সবসময় তো সবকিছু মনের ইচ্ছেমতো হয় না । সে তুমি যতই ঝাড়া হাত-পা থাকতে চাও চলার পথে কিছু গাঁট থাকবেই । যেমন এই মালটাকে টিমের ছোকরাগুলো কিছুতেই বাগে আনতে পারছে না । অথচ পাওনা আছে হড়েগড়ে প্রায় লাখখানেক ।অগত্যা ধিনিকিস্টকেই নামতে হল । দরজা খুলে শুধু থোবড়াখানা দেখেই সব ত্যাঁদরামি জল । জল মানে ডিপ ফ্রিজের চিলড্ ওয়াটার যাকে বলে । -স্যার আপনি আবার কষ্ট করে আসতে গেলেন কেন ? একবার খবর পাঠালেই তো … তবু একবার পায়ের ধুলো যখন দিয়েছেন স্যার এক কাপ চা না খাইয়ে কিছুতেই …
– চা ফা এখন রাখুন তো মশাই । আমার তাড়া আছে । মালটা ছাড়ুন । – হ্যাঁ হ্যাঁ , এই তো স্যার রেডিই আছে । তবে স্যার ওই আশি । এটুকু কনসিডার তো করতেই হবে স্যার । ধিনিকিস্টর আবার দয়ার শরীর । সহজেই গলে যায় । – বেশ তো তাই দিন আপাতত । বাকিটা পরে দেখা যাবে । -আবার পরে ! আবার বাকিটা ! এইবারে খিঁচিয়ে উঠল ধিনিকিস্ট । মানে ? অতগুলো হকের টাকা অমনি অমনি ছেড়ে দেব ভাবলেন নাকি ? ওইজন্যে গুরু বলেছিল চট করে কারোর ভালো করতে নেই । পেয়ে বসে ।
আশি হাজার টাকার বান্ডিলটা পকেটস্থ করে বাড়িতেই ফিরে যাবে ভেবেছিল । কী কুক্ষণেই যে আর এক বেত্তমিজের মুখটা মনে পড়ল আর পড়তেই শরীরটা চিড়বিড় করে উঠল । খুব জ্বালাচ্ছে হারামীটা । তিন রাস্তার মোড় পেরিয়ে হাঁটাপথে মিনিট পাঁচেক মাত্র । স্রেফ পাঁচমিনিট । একসময় ভজকিস্টর এলাকা ছিল । এখন সে রামও নেই বাবরিও নেই । পেছোতে পেছোতে আজ ভজা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে খোঁজও রাখে না ধিনিকিস্ট । সে ভজা চুলোয় যাক । তবু অন্য সময় হলে পায়ে হেঁটে তিন রাস্তার মোড় নির্ঘাৎ পেরোত না । বিশেষ করে এই সন্ধে নামার পর । বুলেট তো থাকতই । দু রকম বুলেটই । কিন্তু আজ পরিবেশটাই সব হড়বড় করে দিল । চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চরাচর । সেই সাথে উতল চৈতি হাওয়া । ধিনিকিস্টর মনে অঢেল ফুর্তি ।
শিরিষতলা আসতেই গেঁজেলটা উঠে দাঁড়িয়ে একটা পেন্নাম ঠুকল । ধিনিকিস্ট একেবারেই পাত্তা দিল না । যেখান থেকে কোনো আমদানি নেই সেখানে সময় নষ্ট করাটা মোটেই কাজের কথা নয় । পাত্তা না দিয়ে ইউ টিউবে শোনা জনৈক রোদ্দুর রায়ের গাওয়া একখানা চমৎকার গান দুকলি গাওয়ার ইচ্ছা হল । কেবল শুরু করেছে ” বাঁ আআ চাঁন উটেচিল গঘনে ” – হঠাৎ মনে হল পেছনে কেউ যেন আসছে । ঠিক ধরেছে । সেই গেঁজেলটা । – দশটা টাকা হবে স্যর ? দাঁড়িয়ে গেল ধিনিকিস্ট । দশটা টাকা বড় কথা নয় । এসব লোককে লাই দেওয়টা মোটেই ভালো কাজ নয় । একবার কড়া চোখে তাকিয়েই আবার চলা শুরু করল । কিন্তু পরিবেশটাই মাটি হয়ে গেল । গান গাওয়ার মুডটাই আর নেই । লোকটা কিন্তু পেছন পেছন আসতেই থাকল । এখন ইচ্ছা করছে এক থাবড়ায় লোকটার একপাটি দাঁত ফেলে দিতে । আবার পরক্ষণে সামলিয়েও নেই । মরুক গে । ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করা তাকে অন্তত মানায় না । – ঠিক আছে স্যার । পাঁচটা টাকা অন্তত … অনেকক্ষণ সামলে রেখে এইবার মেজাজটা হারাল ধিনিকিস্ট ।- ফোট বানচোৎ । আর এক পা এগোতে দেখলে … কী হবে তা আপাতত উহ্য রাখল । কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু নয় । লোকটা যে পেছনে পেছনে আসছে ঘাড় না ঘুরিয়েও দিব্যি টের পাচ্ছে ধিনিকিস্ট । আর বিশ পঁচিশ হাত দূরেই একটা কচুরিপানা ভর্তি নয়ানজুলি আছে । মনে মনে ছক কষে নিল একটা হালকা হাফভলি মেরে মালটাকে ওখানেই গুঁজে দেবে ।
নয়ানজুলির পাঁচ-সাত হাত আগেই লোকটা হঠাৎ সুরুৎ করে ধিনিকিস্টর ঠিক সামনে এসে দাঁড়াল । সামনে মানে এক্কেবারে গাঁ ঘেষে বলা যায় । জায়গাটা খুবই শুনশান । রাস্তায় একফোঁটা আলো টালোও নেই । লোকটাও কি এতক্ষণ এই জায়গাটার অপেক্ষাতেই ছিল । হাফভলি মারার বাঁ পাটা যেন সেই মুহূর্তে মাটিতে হাতখানিক গেঁথে গেল । চাঁদের মায়াবী আলোয় ধিনিকিস্ট দেখল খ্যাঁচামারা লোকটার চোখদুটো অসম্ভব চকচক করছে আর দড়ির মতো শুটিয়ে গুটিয়ে যাওয়া হাতে কী একটা ধরা আছে । চোখের চেয়েও বেশি চকচক করছে সেটা । চাঁদের আলোতেও অভিজ্ঞ ধিনিকিস্টর অরিজিনাল মাল চিনতে ভুল হল না । — ভা ভা ভাইটি তুমি ! অন্ধকারে ঠিক চি চি চিনতে পারিনি । – আবে , অত কথার কী আছে ? আমি ভজাদার লোক আছি । বান্ডিলটা হবে কি হবে না ? ধিনিকিস্ট আবার তোতলালো ।- হ হ হবে না কেন ভাই । খু খু খুব হবে । পকেটে রাখা টাকার বান্ডিলটা কাঁপা কাঁপা হাতে বের করল ধিনিকিস্ট । তারপর অনেকদিনের অনভ্যস্ত একমুখ হাসি ছড়িয়ে বলল , আগে বললেই হতো ।
Tags: আগে বললেই হতো, গল্প, বিষ্ণু বিশ্বাস
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।