।। ১ ।।
পৃথিবীতে কাঙাল অনেকরকম হয় | কিন্তু সবচেয়ে বড় কাঙাল হল সে যে ভালোবাসার কাঙাল | মানতে একটু অসুবিধা হলেও আদতে এরকম হয় যে একজন মানুষ নিঃস্ব হয়েও খুশি অথচ আরেকজন সব পেয়েও আসলে মনের দিক থেকে ভিখারী | সুখ–দুঃখ কে দাঁড়িপাল্লার এক দিকে তুলে অন্যদিকে যদি টাকা পয়সা দিয়ে মাপা হত তাহলে আজ পৃথিবীতে মানুষ নয়, খুচরো কয়েন পড়ে থাকত শুধু | আর সেই কয়েনের স্তুপে পড়ে থাকত কিছু জ্যান্ত লাশ, হতাশা যাদের পাথেয়, একাকিত্ব যাদের ভবিতব্য |
কয়েকটা লাইন লিখতেই নিজের অতীতের চরম মানসিক পতনগুলো ধোঁয়াশার মতন পাকিয়ে উঠে অনির্বানের স্মৃতির আকাশকে কালবৈশাখীর মেঘের মতন এসে ঢেকে অন্ধকার করে দিল | পুজোর পাঁচটা দিন তার কাছে টানা পাঁচটা দুঃস্বপ্নের রাতের মত | লাখে কিংবা কোটিতে হয়ত একজন মানুষ হবে লেখক অনির্বান চৌধুরী যে বাঙালি হলেও বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব তার মনে খুশির জোয়ার নয়, বেদনার প্লাবন নিয়ে আসে |
বছর চারেক আগের কথা | সেদিন ছিল সপ্তমী | স্ত্রী বর্ণালীর সাথে সারারাত শহরের পুজো পরিক্রমা সেরে ভোরের দিকে স্কুটি চালিয়ে বাড়ি ফিরছিল সে | তখনও আকাশে আলো সেরকম ভালোভাবে ফোটেনি | শীতল মনোরম বাতাস চোখের পলক ছোঁয়ায় হালকা তন্দ্রা আসতেই কিভাবে যে এত বছরের পাকা চালক অনির্বান উল্টোদিক থেকে আসা ট্রাকের সাথে এক্সিডেন্ট করে বসল, আজও তার জবাব খুঁজে পায়নি সে | বর্ণালী তখন সদ্য জানিয়েছে যে সে সন্তান সম্ভবা | সেই একদিনেই নিজের একমাত্র ভালোবাসার মানুষ ও সেই মানুষটার মধ্যে আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠা আরেকটি প্রাণকে চিরকালের মত হারিয়ে ফেলে ভাগ্যের চরম পরিহাসে মৃত্যুমুখ থেকে একলা ফিরে আসে অনির্বান |
আঘাতটা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই পরের বছরই অষ্টমীর রাতে কার্ডিয়াক–এরেষ্ট হয়ে নিজের মা কে হারিয়ে ফেলল সে | ছেলেবেলায় বাবা মারা যাওয়ার পর এবার অবশিষ্ট একমাত্র মানসিক আশ্রয়টিও চিরবিদায়নিল |
তারপর থেকে নিজের কাজ ও একাকিত্বকে সঙ্গী করে দিন কাটছিল অনির্বানের | আর্থিক স্বচ্ছলতাকোনোদিনই হয়ত পাশ ছেড়ে যায় নি কিন্তু ওই যে, সুখ-দুঃখের হিসেব দাড়িপাল্লায় চাপিয়ে হয় না | তাই সব পেয়েও মনের দিক থেকে সে সবচেয়ে বড় কাঙাল | কিন্তু কাঙাল হলেও কে জানত যে পার্থিব সুখ থেকে বঞ্চিত অনির্বান নিছক বেঁচে থাকার গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকলেও সেই বেঁচে থাকাটাও যে একটা দ্বিতীয় আশার লড়াই, অস্তিত্বের লড়াই সেটা ভুলে যেতে বসলে তা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য কেউ সবসময় আছে তার পাশে যার অস্তিত্ব সে হয়ত কখনো মানেই নি ? মাঝে মাঝে ভাবে যে তার চিরকালের নাস্তিকতার সাজাই কি সে এভাবে পেল ? নাকি তার ভাগ্যে সুখে থাকা বারণ ?
সময়ের সাথে সাথে দ্বিতীয় প্রশ্নটি অনির্বানের মনে বদ্ধমূল হয়ে যেতে থাকল | ঠিক যেরকম কোনো এক হতদরিদ্র পরিবারের শিশু রাত্রে খাবারের জন্য কাঁদতে কাঁদতে একসময় হার মেনে অনাহারেই ঘুমিয়ে পড়ে, সেরকম | ইদানিং অনির্বান কারো সাথে খুব একটা মিশতে চায় না | প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথা বলে না | চার বছর পেরোতে চলল তবু কোনো নতুন সম্পর্ক তার মনে সাড়া জাগাতে পারে নি | সবসময় রেগে রেগে থাকে | অকারণে চিৎকার করে ওঠে | পরক্ষনেই অঝোরে কান্নাকাটি করে | সারাদিনের মধ্যে শুধু রাত্রিবেলা টুকু শান্তিতে ঘুমায়, সেটাও ঘুমের ওষুধ খেয়ে | এখন আবার হালে মদ খাওয়াও শুরু করেছে | বহুদিনের বিশ্বস্ত ভৃত্য বংশীকাকাকেও, কদিন হল কি একটা ছোট কারণবশত অকথ্য গালিগালাজ করে তাড়িয়ে দিল | পুজোর দিনগুলো কাছে আসতে থাকলেই নিজেকে আর সামলে রাখতে পারে না অনির্বান |
।। ২ ।।
আজ বিজয়া দশমী | সারা জগৎ আজ চোখের জলে মা কে বিদায় জানাচ্ছে | আনন্দ উৎসবে মাতোয়ারা সবাই | সারা বছর ধরে ওৎ পেতে বসে থাকা আপামর বাঙালি পুজোর এই শেষ দিনের উল্লাসটুকু মন প্রাণ দিয়ে বাজেয়াপ্ত করে নিতে বদ্ধ পরিকর | কিন্তু অনির্বানের আজকের রাতটাও কাটবে তার নিজের ঘরেই | কাজই একমাত্র সঙ্গী, লেখালেখি একমাত্র বন্ধু | তাই দু-চার লাইন লিখতে গিয়ে আজ হঠাৎ পুরোনো স্মৃতিগুলো সবাই যেন একসাথে এসে তার মনে একের পর এক আঘাত হানতে শুরু করে | টেবিলে পেন – খাতা ছুড়ে ফেলে দিয়ে ফ্রিজ থেকে বোতলটা বের করে এনে ঢকঢক করে পান করা শুরু করল সে | সঙ্গে ঘুমের বড়ির শিশিটা খুলে নিজের মুখে পুরো উল্টে দিল | জানালা দিয়ে ভেসে আসা বড় রাস্তার জনসমাগমের আনন্দ, হুল্লোড় ক্রমশ কানে ক্ষীণ হয়ে এল | চোখের সামনে আলোর রোশনাই ধীরে ধীরে বিবর্ণ হয়ে যেতে লাগল | অধচেতন শরীর যে কখন মেঝেতেলুটিয়ে পড়ল জানে না সে |
তখন মধ্যরাত পার করে গেছে হবে | হঠাৎ সদর দরজায় ঘন ঘন ধাক্কা দেওয়ার শব্দ হল | আচমকা আওয়াজে তন্দ্রা ভাঙল অনির্বানের | এত রাত্রে কে এল ? কোনোক্রমে নিজেকে সামলে টলতে টলতে গিয়ে দরজা খুলল সে | এ কি ? কেউই তো নেই ! নিশ্চই কোনো বেয়াদপ ছোকরার কান্ড হবে ! ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছে আর আধো অন্ধকার গলিটায় ঢুকে দরজায় ধাক্কা মেরে পালিয়েছে ! বিরক্ত, অর্ধনিদ্রামগ্ন অনির্বান দরজাটা বন্ধ করতে যাবে ঠিক তখনই একটি অদ্ভুত মিষ্টি কণ্ঠস্বর শুনতে পেল |
– শুভ বিজয়া !
অনির্বান লক্ষ্য করল একটি ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে হাতে একটি পুজোর থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসছে | পরনে লাল-পাড় সাদা শাড়ি, গালে–কপালে সিঁদুর খেলার চিন্হ স্পষ্ট |
– কে তুই ? এত রাত্রে কী করছিস এখানে ? – ধমকে উঠল অনির্বান |
– হি হি! – খিল খিল করে হেসে উঠল বাচ্চা মেয়েটি | তারপর বলল –
– বাব্বাহ ! আজকের দিনও এত্ত রাগ ! ফেরার আগে ভাবলাম একবার দেখা করে যাই ! কষ্ট হয় না বল ?
– ফেরার আগে মানে ? – গলা ভারী করে বলে ওঠে অনির্বান – রাত-বিরেতে এসব কী মস্করা হচ্ছে ? যাও এখান থেকে !
– যাচ্ছি গো যাচ্ছি ! – হালকা অভিমানের সুরে বলে ওঠে মেয়েটি | এমন একটা ছোট্ট মিষ্টি মেয়েকে ওরম অভিমান করতে দেখে হঠাৎ যেন বহুকাল পরে মনে স্নেহ জেগে উঠল অনির্বানের | আজ যদি বর্ণালী বেঁচে থাকত, কে বলতে পারে হয়ত এরকমই একটি মিষ্টি কন্যাসন্তান হত তাদের ! ভাবতেই যেন বুক নিংড়ে, চোখ ঠেলে জল বেরিয়ে এল তার | চোখ মুছতে মুছতে সে বলল –
– আহা ! রাগ করে না ! এত রাত্রে এভাবে একা একা ঘুরছো কেন ? এটা ঠিক নয় | যাও বাড়ি যাও |
কিন্তু এ কী ? চোখ থেকে হাত সরাতেই অনির্বান দেখল তার সামনে কেউ তো আর নেই ! কই গেল মেয়েটি ? এত তাড়াতাড়ি ! হন্যে হয়ে বেরিয়ে আসে-পাশে খুঁজে দেখল অনির্বান | না ! কোথাও নেই ! তবে কি মনের ভুল ?
অগত্যা দরজা বন্ধ করে ঘরে এসে আলো জ্বাললো | ঘড়িতে দেখল দুটো বাজছে | বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে ঘন ঘন জলের ঝাপটা দিল | তারপর ঘরে এসে যা দেখল তাতে গা – হাত – পা ঠান্ডা হয়ে এল তার | টেবিলের উপর ঘুমের বড়ির শিশিটা উল্টে পড়ে আছে আর সারা টেবিলজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বড়িগুলো | এমনটা তো হওয়ার কথা নয় ! তবে কি তখন বড়িগুলোর একটাও তার মুখে পরে নি? নেশার ঘোরে কি এতটাও ভুল করতে পারে মানুষ? আর এমন অনিচ্ছাকৃত ভুল যা মানুষকে নতুন জীবন এনে দিতে পারে? আর ওই মেয়েটিই বা কে ছিল ? যার জন্য তাকে উঠতে হল | আর হঠাৎ মেয়েটি গেলই বা কোথায় ?
মাথার উপর সিলিং ফ্যানটা ঘড়ঘড় শব্দ করে ঘুরে চলেছে | একগুচ্ছ অবাস্তব প্রশ্নের ভারে জর্জরিত অনির্বান চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল | দূরে কোথার থেকে ঢাকের আওয়াজের সাথে মা দশভূজার মিলিত জয়ধ্বনি ঘরে ভেসে এল –
“ বল দুগ্গামাঈ কি, জয় !! “
Tags: গল্প, দেবাশিস সাহা, বিজয়া
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।