ছোটোবেলার বন্ধু-র ব্যাপার-ই আলাদা। সময় বদলালেও তাকে যেন ঠিক চেনা যায়। তার কথাবার্তা, চাল-চলন ইত্যাদি যদি পালটেও যায়, তবু তাকে অন্য পাঁচজনের চেয়ে বেশী নিকটের মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। অনেকটা নিজের ছায়ার মত। দিনের বিভিন্ন সময় রূপগতভাবে পালটে গেলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু সাথে থেকে যায়।
নিবারণ চৌধুরি নিজেকে এই ব্যাপারে খুব ভাগ্যবান মনে করেন। নিবারণবাবু ইদানীং প্রোমোটারি ব্যবসা করে বেশ নাম করেছেন। ব্যবসা পুরোপুরি নিজের নয়, তিরিশ শতাংশের পার্টনার আছে। পার্টনারের নাম জগন্নাথ সাহা। জগন্নাথবাবু নিবারণ চৌধুরির স্কুলবেলার বন্ধু। একসাথে প্রায় বারো-তেরো বছর লেখাপড়া করেছেন এক-ই স্কুল ও কলেজে। তারপর জগন্নাথবাবু নিজের বাবার বালি-সিমেন্টের ব্যবসা দেখতে আরম্ভ করলেন আর নিবারণবাবু মন দিলেন সিভিল সার্ভিসের প্রস্তুতিতে। কিন্তু নিয়তি কেন বাধ্যতে! চাকরির বাজারে বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে শেষ অবধি নিবারণবাবুও ব্যবসায় নিজের ভাগ্যান্বেষণ করতে শুরু করলেন। তা … যে সময়ের কথা বলছি, তখন কলকাতা শহর এরকম ছিল না। তার এখনকার কিউবিক খাঁচাটা তখন সবে তৈরী হচ্ছে। ৯০ এর দশক। সে’কালে চারদিকটা বেশ সুন্দর ছিল। টোটো ছিল না। ল্যান ফোনে ব্ল্যাংক কল আসত নিয়মিত। রাস্তায় ত্রিফলা আলো তখনও আসেনি, গলির মোড়ে মোড়ে টিমটিমে হলুদ আলো নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টের আনাচে-কানাচে অন্ধকার বলে একটা গা-ছমছমে জিনিস ছিল। সন্ধ্যা বা রাত্রে লোডশেডিং হলে গলিতে গলিতে লোক জম’ত, ছাদ থেকে ছাদে আড্ডা চলত। গরমের সময়ে মোমবাতি আর তালপাতার হাতপাখার দারুণ কদর ছিল। বর্ষার সন্ধ্যায় কৌলিন্য ছিল চপ-মুড়ি-কাঁচালঙ্কার। ফাস্টফুডের বাজারে এগরোলের মনোপলি চলত। দুর্গাপুজোয় থিম ছিল না, ছিল শরতের মেঘহীন সকালের মত আনন্দ। আরও কত কী! বলতে গেলে সে’ একটা যুগসন্ধিক্ষণ ছিল। আজ আর সে’সব নেই। কোনো কোনো বইয়ের পাতায়, নাইনটি’স এর হিন্দি সিনেমার গানে আর অনেক রাত্রির পেলব কিছু ঠান্ডা হাওয়াতেই কেউ কেউ তার গন্ধ খুঁজে পান। বিষণ্ণ কিন্তু তরতাজা একটা ঘ্রাণ …
যাই হোক, মূল গল্পে ফেরা যাক। নিবারণবাবু আদ্যন্ত ব্যবসায়ী ছিলেন না। তাই শুরুর দিকে তাঁকে অনেক ঝক্কি আর লোকসান পোহাতে হয়েছিল। মূলধনের সমস্যা ছিল গোড়া থেকেই, তাই সবার সাথে কাজ করতে পারতেন না। তাছাড়া কাঁচামাল যোগাড়ের অসুবিধা ছিল সাংঘাতিক। তাই ব্যবসাটা ঠিক জমছিল না।
এইরকম সময়ে একদিন হাওড়ার কাছে কি একটা কাজে নিবারণবাবুকে যেতে হয়েছিল। বিকেলে ফেরার পথে তাঁর হঠাৎ দেখা হয়ে গেল জগন্নাথবাবুর সাথে। দুজনে দেখামাত্র চিনে ফেললেন দুজনকে। তারপরে গিয়ে বসলেন একটা মাঝারি মাপের চায়ের দোকানে।
অল্প কথার পরেই জগন্নাথবাবু বলেছিলেন, ‘কি করছিস এখন?’
সেদিন ছোটবেলার বন্ধুকে দেখে নিবারণবাবু এতটাই আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন যে শুধু ব্যবসা করার কথা-ই নয়, ব্যবসা করতে গিয়ে তিনি যেসব অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন সেগুলোও এক ধাক্কায় বলে ফেললেন। জগন্নাথবাবু হালকা ঘাড় নেড়ে একবার ‘হু’ বলে চা খেতে লাগলেন নিঃশব্দে। সব শুনে তিনি একবার বললেন, ‘ব্যবসা করা অত সোজা নয় হে নিবারণ! … তার উপর তোমার মত ভোলা-ভালা লোক হলে তো আর কথা-ই নেই …’
এরপরে টুকটাক এদিক-ওদিকের কথা চলতে লাগল। জগন্নাথবাবুকে একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল মাঝেমধ্যে। কয়েক মিনিট বাদে যখন চা প্রায় কাপের তলানিতে এসে ঠেকেছে তখন জগন্নাথবাবু হট করে একটা প্রস্তাব দিয়ে বসলেন নিবারণবাবুকে। বললেন, ‘বলছি যে, আমরা কি ব্যবসাটা একসাথে করতে পারি? মানে … মাল আমার, কাজ তোর। আমায় খালি পার্টনার করে নে। ব্যস! …… অ্যাঁ, কি বলিস?’
নিবারণবাবু এর জন্য একেবারেই তৈরী ছিলেন না। কথাটা শুনে তিনি দারুণ আনন্দিত হয়ে পড়লেন। একে ছোটবেলার বন্ধু, তার উপর অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী। এছাড়াও এই পার্টনারশিপ হলে তাঁর কাঁচামালের যোগান নিয়ে আর ভাবতে হবে না। এ তো দারুণ প্যাকেজ! বর্তমান পরিস্থিতিতে এতে রাজী না হওয়া তো চরম মূর্খামি হবে!
সে-ই থেকে নিবারণবাবু আর জগন্নাথবাবু পার্টনারশিপে ব্যবসা চালাচ্ছেন। জগন্নাথবাবু যোগ দেওয়ার পরে সারা কলকাতায় নিবারণ চৌধুরির কোম্পানির বেশ নামডাকও হয়েছে। শহরের অনেক বড়মাপের প্রোজেক্ট এখন তাদের হাতে। এর জন্য জগন্নাথবাবুর বিচক্ষণতা এবং তাঁর পরিচিত অনেকরকম কনট্যাক্টস নিবারণবাবুর সততা আর পরিশ্রমের চেয়ে কম দায়ী নয়। সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রচুর লোকের সাথে চেনা-জানা আছে জগন্নাথবাবুর। যোগ্য কাজের জন্য যোগ্য কর্মী বাছতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। নিবারণ চৌধুরির ব্যবসায় অংশ নেওয়ার পর থেকে জগন্নাথবাবুকেও বেশ খুশি বলেই মনে হয়। তিরিশ পারসেন্ট-এর অঙ্কটা নিয়ে তিনি একেবারেই যেন চিন্তিত নন। নিজের ব্যবসার মত কাজ করেন। ওদিকে নিবারণবাবুও নিশ্চিন্ত। ছোটবেলার বন্ধুকে নিয়ে, তাঁর কাজ বা তাঁর চরিত্র নিয়ে তাঁর মনে কোনো শঙ্কা নেই। একদম আদর্শ পার্টনারশিপ যাকে বলে!
তখন পুজো আসতে মাসখানেক মোটে বাকী। জগন্নাথবাবু একদিন কোথা থেকে যেন খবর আনলেন যে উত্তর কলকাতার ভেতর দিকের এক জায়গায় একটা তিনতলা বাড়ি অর্ধেক তৈরী হয়ে পড়ে আছে প্রায় পাঁচ-ছ’ বছর ধরে। সেই বাড়ি তৈরী হওয়ার সময় সব নিয়মকানুন নাকি মানা হয় নি, শেষে পুরসভা ‘বেআইনি নির্মাণ’ তকমা দিয়ে কনস্ট্রাকশন আটকে দেয়। সেই থেকে বাইরের ইটের তৈরী কঙ্কাল আর অনেকগুলো বাঁশের ঠেকনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই বাড়িখানা। খবর পেয়ে জগন্নাথবাবু লোক পাঠিয়েছিলেন জমির মালিকের কাছে। সে ওই এলাকাতেই থেকে। খুব গরীব নয়, কিন্তু বড়লোকও নয়। তার বক্তব্য হচ্ছে, ওটা একটা আবাসন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হয়নি। জমি তো গেছেই, পাওনা টাকার পুরোটাও সে পায় নি। পুনর্নির্মাণের অনেকরকম চেষ্টা করে সে ব্যর্থতা মেনে নিয়েছে। যারা বাড়িটা বানানো শুরু করেছিল অসুবিধা বুঝে তারাও এখন বেপাত্তা। এখন বাড়িখানা তৈরী হলে সে বাঁচে! দুইখানা ফ্ল্যাট আর বাদবাকী প্রাপ্য বিশ লাখ টাকা হলেই তার হয়ে যায়। এদিকে ওই এলাকাটা যে পুরসভার আওতায় পড়ে, তার বর্তমানের এক বড় অধিকর্তার সঙ্গে জগন্নাথবাবুর নাকি ইতিমধ্যেই কথা হয়ে গেছে। দশ লাখের বিনিময়ে ওই বাড়ি ‘বৈধ’ হয়ে যাবে। সাথে সাথে সমস্ত কাগজে নির্মাণসংস্থা হিসেবে আগাগোড়া নিবারণবাবুদের কোম্পানির নাম চলে আসবে।
ব্যাপারটা শুনলেন নিবারণবাবু। ঘুষ দিয়ে বেআইনি কাজ করা তিনি খুব একটা পছন্দ করেন না। প্ল্যান ফুল প্রুফ নয়, তার উপর বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এ’সবে পরের দিকে ঝঞ্ঝাট বাড়ে। তাছাড়া শুরুতেই একটা তিরিশ লাখের গল্প রয়েছে। পরে উনিশ-বিশ হলে টাকা, সুনাম দুটো-ই যাবে। বাড়তি দুশ্চিন্তার হিসাব তো আলাদা। নিবারণবাবু প্রস্তাবটায় সায় দিলেন না। কিন্তু সরাসরি ‘না’-ও করতে পারলেন না।
বন্ধুর দোটানাভাবটা আন্দাজ করে নিয়ে জগন্নাথবাবু মৃদু হেসে নিবারণবাবুকে বললেন, ‘ঠিক আছে। ভেবে দ্যাখো। তবে, আমি বলি কি, একবার বাড়িটা গিয়ে দেখে আসতে ক্ষতি কি? তিরিশ লাখের বদলে বাড়তি ষাট-সত্তর লাখ কামানো যাবে ওই বাড়ি থেকে। একটু ভেতরে হলেও লোকেশন কিন্তু দারুণ! তাছাড়া আমার কাছে পাকা খবর আছে, ওই এলাকায় এরকম আরও কিছু বাড়ি জাস্ট পড়ে রয়েছে! একটা দিয়ে শুরু করে ধীরে ধীরে পুরো এলাকাটার উপর দখল জমাতে পারলে বুঝতে পারছ তো কতটা লাভ হতে পারে? … একবার গিয়েই দ্যাখো না! আমিও তো যাব তোমার সাথে … ’
কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বাড়িখানা ঘুরে আসতে রাজী হলেন নিবারণবাবু। তাঁর প্রস্তাব ছিল যে একদিন বাদেই শণিবার, ওই দিন সকালবেলায় একবার গিয়ে ঘুরে আসলে হয়। কিন্তু জগন্নাথবাবু বললেন যে ও’দিন সকালে তাঁর কিছু ব্যক্তিগত কাজ রয়েছে, কিন্তু সন্ধ্যেবেলা যাওয়া যেতেই পারে। শেষ পর্যন্ত শণিবার সন্ধ্যেবেলায় যাওয়া-ই ঠিক হল।
সেদিন-ই ব্যবসার কাজ সেরে নিজের অ্যাম্বাসাডার গাড়ি করে ফেরার সময় একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল নিবারণবাবুর। তখন রাত নামতে বেশী দেরী নেই। আকাশের রঙ গোলাপী অতিক্রম করে কিছুটা বেগুনির দিকে ঢলে পড়েছে। সেপ্টেম্বরের এই শুরুর দিকের দিনগুলোর এই সময়ের আকাশটার একটা যাদু আছে বলতে হবে। কেমন যেন সম্মোহন জানে। দেখতে দেখতে মনে হয়, ওটার ঠিক পেছনেই খুব প্রিয় কেউ বা প্রিয় কিছু জিনিস, যে বা যারা হয়ত চিরকালের মত হারিয়ে গেছে, অথবা হয়ত কোনোদিন আসে-ই নি — তারা দাঁড়িয়ে আছে। আর ওদের ভালোবাসার আলো-ই ঠিকরে পড়ছে ছড়ানো-ছেটানো মেঘগুলোতে। আজও আকাশের দিকে চোখ পড়ে যেতেই মনটা উদাস হয়ে গেল নিবারণবাবুর। তাঁর মনে হল, জীবন কত তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে! … কত কী-ই তো হারিয়ে গেছে। কিন্তু এই আকাশ এখনও অবিকল … তাঁর শেষদিনেও হয়ত এমন-ই থাকবে …
কয়েক সেকেন্ড বাদে ঘোর কাটিয়ে নিজের গাড়িতে উঠে বসলেন নিবারণ চৌধুরি। তিনি নিজেই ড্রাইভ করেন। কয়েক সেকেন্ডের মাথায় গাড়ি চলতে লাগল। গতি মাঝারি, ষাটের কাছাকাছি। তবে অল্প কিছুক্ষণ যাওয়ার পরেই গাড়ি থামাতে বাধ্য হলেন নিবারণবাবু। সামনের অপ্রশস্ত রাস্তায় জ্যাম লেগেছে। কতক্ষণ এভাবে দাঁড়াতে হবে কে জানে! দেখে মনে হচ্ছে … সময় লাগবে কিছুটা। এই এক ঝামেলা শহরের! বিরক্তিকর! … ইঞ্জিন বন্ধ করে স্টিয়ারিং ধরে কয়েক সেকেন্ড বসে রইলেন নিবারণ চৌধুরি। তারপর ডানদিকের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে আলগোছে তাকাতেই তার চোখ পড়ল একটা লোকের উপর। রাস্তায় এখন দিনের আলো প্রায় নেই বললেই চলে। অথচ অন্ধকারটাও পুরোপুরি নামতে পারেনি, একটু যেন হলদেটে ভাব লুকানো আছে তার ভেতরে। এরকম একটা পরিবেশে একটা সরু মতন গলির মুখে শীর্ণ একটা উঁচু গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে সেই লোকটা। গলির মুখে কৃত্রিম আলোর অভাবের দরুণ লোকটার মুখ খুব স্পষ্ট না হলেও তাঁর চোখ যে নিবারণবাবুর দিকেই নিবদ্ধ — নিবারণ চৌধুরির পক্ষে সেটা অনুমান করা খুব কঠিন হল না। কিন্তু সেদিকে কয়েক পলক দেখতেই মনটা কেমন যেন ধক করে উঠল নিবারণবাবুর।
… অশোক না??! … হ্যাঁ … সেইরকম-ই তো লাগছে। সে-ই চেহারার গঠন, একটু হেলে দাঁড়ানোর কায়দাটা, মাথার অল্প খাড়া-খাড়া বড়-বড় চুল … সর্বনাশ! বেশ ঘাবড়ে গেলেন নিবারণবাবু। সেকি! … এ এখানে এল কোথা থেকে? … আবার তাকিয়েও আছে মনে হচ্ছে… চিনতে পারলে কি হবে?! … এখন নিবারণবাবু আর বেকার নন, তিনি এখন নিজের গাড়িতে সওয়ার। পকেটে টাকার ব্যাগটা বেশ ফুলে রয়েছে। তাছাড়া হাতের আংটি, গলার চেইন … তাই অশোক আজ চিনে ফেললে তাঁর কোনো অজুহাত আর খাটবে না। মুখ ঘুরিয়ে নিলেন নিবারণবাবু। মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলেন যেন জ্যামটা সরে যায়। লাভ কিছু হবে না জেনেও দু-একবার অধৈর্যের বশে হর্ন-ও দিয়ে ফেললেন। কিন্তু ছটফট করতে করতেও নিজের অজান্তে বারবার বাইরের সেই লোকটার দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল তাঁর। সরাসরি না তাকালেও চোখের কোণ দিয়ে এক-আধবার তাকিয়ে নিচ্ছিলেন নিবারণবাবু। হাইট মাঝারি… ফ্যাকাসে নীল একটা ইস্ত্রি-না-করা হাফশার্ট, অফ হোয়াইট ফর্মাল প্যান্টস … এই রে! এ তো আবার হাত নাড়ছে দেখি! সর্বনাশ! এগিয়ে আসবে নাকি? … তাহলে তো এ নির্ঘাত অশোক! কি হবে এবার?! প্রচন্ড অস্বস্তিতে পড়লেন নিবারণবাবু। লোকটা কিন্তু এগিয়ে এল না। খালি একভাবে দাঁড়িয়ে থেকে খুব ধীরে ধীরে ডান হাতের তালুটা নাড়তে লাগল ‘টা-টা’ করার ভঙ্গিতে। একটু ভালো করে দেখার চেষ্টা করলেন নিবারণবাবু। … নাহ! বাকীটা মোটামুটি বোঝা গেলেও লোকটার মুখ পুরো বোঝা যাচ্ছে না। মুখটা যেন একটা অর্ধস্বচ্ছ পর্দা দিয়ে ঢাকা। এ কি তাহলে অন্য কেউ? … কিন্তু হাত নাড়ছে … আর এত মিল তো আর কারোর চেহারায় …
এমন সময় পেছনের গাড়িটা সজোরে হর্ন মারতেই চমক ভাঙল নিবারণবাবুর। সামনে তাকাতেই তিনি দেখলেন, জ্যাম খুলে গেছে, আর যে গাড়িগুলো এতক্ষণ তার ঠিক নাকের আগে দাঁড়িয়ে ছিল সেগুলো এর মধ্যেই এগিয়ে গেছে বেশ কিছুটা। পেছনের গাড়িটা আসলে হর্ন দিয়ে নিবারণবাবুকেও এগোতে বলছে। ব্যাপার বুঝে দ্রুত ইঞ্জিন স্টার্ট দিলেন নিবারণবাবু। তারপর গাড়ি চালিয়ে দিলেন। একটু শান্ত হলেন মানসিকভাবে। বাঁচা গেল! … লোকটা আছে এখনও? একটু এগিয়ে জানলা দিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে বাইরে তাকাতেই তিনি দেখলেন, সে-ই নিশ্চল লোকটা তখনও সেই গলির মুখটায় দাঁড়িয়ে সম্ভবত একটু অ্যাঙ্গেল পালটে নিয়ে এক-ইরকমভাবে নিবারণবাবুর গাড়ির দিকে তাকিয়ে নিজের ডানহাতটা অবিরামভাবে নেড়ে চলেছে। ভঙ্গিটা এমন যেন তাঁকে বলছে ‘টা টা’ …
বাড়ি ফিরেও চিন্তাটা ছাড়তে পারলেন না নিবারণবাবু। …… সে-ই অশোক!! … এতগুলো বছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু আজও অশোকের কথা মনে আছে নিবারণবাবুর। অশোক তার আর জগন্নাথবাবুর ছোটবেলার একসময়ের সহপাঠী ছিল। ঠিক বন্ধু বলা চলে না তাকে। স্কুলে থাকাকালীন অশোক ছিল যেমন বদমাশ তেমনি মস্তানটাইপের ছেলে। একটু কালোর দিকে গায়ের রঙ, বয়স্কদের মত মোটা কণ্ঠস্বর, মাথায় খাড়া-খাড়া বড়-বড় চুল, প্যান্টসের উপর দিয়ে বের করা অবিন্যস্ত হাফহাতা স্কুলের শার্ট— সেটারও আবার হাতা একটু ফোল্ড গোটানো। ক্লাসের বাইরে কখনও-সখনও রিস্টে একটা সবুজ রুমাল পেঁচিয়ে ঘুরে বেড়াত সে। পুরো সেকালের মস্তান-লুক। স্কুলে অশোক কোনোদিন পড়া করে আসত না, ক্লাসে অসভ্যতা করে শাস্তি পেত নিয়মিত। পরীক্ষায় পাশ করত কালেভদ্রে। সকলেই জানত, অশোক লুকিয়ে বিড়ি খায়। কিন্তু সে খুব গরীব আর অনাথ হওয়াতেই হয়ত স্কুল থেকে তাকে তাড়ানো হত না, শুধু হুঁশিয়ারি দিয়েই ছেড়ে দেওয়া হত। এই অশোকের নজর পড়েছিল নিবারণবাবুর উপর। নিবারণবাবুর বেশ খারাপ স্মৃতি ওই ছেলেটা। প্রথম প্রথম তাঁর টিফিন খেয়ে-ই শান্ত থাকত অশোক। কিন্তু ক’দিন পর থেকে-ই সে পয়সা চাইতে লাগল নিবারণবাবুর কাছ থেকে। নিবারণবাবু বিবাদে যেতেন না, খালি দূরে-দূরে থাকতেন। অশোককে খুব ভয় পেতেন তিনি। জগন্নাথবাবুও সে’কথা জানতেন। ভাগ্যিস সেকশান আলাদা ছিল তাদের আর অশোকের! তবে অন্যান্য ছেলেদের সাথে মারামারি,ঝগড়া, গালাগালি-র সম্পর্ক থাকলেও নিবারণবাবুর সাথে কখনও দুর্ব্যবহার করেনি অশোক। খালি দেখতে পেলেই এক গাল হেসে বলত, ‘ও বন্ধু, দুটো টাকা দে না ভাই! ঝালমুড়ি খাব।’ নিবারণবাবু কোনোরকমে মুখে একটু হাসি এনে বলতেন, ‘আজ তো নেই … যেদিন থাকবে — অবশ্যই দেব।’ এইটুকু বলেই প্রচন্ড দ্রুত হেঁটে একরকম পালিয়ে যেতেন তিনি। অনেকসময় পেছন থেকে শুধু হাসির আওয়াজ শোনা যেত অশোকের। আবার অনেক সময় সে বলে উঠত, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোর টাকা হলেই দিস বন্ধু … সময় হলে অশোক ঠিক চলে আসবে নিতে … ’
এরকমভাবে বেশ কিছু বছর কেটে গিয়েছিল। ক্লাস নাইনের পরীক্ষায় অশোক বাজে ভাবে ফেল করল। হেডস্যার অশোকের লোকাল গার্ডিয়ানকে ডেকে সাফ জানিয়ে দিলেন যে মাধ্যমিকের জন্য যে প্রি-টেস্ট নেওয়া হবে তাতে যদি অশোক পাস করতে না পারে তাহলে আর তাকে স্কুলে রাখা সম্ভব হবে না। কিন্তু অশোকের কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। শেষপর্যন্ত সে প্রি-টেস্টেও আটকে গেল। হেডস্যার তাঁর কথা রাখলেন। শেষ যেদিন নিবারণবাবু অশোককে স্কুলে দেখেছিলেন সেদিন সে টি.সি. নিতে এসেছিল। নিবারণবাবুকে দেখে সে আগের মতই হেসে বলেছিল, ‘চলি বন্ধু। তবে … পরে একদিন ঝালমুড়ির পয়সা নিতে ঠিক আসব কিন্তু! সেদিন কিন্তু আর ‘নেই’ বললে হবে না …’ অশোকের হাসির বদলে ছোট্ট করে হেসেছিলেন নিবারণবাবু। ভেবেছিলেন, বেশ হয়েছে! যাক, এতদিনে আপদ বিদায় হল তাহলে! এর পরে কম-বেশী প্রায় পনের-ষোলো বছর পার হয়ে গেছে। আর কখনও অশোককে দেখেন নি নিবারণ চৌধুরি। ফের দেখলেন আজ। হয়ত।
রাতের খাওয়া সারা হল। জগন্নাথবাবুকে একটা ফোন লাগালেন নিবারণবাবু। জগন্নাথবাবু ফোন তুলতেই নিবারণবাবু সোজাসুজি বললেন, ‘জগন্নাথ, তোমার অশোককে মনে আছে?’
জগন্নাথবাবু একটু বিস্ময়ের সুরে বললেন, ‘অশোক? … কোন অশোক?’
— ‘আরে সেই স্কুলে পড়ত না! লোফারটা! … ’
— ‘স্কুলে পড়ত? … অশোক?! … না ……… ও ও ও … হ্যাঁ, মনে পড়েছে। হ্যাঁ হ্যাঁ, অশোক … স্কুলের পর তো আর দেখিনি… মনে ছিল না… তা কি হল? অশোকের কোনো খবর আছে নাকি?’
—- ‘না … খবর নেই। কিন্তু আজ যেন রাস্তায় ওকে দেখলাম জানো! … আসার পথে, একটা ঘুপচি গলির মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। আবার আমায় গাড়িতে দেখে আবার হাত নাড়ছিল মনে হল …’
ফোনের ওপার থেকে জগন্নাথবাবুর হাসির শব্দ ভেসে আসল। তিনি বললেন, ‘তুমি এখনও ভয় পাও অশোককে? … সত্যি! হা হা হা হা … আরে ধুর! দেখলে দেখেছ! তো কি হয়েছে?! তোমার বাড়ি থোরাই চেনে ও! আর চিনলেও ভয়ের কিছু তো নেই। আর ওটা যে অশোক-ই তার কি গ্যারান্টি? সে লোক তো অন্য কাউকে দেখেও হাত নেড়ে থাকতে পারে … আর যদি অশোক হয়-ও … তা তুমিও সেই সুবোধ খোকা নেই, আর ও-ও হয়ত পালটে গেছে। মানুষের পরিবর্তন তো হয়-ই! … তুমি অহেতুক ভেবো না … যাক গে, পরশু যাচ্ছ তো? সন্ধ্যে সাতটায়? ’
— ‘সে নাহয় যাব। কিন্তু কি আজব ব্যাপার দ্যাখো জগন্নাথ, লোকটা যদি অশোক-ই হয় তাহলে দারুণ দৃষ্টি আর স্মৃতিশক্তি বলতে হবে! … এতগুলো বছর পরে… তাও গাড়ির ভেতরে বসে থাকা আমায় দেখে ওভাবে হাত নেড়ে …’
— ‘আহা! তুমি অকারণ চিন্তা করছ ব্যাপারটা নিয়ে। বললাম তো যে ওই লোকটা যে অশোক তার কি প্রমাণ আছে? … অন্য কেউ হয়ত অন্য কাউকে দেখে হাত নেড়েছে আর টেনশান করছ তুমি! … ওসব ছা’ড়, শুয়ে পড়। সামনে আমাদের অনেক কাজ! এসব তোমার এখন না ভাবলেও হবে। … বুঝলে?’
‘হ্যাঁ’ আর ‘গুড নাইট’ বলে ফোনটা নামিয়ে রাখলেন নিবারণবাবু। জগন্নাথবাবু ঠিক-ই বলেছেন। সময়, পরিস্থিতি সব-ই বদলে গেছে। মানুষ-ও হয়ত পালটে গেছে। হয়ত ওটা অশোক ছিল-ই না। আর যদি অশোক হয়েও থাকে আর নিবারণবাবুকে চিনেও থাকে, হয়ত বা সে পুরোনো বন্ধুকে দেখেই সে সহৃদয়তা আর সৌজন্যের হাত নেড়েছে। হতেই পারে। সত্যি-ই তো, এতে এত ভাবার কি আছে? সামান্য হালকা মনে বিছানায় গিয়ে শুলেন নিবারণবাবু। অন্যান্য দিনের মত আজও তাঁর ঘুম আসতে বেশী দেরি হল না।
পরের দিন অফিসে গিয়ে নিবারণবাবু দেখলেন, জগন্নাথবাবু তখনও আসেন নি। তিনি আসলেন একটু বেলার দিকে। হয়ত সেই ব্যক্তিগত কাজ সারতে গিয়েছিলেন। নিবারণবাবু তাঁকে কিছু বললেন না। দিনটা নির্বিঘ্নে-ই গেল।
রবিবার অফিস বন্ধ। তাই শণিবার সব কাজ গুছিয়ে উঠতে উঠতে বিকেল গড়িয়ে গেল। নিবারণবাবু তাও আগে কাজ মিটিয়েছেন, জগন্নাথবাবুর দেরী হয়ে গেল। বেরোবার আগে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলতে লাগালেন প্রায় পাঁচ মিনিট। সত্যি! ব্যবসার কাজে হাজার ঝক্কি! … শেষমেশ বাইরে বেড়িয়ে দুই বন্ধু দেখলেন, আকাশ বেশ মেঘলা। শরৎকালে এরকম হয়েই থাকে, নতুন কিছু নয়। দু’জনেই গাড়িতে উঠে বসলেন। ঠিক হল, আজ চালাবেন জগন্নাথবাবু। রাস্তা তাঁর চেনা। নিবারণবাবু কোনো আপত্তি করলেন না।
কুমোরটুলির দিকটা পার করতে করতেই আচমকা বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেল। গাড়ি আছে বলে নিবারণবাবু বিশেষ চিন্তা করলেন না। জগন্নাথবাবু সামান্য উসখুস করতে লাগলেন। তাঁর ‘এহে! বৃষ্টি নেমে গেল?! … যাচ্ছেতাই ওয়েদার হয়েছে আজকাল… যা তা…’ কথাগুলোতে তাঁর অস্বাচ্ছন্দ্যটা বেশ স্পষ্ট হয়ে পড়ছিল। নিবারণবাবু একসময় বলে-ই বসলেন, ‘আরে, গাড়ি আছে তো! … চিন্তা কি তোমার?’ জগন্নাথবাবু একটু আমতা-আমতা করে বললেন, ‘না … মানে … ছাতা আনিনি কিনা! বাড়ি ফেরার সময় …’ নিবারণবাবু ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দেওয়ার মত বললেন, ‘আরে, এ কি কথা! তোমায় বাড়িতে নামিয়ে তবেই তো ফিরব। … ওহ! তুমিও পা’র বটে জগন্নাথ!’ জগন্নাথবাবু তাও যেন নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। গাড়ি চালাতে চালাতেও মুখটা গম্ভীর করে রইলেন। মনে মনে একটু খুশি-ই হলেন নিবারণবাবু। এতদিনের পরিচয়, এমনকি বিজনেসে গুরুত্বপূর্ণ পার্টনার — তা সত্ত্বেও মুখ ফুটে সাহায্য দাবী করতে কুণ্ঠাবোধ করছেন জগন্নাথবাবু। এরকম লোক এখনও আছে? … নাহ! ছোটোবেলার বন্ধু-র ব্যাপার সত্যি-ই আলাদা।
জায়গাটাতে পোঁছোতে পৌঁছোতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। মেঘের জন্য আজ আলো চলে গেছে তাড়াতাড়ি। আজকেও ট্র্যাফিক ছিল। তবে একটু হালকা। কাঁচ-তোলা জানালা দিয়ে তবে আজ আর কাউকে রাস্তায় দেখতে পান নি নিবারণবাবু। এর মধ্যেই বৃষ্টি থেমে গেছে। তবে মেঘ হালকা গুরগুর করে চলেছে।পরে আবার হয়ত নামবে। দু’-তিনটে গলি ঘুরে একটা বেশ ফাঁকা জায়গার সামনে গাড়ি থামালেন জগন্নাথবাবু। তারপর ইঞ্জিন অফ করতে করতে নিবারণবাবুকে বললেন, ‘নিবারণ, চলে আ’স। এসে গেছি।’
গাড়ি থেকে নামলেন দু’জনে। প্রায় সাথে-সাথেই একখানা মোটরসাইকেল তাদের পাশ দিয়ে মাঝারি স্পিডে বেরিয়ে গেল। হয়ত কাছাকাছি-ই কোথাও থামবে। সেটার আওয়াজটা থেমে যেতেই নিবারণবাবু বুঝতে পারলেন, এলাকাটা অস্বাভাবিক চুপচাপ। বাড়িঘর আছে, কিন্তু একটু ছড়ানো-ছেটানো আর সামান্য দূরে-দূরে। ফাঁকা রাস্তা। রাস্তায় আলোও খুব বেশী নেই। কেমন কালো,ধূসর আর স্ট্রিটপোস্টের বাল্বের আলোর হলদে রঙ দিয়ে তৈরি পুরো জায়গাটা। কিন্তু সামনের দিকে তাকাতেই চোখ দুটোর একটু মিশ্র প্রতিক্রিয়া হল নিবারণবাবুর। ঠিক-ই আছে, কিন্তু জগন্নাথ যতটা বলছিল ততটা বিশাল কি জায়গাটা? ত্রিশ-চল্লিশ ফুট দূরে ‘বাড়ি’ বলতে যেটা দাঁড়িয়ে রয়েছে সেটা হচ্ছে কোন বাড়ির কাঠামো বা কঙ্কালমাত্র। আলো কম থাকায় পরিষ্কার দেখাও যাচ্ছে না সবটা। কিন্তু যেটুকু যাচ্ছে তা থেকেই বাড়িটার ভবিষ্যৎ চেহারাটা বুঝে নিল নিবারণবাবুর অভিজ্ঞ চোখজোড়া। মোটের উপর ভালো প্রসপেক্ট কিন্তু! এখন মোটে আড়াই তলা মত বানানো হয়েছে, কিন্তু আধখানা পাঁচিল দেওয়া হলেও সামনে যা জমি রয়েছে অনায়াসে চার-পাঁচ তলা বানানো যেতে পারে যদি ভিত সেরকম থাকে। তাছাড়া ছোট একটা পার্কও হয়ত হয়ে যাবে টেনে-টুনে। প্যাকেজ বাড়বে। কিন্তু এলাকাটা একটু ভেতর দিকে, খুব শুনশান-ও। অবশ্য তাতে খুব অসুবিধা নেই। ‘শহরের কোলাহল থেকে দূরে’, ‘নিরিবিলি পরিবেশ’ ইত্যাদি গুলগাপ্পা মেরে মার্কেটিং করে দেওয়া যাবে। আর একবার ফ্ল্যাট জমে গেলে এলাকার চেহারা বদলাতে সময় লাগবে না। তাছাড়া এই বাড়িটার কাছাকাছি অন্তত দুটো লড়ঝড়ে বাড়িও অন্ধকারে মোটামুটি চোখে পড়ল নিবারণবাবুর। নাহ … জগন্নাথবাবুর খবর একেবারে ভুল নয়। নিজেদের তৈরী একাধিক বিরাট হাউজিং কমপ্লেক্স যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন নিবারণবাবু।
— ‘কি? … কেমন?’
জগন্নাথবাবুর প্রশ্নে ঘোর কাটল নিবারণবাবুর। তিনি বলে উঠলেন, ‘ও ও … হ্যাঁ… দারুণ। দারুণ প্রসপেক্ট বেছেছ জগন্নাথ। কিন্তু ঘুষ দিয়ে বেআইনি কাজ করাটা কি ঠিক হবে? …’
নিজের হাতঘড়িতে সময় দেখতে দেখতে জগন্নাথবাবু বললেন, ‘ও নিয়ে তুমি ভেবো না। সব জায়গায় আমার লোক আছে। আমি প্ল্যান করে নিয়েছি … সব।’ কথাগুলো শেষ হওয়ার পরেই তিনি একটু ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘নিবারণ, তুমি কিছুক্ষণ গাড়িতেই বসো। আমি একটু গিয়ে দেখি মালিকের কাছ থেকে বাড়ির ভেতরে ঢোকার চাবি যোগাড় করতে পারি কিনা! তোমার যাওয়ার দরকার নেই এখন, আমি গেলেই হবে। চাবিটা আগে পাই, তারপর নাহয় একসাথে ভেতরটায় যাওয়া যাবে’খন … দাঁড়াও, গাড়িটা খুলি … ’ এই বলে গাড়ির দরজাটা খুললেন জগন্নাথবাবু। অন্যপাশ দিয়ে নিবারণবাবুও ব্যাকসিটে উঠে বেশ গুছিয়ে বসলেন। অচেনা এলাকায় একা-একা রাস্তায় দাঁড়ানো ঠিক নয়। তাও রাত্রি বেলা। আর কিছু না হলেও, রাস্তার বাউন্ডুলে কুকুরগুলো তো আছেই। গাড়ির ভেতরটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে নিজের হাতব্যাগটা বনেটের কাছ থেকে তুলে নিলেন জগন্নাথবাবু। তারপর গাড়ির দরজাটা সশব্দে ভেজিয়ে দিয়ে নিবারণবাবুর উদ্দেশ্যে একবার হাত তুলে ‘বস, আমি আসছি’ বলে বেশ চটজলদি পা চালিয়ে সেই বাড়িটার সামনের রাস্তাটার একটা বাঁকে মিলিয়ে গেলেন। যেতে যেতে হাতব্যাগ থেকে একটা টর্চ বার করে বাড়িটার দিকে কেন-জানি দুইবার আলো মারলেন তিনি। কয়েক সেকেন্ড সেদিকে তাকিয়ে রইলেন নিবারণবাবু। একটু পরেই আবার একটা মোটরবাইকের আওয়াজ ভেসে এল। নিবারণবাবুর মনে হল,যেদিকে জগন্নাথবাবু গিয়েছেন, শব্দটা যেন সেখান থেকেই আসছে। সেটা অবশ্য দূরে মিলিয়ে যেতে খুব সময় নিল না। আরোহী ফিরে গেল মনে হয়। তারপর ফের সব চুপচাপ। একটা নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে শরীর এলিয়ে দিলেন তিনি।
সারাদিন খাটনি কম হয় নি। তার মধ্যে বৃষ্টির ঠান্ডা-ঠান্ডা হাওয়া আর চারদিকের নৈঃশব্দের জন্যই হয়ত সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখ লেগে গিয়েছিল নিবারণবাবুর। কখন-যেন আচমকা চারপাশ থেকে একটা ঝমঝম শব্দ ওঠায় তন্দ্রা কেটে গেল তাঁর। আবার বৃষ্টি নেমেছে। এবার বেশ জোরে। কিন্তু … জগন্নাথবাবু কোথায়? এখনও আসেন নি কেন? এসে যাওয়ার কথা। ঘড়িতে সময় দেখলেন নিবারণবাবু। সাতটার কাছাকাছি। বাবা! আধাঘন্টা হতে চলল এখানে এসেছেন তাঁরা। তিনি এতক্ষণ ঘুমালেন নাকি? কি অবস্থা! … কিন্তু জগন্নাথবাবু এই বৃষ্টির মধ্যে যে কোথায় গেলেন …
জগন্নাথবাবু যেই পথে গিয়েছিলেন সেদিকে নিবারণবাবু আরেকবার তাকালেন। বৃষ্টির শব্দ আর অন্ধকার ছাড়া আর কিছু তাঁর অনুভবে এল না। একটু বিরক্ত হলেন তিনি। কি যে করে জগন্নাথ! একসাথে গেলে এরকম বাজে অবস্থায় পড়তে হত না। এখন একা-একা এই বৃষ্টির মধ্যে জনশূন্য রাস্তায় কতক্ষণ বসে থাকতে হবে কে জানে! ছাতা আনেন নি জগন্নাথবাবু। সুতরাং বৃষ্টি না ধরলে তিনিও আসবেন না। নিজেও তিনি গাড়ি থেকে নামতে পারবেন না। ধুর! আজ না এলেই ভালো হত … বিরক্তভাবে এবার অন্য পাশের জানালার দিকে তাকালেন নিবারণবাবু। ওপাশের দৃশ্য খুব আলাদা নয়। খালি হলুদ আলোটা খুব অল্প হলেও তুলনামূলকভাবে বেশী আর রাস্তাঘাট বেশ বিস্তৃত। বৃষ্টির আঘাতে অদ্ভুত সব সুর ভেসে আসছে সেই সব থেকে। আলোর ব্যাকগ্রাউন্ডে কালো-কালো ঘরবাড়িগুলো অসংলগ্ন কিছু সরলরেখাকে মূলধন করে বিভিন্ন দ্বিমাত্রিক জ্যামিতিক চিত্র গঠন করেছে। সেইদিকে কিছুক্ষণ বিমনাভাবে চেয়ে রইলেন নিবারণবাবু। একঘেয়ে দৃশ্য। চোখ, মন সয়ে যায় একটু বাদেই। অবশ লাগে। কিন্তু মাত্র কয়েক সেকেন্ড পরেই তিনি এমন একটা জিনিস দেখলেন যাতে তার বুকটা একবার মৃদুভাবে কেঁপে উঠল আর দেহ-মনের সমস্ত অবশতা উবে গেল এক নিমেষে।
সামনের রাস্তাটা আরও কিছুটা পথ অতিক্রম করে অল্প আলো-আঁধারি সঙ্গে করে যেখানে একটা গলির মুখ থেকে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে — সেখানটায় একটা লাইটপোস্ট আছে। সেটার আলোটা এখন কোনো কারণে পুরোপুরি জ্বলছে না, মৃদু দপদপ করছে। সেই অস্থায়ী আলোটার নীচে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে।একটু হেলে দাঁড়িয়ে থাকা অবয়বটার মাঝারি হাইট, মাথায় বড়-বড় অবিন্যস্ত চুল, খুব সম্ভবত হাফহাতা শার্ট আর প্যান্টস পরনে। লোকটা যেন এদিকেই তাকিয়ে আছে। ভালো করে তাকালেন এবার নিবারণবাবু। সেকি! এই লোকটাই কি সেদিন রাস্তার সাইডে দাঁড়িয়ে ছিল?… পুরো অশোকের মতন চেহারা কিন্তু! … মনটা প্রবলভাবে সংকুচিত হয়ে গেল নিবারণ চৌধুরির। মনে হল, তাঁর হার্টটা হয়ত এমন সিস্টোলিক কন্ডিশান থেকে আর ফিরবে না কোনোদিন। অনেক দূরে হলেও লোকটার উপস্থিতি যেন সহ্য করতে পারছেন না তিনি। মুখটা ঘুরিয়ে নিলেন নিবারণবাবু। কিন্তু মনের খচখচানিটা গেল না। এদিকে জগন্নাথবাবুরও দেখা নেই। একবার তিনি এসে পড়লেই চলে যেতে পারেন নিবারণবাবু। সাহসও পান। কিন্তু এখন তার উপায় নেই। ফের একবার বাইরে তাকালেন নিবারণবাবু। হ্যাঁ, এখনো সেইভাবে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। পুরো নিশ্চল, স্থির কোনো ছবির মতন। বৃষ্টির কোন প্রভাব নেই লোকটার উপর। একটা অন্য টাইম অ্যান্ড স্পেসের আবরণ মেখে যেন দাঁড়িয়ে আছে সে। এই দুনিয়ার দিন, রাত্রি, আলো, অন্ধকার, রোদ, বৃষ্টি — কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করতে পারছে না।
লোকটার দিকে তাকিয়ে এইবারে বেশ ভয় পেয়ে গেলেন নিবারণবাবু … এ কে? সেদিনও ছিল, আজও এভাবে, এখানে …… লোকটা নিবারণবাবুকে ফলো করছে নাকি? কোন বদমতলব নেই তো? … আর অশোকের সাথে চেহারার অত মিল?! কি করে? … গাড়ির দরজার লকটা আবার চেক করে নিলেন নিবারণবাবু। দেওয়া আছে। জগন্নাথ হয়ত লক মেরে গেছে। বাঁচিয়েছে! … সিটের একটু ভেতরে সেঁধিয়ে বসলেন নিবারণবাবু। হাতঘড়ির দিকে ফের তাকালেন নিবারণবাবু। সাতটা চার। কিন্তু মনে হচ্ছে রাত ১২ টা। বৃষ্টির থামা বা জগন্নাথবাবুর প্রত্যাবর্তন — কোনোটার-ই পাত্তা নেই। একটু বাদে কৌতূহলবশত ফের বাইরে তাকালেন নিবারণবাবু। লোকটা নেই। সামান্য চমকালেও মনটা হালকা হল নিবারণবাবুর। তিনি এইবার জানালার কিছুটা কাছে সরে এসে বৃষ্টির ঝাপটা লাগা কাচে নাক লাগিয়ে বাইরে ভালো করে দেখতে লাগলেন। না, লোকটা নেই কোথাও। কোথায় গেল লোকটা? তাও এত তাড়াতাড়ি? …
এমন সময় আচমকা কোথা থেকে যেন মাটি ফুঁড়ে সেই লোকটা হুমড়ি খেয়ে পড়ল নিবারণ চৌধুরির মুখের সামনের জানালার উপর। মারাত্মক চমকে উঠে ছিটকে সরে গেলেন নিবারণবাবু। নিবারণবাবুর রক্তচাপ কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দিয়ে লোকটা এবার জানালার কাচ হাত দিয়ে চাপড়াতে লাল। কাচ কাঁপতে লাগল থরথর করে। নিবারণবাবু কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। লোকটা এবার আরও জোরে জোরে আঘাত করতে লাগল জানালার উপরে। সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি। ঝমঝম শব্দ। ভয়ানক পরিস্থিতি। নিবারণবাবুর মনে হল, এবার যেন কাচ ভেঙেই যাবে। বাধ্য হয়ে তিনি কাচ নামালেন খুব অল্প করে। কাচ একটু নামাতেই কিন্তু লোকটা থেমে গেল। … কিছু বলবে কি? … নিবারণবাবু জানালার একটু কাছে যেতেই জমাট বরফের মত ঠান্ডা অথচ খুব মৃদু আর দূরাগত গলায় কথা বলে উঠল লোকটা, ‘বন্ধু, দুটো টাকা হবে? …… একটু ঝালমুড়ি খাবো …’
অশোক!!! হ্যাঁ… অশোক! আর কোনো সংশয় নেই! কিন্তু … এখানে … এভাবে… কিভাবে? আর … কেন? কি চাই ওর?
এক নিমেষে স্কুলের সেই ভয়টা যেন ফিরে এল নিবারণবাবুর মনে। নিজেকে আজ আবার সেই অসহায় ‘ভালোছেলে’-টা বলে তার মনে হতে লাগল যার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেদিনের-ই স্কুলের গুন্ডা অশোক। কিন্তু অশোককে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কেমন যেন ঝাপসা মতন। হয়ত বৃষ্টির জন্য হবে। নিবারণবাবু কোনো মতে গলায় একটু জোর আনার চেষ্টা করে বললেন, ‘ক…ক… কে আপনি? … আর … কি … কি চান?’
এবার একটু হেসে উঠল লোকটা। তারপর বলল, ‘সেকি, ছোটোবেলার বন্ধুকে ভুলে গেলে বন্ধু? … বলেছিলাম না, সময় মত আসব?! … নাও … এসে গেলাম… আসতেই হল … সেদিন কত না করলাম, শুনলে না … তাই …’
নিবারণবাবু একবার ভাবলেন যে পকেট থেকে একটা দশটাকার নোট বের করে দিয়ে দেবেন অশোককে। যা-তা বকছে, হয়ত নেশা-টেশা করবে। করুক গে’, তার কি? তাঁর বাঁচা দিয়ে কথা! তিনি এইবারে নিজের প্যান্টসের পকেটে হাত ঢোকাতে যেতেই ফের খসখস করে হেসে উঠল অশোক। সেই আওয়াজে টাকা আর বের করা হল না নিবারণবাবুর। হাসির সেই শব্দ যেন সমস্ত প্রকৃতিতে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। হাসিটা থেমে গেল একসময়। তারপর অশোক বলল, ‘পয়সা চাই না … রেখে দাও … ’
এই রে! তাহলে? … নিবারণবাবু কাঁপা গলায় বললেন, ‘ তাহলে? … তাহলে কি চাও?’
চট করে কথাটার কোনো উত্তর দিল না অশোক। এখন তার শরীরটা যেন আরও ঝাপসা ঠেকছে নিবারণবাবুর চোখে। বৃষ্টি কি আরও বাড়ল নাকি? …… হঠাৎ অশোক বলে উঠল, ‘কিছু লাগবে না … পালাও বন্ধু, পালাও … ’
কথাটা শেষ হওয়া মাত্র যেন বৃষ্টির ভেতরেই অদৃশ্য হয়ে গেল অশোক। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নিবারণবাবুর গাড়ির ইঞ্জিনটা চালু হয়ে উঠল সশব্দে। চমকে উঠলেন নিবারণবাবু। না, জগন্নাথবাবু তো আসেন নি! তাহলে গাড়ি স্টার্ট দিল কে? এইবারে বেশ জোরে নড়ে উঠল গাড়িটা। তারপরেই এগিয়ে গেল খানিকটা। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হতভম্ব নিবারণবাবুকে আরও হতভম্ব করে দিয়ে সেই নির্মীয়মান বাড়িটার দিক থেকে টায়ার ফাটার মত জোরালো একটা শব্দ হল আর একটা ধাতব কিছু সজোরে ঠং করে এসে লাগল গাড়ির পিছনের ডিকির দিকটায়। বুলেট?! … কিন্তু কিছু ভাবার সময় নেই এখন নিবারণবাবুর। তাঁকে নিয়ে অঝোর বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে ড্রাইভারহীন গাড়িটা হু হু করে এগিয়ে চলেছে রাস্তার আলো-অন্ধকার ভেদ করে। প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলেন নিবারণবাবু। কিভাবে চলছে গাড়িটা? … কে চালাচ্ছে? … আর জগন্নাথবাবু-ই বা কোথায় গেলেন? তাঁকে ফেলে এভাবে যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? … কিন্তু কিছু করার নেই নিবারণবাবুর। গাড়ি স্বয়ং এখন তাঁর মালিক। এর মধ্যে ড্রাইভারহীন গাড়ির বেগ আরও বেড়ে উঠেছে। এখন একটা বড় রাস্তার উপরে দৌড়াচ্ছে গাড়িটা। নিবারণবাবু দেখলেন, উলটো দিক থেকে বেশ কিছু বড় গাড়ি আসছে। ভয়ে চোখ বুজলেন নিবারণ চৌধুরি …………
সেদিন রাত্রে একেবারে নিবারণবাবুর বাড়ির গলিমুখের সামনে এসে থেমেছিল গাড়িটা। কোনোরকমে টলতে টলতে ঘরে ঢুকেছিলেন তিনি। রাত্রে কিছু খেতে পারেন নি। শোওয়ার আগে একবার জগন্নাথবাবুর বাড়ির নম্বরে ফোন করলেন। খোঁজ নেওয়া খুব দরকার। কিন্তু ফোনটা কেউ ধরল না। দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেল নিবারণবাবুর। কি ব্যাপার? … ওর কিছু … তিনি সামান্য উত্তেজিতভাবে বারবার রি-ডায়াল করতে লাগলেন।
চার বা পাঁচ নম্বর বারে ওপাশে ফোন তুলেই জগন্নাথবাবু চাপা গলায় খুব ব্যগ্রভাবে বলে উঠলেন, ‘দ্যাখ বিশু, বারবার ফোন করবি না! বললাম তো, তোর লোক কাজ করতে পারে নি যখন, আর একটা পয়সাও পাবি না! … তার উপর তোর আরেক দোস্তের বাইকে বসে আমার মাজা ধরে গেছে! কতবার বললাম, আস্তে চালাতে … ইডিয়েট! … দ্যাখ, এখন রিস্ক আছে। এখন ছাড়, যা বলছি শোন, আবার পরে দেখা যাবে …’
নিবারণবাবুর মুখ দিয়ে আপনা থেকে-ই বেরিয়ে গেল, ‘আমি নিবারণ বলছি জগন্নাথ।’
দুম করে ফোন রেখে দিলেন জগন্নাথবাবু। এদিকে খুব গম্ভীর চিন্তায় ডুব দিলেন নিবারণবাবু। সন্ধ্যের ঘটনাগুলো একটু তলিয়ে ভাবতে-ই একটা মারাত্মক সম্ভাবনা কুন্ডলী ছেড়ে নিজেকে প্রকাশিত করতে লাগল ধীরে ধীরে। কয়েকমিনিট বাদে ফের ফোনের ঘন্টা বেজে উঠল নিবারণবাবুর ঘরে। জগন্নাথবাবুর কল হতে পারে। নিবারণবাবু ফোনটা আর ধরলেন না।
নিবারণ চৌধুরির ব্যবসা কিন্তু এখনও চলছে। তবে জগন্নাথবাবুর সাথে তাঁর পার্টনারশিপ আর নেই। কোনো কারণে তিনি হয়ত তাঁর এই ‘ছোটোবেলার বন্ধু’-র উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন।
Tags: গল্প, ছোটবেলার বন্ধু, পূষন
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।