22 Oct

উলটাবুড়ি

লিখেছেন:চমক মজুমদার


অফিসের আইডিতে যখন মেলটা ঢুকলো তখন অফিস আওয়ার শেষ। তবে সরকারী কাজের চাপে বিডিও ও তাঁর কয়েকজন অফিসারকে বেশ রাত পর্যন্ত কাজ করতেই হয়। মেলটা জাতীয় উপজাতি কমিশন থেকে পাঠানো। জাতীয় কমিশন যখন গুরুত্ব দিতেই হবে। চিঠিতে জানানো হয়েছে কমিশনের ফুল বেঞ্চ আগামী পরশু জেলা সফরে আসছেন এবং তারা নির্বাচিত কয়েকজন উপজাতি মহিলার সাথে আলোচনায় বসতে চান। চিঠিতে সেইসব মহিলাদের তালিকা  আছে। বিডিও ময়ূরবাহন সরকার খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন সেই তালিকা। হ্যাঁ আছে। সরলা হেমব্রম, বয়স একাত্তর, বাড়ি এই ব্লকের বড়াফেনী এলাকায়। জঙ্গলঘেরা আদিবাসী অধ্যুষিত ব্লকে উন্নয়নের কাজ কম হয়নি। তবু আমাদের মতো দেশে উন্নয়ন সিস্টেমের ফিল্টারে চুঁইয়ে কতটুকুই বা নীচে এসে পড়ে! ব্লক এলাকায় জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, সবেরই দায়িত্ব নিতে হয় বিডিও সাহেবকে। ময়ূরবাহন জানেন জাতীয় কমিশনের সামনে মহিলাকে হাজির করানো ওর কাছে কোনও সমস্যাই নয়। কিন্তু অভিজ্ঞ আমলা জানেন, তার আগে কীভাবে মহিলাকে পাখি পড়ানো পড়াতে হবে। কিছু খামতি থাকলে এ-কদিনেই ব্যবস্থা নিতে হবে। উন্নয়নের জোয়ারে আদিবাসী সমাজ ভেসে গেছে এটা না দেখাতে পারলে সরকারি কাঠামোতেই প্রশ্ন চিহ্ন পড়ে যাবে। আর একবার কমিশনের কাছে বেফাঁস  মন্তব্য করে দিলে রাজ্যের সরকারের মুখ তো পুড়বেই সাথে ময়ূরবাহনের কেরিয়ারে লাল কালি। অনেক কষ্ট সহ্য করে এতদিন মুখ  বুঁজে বাড়ি থেকে দূরে চাকরি করেছেন ময়ূর। এবার ঘরের কাছে জেলা সদরে পোস্টিং ওকে পেতেই হবে। ময়ূর চান না ওর এই পরিকল্পনায় কোনও আদিবাসী মহিলা জল ফেলে দিক।

কাজটা কীভাবে করতে হবে, সে বিষয়ে বিডিও সাহেব পুঙ্খানুপুঙ্খ জানেন। মোবাইল বের করে বড়াফেনী এলাকার পঞ্চায়েত প্রধানকে ফোন লাগালেন ময়ূর। সবটুকু বুঝিয়ে কালকেই মহিলাকে ওর দপ্তরে হাজির করার নির্দেশ দিলেন।

—সাথে ভোটার কার্ড, আধার কার্ড নিয়ে আসতে বলবেন, বুঝেছেন?

—সব বুঝেছি স্যর। কিন্তু এল্যাকাটা তো নদীর উপাড়ে। ঢুঁনড়তে সময় লাগব্যে। দেখি উহানের মেম্বারকে খপর কর‍্যে।

ছোটো টিলা থেকে একটা জলধারা বেড়িয়ে পঞ্চায়েতের ধার ঘেঁষে কিছুটা এলাকা চিরে চলে গেছে। নদীর নামেই এলাকার নাম। ও পাশে গোটা পাঁচেক গ্রাম। নদীতে জল তেমন থাকে না। লোকজন কাপড় তুলে হাঁটু ডুবিয়েই যাতায়াত করে। এপাশ থেকে অঙ্গনওয়াড়ির দিদিমণি ঘাড়ে সাইকেল তুলে শাড়ি উঁচিয়ে পড়াতে যায়। ওপাশ থেকে বাচ্চাকে কাঁধে চাপিয়ে হাসপাতলে পোলিও খাওয়াতে নিয়ে আসে বাবা। সমস্যা বাড়ে বর্ষাকালে। সরু বড়াফেনী তখন ফুলে-ফেঁপে একসা। পাঁচ  গ্রামের লোকের তখন ছয় কিলোমিটার ঘুরে যাতায়াত। মনে পড়ে গেল ময়ূরের। এতদিনে নিজের ব্লক এলাকাটা হাতের তালুর মতো চেনে ও। বড়াফেনীর উপর একটা ব্রীজের ডিমান্ড উঠেছিল একসময় হালকা করে। আসলে বড়াফেনীর লোকজন সকলেই দিন আনে, দিন খায়। ওদের  হয়ে ডিমান্ড করবেই বা কে? তবে কি যাতায়াত ব্যবস্থা কমিশনারের সামনে ইস্যু হতে পারে? রিস্ক নিয়ে লাভ নেই। কালকেই ব্রিজের ফাইল ইনিশিয়েট করতে বলবেন ইঞ্জিনিয়ারকে—অফিস থেকে বের হতে হতে ভাবতে থাকেন বিডিও ময়ূরবাহন।

সকাল বেলা কাজের চাপটা বেশ থাকে। কাজের চাপে বিষয়টা মাথা থেকে একদম বেড়িয়ে গিয়েছিল ময়ূরবাহনের। জেলা প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে ফোনটা আসার পরই চটকা ভাঙে ওর। ডিএম সাহেব সতর্ক করে দিয়েছেন জাতীয় কমিশনের কাছে যেন কোনও ভাবেই জেলার বা রাজ্যের নাক যেন না কাটা যায়। ফোনে জেলাশাসককে বারবার আশ্বস্ত করেছেন ময়ূর। সাহেবের ফোনটা কাটার পরই শশব্যস্ত হয়ে প্রধানকে ফোনে ধরলেন বিডিও।

—স্যর, ও বুড়িকে গত কয়েকদিন ধ্যরে খুঁইজে লারছি। উ নামে তো কেউ নাই উতা।

—সামান্য একটা কাজ আপনাদের দিয়ে হয় না? কী করেন ওখানে বসে? একটা জলজ্যান্ত মানুষ উধাও হয়ে গেল?

চিৎকার করে উঠলেন ময়ূর। চমকে উঠলেন ঘরে উপস্থিত অন্য অফিসাররা। বিডিও সাহেবকে কখনো এত রেগে যেতে দেখেননি ওরা। বরং ওনাকে নম্র, মিশুকে বলেই জানতেন। গ্রামবাসীদের কাছ থেকে সরাসরি অসুবিধার কথা শোনেন, চাষীদের সাথে একসাথে খেতে বসে যান। এমন মানুষটিকে রেগে যেতে দেখে হকচকিয়ে গেছেন অন্যরা।

কী করবেন ভেবে উঠতে পারছেন না ময়ূর। সামনের অফিসারদের তৎক্ষণাৎ অর্ডার দিলেন—আজ বিকেল পাঁচটায় সব ডিপার্টমেন্টের অফিসারদের বড়াফেনীর ডেভলপমেন্ট নিয়ে আমার ঘরে মিটিং ডাকুন। আর্জেন্ট।

—স্যার, বিকেল পাঁচটায়! তুতলিয়ে প্রশ্ন করেন একজন।

—হ্যাঁ কোনও অসুবিধে?  হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন বিডিও।

ব্লক সদর থেকে জেলা সদরের উদ্দেশ্যে অফিস টাইমের শেষ বাস রওনা দেয় বেলা পৌনে পাঁচটায়। মিস করলে পরের বাস সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায়। সেটা মিস করলে এখানেই থেকে যেতে হবে। তাই শহরের দিকে থাকা কর্মচারীদের চারটে বাজতে না বাজতেই অফিস ফাঁকা করে রওনা দেন। বিডিও সাহেব দেখেও দেখেন না। কিন্তু আজ….। কর্মচারীরা বুঝল সিরিয়াস কিছু। বিডিও সাহেব ফোন লাগালেন পার্টির বড়ো নেতাকে। প্রসাশন চালাতে গেলে অনেক কিছুই করতে হয়। যেভাবেই হোক ওই সরলা হেমব্রমের খোঁজ ময়ূরের চাইই।

বিকেলের মিটিংয়েও অস্থির রইলেন সাহেব। এখনো কোনোভাবেই খবর পাওয়া গেল না সরলা হেমব্রমের। প্রতিটা দপ্তর উন্নয়নের খতিয়ান দিচ্ছে। পানীয় জলের কলটা খারাপ হয়েছে বড়াফেনীর, রিপোর্ট বলছে। স্বাস্থ্য দপ্তর জানাচ্ছে গত সপ্তাহে দুটো বাচ্চার ডায়েরিয়া হয়েছিল, নদী পেরিয়ে হাসপাতালে ভর্তি না করলে সম্ভাবনা ছিল অনেক কিছুর। বিডিওর মাথায় কিছুই ঢুকছে না। মিটিংয়ের মাঝেই থানার ওসিকে ফোনে ধরলেন। সবকিছু জানিয়ে সাহায্য চাইলেন। যেভাবে হোক সরলা হেমব্রমের খোঁজ না পেলে ময়ূরবাহনের কপালে শনি।

মিটিং শেষ হতেই চেম্বারে ঢুকলেন প্রধান সাহেব, সাথে একটা কমবয়সী ছেলে। কালকের পর থেকে এই লোকটাকে দেখলেই মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে ময়ূরের।

—স্যর, ই হুলো ক্যানেল, ক্যানেল হেমব্রম। বড়াফেনীর মেম্বর। দাঁত বার করে লোকটা। মনে হয় পার্টির বড়ো নেতার কাছ থেকে চাপ পড়েছে। বিরক্তিটা বাড়ে ময়ূরের। কথা বলেন না।

—স্যর উই নামে ওহানে কেউ নাই। মুখ খোলে ছেলেটি, হয়তো গ্রামে নতুন ক্যানেল কাটার বছরে তার জন্ম, সেই থেকেই এমন নাম।

রাগ আরো চড়ে যায় বিডিওর। —তাহলে নামটা কি আকাশ থেকে পড়ল?

—বলছি স্যর, কাউরে সাজায়ে লিয়্যে গেইলে হয় না? প্রধানের চোখে উৎসাহ ঝিলিক মারে।

আরো মাথা গরম হয়ে যায় ময়ূরবাহনের। যে কমিশন এত জনের নামের মাঝে একটা নাম বাছাই করে, তাদের কাছে কি এই মহিলা সম্বন্ধে তথ্য নেই? কী ভাবে এরা? কমিশন চাইলে এক মুহূর্তে ময়ূরের চাকরি নট হয়ে যেতে পারে।

এক গ্লাস জল খেলেন বিডিও, সামলে নিলেন নিজেকে কিছুটা। মাথা ঠাণ্ডা করে বললেন—ভোটার লিস্ট খুঁজে বের করো।

এই বুদ্ধিটা কারোর মাথায় আসেনি। দপ্তরের কর্মীরা তাড়াহুড়ো করে খুঁজতে শুরু করে।

—পাওয়া গেছে স্যার। বেশ কিছুক্ষণ পর এক কর্মী ভোটার লিস্ট খুলে এগিয়ে দেয়। এই যে সিরিয়াল ৯৩১।

ভালো করে খুঁটিয়ে দেখেন ময়ূর। নাম ও তথ্য মেলান। তারপর এগিয়ে দেন ক্যানালের দিকে, ছবিতে তর্জনী রেখে বলেন—চেন?

ওর মুখ দেখেই বোঝা যায় সদর্থক নয়। বিডিও মনে মনে বিরক্ত হন—অপদার্থ।

—তবে স্যর, ও গ্রামের মাঝিরা কিছু বইলত্যে পারেন। বলে ক্যানেল প্রধানের মুখের দিকে তাকায়। হয়ত সমর্থন চায়।

—কাল সকালেই আমি ওই গ্রামে যাব। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন ময়ূর।

#

সকাল হতে না হতেই ময়ূরবাহন এসে পড়েছেন বড়াফেনীতে। বসে আছেন গ্রামের মোড়ল মাঝির বাড়ি উঠোনে খাটিয়ায়। সামনে হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে আছে মাঝি। দাওয়ায় বসেছে প্রধান। বাকিরা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে।

—আপনি সরলা হেমব্রমকে চেনেন? এই গ্রামে বাড়ি?

বিডিও-র প্রশ্নের উত্তরে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে মাঝি। হাতের ভোটার লিস্টটা মেলে ধরেন বিডিও, তর্জনী ৯৩১ এ। —একে চেনেন?

ভোটার লিস্টটা চোখের কাছে টেনে নিল মাঝি। উপস্থিত সবার উৎসুক দৃষ্টি মাঝির দিকে।

—ইটা উলটাবুড়ি লয়? ভোটার লিস্টটা আরেকজনের দিকে এগিয়ে দেয় মাঝি।

—হ, ই তো উলটাবুড়ি বট্যে।

ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল, অস্থির হয়ে উঠলেন ময়ূরবাহন। উলটাবুড়ি না কে তাকে নিয়ে ওর কোনো মাথা ব্যাথা নেই। ওর চাই সরলা হেমব্রমকে।

—স্যরকে পুরাটা বলো না, ক্যানে। প্রধান খেঁকিয়ে উঠলো।

ভিড়টা  থেকে যা জানা গেল তা হল—ছবিটা উলটাবুড়িরই। উলটাবুড়ির আসল নাম কী, কেউই মনে রাখেনি। তবে গ্রামের লোকেদের মতামতের উলটো কথা বলে বলেই ওর এমনতর নাম। গ্রামের সব কিছুতে ওর বাগড়া। নদীর জল না খেয়ে টিউকলের জল খাও, খিচুড়ি স্কুলে বাচ্চাদের পাঠাও—গ্রামের সমাজটাকে উল্টো ধারায় বাইতে চেয়েছিল বুড়ি। গ্রামের লোকের ধারণা ও আসলে ডাইন। এমন করে শহুরে বিষ হাওয়া গ্রামের ভিতরে ঢুকিয়ে গ্রামকে নষ্ট করে দিচ্ছিল। শেষে দুটো বাচ্চার বমি পায়খানা হতেই ওঝার কাছে যেতে না দিয়ে নদী পার করে হাসপাতালে পাঠাতেই গাঁয়ের লোকের রোষ গিয়ে পড়ে বুড়ির উপর। রাস্তায় ফেলে মারধর করা হয়। সেই দিনের পর থেকে আর বুড়িকে কেউ দেখেনি।

জঙ্গল-নদী পেড়িয়ে উন্নয়নের ঝাঁ চকচকে রাস্তা বেয়ে এসব খবর সদরে পৌঁছায় না। গ্রাম্য সমাজ নিজের মতো করেই গড়ে নেয় নিজেদের যাপন। এসব খবর কমিশনের কাছে পৌঁছালে কী যে হবে বেশ জানে অভিজ্ঞ আমলা। মিডিয়াও এসব খবর পেলে ছিঁড়ে খাবে। গরীবের ঘরে তোষক ছিঁড়ে ফর্দাফাই হয়ে গেলেও অতিথির সামনে তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় নতুন কাপড়। লুকিয়ে রাখতে হয় দুরবস্থা। ময়ূরেরও তাই অবস্থা। কিন্তু সময় কোথায়!

মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন বিডিও। কী করবেন বুঝে উঠতে পারেন না। কিন্তু এভাবে বসে থাকলে তো হবে না। তাকান প্রধানের দিকে।

—স্যর আমি লোক পঠাইছি, খবর লিচ্ছি।

থানার ওসিকে ফোন করেন ময়ূর। আজকের দিনটাই হাতে। শেষ চেষ্টা করে দেখতে হবে। সম্ভাব্য সব জায়গায় লোক পাঠানো হয়েছে। এ অঞ্চলটা জঙ্গলঘেরা। ময়ূরের মনে হতে লাগলো জঙ্গলটা যেন ওকে খেতে আসছে। জঙ্গলটা এগিয়ে আসছে, দিনের আলো খেতে খেতে।

সারাদিন ক্লান্তিময় খোঁজ চালানোর পর ক্যানেলই দিল খবরটা। পশ্চিমের জঙ্গলের ভিতরে ডেরা বেঁধেছে বুড়ি। আর দেরি করলেন না বিডিও সাহেব। প্রধান, ওসিকে নিয়েই রওনা দিলেন মরা বিকেলে, সামনে ক্যানেল।

পশ্চিমের জঙ্গলটায় ওরা যখন ঢুকছে তখন রাত নেমেছে। আকাশে তারার খেলা। সামনে ক্যানেল টর্চের আলোয় পথ দেখাচ্ছে। অন্ধকারেই তো আসল আলোর সন্ধান পাওয়া যায়। উত্তেজনা বাড়ছে ময়ূরের। সময়ের সাথে সাথে কমছে তারার সংখ্যা। আকাশের দখল নিচ্ছে বড়ো গাছ। একটা বড়ো গাছের তলায় খোঁজ পাওয়া গেল বুড়ির ঝুপড়ির। গাছতলাটা বেশিই অন্ধকার। চারদিকে একটা বোঁটকা গন্ধ। কয়েকটা শুকনো ডাল জড়ো করে ছাদ বানিয়েছে ঝুপড়ির। সামনে আগুন জ্বলছে, ঝলসে যাচ্ছে কিছু একটা। সামনে বসে সময় থমকে রাখা এক নারী, বৃদ্ধার খোলা চুল যেন অন্ধকারকে আরো ডেকে আনছে। সামনের আগুনও তাতে হার মানছে। নারীর হাতে নারকেলের মালায় কিছু তরল। এ অঞ্চলের নেশা করাটা খুবই স্বাভাবিক। পাত্তা না দিয়ে গোড়ালিতে ভর দিয়ে বসলেন ময়ূরবাহন।

—মা, আপনিই কি সরলা হেমব্রম?

প্রশ্নটা নারীকে স্পর্শ করেছে বলে মনে হলো না। স্রেফ ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি। তারপর অস্ফুটে বললেন—উলটাবুড়ি।

থতমত খেয়ে গেলেন বিডিও। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালেন। সবাই দূরত্ব বজায় রেখে নাকে কাপড় দিয়েছেন।

—আমরা আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি। হাল ছাড়লেন না ময়ূর।

কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ। বুড়ি চুমুক দিলো তরলে। ময়ূর দেখল, একটা আধখাওয়া পেয়ারা, একটা ধারালো তীর আর একটা গুলতি। আগুনটা ঝলসে উঠলো।

—বাদরুচ দিখ্যছিস বাবু?

ময়ূর কিছু না বুঝে বসে রইল একইভাবে।

—তুরা ভাবিস উল্ট্যা আছে বট্যে। কিন্তু উ সব সুজা দেখ্যে। সব সুজা। আন্ধারে তো সবচিয়া বেশি দেখ্যে।

—আপনাকে আপনার ঘরে নিয়ে যেতে এসেছি মা। চলুন আমাদের সাথে। আপনার কোনো অসুবিধে আর হবে না মা।

ময়ূর সোজা বিষয়ে চলে আসে। বৃদ্ধাকে না নিয়ে যেতে পারলে ওর চাকরিই সংশয়ে। হাতের মালাটা এগিয়ে দেয় বৃদ্ধা। পরিষ্কার ময়ূরকে পাণীয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে—অর্থাৎ অতিথির সম্মান দিচ্ছে। হাত বাড়িয়ে নেয় ময়ূর। ও কখনো নেশা করেনি, তবে এভাবে প্রৌঢ়ার আত্মবিশ্বাস জিতে ওকে নিয়ে যেতে চায় ময়ূর। বোঁটকা গন্ধটা বেশি করে নাকে ধাক্কা মারলো। উপরের দিকে তাকাল ময়ূর। আকাশ দেখা যায় না। ঘন অন্ধকার। তবে যেন অসংখ্য লাল চোখ ওর দিকে চেয়ে আছে। ততক্ষণে প্রৌঢ়ার হাতে ওঠে আরেকটা তরল ভর্তি পাত্র। ময়ূর তাকালো নিজের হাতের তরলের দিকে। কালচে লাল। চুমুক দিল ও। কশাটে।

—বদরুচ্চের মায়াং আছে মোর শরিলে। হামি আন্ধারেও দেখতে পাই। প্রৌঢ়ার ছুড়ে ফেলা পানীয়র মালা আগুনে পড়তেই ঝলসে উঠল আগুন। মহিলার চুল খোলা, দু হাত বাদুরের ডানার মতো খোলা, মুখের কশ থেকে বেয়ে পড়েছে কালচে লাল তরল।

—স্যার, ফেইল্যে দিন, উটা বাঁদুরের রক্ত। চিৎকার করে উঠল ক্যানাল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন ময়ূর। অট্টহাস্য উঠল সেই প্রৌঢ়া। নারীর সেই হাসি কানের পর্দা যেন ফাটিয়ে দিচ্ছে ময়ূরের। হাতের নারকেলের মালা থেকে তরল মাটিতে পড়ে যায়। আগুনের হলকায় উড়তে থাকে উল্টাবুড়ির সাদা চুল। আকাশ ঢেকে দেওয়া গাছ থেকে ঝুলন্ত বাঁদুরের লাল চোখ ময়ূরকে বিদ্ধ করতে থাকল। ছিটকে আসেন ময়ূর।

সারা জঙ্গল জুড়ে যেন হা হা শব্দে উলটাবুড়ির হাসির প্রতিধ্বনি হতে লাগলো।

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ