শীতের রাত । চারিদিক সুনসান । ফাঁকা প্ল্যাটফর্মের শেষের দিকে যে লম্বা সিমেন্টের বেঞ্চি সেখানেই রোজ শুয়ে পড়ে হারু । প্রতিটি রাতেই কিছুদিন ধরে এটাই তার শোবার জায়গা। বেশ আরামেই ঘুমিয়ে থাকে। খোলা জায়গায় জোর হাওয়ায় মশার অত্যাচার নেই। তাছাড়া ভবঘুরে হারুর দিনের শেষে ক্লান্তিতে চোখ জড়িয়ে আসে গভীর ঘুমে ।
পরনে ছিন্ন জামাকাপড় , তার ওপরে গায়ে একটা ঢাউস পুরোনো কম্বল জড়িয়ে নির্দিষ্ট বেঞ্চিটার কাছে হারু এসে দেখলো লম্বা বেঞ্চিটার খানিকটা দখল করে ছেঁড়া দুর্গন্ধযুক্ত
কাঁথা মুড়ি দিয়ে একজন দিব্যি শুয়ে আছে।হারু ভালোভাবেই জিজ্ঞেস করলো ,
— কে আপনি ? উঠুন , এটা আমার জায়গা ।
কোনো নড়াচড়া নেই দেখে আস্তে ঠেলা দিয়ে বললো,
— কী হলো ? উঠে পড়ুন ।
এবার কাঁথা সরিয়ে একটা মুখের অংশ বেরিয়ে এলো । হারু দেখলো এ একটা মেয়ে । হারু আবার বললো,
— অন্য বেঞ্চিতে যান , এটা আমার জায়গা।
হঠাৎ মেয়েটা খিঁচিয়ে উঠলো ,
— আমাকে আবার আপনি-আজ্ঞে করছিস কি ?
তুইতোকারি কর । আমি কোত্থাও যাবনা ।
তুইও ইচ্ছে করলে এখানেই —
মেয়েটা একটা ইঙ্গিতপূর্ণ মুচকি হাসলো । হারু অবাক । এ কোথা থেকে এসে জুটলো । বললো,
— থাকিস কোথায় ? কাজটাজ কিছু করিস্ ?
নাম কী তোর ?
মেয়েটা বিরক্ত হলো ।
— আমার নাম জাহানারা । নামের সঙ্গে তোর
কি ? সাতকুলে কেউ নেই, থাকার জায়গাও
নেই । সারাদিন ঘোরাঘুরি করি ।
— রোজগার টোজকার ? চলে কীভাবে।
জাহানারা খুব সহজেই বললো,
— এই ধর, তোদের মতো মরদদের সাথে একটু
ঢলাঢলি , আড়াল পেলে একটু শোয়া । দুদশ
টাকা আমদানি হয়। একটাই পেট , চলে যায়।
জাহানারার কথাগুলো শুনে হারুর গা ঘিনঘিন করে উঠলো । যাইহোক, এসব শুনতে ভালো লাগছে না। ভীষন ঘুম পাচ্ছে। রাগ হচ্ছে। নিশ্চিন্তে ঘুমোবার জায়গা বেদখল। এবার ইচ্ছে করে একটু জোরেই বললো ,
— ঠিক আছে, এখন যা । আমি ঘুমোবো । খুব
শীত করছে ।
মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠলো । তোর নামটা বলিসনি ।
গায়ে পড়ে আলাপ হারুর ভালো লাগলো না। কথা না বাড়িয়ে জবাব দিলো,
— আমি হারু । যা এবার এখান থেকে। বলছিনা
শীত করছে ।
— তোর শীত কমে যাবে । তোর কম্বলের ভেতর
আমাকে নিয়ে নে , শরীর গরম করে দেবো।
তবে মাগনা হবেনা শালা , দশটা টাকা দিবি ।
হারুর মাথাটা হঠাৎ গরম হয়ে গেলো । সে সাধারণত চেঁচিয়ে কথা বলেনা , খারাপ কথাতো একদম নয় । তখন কিযে হয়ে গেলো সেই মানুষের –
রাগে প্রচন্ড চিৎকার করে মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো,
— এখান থেকে দূর হয়ে যা খানকি মাগী । তোর
বাপ-মা আবার সাধ করে নাম রেখেছে
জাহানারা ।
ধমকেও জাহানারার কোনো তাপ উত্তাপ নেই হারু খালি জায়গাটায় কোনোরকমে শুয়ে পড়লো । ক্লান্ত শরীরে নামলো গভীর ঘুম । ভোরের দিকে উঠে পড়লো । রোজই তাই করে। এর বেশি দেরি হলে প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ধরতে আসা মানুষের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। তাই তার আগেই সে ওখানেই পাবলিক টয়লেটে প্রাতকৃত্য
শেষ করে চোখেমুখে জল দিয়ে একটু পরিস্কার হয়ে ওখানেই গগনদার দোকানে একভাঁড় ধোঁয়া ওঠা গরম চা আর দুটো লেড়েবিস্কুট খেয়ে নেয়। ব্যস্ , তারপর পথে পথে ঘোরাঘুরি শুরু হয় উদ্দেশ্যবিহীন।
দিনের খাওয়াটা ভাবতে হয়না হারুকে । যেখানেই থাকুক প্রতিদিন বেলা একটার সময়ে পৌঁছে যায় ওর মেজদি মঞ্জুর বাড়িতে । সেখানে পেটভরে দুপুরের খাওয়াটা সেরে নেয় । একটু বেশি করেই খেয়ে নেয় যাতে রাতে বেশি খিদে না থাকে । মঞ্জু বুঝলেও কিছু বলেনা । কিন্তু এটুকুই । তারপর চলে যেতে হবে , তেমনি শর্ত। রাতে খাওয়া বা থাকা চলবেনা । এই ভবঘুরে অপগন্ড ছেলেটাকে মঞ্জুর বর পছন্দ করেনা । তবে রোজ একটা বেলার ভাত খাওয়ানোর দায়িত্ব মঞ্জু নেওয়াতে আপত্তি করেনি । ওর বাবা-মা দুজনেই কয়েকবছর আগে মারা গেছেন, থাকার বলতে একটা দাদা আছে যে পরিবার নিয়ে মধ্যপ্রদেশের কোথাও থাকে, হারুর সঙ্গে সম্পর্ক রাখেনা ।
মাঝে মাঝে হারু ভাবে তার জীবনটা এমন হবার কথা ছিল কি ? ভালো পরিবারের ছেলে, লেখাপড়ায় নেহাত খারাপ ছিলনা । টাকাপয়সার অভাবে বেশি এগোতে পারেনি । এখন সে আত্মীয় স্বজনদের চোখে ঘৃণা আর অবজ্ঞার পাত্র । সে যেন হাওয়ায় ভেসে আসা নোংরা কাগজের টুকরো , ছেঁড়া মোজা বা বাতিল বাসের টিকিট । এইসব ভাবতে ভাবতে হাতে একভাঁড় গরম চা নিয়ে ঐ বেঞ্চির একপাশে বসে সবে একটা আরামের চুমুক দিয়েছে, হঠাৎ
— তুই কেমন ঢ্যামনারে শালা । সকালে একা
একা চা খাচ্ছিস । আমাকে খাওয়াবি না ?
নোংরা কাঁথাভর্তি দুর্গন্ধ মেখে জাহানারা কখন উঠে পড়েছে খেয়াল করেনি হারু ।
পকেটে কয়েকটি টাকা ছিলো । বেলা বাড়লে ব্যাঙ্কের সামনের দোকান থেকে ছোলার ডাল আর দুটো কচুরি খাবে । যাইহোক ভাবলো চাইছে যখন একভাঁড় চা নাহয় খাইয়ে দেবে । বললো,
— আমি পয়সা দিয়ে দিচ্ছি , একটু এগিয়ে গিয়ে
নিজে কিনে খাবি ।
জাহানারা বেশ বিরক্তই হলো।
— আমি এখন উঠে যেতে পারবোনা । তুই এনে
দে না মাইরি । তুই তো দেখছি বেজায়
ভদ্দরনোক । সাধুসন্ন্যাসী নাকি ? শালা ,
সারারাত আমার কাছাকাছি শুয়ে থাকলি ,
একবার ছুঁয়েও দেখলিনা । আমিতো দশ
টাকাতেই দিতে চেয়েছিলাম । তুই রাম
কঞ্জুস আছিস্ । মাঝখান থেকে কাল আমার
কামাই হলোনা । নে , এখন গরম চা খাওয়া
দেখি ।
হারুর মাথাটা আবার গরম হয়ে উঠলো । তবু নিজেকে সংযত করলো । ভাবলো এই নোংরা ভিখিরিটার ওপর রাগ করে লাভ নেই। কোনো কথা না বলে চা এনে দিলো । প্রথম চুমুকটা সশব্দে গলায় ঢেলে জাহানারা আওয়াজ করলো,
— আ:
হারু বেরিয়ে গেলো , রোজ যেমন যায় । এ এক অদ্ভুত সফর , বিচিত্র জীবন । কোনো বিশেষ ভাবনা নেই তবু ভেবে যাওয়া । কোনো গন্তব্য নেই, তবু চলা । এই চলমান জগৎসংসারে এক অদৃশ্য প্রান্তিক চরিত্র , কোথাও কোনো ভূমিকা নেই । গায়ের জামাকাপড়ের তেমন বদল ঘটেনা,
বিশেষ কিছু নেই । বেশিদিন হয়ে গেলে তার মেজদিই মাঝে মাঝে তার বরের পুরোনো বাতিল সার্টপ্যান্ট বা পাজামা-পাঞ্জাবী ওকে চুপিচুপি দিয়ে দেয় ।
রাতের খাওয়া নিয়ে হারুর সমস্যা আছে। রোজগার কিছু নেই, চেষ্টাও নেই । তবে প্রয়োজনটাও খুব কমিয়ে ফেলেছে । একটা কোয়ার্টার বা হাফ পাঁউরুটি আর পাঁচটাকার ঘুগনি হলেই হয়ে যায় । কিন্তু সেটাইবা নিয়মিত পাবে কোথায় । তাই মাঝে মধ্যে রাতে কিছু খাওয়াই হয়না । মেজদি লুকিয়ে চুরিয়ে দশবিশ টাকা এই প্রকৃত সর্বহারা বাউন্ডুলে ভাইটাকে দেয় বটে কিন্তু তার ওপরে কিছু লাগে । হারুতো ভালো বংশের ছেলে তাই সরাসরি কারো কাছে হাত পাততে সঙ্কোচ বোধ করে । বেশ লম্বা এবং ফর্সা হারু ঐরকম উদ্ভট নোংরা বেশভূষাতে থাকলেও সে যে ভিখারি সমাজের লোক নয় সেটা ওকে দেখলেই বোঝা যায়। তাই পরিচিত কাউকে দেখলে দশবিশ টাকা ধার হিসেবেই চাইতো । সবকিছু বুঝতে পেরেও কেউ কেউ একআধবার দিতো । ফেরৎ দেয়া হতোনা, এরপর হারু ঐপথ দিয়ে যাওয়া আসা বন্ধ করে দিতো ।
এভাবেই দিন থেকে মাস, মাস থেকে বছরগুলি কেটে যায় । বেঁচে থাকাটাও অভ্যাস হয়ে যায়। ভালো লাগুক , খারাপ লাগুক , কষ্ট আসুক তবু বাঁচতে হয় । হারুও বেঁচে থাকে । তাকে তার পরিবারের সদস্যরা অস্বীকার করে, বাইরে কেউ কেউ চিনতে পারলেও না-চেনার ভান করে এড়িয়ে যায় । তাকে ভুলেও গেছে অনেকে । হারু এসব বোঝে , সবকিছুই বুঝতে পারে। কিন্তু কোনো কিছুতেই দূঃখ না পাওয়াটাও সহ্য হয়ে গেছে । অভিমান বা রাগ হয়না । এসব অনুভূতির জগৎ থেকে সে নিজেকে মুক্ত করে ফেলেছে । তার সমস্ত পৃথিবী জুড়ে শুধু পথ, সকালে এক ভাঁড় গরম চা, বেলায় দুটো কচুরি আর রাতে হাফ পাঁউরুটি । ব্যস্ , তার শুধু খিদের কাহিনী ।
তাকে যারা ছোটবেলা থেকে চিনতো তারা জানে হারুর গানের গলা বেশ ভালো ছিলো । রিতিমত ভালো । সেভাবে কখনো শেখেনি , শুধু শুনে শুনে শিখে ফেলতো ।কারো বাড়ির রকে বা কোনো চায়ের দোকানে কেউ অনুরোধ করলে বা মুডে থাকলে ধনঞ্জয় , শ্যামল বা হেমন্তের হিট গানগুলি তার দরাজ সুরেলা কন্ঠে একটার পর একটা গেয়ে শোনাতো আর উপস্থিত সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনতো । বিনিময়ে কেউ কিছু মিষ্টি বা চারটে সিঙ্গাড়ার সঙ্গে এক কাপ স্পেশাল চা খাইয়ে দিতো খুশি হয়ে । কৈলাসদার চায়ের দোকানে গাইলে সে বিনাপয়সায় চা খাওয়াতো। এর ওর দৌলতে খেয়ে বেড়ানোর সেই হাতেখড়ি। হারু ভেবে নিতো এওতো গান গেয়ে
রোজগার , খারাপ কি । অনেক পরে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্কহীন হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ানো ভবঘুরে হারুর গলায় সুর লেগে থাকলেও গান আর সে গাইতোনা । চেষ্টা করলে হয়তো একটুখানি পারে । তাই সময় কাটাতে রাতের দিকে ফাঁকা হয়ে যাওয়া নদীর ঘাটে যখন আপনমনে অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকে তখন মাঝে মাঝে গুনগুন করে ।
প্রয়োজন ব্যাপারটা আপেক্ষিক । হারু তার জীবনের প্রয়োজন খুব কমিয়ে ফেলেছে, তলানিতে বলা যায় । একটা ব্যাপারে সে ভাগ্যবান । এতো কষ্টের মধ্যেও , অর্ধাহার বা অনাহার এবং যেখানেসেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকা শোয়া স্বত্ত্বেও তার শরীরটা বেশ মজবুত, অসুখবিসুখ করেনা বললেই চলে ।
কিন্তু মাঝেমাঝে যখন কিছুই জোটেনা তখন দিশেহারা লাগে । যুদ্ধ বা প্রেমের মতন খিদে কোনো নিয়মের তোয়াক্কা করেনা । হারুও ইদানিং উঞ্ছবৃত্তিতে কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। না , চুরিচামারি এসব থেকে দূরে থাকে । কিন্তু কাছেপিঠে কোথাও বিয়ে, পৈতে বা শ্রাদ্ধ ইত্যাদি উপলক্ষে নিমন্ত্রণের পরোয়া না করে মানুষজনের সাথে মিশে গিয়ে খেতে বসে যায়। ভদ্রতা বা আপ্যায়ন নিয়ে মাথা ঘামায় না। একটু
চালাকি করে বটে । মঞ্জু তার বরের অজান্তেই একবার পূজোর সময় তাকে একটা পায়জামা আর একটা কাজকরা পাঞ্জাবি দিয়েছিলো । হারু খুব সাবধানে ওর একটা গোপন জায়গায় সেটা রেখে দিয়েছে । দরকার হলে সেইটা পরে যেকোনো ভোজবাড়িতে ঢুকে পড়ে। চেহারাটা খারাপ নয় , অনেক অতিথির ভীড়ে উৎসবের অঙ্গনে তাকে কেউ সন্দেহ করেনা । দু একবার অবশ্য ধরা পড়েছে কিন্তু কেউ কেউ বুঝতে পারলেও কিছু বলেনি । কখনো যে অপমানিত হয়নি বলা যায়না ।
হারুর একটা স্বভাব সে মেয়েদের দিকে ভালো করে তাকায়না । সকলকেই তার বাজে মনে হয়।
বেশ কয়েকদিন ধরে সে রাতে ফাঁকা প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে জায়গা ভাগাভাগি করে যার সঙ্গে শুয়ে ঘুমিয়ে থাকে তার সঙ্গে একটাও বাড়তি কথা বলেনা এমনকি তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেনা । আসলে জাহানারা নামের মেয়েটাকে সহ্য করতে পারেনা । যেহেতু এতো লম্বা প্ল্যাটফর্মে ঐ জায়গাটাই ও তার চারিপাশ পরিস্কার লাগে তাই একটা নাছোড়বান্দা উটকো উৎপাৎ সহ্য করেও এই জায়গাটা ছাড়তে চায়না।
একদিন জাহানারা জিজ্ঞেস করলো,
— তুই আমার সাথে কথা বলিসনা কেনরে ?
আমাকে ঘেন্না পাস ? সকালে তুই চলে
যাওয়ার পর আমি আবার একটু চা খাই।
তারপর লোকজন এসে পড়ার আগে
এখানেই সামনের কল থেকে জল নিয়ে চান
করি ।
— চান করিস্ ? ঐখানে জলের কলটাতো
একটু উঁচু । দাঁড়িয়ে হাত পাওয়া যায়।
— জানি । আমার সঙ্গের পুঁটলিটার ভেতরে
জামাকাপড় ছাড়াও একটা ছোট মগ আছে।
সেইটা দিয়ে সব কাজই করতে হয় । তারপর
সবকিছু হয়ে গেলে কাপড় পরে বেরিয়ে যাই।
হারু একটু অবাক হলো । অভ্যাসমত ওর দিকে না তাকিয়েই বললো ,
— কোথায় বেরিয়ে যাস্ ?
জাহানারা জোরে জোরে হাসতে লাগলো । এতো হাসির মতো কী বললো হারু বুঝতে পারলোনা।
হাসি থামিয়ে জাহানারা জবাব দিলো,
— ধান্ধা করতে । নাহলে পেট চলবে কি করে ।
কোন নাগর আমাকে মাগনা খাওয়াবে ?
ফেলো কড়ি মাখো তেল । ওসব তুই বুঝবিনা।
তুইযে শালা একটা আস্ত ঢ্যামনা সেটা আমি
প্রথম দিনেই বুঝেছিলাম । তোকে দিয়ে কিস্যু
হবেনা । যা, নিজের জায়গায় ঘুমিয়ে থাক ।
হারু আর কথা বাড়ালোনা । এই হাড়হাভাতে নোংরা মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতেই ইচ্ছে করেনা । মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতেও ইচ্ছে করে না। ওর বয়সটা আন্দাজ করলে মনে হয় পঁচিশ তিরিশ হতে পারে।
ঘুমিয়ে পড়ার আগে মাথার মধ্যে অনেক চিন্তা ঘোরাঘুরি করে। ভাবে , তার জীবনটা কি একটু ভালো হতে পারতোনা ? সবায়ের কাছে বাতিল, যাচ্ছেতাই হয়ে বেঁচে থাকতে থাকতে তার নিজের ওপরেই ঘেন্না ধরে যায় । জাহানারার মতো রাস্তার একটা ফালতু মেয়েও তাকে আজ অপদার্থ বলছে ।
পরদিন কাকভোরে একটা দূরপাল্লার ট্রেন এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার চলে গেলো । লটবহর সমেত কয়েকজন প্যাসেঞ্জার নামলো আবার মালপত্র নিয়ে চলে গেলো । মনে হয় কোনো পরিবার দল বেঁধে বেড়াতে গিয়েছিলো । নিজেরাই হাতেহাতে সব কিছু নিয়ে চলে যাওয়ার পর দেখা গেলো সুনসান স্টেশন চত্বরের শেষের দিকে জাহানারা দৌড়ে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এলো । আসার পর দেখা গেলো তার হাতে একটা ব্যাগ । হারুর জিজ্ঞাসু চোখের দিকে না তাকিয়েও জাহানারা বুঝতে পারলো যে সে এই কাজটা পছন্দ করেনা । বললো,
— হাঁ করে দেখছিস কি ? অনেকক্ষণ আগে
ওরা এটা ফেলে চলে গিয়েছে । আমি না
নিলেও পরে অন্য কেউ নিয়ে নিতো ।
হারুর মনের ভেতর কিছু কিছু মূল্যবোধ যা এখনো হারিয়ে যায়নি সেখান থেকে বলে উঠলো ,
— এটাতো চুরি করলি ।
— বেশ করেছি । এখন দেখবো কী আছে ।
দেখলো ব্যাগের ভেতরে একটা নতুন শাড়ি , ব্লাউজ, আরো কিছু টুকিটাকি । লিপস্টিক , এক প্যাকেট নানা রঙের টিপ । জাহানারা খুব খুশি।
হারু বললো,
— কাউকে দেবার জন্যে হয়তো কিনেছিলো ।
জাহানারা একটু ঠেস মারলো,
— তোর যে খুব দরদ দেখছি । ছাড়তো এসব ।
ও শালাদের এসব অনেক আছে ,আরো
হবে ।
হারু চুপ করে গেলো । ঠিকই বলেছে তো । এই ভিখিরিমার্কা সাতঘাটের জল খেতে খেতে ভেসে বেড়ানো মেয়েটা হয়তো জীবনে এসব পায়নি ।
গগনদার চায়ের দোকান খুলে গেছে । কলের কাছে গিয়ে চোখেমুখে জল দিয়ে হারু বেঞ্চের ওপর পা তুলে বসলো । ভাবছিল এখন একটু গরম চা দরকার । কিন্তু অতদূর যেতে ইচ্ছে করছে না। হঠাৎ জাহানারা বললো ,
— আজ ভাগ্যটাই ভালো । সকালেই নতুন শাড়ি
জামা পেলাম । তোকে চা খাওয়াতে ইচ্ছে
করছে । দোকানটাও খুলে গেছে কিন্তু আমার
কাছে তো পয়সা নেই ।
হারু ভাবলো কাল থেকে একটা দশটাকার নোট
পকেটে চিপ্টে লেগে আছে , বেশিক্ষণ থাকলে ছিঁড়ে যাবে । তাই বললো,
— পয়সা আমি দিচ্ছি । ঐ দোকান থেকে দুটো
চা আর চারটে বিস্কুট নিয়ে আয় । যা দিচ্ছি
ওতেই হয়ে যাবে ।
জাহানারা খুব খুশি । একটু হেঁটে গিয়ে গগনদার দোকান থেকে চা নিয়ে এসে বেঞ্চিটায় বসলো । হারু আরাম করে সকালের চা তারিয়ে তারিয়ে খেতে শুরু করলো । খাওয়া হবার পর খালি ভাঁড়টা খুব জোরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো অদূরে রেললাইনের ওপর । জাহানারাও চা শেষ করে ভাঁড় ফেলে দিলো। সদ্য সদ্য নতুন শাড়ি পেয়ে আজ সকাল থেকেই মনটা ফুরফুরে লাগছে জাহানারার । সাতসকালে হারুর মুখটা গম্ভীর দেখে আবেগ নিয়ে বললো ,
— এতো দূরে দূরে কেনরে । আমার কাছে এসে
একটু বসলে তোর কি জাত যাবে ? কাছে
আয় না । এখানে কেউ নেই।
হঠাৎ হারুর মাথায় আগুন উঠে গেলো । রাগে দুটো চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে এলো। চন্ডালের রাগ । চিৎকার করে উঠলো ,
— ভাগ্ এখান থেকে । এসব ছেনালী অন্য
জায়গায় করবি । আমার সঙ্গে করতে এলে
এমন লাথি মারবো যে সামনের লাইনের
ওপরে পড়বি , ভাগ্ ।
জাহানারা এই আপাতশান্ত মানুষটির ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে ঘাবড়ে গেলো । চুপ করে বসে থাকলো । একটু পরে হারু নিজেও কোথাও চলে যাবার জন্যে পা বাড়ালো ।
একা একা অনেক কিছু ভাবতে লাগলো জাহানারা । ভাবতে হয়না , ভাবনাগুলো নিজে থেকেই এসে যায় । তার জীবনটা কেমন উদ্ভট নোংরা হয়ে গেছে। কতোই বা তার বয়স, পঁচিশ হতে পারে ।
জাহানারা ভাবতো তার মন বলে আর কিছুই নেই । এখন বুঝলো নিশ্চয়ই আছে । নাহলে একটু আগে হারুর কথাগুলো তার মনটাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলো কীভাবে। অনেকদিন পরে আজ তার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসছে । ভাবলো এতোটা খারাপ জঘন্য একটা জীবন কেমন করে তার হয়ে গেলো । মনে আছে আব্বুর একমাত্র সন্তান ছিলো বলে ভীষন আদর পেতো । কিন্তু এতো ভালোবাসা আল্লা তার জন্যে বরাদ্দ করেনি । তার যখন দশবছর, আব্বুর ইন্তেকাল হলো । দুবছর পরে আম্মি আবার নিকে করে তাকে চাচার কাছে রেখে দিয়ে বহুদূরে চলে গেলো । আর কখনও কোনো খবর নেয়নি । আরো একটু বড়ো হলে জাহানারা
বুঝতে পারতো চাচা-চাচি দুটোই হারামী । বাড়িতে ভীষন খাটাতো আর যখনতখন মারধর করতো। এভাবে আরো কয়েকবছর কাটাবার পর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে নিজের যেক’টা কাপড়জামা ছিল পুঁটলি করে নিয়ে পালিয়ে গেলো । সেই থেকে পথে পথে ঘোরাঘুরি। সহায় সম্বলহীন । বাইরে বেরিয়ে বুঝতে পারলো দুনিয়াটা বড়ই নিষ্ঠুর । খিদের জ্বালায় , বেঁচে থাকার জন্য কিছু পয়সাকড়ি কামানোর বাঁকা পথ ধরতেই হলো । পুরুষের লুব্ধ দৃষ্টি ওর শরীরের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে টের পেতো । সেইসব সূক্ষ্ম ও স্থুল ইশারা একটুআধটু কাজে লাগাতে শুরু করে দিলো জাহানারা । প্রথম প্রথম খারাপ লাগতো , মন বিদ্রোহী হয়ে উঠলেও কিছু করার ছিলনা । তবে কারো সাথেই কোনো পরিস্থিতিতেই কখনও
সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তো না । মানুষ চিনতেও কিছুটা পারতো । অভিজ্ঞতা সব শিখিয়ে দিতো।
তাই বেশি আদিখ্যেতা নয় , জাহানারা বলতো আগে কড়ি ফেলো তারপর মাখো তেল । এই দুনিয়ায় মাগনা কিছু হয়না ।
একটা একটা করে দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। হারু এরপর থেকে ঐখানে শুতে এলেও একটা কথাও জাহানারার সঙ্গে বলেনা ।
দূর্গাপূজা এসে গেছে । পাড়ায় পাড়ায় মন্ডপসজ্জা শেষ , প্রতিমাও এসে গেছে । চারিদিকে উৎসবের মেজাজ । পূজোর দিনগুলো হারুর এখনও খুব ভালো লাগে। যদিও সঙ্গীবিহীন একা একা ঘোরে । তবু ভালো লাগে । সকালে সব জায়গাতেই অঞ্জলীর পরে ফলমিষ্টি পাওয়া যায় । দুপুরে যেকোনো প্যান্ডেলে খিচুড়ি পায়েস খাওয়া । কেউ আপত্তি করেনা । দুপুর বেলায় এই ক’টা দিন অতদূরে মেজদির বাড়ি খেতে যায়না , তার বদলে রাতে খায় । তেমনি ব্যবস্থা চলছে ।
সেদিন ছিলো মহাসপ্তমী । হারু সকাল থেকে পাজামা-পাঞ্জাবী পরেই ঘোরাঘুরি করে যাচ্ছে প্রতিবারের মতো । সন্ধ্যায় কয়েকটা প্রতিমা দেখা হয়ে গেলে তার মেজদি অর্থাৎ মঞ্জুর বাড়িতে খেতে গেলো । খাওয়ায় পর হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের কাছাকাছি এলেও রাত হয়ে যাচ্ছে বলে হারু প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে আর শুতে গেলোনা। তার বদলে টিকিট ঘরের পেছনে একটা হলের মতো জায়গা, যেটাকে লোকেরা মুসাফিরখানা বলে, সেইখানে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
পরদিন ঘুম ভাঙতে অন্যদিনের তুলনায় দেরি হয়ে গেলো । রাস্তার কলে ভালো করে মুখহাত ধুয়ে স্টেশন প্ল্যাটফর্মের দিকে গেলো । প্রতিদিনের অভ্যাস মতো গগনদার চায়ের দোকানে চা খাবার আগে সেই বেঞ্চিটার দিকেই রওনা দিলো ।
চারিদিকে একটু একটু করে উৎসবের শহর জেগে উঠছে । বহুদূরে কোথাও খুব হালকা সানাই বাজছে । তার আওয়াজ এখানেও শোনা যাচ্ছে। বেঞ্চিটার সামনে পৌঁছে হারু দেখলো কে
একজন মহিলা বসে আছে । ভাবলো ঠিক জায়গায় এসেছে কি ? চারপাশে ভালো করে ঠাহর করার চেষ্টা করতে লাগলো । না, ঠিক জায়গাতেই এসেছে । কিন্তু ওখানে বসে কে ঐ অপরিচিতা ?
এবার তার মুখের দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হারু চমকে উঠলো । নিজের দৃষ্টিকেই বিশ্বাস করতে পারছেনা । নতুন একটা শাড়ি পড়ে বসে আছে এক স্নিগ্ধ লাবন্যময়ী নারী । বিস্মিত হারু অবাক হয়ে ভাবছিলো জাহানারার চোখ দুটি যে এতো সুন্দর এর আগে দেখেনি বা দেখবার চেষ্টাও করেনি ।
জাহানারাই নীরবতা ভঙ্গ করলো,
— কাল রাতে না দেখতে পেয়ে ভীষন চিন্তায়
ছিলাম । আজ সকালে দূরে দেখতে পেয়েই
দৌড়ে গিয়ে দুটো স্পেশাল চা নিয়ে এলাম ।
হারুর তখনো ঘোর লাগা অবস্থাটা কাটেনি । ওর মুখের থেকে চোখ সরাতে পারছেনা। জাহানারা আবার একবার বললো ,
— কী হলো । কতক্ষন চা ধরে থাকবো ? আমার
বুঝি হাত ব্যাথা করেনা ?
সম্বিত ফিরলো হারুর । হাসতে হাসতে হাতটা এগিয়ে দিয়ে বললো ,
— দাও
Tags: অনিলেশ গোস্বামী, গল্প, জন্মান্তর
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।