সারা দিন ঘরে আটকে থাকার পরে তিতির বিকেলে তার মা-কে ছাদে নিয়ে যাবার জন্য তিতিবিরক্ত করে তোলে।খাওয়া,ঘুম, অনলাইনে পড়ার বাইরে সামান্য টিভি বা সেলফোন দেখা ছাড়া সারাদিন আর আছে কি?নইলে বসে থাকো খাটে, চেয়ারে,অথবা ছোট ওই বারান্দায়।কাগজ পড়তেও তার ইচ্ছে হয় না।পাঁচ-সাত মিনিটে দেখে মুড়ে রাখে।ঘরে যতই খেলার ইচ্ছে হোক,জায়গা কই !লাফাতে সাধ হলেও এক জায়গায় কত আর লাফাবে?
ছাদে পা দিলেই তিতিরের ছিরিছাঁদ বদলে যায়।দেখে মনে হয় যত দুঃখ,আফসোস আর রাগ সে বেঁধেছেঁদে ঘরে সরিয়ে রেখে এসেছে।প্রথমেই সে কার্নিসের পাশ বরাবর ঘুরে দেখে নেয় চারদিক।রোদ কমার সাথে সবগুলো ছাদ যেন গরম থেকে নিস্তার পেয়ে হাঁপ ছাড়ে।পায়রার দল ড্রিল করতে বাড়তি দম নিয়ে নানা বাঁক নেবার কায়দায় চিরে ফালা করে দেয় বাতাস।বিকেলের মিঠে হাওয়ায় গাছের পাতা দোলে।
মেঘের ছাড় পেলে কার্শিয়াঙের দুদিকের পাহাড় মাথা তুলে তাকায়।সেই সব দিন তিতির বাড়তি আনন্দ পায়।আগে নাকি প্রায়ই কাঞ্চনজঙ্ঘা উঁকি দিত।তিতিরের কপাল মন্দ,সব ভালোই তার জন্মের আগে ঘটত।আজকাল লকডাউন আর বৃষ্টির জন্য আকাশ সাফ থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘা চোখ খোলে।সে দু’দিন এমন লটারি পেয়ে খেলা ভুলে ঘুরেফিরে তাকে দেখেই বিকেল কাটিয়ে দিয়েছে।তিতিরের আরেক পছন্দ তার পশ্চিমের কুম্ভকর্ণ পর্বত।দার্জিলিঙ গিয়ে চেনাশোনা করে এসেছে।কেমন সুন্দর হেলান দিয়ে লম্বা ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে চলেছে।কাজ নেই,তাড়া নেই, খালি শান্তি !
ফ্ল্যাটের অন্যরাও আসে ছাদে।ভাব আছে যাদের মধ্যে,তারা কাছাকাছি সময়ে আসে।তিতির দেখেছে এভাবে পালা করে ছাদে আসার সময়টা ভাগ হয়ে যায়।তার খেলার সাথী সোনু আর বালা।আর আছে করমাসি,আবদার করে তার কাছ থেকে নতুন কত খেলা শেখে তারা।কখনো এক পায়ে তেড়ে গিয়ে ছুঁয়ে দেওয়ার কায়দা।নয়ত চু কিত কিত খেলায় দম কিভাবে ধরে রাখতে হয়।লকডাউনে এত সময় না পেলে তিতির কি সেসব জানতে পারত!নাকি এত মজা করতে পারত !
তিতিরের মা কেবল এক কোণে সোনালি মাসির সাথে গল্প করবে। বুড়ি ঠাকুমা টবের গাছে জল দেবে, আর কী সব বকবক করবে।আরও কেউ অবশ্য আসে,তবে রোজ নয়।করমাসি সবচেয়ে ভালো, খেলতে উৎসাহ দেয়।কোনদিন দেখাতে গিয়ে নিজেই খেলতে শুরু করে দেয়।কী যে দারুণ লাগে তখন !
আশেপাশের ছাদ থেকে তাদের খেলা দেখে অন্যরা।অন্য অনেকে তাদের চৌহদ্দিতে পায়চারি করে।পশ্চিম দিকে অস্ত যাবার আগে সূর্যের লালচে আলো পড়ে।তা গায়ে মেখে ওদিকের ছাদে লম্বা দাদাটা এক মনে ডুবে থাকে ফোনে।কাছে দূরে রোজ বেড়ে চলে ঘুড়ি ওড়ানোর লোক।আম কাঁঠালে ঘেরা বাড়িটার ছাদ কেবল ফাঁকা থাকে।
কোণের বাড়ির তিন নেপালি মেয়ে তাদের মায়ের সাথে গল্পের মাঝে খুব হাসে।তাদের গা ঘেঁষা বাড়ির ছাদে দুই দাদু আবার বেশ হাত মাথা পা নেড়ে ব্যায়াম করে।তারা নেপালি মেয়েদের দিকে প্রায়ই অসন্তুষ্ট হয়ে তাকায়।কেমন রাগের ভাব থাকে।যেন মেয়েগুলো তাদের ব্যায়াম দেখে হাসছে!
তিতিররা এলে পায়রার দল কেমন দিব্যি জায়গা ছেড়ে দিয়ে আশেপাশের পাইপ বা গর্তে উড়ে যায়।অথচ ঝামেলা পাকায় কাক।বলবে দখল করতে এলে কেন!কখনো চোখ পাকায়, অত হৈ চৈ চেঁচামেচি করা চলবে না বাপু।তিতির তেড়ে গেলে চিলেকোঠার মাথায় নয়ত ডিশ অ্যান্টেনার টাকে বসে মুখ চালিয়ে যাবে।যেন কিনে রেখেছে জায়গাটা !
গোপন কথা বলা হয়ে গেলে তিতিরের মা আর সোনালি মাসি করোনা-কাণ্ড নিয়ে শ্রাদ্ধ শুরু করে। তখন ভাইরাস,দীর্ঘশ্বাস,কারাবাস এসব শব্দ সজোরে ছিটকে বেরোতে থাকে।দোষী হতে কেউ বাদ থাকবে না !কাগজে কী লিখল,টিভি কী বাদ দিল তা সবাই জানতে পারবে।
সেদিন দেরি হয়ে যায় ছাদে আসতে।ফোনে পড়াবার সময় দিদিমণি কিছু বাড়তি পড়া আর গাইডলাইন দিল যে ! তার মা এল না।বেশ স্বাধীন ভাবে খেলার সুযোগ থাকলেও সময় জলদি শেষ হয়ে যায়।আলোতে যতক্ষণ ঠাহর করা যায় তত সময় খেলতে থাকে ওরা।সেদিন আম কাঁঠালে ঘেরা বাড়িটর ছাদে ছোট ছেলেটাকে নিয়ে ঘুরছিল তার বাবা।তিতিরদের খেলা লক্ষ করে ছেলেটাকে কী সব বোঝাচ্ছিল।তখন হঠাত চলে যাবার সময় হয়ে গেছে টের পেয়ে সূর্য তার আকাশে আঁকা ছেড়ে ডুব দিতে থাকে।ফেলে যাওয়া রঙগুলো পড়ে গিয়ে ছড়াতে থাকে।লাল কমলা হলুদ আসমানি মিশে মেখে একেক বার একেক ঘনত্বে চমক দিতে থাকে।সব ছাদের মুখ পশ্চিম দিকে ঘুরে যায়।তিতিরের মনে হতে থাকে কোথাও ঘুরতে গিয়ে অস্ত যাবার খেলা দেখছে।
তিতিরের তখনো অবাক হবার বাকি ছিল।সোনু আর বালার সাথে গোল করে খানিক ছুটে নিয়ে নেমে যাবে ভেবেছিল।রঙগুলো গলে আকাশ থেকে পড়ে যেতেই পর্দার ওপরে ফুটে উঠতে থাকে পাহাড়ের গায়ে বসানো চুমকি।আকাশে তারা, তার নিচে হীরের কুচি ছড়ানো।মন কেমন আনন্দে পালকের মতো হালকা লাগে।
পরদিন বিকেলে ওপরে যেতে ফের কাকের তুমুল চিৎকার।প্রতিবাদ নাকি বিক্ষোভ ! তার মাঝে অন্য দিকে চেয়ে কাকে যেন নালিশ করতে থাকে।তাই শুনে বড়সড় কাক তার পাশে উড়ে আসে, হয়ত প্রতিবাদী কাকের বর হবে!সে সব শুনে কৈফিয়ত চাওয়ার ভঙ্গিতে তাকায়।নিচু স্বরে কিছু বলে। বউকে হয়ত বোঝায় যে তিতিরদের নিয়ে কোন ভয় নেই। তারপর বউকে নিয়ে সটান চিলেকোঠার ওপরে গিয়ে পুলিশের মতো নজর রাখতে থাকে।
তখনি তিতিরের চোখে পড়ে যে পাশেই যে নারকেল গাছ, সেখানে কাকের বাসায় তিনটে ছানা হাঁ করে ডাকছে!সে বোঝে কাক-মা সেজন্যই চিন্তায় আছে।ও তখন বন্ধুদের নিয়ে ছাদের অন্য দিকে গিয়ে খেলতে থাকে।করমাসিকে পেয়ে আরও মজা।চটি দিয়ে ঘেরা জায়গায় জলাশয় বানিয়ে নতুন কুমীর-ডাঙা খেলা জমে ওঠে।তিতিরের মা, সোনালি মাসি, বুড়ি ঠাকুমা ছাড়াও নতুন আসা মাসিটা দেখছে।অন্যান্য ছাদ থেকেও অনেকে নজর করে।তাদের প্রাণবন্ত খেলা দেখে আম কাঁঠালের ছাদে ছেলেটির বাবা গিয়ে বল নিয়ে আসে।দুজনে আস্তে করে খেলতে থাকে।আনন্দ হয় তিতিরের।সবাই খেলতে পারছে,তার চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে!ঘরবন্দীর দুঃখ ভোলাতে খেলা সেরা জিনিস।
কোণের বাড়ির তিন নেপালি মেয়েও কুমীর-ডাঙা খেলা দেখছিল।হঠাত করে তারা তাদের মাকে ঘিরে কেমন যেন নড়াচড়া করতে থাকে। তারপর বোঝা যায় যে কিছু একটা করতে রাজি করাতে চাইছিল। কারণ তিতির খেয়াল করে তারা মা-মেয়ে চারজনে মিলে সুরেলা নেপালি গান গেয়ে দিব্যি নাচতে শুরু করেছে!সেই নাচ-গান চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।কোন দিকে পরোয়া নেই তাদের।
বড় মন-ছোঁয়া সে দৃশ্য নজর টেনে নেয়।তাদের পা দোলা দেয়,হাতের আঙুল খেলা করে,ঠোঁট নড়ে,মুখে ভরা থাকে হাসি।চারদিকের গাছপালা,ছাদ-ছাউনি বুঝি তাদের সাথে তাতাথই করে তাল মেলায়,তেতে ওঠে।
খেলা ভুলে তিতিররাও মনে মনে ভালোলাগার স্রোতে তিরতির করে কাঁপতে থাকে।
Tags: অমিত মুখোপাধ্যায়, গল্প, মুক্তির স্বাদ
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।