22 Oct

ইউসুফ মিঞার জমি

লিখেছেন:ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায়


সকাল বেলাই সুরজিতের ডাক পড়ল ডিরেক্টর সাহেবের ঘরে । হেড অফিসের চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বললেন- মিঃ মন্ডল, পানাগড়ে চাকরি জীবন শুরু করেছিলেন, পানাগড় নিয়ে লড়াইও করলেন অনেক, এবার গিয়ে প্রজেক্ট গুটিয়ে ফেলুন তাড়াতাড়ি। ইন্সপেকশন বাংলো রেডি করে রাখতে বলেছি, কিছু স্টাফ এখনও আছে । দুজন স্টোরকিপার থাকছে, তাদের নিয়ে আসেট লিস্ট তৈরি করে তাড়াতাড়ি ডিসপোসাল অ্যাকশান নিন। দুর্গাপুর থেকে চারজন সিকিওরিটি গার্ড কে পাঠান হচ্ছে ওখানে আপনার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা ওখানে থাকবে ।

– সুরজিত ইতস্তত করে বললেন ‘এটা কি আমাকে শাস্তি দেওয়া হল স্যার ?  অন্য কাউকে পাঠালে……’

– আপনি এরকম ভাববেন না। আপনার যুক্তি ম্যানেজমেন্ট মানেনি বটে কিন্তু সকলেই প্রশংসা করেছে আপনার স্পিরিটের, আপনার লজিকের । আর ম্যানেজমেন্টেরও কিছু বাধ্যবাধকতা থাকে এটা আপনি নিশ্চয়ই মানবেন ।

– সেতো বটেই । তবে আমাকে না পাঠালেই পারতেন, স্যার । পানাগড়ের সঙ্গে আমার একটা সেন্টিমেন্ট রয়েছে। তা ছাড়া আমি তো এটা নিয়ে লড়াই করলাম, এবং হেরে গেলাম। তাই শেষ কাজটা……

– দেখুন, চাকরি জীবনে ব্যক্তিগত সেন্টিমেন্ট এর কোনও মূল্য নেই । আর এটাকে আপনি ব্যাক্তিগত হারজিৎও ভাববেন না । এটা একটা অফিসিয়াল ডিসিশান, আর যারা ডিসিশান নিয়েছেন তারাও জিতে গিয়েছেন মনে করবার কোনও কারণ নেই। যাইহোক, এটাকে আমরা সবাই অনার করব।  শুনুন, প্রজেক্ট গোটানো নিয়ে অনেক  অ্যাজিটেশান হয়েছে। কিছু গোলমাল এখনও হতে পারে । আপনি থাকলে সহজে সেসব সামলাতে পারবেন সে বিশ্বাস আমার আছে।

হ্যাঁ, আপনার যা দরকার প্রপোজাল পাঠাবেন, সব পেয়ে যাবেন।মাস্টার রোলে দরকার মত লোকজন নিয়ে নেবেন।আপনার ব্যক্তিগত কাজের জন্যে আলাদা একজনকে রেখে দিতে পারেন । আপনাকে ফ্রীহ্যান্ড দেওয়া থাকলো। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে ফিরে আসুন।

#

এ  যেন এক বৃত্ত সম্পুর্ণ হওয়া।কৃষক পরিবারে জন্ম সুরজিতের। ছেলেবেলা থেকেই কৃষিতে উৎসাহ ছিল। বাড়িতে সেই ভাবে পরামর্শ দেওয়ার কেউ ছিলনা। বলা যায় নিজের উৎসাহেই বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন । সেখান থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাঠ শেষ করে  পছন্দের চাকরি পেয়েছিলেন পানাগড় এগ্রিকালচারাল ফার্মে,  অ্যাগ্রিকালচার এক্সটেন্সান অফিসার ।

পানাগড় ফার্ম একেবারে দামোদরের ধারে । চাকরি জীবনের প্রথম দশ বছর কেটেছিল এই প্রজেক্টে । এখানে কৃষকদের শেখানো হত কী ভাবে ক্যানেলের জলে সারা বছর চাষ করা যায় । বিজ্ঞানভিত্তিক চাষের শিক্ষা দেওয়া হত এই ফার্মে। জমির মাটি পরীক্ষা করে চাষীদের বলে দেওয়া হত তাদের জমি কোন ফসল চাষের উপযুক্ত, কী সার দেওয়া দরকার । সুরজিতের মনে পড়ে প্রথম প্রথম কীরকম বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল ফার্মের কর্মীদের । বৃদ্ধ চাষীরা ভাবতো যে আজন্ম চাষ করার পর এই সব শহুরে যুবকদের কাছে চাষ শিখতে হবে! গ্রামে গ্রামে গিয়ে মিটিং করা হত, চাষীদের বোঝান হত  কী ভাবে এই ফার্ম তাদের উন্নত পদ্ধতিতে চাষ বাস করতে সাহায্য করবে । অনেক প্রচেষ্টার পর গ্রামের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল এবং তাতে নিজের ভূমিকার কথাও মনে পড়ছিল সুরজিতের। চাষবাসে শিক্ষা দেওয়া ছাড়াও চাষিদের দেওয়া হত ফার্মে উৎপাদিত  উন্নত বীজ, উচ্চফলনশীল ফলের গাছের চারা । ক্যানেলের জল আর সঠিক চাষবাসের শিক্ষায় বর্ধমান জেলা হয়ে উঠল রাজ্যের শষ্য ভান্ডার । আজ সেই সম্পর্ক ছিন্ন করতেও তার ভূমিকা থাকবে । এও এক নিয়তির পরিহাস।

#

শতাব্দীর শেষ দশকে বিশ্বায়ন এসে বদলে দিয়ে গেল পৃথিবীকে এবং আরও অনেক কিছুকে । সেই আরও অনেক কিছুর মধ্যে একটা এই পানাগড় ফার্ম। বানিজ্যই শেষ কথা। সরকারী সংস্থাকেও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে বানিজ্যিক ভাবে। তাই সংস্থার মূল  কার্যক্রম বিদ্যুৎ উৎপাদনকে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখবার জন্যে অন্য সমস্ত জায়গায় ব্যয় কমাতে হবে । তার জন্যে খোঁজা শুরু হল  কোথায়  কোথায় ব্যয় সংক্ষেপ করা যায় । সংস্থার  ড্যাম গুলোতে মাছ চাষ করার জন্যে ফিশারি ডিপার্ট্মেন্ট ছিল, সেটা বন্ধ হয়ে গেল । তারপর  এল পানাগড় ফার্ম ।  খবর ছড়িয়ে পড়তেই বিক্ষোভ আন্দোলন শুরু হল । কর্মচারীরা নিজেদের চাকরির স্বার্থে, ইউনিয়ন গুলো কর্মী সংকোচনের বিরুদ্ধে,  আর গ্রামবাসীরা এই ফার্ম থেকে যে সুবিধা পেত তা হারানোর আশঙ্কায় আন্দোলন শুরু করল । আন্দোলন ধীরে ধীরে তীব্র হতে লাগলো । চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার আগে হেড অফিসে সকল পক্ষকে আহ্বান করা হল, উদ্দেশ্য শান্তিপূর্ণ ভাবে সমস্যার সমাধান করা ।

ইউনিয়নের নেতারা একদিন সুরিজিতের সঙ্গে দেখা করে বললেন,

– স্যার, আপনি মিটিঙে আমাদের প্রতিনিধিত্ব করুন ।

– সে কি কথা? আমি কি ইউনিয়নের, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি হতে পারি? সেটা আমার চাকরির শর্তে আটকায়।

– সে অনুমতি যোগাড় করার দায়িত্ব আমাদের ।আমরা জানি আপনি পানাগড় ফার্মের অতীত,বর্তমান, সমস্যা,সম্ভাবনা সব অন্য সকলের চেয়ে বেশি জানেন । আপনার কোনও প্রস্তুতির দরকার হবে না।

সুরজিত কথাটা মেনে নিলেন । – ‘ঠিক আছে, আমি রাজি হলাম। কিন্তু আমাকে চিঠি দিয়ে আমন্ত্রন জানাতে হবে’।

-ঠিক আছে স্যার, সে দায়িত্ব আমাদের ।

রাজ্যে তখন ক্ষমতায় বামপন্থী সরকার । সুরজিত পরে জেনেছিলেন ইউনিয়নের লোকজন তাদের প্রভাব খাটিয়েছিলেন যাতে সিদ্ধান্ত গ্রহনের আগে সকল পক্ষের বক্তব্য শোনা হয়  এবং কর্মচারী ইউনিয়ন, গ্রামবাসীদের প্রতিনিধিত্ব করবেন সুরজিত মন্ডল । সুরজিত আমন্ত্রন পত্র যথা সময়ে পেয়ে গিয়েছিলেন।

সংস্থার সচিবের উপস্থিতিতে মিটিং হয়েছিল। শুরুতেই সকলকে খসড়া রেজলিউসান দেওয়া হয়েছিল । বিশ্বায়নের ফলে আমরা এক নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে প্রবেশ করেছি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটা সময় ছিল যখন আমাদের কোনও প্রতিযোগী ছিলনা, আজ বড় বড় সংস্থা বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে চলে আসছে । তাদের সঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে। আমাদের খুঁজে বার করতে হবে কোথায় কোথায় ব্যয় সংকোচন করা যায় ।পানাগড়  অ্যাগ্রিকালচার ফারম আজ আর প্রাসঙ্গিক নয় কারণ  রাজ্য সরকারের কৃষি বিভাগ এখন গবেষণা এবং চাষীদের পরামর্শ দেবার কাজ দক্ষতার সঙ্গে করে চলেছে। ব্যাক্তিগত উদ্যোগে এখন ভাল ভাল নার্সারী তৈরী হয়েছে। উন্নত বীজ, চারা এখন সেখান থেকেই কিনতে পাওয়া যায়।ফলে চাষীরা এখন আর এই ফার্মের ওপর  নির্ভরশীল নয় । সুতরাং এই ফার্ম চালু রাখা এখন অর্থের অপচয় ।

সুরজিত বুঝতে পেরেছিলেন সিদ্ধান্ত হয়েই গেছে । তাঁর বিশেষ কিছু করার নেই ।আরও লক্ষ্য করলেন সচিব মিটিঙে খুব মনোযোগী নন, তাঁর কাছে অন্য কাজ নিয়ে অফিসাররা আসছেন, উনি নির্দেশ দিচ্ছেন, ফাইলে সই করছেন । বোঝাই যাচ্ছে ওনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েই গেছে ।

এরপর সচিবের নির্দেশে অর্থ বিভাগের আধিকারিক গত পাঁচ বছরের হিসাব পেশ করলেন । আয়ের ঘর প্রায় শূন্য, বেতন এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক ব্যয় লক্ষ লক্ষ টাকা । সচিব জানতে চাইলেন আগে এখানে কী ভাবে আয় হোত, আর এখন কেনই বা হচ্ছেনা । বিভাগীয় প্রধান জবাব দিলেন, ‘স্যার, কোনদিনই এই প্রজেক্ট সেই অর্থে লাভজনক ছিল না। এর উদ্দেশ্যই ছিল জনহিত এবং এলাকার মানুষের সার্বিক উন্নতি। সেই কাজ এই ফার্ম প্রায় তিন দশক ধরে সাফল্যের সঙ্গে করেছে। কিছু আয় হোত এখানে উৎপন্ন উন্নত ধানের বীজ চাষীদের কাছে  বিক্রী করে।এ ছাড়া চাষীদের জমির মাটি এখানকার লেবরেটারীতে পরীক্ষা করে দেওয়া হত, ফার্মের নিজস্ব জমিতে যে ফসল ফলত, ফল গাছে যে ফল পাওয়া যেত তা বিক্রী করে আয় হত । এসব কাজও এখন আর কর্মীদের দিয়ে হয় না কারণ কর্মী সংখ্যা কমে গেছে, যারা আছেন তারা সব বয়স্ক। । এখন নিজস্ব জমিতে চাষ করতে, ফসল কাটতে, গাছের ফল পাড়তেও আলাদা করে লোক নিয়োগ করতে হয়। অনেক সময় দেখা যায় ফসল থেকে ফসল কাটার  খরচ ওঠে না । এমনকি ফল গাছ থেকে ফল পাড়ার খরচ ফল বিক্রি করে পাওয়া যায় না ।কিন্তু মূল কথা হল চাষীরা এখন আর এই ফার্মের ওপর নির্ভরশীল নয়।

সচিব আর সময় নষ্ট করতে চাইছিলেন না । নিয়ম মাফিক এই মিটিং সমাপ্ত করার আগে সুরজিতকে ইঙ্গিত করলেন বলার জন্যে ।

সুরজিত শুরু করলেন, “স্যার,  পানাগড় ফার্ম  একসময়ে দেশের সবুজ বিপ্লবে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে  বর্ধমান জেলার চাষীরা  জেলাকে রাজ্যের শষ্য ভান্ডারে পরিনত করেছে । আমরা শিখিয়েছিলাম সেচের জলে কীভাবে তিনটে ফসল তুলতে হয় । দেশে যখন খাদ্যের অভাব ছিল, বিদেশ থেকে গম আমদানি করতে হত আমরা তখন চাষীদের প্রচলিত ধানের চাষ বন্ধ করে হাই ব্রিড ধান  ‘শতাব্দী’ চাষ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলাম। সেই  ‘শতাব্দী’- যার প্রচলিত নাম ‘মিনিকিট’ দেশের খাদ্য সমস্যার সমাধান করেছে । বর্ধমান, হুগলী জেলার একটা অংশ যা দক্ষিণ-দামোদর নামে পরিচিত সেখানে সারা দেশের মধ্যে পরিমানে এবং মানে সেরা সুগন্ধী  চাল উৎপন্ন হয় । এর কৃতিত্ব আমরা দাবী করতে পারি । আমরা সেচের জলের ব্যবস্থা করেছি, আমরা উৎকৃষ্ট বীজ সরবরাহ করেছি, মাটি পরীক্ষা করে  আমরা বলে দিয়েছি কোন জমিতে কী চাষ করতে হবে, কী সার দিতে হবে।। বিজ্ঞানভিত্তিক চাষ আমরা  চাষীদের শিখিয়েছি।

অর্থ বিভাগের এক আধিকারিক সুরজিতকে থামিয়ে দিয়ে বললেন এ সব সকলেই জানে । কিন্তু এ তো অতীত । এখন আর নতুন করে চাষীদের … তাছাড়া এখনকার দিনে আমাদের সমস্ত ক্ষেত্রে কস্ট এফেক্টিভ ……।

কেউ একজন বললেন এখন চাষিরা আমাদের ফার্মের ওপর নির্ভর করে না । এখানে কেউ আসেনা পরামর্শের জন্যে ।

সচিব ইশারা করলেন, ওনাকে বলতে দিন।

সপ্তরথীর মাঝে একা অভিমন্যুর মত সুরজিত আবার গান্ডিব তুলে নিলেন এ যুদ্ধ জেতা যাবেনা জেনেও । বিভাগীয় ডিরেক্টর রাও সাহেব নিজে একজন কৃষি বিজ্ঞানী । তিনি চাননি নিজের কাজের ক্ষেত্রকে ছোট করতে, বিশেষ করে  এমন একটা বিভাগ যেখানে গবেষণা নির্ভর কাজ হয় । রাও সাহেব বলে দিয়েছিলেন উনি মিটিং এ বিশেষ  কথা বলতে পারবেন না । যে মিটিং এ ফার্ম তুলে দেবার সিদ্ধান্ত হয়েছিল সেখানে তিনি নিজে উপস্থিত ছিলেন । সুরজিতকে নির্দেশ দিয়েছিলেন মন খুলে কথা বলতে, কারণ আমাদের হারাবার কিছু নেই ।

স্যার, আমাদের কাছে আজ আর কেউ পরামর্শ চাইতে আসে না কারণ আমাদের ল্যাবরেটরি তে কেমিস্ট নেই দীর্ধদিন, অব্যবহারে সেখানে এখন আবর্জনার পাহাড় । আমাদের ট্রাক্টার, টিলার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতিতে জং ধরে গেছে।বাজেট বরাদ্দ না থাকায় আমাদের বীজ উৎপাদন কেন্দ্র বন্ধ। দীর্ঘদিন ধরে কাজ না করিয়ে, কর্মী সঙ্কোচন করে করে ফার্মকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে । এখন সেই অজুহাতে ফার্মকে তুলে দেবার কথা হচ্ছে।

স্যার,চাষিদের জন্যে এই ফার্মের উপযোগিতা কিন্তু শেষ হয়নি। অন্য যে কোনও ক্ষেত্রের মতই কৃষিবিজ্ঞানেও গবেষণার প্রয়োজন কখনও শেষ হয়না। যারা কৃষির অগ্রগতির খবর রাখেন তারা জানেন যে শতাব্দী বা মিনিকিটের দিন শেষ হয়ে আসছে । গবেষণা হচ্ছে আরও উচ্চ ফলনশীল, আরও সুস্বাদু এবং একই সঙ্গে আমাদের আবহাওয়ার উপযুক্ত এবং একই সঙ্গে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ধানের। এবং এটাই রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার কমানোর পথ।  সেই নতুন ধানের বীজ এসে গেলে আমাদেরই তো চাষীদের পরামর্শ দেবার জন্য তৈরী থাকতে হবে ।

আমরা এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ন হয়েছি । কিন্তু স্বয়ংসম্পুর্ন হতে গিয়ে আমরা আমাদের নিজস্ব ভ্যারাইটি গুলো হারিয়ে ফেলেছি। এখন আমাদের সময় এসেছে সেগুলো উদ্ধার করার । উত্তর ভারতের দেরাদুন রাইস শুধু সারা ভারতে নয় বিদেশেও জনপ্রিয়।দেরাদুন রাইস রপ্তানি করে আমাদের দেশ অনেক বিদেশী মুদ্রা আয় করে। আমাদের গোবিন্দভোগ কিন্তু এই প্রতিযোগিতায় অনেক পেছিয়ে। আমরা গোবিন্দভোগের পাশাপাশি আমাদের অপ্রচলিত ভ্যারাইটি রাধাতিলক, উত্তর বঙ্গের তূলাইপাঞ্জি, কালোনুনিয়া, কনকচূড়, রাঁধুনিপাগল,বাদশাভোগ প্রভৃতি সুগন্ধী ধান চাষে চাষীদের উদ্বুদ্ধ করতে পারি । আমাদের বাংলায় দুশো প্রজাতির ধান আছে। সেগুলো উদ্ধার করে বানিজ্যিক ভাবে চাষ করার সুযোগ আছে। আয়রন-সমৃদ্ধ কালাভাত এর আজ বিদেশে ভীষন চাহিদা। এই চাল ক্যান্সার প্রতিষেধকও বটে। স্যার, এসব কথা এখানে এত বিস্তৃত ভাবে বলার সু্যোগ নেই। আমি শুধু একটা কথা বলতে চাই আমরা কৃষি থেকেই অনেক বিদেশী মুদ্রা অর্জন করতে পারি।এজন্য এখনই সুরু কর প্রয়োজন জৈবচাষ। উন্নত দেশগুলি আমাদের দেশে রাসায়নিক সার রপ্তানি করে কিন্তু নিজেদের দেশে তা ব্যবহার করেনা। আমাদের চাষীদের জৈব চাষে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজন গবেষণা এবং ট্রেনিং। আমাদের এই ফার্ম  এই কাজে পথপ্রদর্শক হতে পারে।

একটু থেমে সুরজিত বলতে থাকেন,’আমি যে কথাটা বলে শেষ করব তা হল আয় ব্যয়ের যে হিসাব এখানে দেওয়া হয়েছে তা  সঠিক নয়’ ।

মিটিং এ উপস্থিত অন্যান্য অফিসারদের মধ্যে একটা গুঞ্জন শোনা গেল। সচিব ইঙ্গিতে তাদের থামতে বলে সুরজিতের দিকে তাকালেন।

– স্যার, শিক্ষাখাতে সরকারের  যে ব্যয় হয় তার কি লাভ ক্ষতির হিসাব হয়? ঠিক তেমনি এ ক্ষেত্রেও হয়না। হিসাব যদি করতেই হয় তবে আমরা কাজ শুরু করার পর গত চল্লিশ বছরে লক্ষ লক্ষ চাষির জীবনযাত্রার মান যে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাঁদের ঘরে যে সম্পদ সৃষ্টি হয়েছে তা আমাদের ক্রেডিটে নিতে হবে। তখন দেখা যাবে আমরা বহু বহু লাভ করেছি। সেই লাভের টাকা হয়তো আমাদের ঝুলিতে আসেনি কিন্তু দেশের অনেক লাভ হয়েছে । এবং সেই লাভের ভাগীদার আমরা। দেশের মানুষের সমৃদ্ধিতে আমাদের সক্রিয় ভূমিকা আছে। আজ আমরা সেই দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারি না।

সুরজিত লক্ষ্য করেছিলেন, সচিব প্রথম দিকে মিটিং এর আলোচনায় খুব একটা মনোযোগ দিচ্ছিলেন না । একটু পরে কিন্তু তিনি মন দিয়ে সুরজিতের বক্তব্য শুনছিলেন । সুরজিত বলতে শুরু করলেন, স্যার আমরা নামমাত্র ক্ষতিপূরনে চাষীদের জমি অধিগ্রহণ করেছিলাম, আজকের দিনে সেটা কল্পনা করা যাবেনা । সেই জমিহারারা এখানে শুধু নানারকম কাজ করে উপার্জন করে তাই নয়, তাদের একটা আবেগ কাজ করে যে তারা নিজের জমিতে কাজ করছে। স্যার, আমাদের সংস্থা একটা বট গাছের মতো । এর ডালে-ডালে, পাতায়-পাতায় অসংখ্য পাখি, কীট, পতঙ্গ বাস করে । এর ছায়ায় কত মানুষ বিশ্রাম নেয়……

সচিব বলেন,’শুনুন, আপনি আবেগপ্রবন হবেন না । আবেগতাড়িত হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনও সংস্থা চালানো যায় না’ ।

সরি স্যার, আমি সত্যিই আবেগপ্রবন হয়ে পড়েছিলাম । আমি ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে পানাগড় ফার্মে  চাকরি জীবন শুরু করেছিলাম । প্রথম দিনের কথা আমার আজও মনে আছে । প্রজেক্টের গেট দিয়ে ঢুকে দুধারে সবুজের সমারোহের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গিয়ে পৌঁছেছিলাম অফিসে । সুন্দর কোয়ার্টার, কোয়ার্টার সংলগ্ন নিজস্ব বাগান । দশ বছর চাষীদের সঙ্গে , তাদের সুখ দুঃখের সঙ্গে জড়িয়ে কাজ করেছি । প্রোজেক্টের জমিহারাদের সঙ্গে আমার আবেগ মিশে গিয়েছিল । আমার বাবা পূর্ববাংলা থেকে ঘর-বাড়ি,জমি-জায়গা হারিয়ে এদেশে এসেছিলেন। তাই জমিহারাদের ব্যাথা আমি জানি। তাই কিছুটা আবেগ প্রবন হয়ে পড়ে ছিলাম । স্যার, আমি জানি সংস্থার একজন আধিকারিক হয়ে আমি এইসব কথা এখানে বলতে পারিনা । কিন্তু আমি এখানে কর্মচারী ইউনিয়ন, স্থানীয় চাষি, এবং ঠিকা শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করছি । আমি এখানে তাদের কথা বলছি। তাদের আবেগকে এখানে পৌঁছে দেওয়া আমার কর্তব্য । বটগাছের মত আমাদের এই সংস্থায় এরা আশ্রিত । এরা চান  এই ফার্ম উজ্জীবিত করে আমরা নতুন করে কাজ শুরু করি এবং রাজ্য সরকারের পাশাপাশি সুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে কৃষির উন্নতিতে আমরা অংশগ্রহন করি। সিদ্ধান্ত নেবার আগে এদের কথা বিবেচিত হবে আশাকরি , স্যার।

সচিব  বললেন, আমরা বিষয়টা সমস্ত দিক থেকে  আলোচনা করলাম। আমরা এ থেকে সিদ্ধান্ত নেব। অবশ্যই সঠিক সিদ্ধান্ত নেব।  সচিব উঠে পড়লেন । মিটিং এখানে শেষ। কনফারেন্স রুম থেকে বেরোবার সময়ে সুরজিতের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন ‘আপনাকে আমার মনে থাকবে’ ।

কয়েকদিন পরে  অর্ডার এসে গিয়েছিল। ফার্ম গুটিয়ে ফেলা হবে। তবে চাষীদের, স্থানীয় মানুষদের স্বার্থ কী ভাবে রক্ষা করা যায় তার বিশদ পরিকল্পনা করার নির্দেশ দিয়েছেন সচিব ।

#

একদিন সুরজিত গিয়ে পৌঁছলেন পানাগড়ে। মনে পড়ছিল প্রথম দিনের কথা । সেদিনের সেই সবুজ আজ হারিয়ে গেছে, মনে হচ্ছে যেন একটা মৃত নগরীতে প্রবেশ করছেন । বেশির ভাগ কোয়ার্টারের ভগ্ন দশা, জঙ্গলে পরিপূর্ণ । ফার্মের কাজ অনেক দিনই বন্ধ রয়েছে,কর্মীদের ধীরে ধীরে অন্য প্রজেক্টে বদলি করা হচ্ছে। নিজের কোয়ার্টারের সামনে এসে সুরজিত গাড়িটা থামাতে বললেন । দশ বছর এখানে কাটিয়ে গেছেন। পিছনের নিম গাছটার দিকে তাকালেন । অনেক গল্প মনে পড়ল।

অফিসে পৌঁছে দেখলেন দুজন স্টোরকীপার ওনার জন্যেই অপেক্ষা করছেন । যাদের এখনও বদলির আদেশ আসেনি তারা কর্মহীন দিন কাটাচ্ছেন । স্টোরের লোকজনকে এখনও রাখা হয়েছে মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রীর বিলি ব্যবস্থা  করার জন্যে। সুরজিতের নিজেকে এক ডুবন্ত জাহাজের ক্যাপ্টেন মনে হল । সব বিলি ব্যবস্থা করে, সকলকে রওয়ানা করিয়ে দিয়ে শেষ লাইফবোটে উঠতে হবে ।

ডিরেক্টার সাহেবের কথা গুলো মনে পড়ল – ‘আমি জানি ওখানে থাকতে আপনার অসুবিধে হবে, দুর্গাপুরে থেকেও রোজ আসা যাওয়া করে হয়তো কাজটা করা যাবে। কিন্তু আমার আশঙ্কা সেক্ষেত্রে আমাদের সম্পত্তি গুলো নয়ছয় হয়ে যাবে। বিশেষ করে মূল্যবান কাঠ, আমাদের লেজার ব্যালান্স অনুযায়ী  কোটি টাকার শুধু কাঠ থাকার কথা। ঠিক ঠাক সুপারভিশান না হলে বেশির ভাগই হয় উইপোকার পেটে অথবা পচে যেতে পারে’।

গ্রামের মানুষ সুরজিত, চাকরি জীবনও কেটেছে কৃষি, অরণ্য বা নদী সংক্রান্ত কাজে । ফলে মাস খানেক এখানে কাটাতে মানসিক ভাবে কোনও বাধা ছিল না । ইন্সপেকশন বাংলোটা সাফসুতরো করে রাখাই ছিল।আগামী কিছুদিনের জন্য সুরজিতের অস্থায়ী বাসস্থান হল এই বাংলো।

দ্রুত কাজ শুরু হয়ে গেল। স্টোরে ভর্তি দামি দামি কাঠ। চাষ বাস সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি, ট্রাক, ট্রাক্টর, অফিসের আসবাবপত্র, আরও কত কি! দুজন স্টোরকিপারের দায়িত্বে এই সব মালপত্র।  এই সব মালপত্র নাড়াচাড়া, সরানো-নড়ানো করার জন্যে  ক্যাজুয়াল কর্মীদের একটা গ্যাং তৈরি করা হল।  শীতের দিন  বেলা ছোট, ঠিক  হল সকাল সকাল কাজ শুরু হবে  আর এক বেলাই কাজ হবে ।

প্রথমদিনই ক্যাজুয়াল কর্মীদের একজনের ওপর সুরজিতের চোখ আটকে গেল। এ যেন ত্রিশ বছর আগের ইউসুফ!অনুমান সত্যি হল, ওর নাম আসগর। আসগরের বাবাই ইউসুফ। সন্ধ্যে বেলা আসগর কে বাংলোয় দ্যাখা করতে বললেন সুরজিত।

#

সুরজিত তখন এগ্রিকালচার এক্সটেনশান অফিসার। আর ইউসুফ ছিল পাশের গ্রামের একজন ভূমিহারা চাষি। কিন্তু ওর সঙ্গে কেমন যেন ভালবাসা হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য প্রথম প্রথম ওর গায়েপড়া স্বভাব সুরজিতের ভাল লাগতো না।পরে ধীরে ধীরে ওর গল্প শুনতে শুনতে একটা সম্পর্ক তৈরী হয়ে গিয়েছিল । খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে, ওর গল্প শুনে সুরজিত জেনেছিল বড় বড় কর্মযজ্ঞের পেছনে মানুষের বেদনার কথা,তাদের অশ্রুর কাহিনী।

-তোমাদের জমি কবে সরকার নিয়েছিল ইউসুফ ?

-সে তো আজাদীর সময়ের কথা।মাপজোপ কিছুদিন ধরেই হচ্ছিল। এক দিন জানা গেল আমাদের জমি চলে গেছে সরকারের ঘরে।

– কত বয়স তখন তোমার?

– তখন তো আমার বাপ বেঁচে, আমি খেলে বেড়াই। দশ বছর হবে।জমি চলে গেছে সরকারী খাতায়, কিন্তু আমার বাপ তখনও চাষ করত। এখানে তখনও ফার্মের কাজ শুরু হয়নি।

-তোমরা বাধা দাওনি?

-আমি তখন ছোট। তাছাড়া তখন তো আজকের জমানা ছিলনা। আজ জোর করে কারও জমি নেওয়া যায়না। জমি নিলে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায় ভাল।

– তোমরা কত টাকা পেয়েছিলে?

-ঠিক বলতে পারিনা। কয়েক শো টাকা হবে। বাবা বলেছিল ঐ টাকা দিয়ে ঘরটা পাকা হয়েছিল, বাকি টাকা ঘরে রাখা ছিল বাক্সে। সে টাকা চুরি হয়ে গিয়েছিল।

-টাকা কি কেউ বাক্সে রাখে? ব্যাঙ্কে একটা খাতা করতে পারেনি তোমার বাবা?

– তখন কোথায় ব্যাংক? আর আমার বাবা তো পড়ালেখা জানা মানুষ ছিলনা।

– তোমার বাবা কী করল সারাজীবন?

-এই, আমি যা করছি।বাড়ির কাছে সামান্য কিছু জমি আছে তাতে সবজি ফলাই। আর এই ফার্মে আপনারা ডেলি রোজে কাজ দিলে করি। আপনাদের বাগানে সবজি ফলাই, ফুল ফোটাই।আর দামোদরে মাছ ধরি। নদির খয়রা, বেলে, কাজরী বড় মিষ্টি মাছ গো……।

সুরজিত ইউসুফকে কাজ দিত, অন্য সকলের চেয়ে বেশি।

ওর সঙ্গে সুরজিতের সম্পর্ক্টা গভীর হয়েছিল তার আর একটা কারণ ছিল। ওর ধারনা সুরজিতের কোয়ার্টারটা ওর জমির ওপরই হয়েছে।

-কী করে জানলে তুমি?

বাবা বলত ঐ যে নিম গাছটা দেখছেন ওটা আমাদের জমিতে ছিল।

ফার্ম যখন তৈরি হয় তখন অনেক গাছকেই বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। ঐ প্রাচীন নিম গাছটা তাদের একটি। তবে ফার্মের মধ্যে আরও অনেক নিমগাছ আছে, সুরজিত সেসব কথা তুলে ওর সুখ কেড়ে নিতে চাইত না। বরং একটা জায়গায় ইউসুফের সঙ্গে একাত্ম হত।পূর্ববাংলা থেকে আসা বাবার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভিটে মাটি  হারানোর বেদনা ছিল। ইউসুফের জমি হারানোর বেদনার মধ্যে সুরজিত নিজের বাবার বেদনা খুঁজে পেত।

কিছুদিনের মধ্যেই সুরজিত তরুণী স্ত্রীকে নিয়ে এসে সংসার পেতেছিল । গাছ পালায় তারও ভীষন ঝোঁক। সঙ্গে পেল ইউসুফকে।ফুল, সব্জি তে ভরে গেল কোয়ার্টারের বাগান।ছোট ছোট কেয়ারি করে নানা রকমের সব্জি চাষ হোত কোয়ার্টারের সামনে পেছনে । শীতে হোতো মরশুমি ফুল।অন্য কোথাও কাজ না পেলে ও চলে আসত, ও বুঝে গিয়েছিল কাজ করবে কি না অথবা কী কাজ করবে সেটা গৃহিনীই ঠিক করেন । কাজ যদি নাও থাকে চা-রুটি সব্জি তো ওর জন্যে বাঁধা বরাদ্দ। ছুটির দিনে ওর সঙ্গে সুরজিতও ঝুরঝুরে মাটি মেখে বাগানে কাজ করত। চা খাওয়া হলে ইউসুফ বলত দ্যান, সাহেব একটা সিগ্রেট দ্যান। ওরা একসঙ্গে গাছতলায় বসে  সিগারেটে সুখটান দিত। কর্মীদের মধ্যে নদির টাটকা মাছের খুব চাহিদা ছিল, ইউসুফ মাছ পেলে ওদের জন্যে কিছুটা আলাদা করে রেখে তারপর বিক্রী করতে বসত। শুধু কালোজিরে আর হলুদ দিয়ে কী করে কাজরী মাছ রাঁধতে হয় নতুন সংসারী স্ত্রীকে ইউসুফই শিখিয়ে দিয়েছিল।

ইউসুফ রোজা রাখতে পারত না। বলত রোজা রাখলে কাজ করতে পারে না। কাজ না করলে খাবে কী? কিন্তু পরবের দিন  ওর শিশুপুত্রের হাত ধরে, নতুন জামা লুঙ্গী পরে খাবার নিয়ে আসত। প্রথম বার সুরজিতকে ইতস্ততঃ করতে দেখে ইউসুফ বলেছিল, ‘আমরা ঐ মাংস খাই না। আর খেলেও তা কি আপনাদের জন্যে আনব?’ সুরজিত লজ্জা পেয়েছিল।পুজোর পর সুবিধে মত ইউসুফকেও একদিন  খাওয়ানো হত। সুরজিত স্ত্রীকে বলত মাংসটা আজ ওদের মত রান্না কোর, মানে মোগলাই খানা।এখান থেকে বদলি হয়ে চলে যাবার পর সুরজিত মাঝে মাঝে এসেছেন, দুএক ঘন্টার কাজ সেরে ফিরে গিয়েছেন। ইউসুফের খোঁজ করেছে্ন কখনও কখনও, কিন্তু দ্যাখা হয়নি। তারপর দীর্ঘ অদর্শনের প্রলেপ পড়ে গেছে ইউসুফের ওপর ।

#

আসগর কে দেখে সুরজিতের সব মনে পড়ে গেল। দিনে ও সকলের সঙ্গে স্টোরে কাজ করত। ও রান্না করতে জানে শুনে  ওকে  বাংলোয় নাইট-গার্ড-কাম-কুক হিসাবেও রেখে দেওয়া হল।সুরজিত আসগরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন  ওর বাবার কথা। কোন বছর ইউসুফ মাটি নিয়েছে আসগর ঠিক বলতে পারলনা। কোন এক বন্যার বছরে। চারদিক তখন জলে ভরা।কবরস্থানে অসুবিধা হয়েছিল সেটা মনে আছে। এই ফার্ম করার জন্যে ওদের জমি গেছে সেটা ও জানে। কিন্তু তার বেশি আবেগ ওর নেই।

চাকরি জীবনের বেশীর ভাগ সময় ফরেস্ট ডিপার্ট্মেন্টে কেটেছে। ফলে জঙ্গলের প্রতি একটা  ভালবাসা  আছেই। বাংলো থেকে একটু হেঁটে গেলেই দামোদর। শীতের বিকেল, তির তির করে বয়ে যাওয়া সচ্ছ দামোদর । দিন গুলো কেটে গেল কাজের মধ্যে দিয়ে আর পুরোন কথা ভেবে।

কাজ প্রায় শেষ হয়ে এল,  এখন গোটানোর পালা। সন্ধ্যেবেলাটা  বাংলোর বারান্দায় বসেই কাটে , আজও তেমনই বসে ছিলেন সুরজিত। শীত কালে এখানে রাত আটটা মানেই গভীর রাত।আসগর আসার সময় হয়েছে। ও এসে গরম রূটি বানাবে। একটু দূরেই দামোদর বয়ে চলেছে। নদীর জলের শব্দ, অমাবাস্যার নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, চারিদিকের নির্জনতা মিলে মিশে এক রহস্যের মায়াজাল সৃস্টি করেছে।সেই রহস্যময়তাকে বাড়িয়ে দিয়ে হঠাৎ এক আকাশ কুয়াশা এসে ভরিয়ে দিল চারদিক। ল্যাম্প পোস্টের টিমটিমে আলো কুয়াশায় আস্তরনে ঢাকা পড়ে সেই রহস্যময়তাকে আরও বাড়িয়ে দিল ।

এমন সময় লনের লোহার গেট খোলার আওয়াজ, অভ্যস্ত ভাবেই তাকালেন সুরজিত, কিন্তু আসগর নয়। কুয়াশার চাদর ভেদ করে একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্ত্তি ধীরে ধীরে এগিয়ে এল।কোন রকম জড়তা ছাড়াই, ঈষৎ কুঁজো,পরনে ফুলশার্ট আর চেক লুঙ্গী, হাতে একটা বাঁশের লাঠি।সুরজিত চমকে উঠল।

-ইউসুফ?

-চিনেছেন?

-তোমাকে চিনব না ইউসুফ? কিন্তু তুমি তো…… আসগর বলছিল-

-মরে গেছি? আমাদের জীবন কবে ছিল সাহেব যে মরন হবে? ও কথা থাক।আপনি কেমন আছেন ? মেমসাহেব ? আর বাবু? আপনি যখন চলে গেলেন তখন বাবু ইস্কুল যেতে শুরু করেছে।

সবাই ভাল আছে ইউসুফ, তোমার কথা বল ।

-সাহেব, আজ অন্য একটা কথা বলতে এসেছি। শুনলাম এই ফার্ম উঠে যাচ্ছে? আর গোটানোর কাজ করতে আপনি এসেছেন, একদিন এই ফার্ম গড়ার কাজ করে গেছেন, আজ এসেছেন ভাঙতে।

-কী করব বল? আমি তো চাকরি করি।

– সে তো আমি বুঝি।তবে ছেলেটার জন্যে বড় কষ্ট লাগে। এখন জমির কত দাম। থাকলে তো ছেলেটারই থাকতো।

-তুমি আজ আমাকে এসব কথা বলছ কেন? তোমাদের জমি নেওয়া হয়েছিল তো আজকে নয়।

–  ঠিক কথা, জমি হারানোর দুঃখ আমি ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু আজ যখন দেখছি, যে দরকারে আপনারা জমি নিলেন সে দরকারটাই ফুরিয়ে গেছে তখন বেদনাটা আবার আমার ফিরে এল। এই ফার্মকে ঘীরে কত মানুষ বেঁচে আছে, দশ গাঁয়ের লোক এখানে কাজ করে পেটের ভাত জোগাড় করে।ইচ্ছে হলেই কি এটা বন্ধ করে দেওয়া যায়?

-কিন্তু তুমি আমাকে কেন এসব বলছ ইউসুফ।আমি তো একজন সাধারণ কর্মী। সরকার যা চায় তাই তো হয়।

আমরা অনেকক্ষণ নিশব্দে বসে থাকি। কুয়াশা আরও গাঢ় হয়, আমার চেয়ে কয়েক হাত দূরে মাটিতে উবু হয়ে বসে ইউসুফের ছায়ামূর্তী।

– আচ্ছা, জমিটা এখন আমাদের ফেরৎ দিলে তা অন্যায্য হবে? কী হবে এই জমি এখন?পড়ে থাকবে, এক সময় হয়তো বিক্রী হয়ে যাবে।  আমি তো আর কাউকে পাব না বলবার মত।আপনি বহুদিন পরে এসেছেন, তাই ভাবলাম আমাদের দুঃখের কথা একবার জানিয়ে যাই।আপনার সঙ্গে আমার একটু ভাব তো ছিল।

– তোমার কষ্ট আমি বুঝি ইউসুফ, কিন্তু তোমাকে আমি কী করে  বোঝাব। জমি একবার সরকারী কাজে নেওয়া হলে তা আইনত আর ফেরত দেওয়া যায়না।

– আইনের কথা বাদ দ্যান সাহেব, ন্যায্য অন্যায্য বলুন। আইনের পরেও ধর্ম আছে, ধর্মের কথা বলুন । আপনারা জমি নিলেন দেশের কাজে। সে কাজ আপনাদের ফুরিয়েছে।বুকে হাত দিয়ে বলুন তো আজ কি জমিটা আমাদের প্রাপ্য নয়? আজ  জমিটা থাকলে আমার ছেলেকে তো পরের দুয়ারে ফরমাস খেটে খেতে হোত না।

সুরজিত স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলেন ।  শুধু কানে বাজতে লাগলো এক জমিহারার আর্তনাদ । ‘আইনের কথা বাদ দেন সাহেব, ন্যায্য অন্যায্য বলুন’ ।

-ইউসুফ, আমাদের ফার্ম উঠে গেলেও এখানে রাজ্য সরকার নতুন ফার্ম করবে। এখানকার সমস্ত মানুষ কাজ পাবে, চাষিরা সাহায্য পাবে- সেই ব্যবস্থা হচ্ছে।-সুরজিত মৃদু কন্ঠে বলতে চেষ্টা করলেন।

 

টং করে গেট খোলার আওয়াজ। আসগর আসছে। কিন্তু ইউসুফ ! ইউসুফ কোথায় গেল।

– ইউসুফ! ইউসুফ!

– স্যার, আমি আসগর। আপনি কাকে ডাকছেন স্যার?

– ও- আসগর। আমার মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যায়।

নিজের ছন্দে কিচেনের দিকে যেতে যেতে আসগর বলল- আজ কী সব্জি করব?

সুরজিতের হঠাৎ ইউসুফের সঙ্গে  একসঙ্গে বসে খেতে ইচ্ছে করল।

– আসগর, ফ্রীজে চিকেন আছে তো?

– আপনি তো রাতে চিকেন খাননা স্যার।

-আজ খাব। হ্যাঁ, শোন। আমি যেমন খাই তেমন রান্না কোর না। তোমরা যেমন ভালবাস, মানে মোগলাই খানা বানাও।

আসগর অবাক হয়ে তাকায়।– স্যার, আপনি তো ওরকম খাননা।শরীর খারাপ হবে।

– কিছু হবে না, তুমি বানাও। আজ তুমি আর আমি একসঙ্গে খাব। সুরজিত ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসলেন। ।

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ