গাড়ি থেকে নামতেই হাড়কাঁপানো শীতটা গালে চড় কষিয়ে দিল। সোয়েটারের ওপরে উইনচিটারের চেন টেনে দুই হাত ঘষতে থাকলো সুনীল। সবার শেষে গাড়ি থেকে নেমে আঁতকে ওঠে। মাফলার টাইট করে বলল, ‘’কিরে মনোজ, তুই যে কাল বললি গরুমারায় ঠাণ্ডা বেশ কম। এই তার নমুনা ? আমার তো মনে হচ্ছে এক্ষুনি বরফ পরবে। এর চেয়ে সান্তালেখোলার শীত ভদ্র ছিল।‘ মনোজ আর সুনীল কলকাতায় ফিসারি দপ্তরে চাকরী করে। তাদের বন্ধুত্ব কেবল অফিসের চার দেওয়ালে সীমাবদ্ধ নয়। মধ্যবয়সী দুই বন্ধু তাদের পরিবার নিয়ে বছরে এক আধবার বেড়িয়ে পড়ে।
সুনীলের মাথায় বিশাল টাক থাকায় শীতের বহর একটু বেশি। তার ধারনা মাথার চুল শরীরের তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রন করে। মনোজ ঘাড়ে হাত দিয়ে বললো, ‘আরে ভাই , আমি কিভাবে জানবো হঠাৎ তাপমাত্রা ফল করবে। মোবাইল যে বিভীষণ হবে তা বুঝিনি। তবে সঙ্গে যা গরম পোশাক আছে, সুইজারল্যান্ডে আল্পসের গোড়ায় থাকা যাবে।‘ মাফলারের লেজটাকে আরেক পাক দিয়ে বড় চোখে সুনীল জানায়, ‘রক্তের প্রবাহে বরফের কুচোগুলো হার্ডেল রেস করছে। এইমাত্র গরম কিছু না পেলে গণ্ডারের পরিবারকে আর দেখা হবে না’। সাতচল্লিশ বছরের সুনীলের চোখদুটি তার শরীরের মধ্যে সবচেয়ে রহস্যজনক। হাল্কা নীল ও সবুজের বিস্ময়কর সমন্বয়ে তৈরি। দূরে থাকলেও তার চোখ থেকে দৃষ্টি সরানো যায় না। তবে এই চোখ তার স্বভাব চরিত্রের সাথে সখ্যতা রাখেনি।
সান্তালেখোলাতে দুদিন নির্মল আনন্দে কেটেছে। সামসিং লজ থেকে দু কিমি হেঁটে শুকনো পাথুরে নদী, রকি আইল্যান্ডে পাহাড়ের মত পাথর, ভুটান পাহাড়ের বিপরীতে কাঠের বেঞ্চে বসে ধোঁয়া ওঠা কফি, অসামান্য বিন্দু ও ঝালং, জলঢাকার রিভার বেডে বসে আলুর পরোটা ও আঁচার – সব মিলিয়ে জমজমাট ব্যাপার। ভালো খারাপ, শ্লীল অশ্লীল সব পোজের ফটো তুলেছে। ঠাণ্ডা জল ছুড়েছে, নাচ করেছে। রুন ও বাপন হল সুনীলের দুই ছেলেমেয়ে। নবম এবং ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। তবে স্ত্রী সুচিত্রা বা রুন, বাপনের কাছে সুনীল সর্বদাই গ্রাহ্যতার গণ্ডীর বাইরে থেকেছে। প্রিয় বন্ধু, প্রিয় স্বামী বা প্রিয় অভিভাবক – কোন বিশেষণের তকমা সুনীলের প্রশস্ত কপালে জায়গা পায়নি। তিনজনের ছায়ায় চিরকাল মুহ্যমান থেকেছে। তবে সুনীলের কোন আক্ষেপ বা অভিযোগ নেই। বয়ে চলা নদীর জলের মত মানসিকতা। প্রতি মুহূর্তের লাঞ্ছনা সুনীলের গতিপথ পরিবর্তন করেনি। হয়তো ভেতরের গোপন স্রোত চরা পড়তে বাঁধা দিয়েছে।
‘কেমন হোটেলের ব্যবস্থা করেছি বল! জঙ্গল পার্ক হোটেলের নাম অনেকেই জানেনা। নতুন এসেছে কিনা মার্কেটে। নে, সিগারেট ধরা। এই দুদিন কেবল শাল, সেগুন, শিরিষ আর শিমুলের দলে জংলী হয়ে থাকা, ভাবতেই রোমাঞ্চিত হচ্ছি বস ‘ – মনোজের কথাগুলো সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে মন দিয়ে শুনছিল সুনীল। রাস্তার উল্টোদিকে প্রায় অন্ধকার জঙ্গলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
‘ কি ভাবছিস এত ? বেড়াতে এসে মন খারাপ নয় বন্ধু। তুই তো কবিতা লিখিস। দেখবি এই জঙ্গলে কত লেখার রসদ পাবি ‘ – মনোজ জোর গলায় বলে। সুচিত্রা সোয়েটারের ওপর শাল চাপিয়ে ব্যালকনিতে এসে বলে – ‘বেড়ালের আবার মন খারাপ হয় নাকি মনোজদা ? সারাক্ষন ভয় আতঙ্ক নিয়েই তো পেছন সারিতে পড়ে থাকে, ওর আবার চিন্তা কি ! বাড়ি থেকে অফিস আর অফিস থেকে বাড়ি। তাও যদি স্যালারিটা হ্যান্ডসাম হত ।‘ রুন, বাপন দৌড়ে এসে বলল – ‘ কি বাবাই, ক্লাস শুরু ? গুড বয় হয়ে থেকো। কথা না শুনলেই পানিশমেন্ট পাবে কিন্তু। মা, আমরা নিচের বাগানে ফুল দেখে আসি ।‘
অফিসে সুনীলের একটা পদমর্যাদা আছে। ম্যানেজমেন্ট কমিটির মিটিং এ সুনীলের যুক্তি, পরিকল্পনাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এফ.এফ.ডিও নিজে সুনীলের সাথে ইউ.সি এপ্রুভাল, লোকাল এরিয়া প্রোজেক্ট, অডিট নিয়ে আলোচনা করেন। অথচ বাড়িতে, বাজারে, রাস্তায় সুনীলকে যেন কিসের আতঙ্ক কুরেকুরে খায়। হাজার লাঞ্ছনা সত্ত্বেও মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা সুনীলের মধ্যে দেখা যায় না। একটা শিশুসুলভ হাসি দিয়ে সব কিছু ঢেকে রাখার চেষ্টা করে। যদিও তার বেড়াল চোখের পলকহীন দৃষ্টি প্রমান করে দেয় ঝড় বৃষ্টির বিহ্বলতা।
সুচিত্রা, ঘুমিয়ে গেলে ? একটু যাবে ব্যালকনিতে ? রাতের অন্ধকারে জঙ্গল অপরূপ।
আমার ঘুম পাচ্ছে। জ্বালিও না।
বেড়াতে এসে ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করবে ? প্রকৃতিকে প্রাণভরে দেখে নেবেনা ?
আহা, আমার প্রকৃতি প্রেমিক! বেড়ালের চোখ দিয়ে কি দেখবে ওই লম্বা গাছগুলোর ?
আর এত যখন জঙ্গলের প্রতি প্রেম, যাও না একা। আমায় বিরক্ত করছ কেন ?
আমার একা যাওয়ার সমস্যা তো জানোই। ভয় করে যে। চল না প্লিজ।
ধুর বাবা। আচ্ছা চল। ফ্লাস্কের চা এখনও ঠাণ্ডা হয়নি বোধ হয়, নিয়ে চল।
গোল খোলা ব্যালকনিতে একটা বেতের চেয়ারে বসলো সুচিত্রা। চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে সুনীল সিগারেট ধরাল। অন্ধকার রাত, রাস্তায় কোন আলো নেই। খানিকটা চোখ সয়ে গেলে বোঝা যাচ্ছে দোকানঘর, গাছ, আকাশ। কালো পিচ রাস্তা এঁকেবেঁকে পূর্বদিকে জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেছে। তাপমাত্রা বোধহয় দুই বা তিন ডিগ্রি। একটা বরফ বাতাস গাল, ঠোঁটকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে ঘনঘন। কিছু ঝোপের মাথায় সাদা ফুল ফুটেছে। পাতায় জমা হিম ভারী হয়ে টুপটাপ শব্দে ঝরে পড়ছে। নিঃশব্দে অনেকটা সময় কেটে গেল দুজনের। সুনীল দীর্ঘ নীরবতা ভেঙ্গে বলল -‘ আচ্ছা সুচিত্রা, আমার সম্পর্কে তোমার অনেক অভিযোগ। আমি ভীতু, ব্যাক্তিত্বহীন, কদাকার, বেড়াল চোখ ইত্যাদি। তোমরা সব সময় আমায় বিদ্রুপ কর। কিন্তু একদিনও কি আমায় বোঝার চেষ্টা করেছ ? রূপ, বৈশিষ্ট গঠনে আমার নিজের কি কোন হাত আছে ? সুচিত্রা, চুপ করে আছো যে। সুচিত্রা ? সুচিত্রা কোথায় তুমি ?’ প্রশ্নটা শেষ করে পেছন ফিরে দেখে সুচিত্রা নেই। সুনীলের বুকের ভেতরটা কাঁপতে থাকলো। সামনে লক্ষ লক্ষ গাছ দাঁড়িয়ে। ঝিঁঝিঁ পোকার একঘেয়ে তীক্ষ্ণ ডাক। হাতের তালু খুব চুলকাচ্ছে। সামনের গাছগুলো যেন দুলছে। ঝড় আসছে কি ? খুব কাছ থেকে কানে নুপুরের শব্দ আসছে। সুনীলের পা কাঁপতে শুরু করে। এক দৌড়ে বারান্দা পার হয়ে ঘরে ঢুকে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দেয়।
মাঝ রাতে এত জোরে কেউ দরজা বন্ধ করে ? তোমার কি বোধ-বুদ্ধি কিচ্ছু নেই ?
তুমি চলে এসেছ কখন ? বলবে তো, আমিও চলে আসতাম।
এমন জঙ্গলের মধ্যে তোমার মত ভুতের সঙ্গে আড্ডা দেবার কোন রুচি আমার নেই। তাছাড়া তোমার দৌড় কতটা সেটা দেখবার জন্যেই তো চুপ করে চলে আসি।
একটা কিছু ঘটে যেতে তো পারতো, তখন ?
কি আর হবে ? তোমার চোখের দিকে তাকালে পশু পাখি ভুত সবাই পালিয়ে যাবে।
এক আমি রয়ে গেলাম।
রাত তিনটে বাজে। জোর ধাক্কায় ঘুম ভেঙ্গে যায় সুনীলের। ঘরে আলো জ্বলছে। পাশে সুচিত্রা ভয়ে তাকিয়ে আছে। ওদিকের বিছানায় রুন ও বাপন আতঙ্কে একে ওপরের হাত ধরে গোঁ গোঁ শব্দ করছে। ছাদের ওপর কেউ যেন খুব জোরে শব্দ করে হাঁটছে আর আঁচড় কাটছে। শব্দটায় গা গুলিয়ে উঠলো সুনীলের। ভয়ে কম্বলদুটো আরও টেনে নিল। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়লো। বেশ জোরে বারবার। সুনীল কিছুতেই বিছানা ছেড়ে নামলো না। বাধ্য হয়ে সুচিত্রা দরজার কাছে গিয়ে কোন রকমে জিজ্ঞাসা করলো,
কে ?
আমি বৌদি, মনোজ। দরজা খুলুন।
আমরা তো সবাই ভয় পাচ্ছিলাম। কিসের শব্দ হচ্ছে মাঝরাতে ?
সেই জন্যই তো আমি বলতে এলাম। ছাদে একটা বানরের দল এসে তাণ্ডব চালাচ্ছিল। ম্যানেজারকে ফোন করে জানলাম, ছাদে অনেক কুল আর স্কোয়াশ রাখা ছিল। কিরে সুনীল, খুব ভয় পেয়েছিস নাকি ?
সকাল থেকে মেঘলা আকাশ। দু এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে দফায় দফায়। ভেজা পিচের রাস্তার বাঁ দিকে সারিবদ্ধ দোকান। হস্তশিল্প, চা, খাবার হোটেল, টেলিফোন বুথ, ওষুধের দোকান, টিকিট বুকিং এজেন্সি ইত্যাদি। আর ডানদিকে রাস্তা থেকে ৭/৮ ফুট দূরে জঙ্গলের সীমানা। কয়েকটি তার দিয়ে ঘেরা। তারগুলি বিদ্যুৎ সংযুক্ত থাকার কারনে সাবধান করে দিচ্ছেন সিকিউরিটি গার্ডরা। কিছু শাল ও শিরিষ গাছ বহু পুরনো। পুরু শ্যাওলার স্তর গাছের গায়ে পনেরো কুড়ি ফুট উচ্চতা পর্যন্ত উঠে গেছে। নাম না জানা হরেক রকমের জংলী লতা আশেপাশের বিভিন্ন গাছের মধ্যে দোলনা তৈরি করেছে। একধরনের কাঁটা জাতীয় ঝোপ দেখা যাচ্ছে সব দিকেই, তাতে বাহারি ফুল ফুটে আছে। সুনীল রাস্তা দিয়ে হাঁটছে আর ভাবছে – ঝড়, বৃষ্টি, ভুমিকম্প, বন্যার মধ্যেও দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলি শতাব্দীর পর শতাব্দী। কত অত্যাচার সহ্য করেও এরা অবিচল। যারা সয় তারা রয়।
বিকেল চারটা নাগাদ গরুমারা ন্যাশনাল পার্কের মেন গেটের টিকিট কাউনটারে লাইন দিল সুনীলরা। একটা জিপসি গাড়ির পেছনে ছয় জন দাঁড়িয়ে পড়লো। সামনে ড্রাইভার আর একজন হেল্পার। পরপর আটটা জিপসি গাড়ি পর্যটকদের নিয়ে ঢুকে গেল জঙ্গলে। সুনীলদের গাড়ি সবশেষে। শুরুতেই বিরাট ব্যানারে লেখা – Welcome to Gorumara National Park. প্রত্যেকে বিস্মিত চোখে চারিদিক দেখছে। সুনীল বলে উঠলো – ‘ আচ্ছা জুরাসিক পার্কের মতো লাগছে না ?’ হেল্পার সামনে থেকে জবাব দিল, ‘ঠিক বলছেন স্যার, কিন্তু ডাইনোগুলা এহানে আসবো না, আরও ডেঞ্জার আসতে পারে।‘ সুনীল গাড়ির মাঝখানে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। সুচিত্রা ঝাঁঝিয়ে উঠলো –‘ ওই যে ভীতুর ডিম, জঙ্গলে এলে কেন এত ভয় যখন ? আর তুমি তো বেড়াল! ভয় কর কোন লজ্জায় ?’ পাশেই ময়ূরের কর্কশ ডাক শোনা গেল।
ছয় কিলোমিটার যাওয়ার পর একটা উপজাতি গ্রাম পড়লো। নয় দশটা ঘর নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে গ্রাম। সবকটি ঘর বাঁশ ও কাঠের খুঁটির ওপর মাচা করে নির্মিত। বাইসন, হাতি, লেপার্ডের হাত থেকে বাঁচার জন্যে এই ব্যবস্থা। শেষ এক কিলোমিটার গরুর গাড়িতে করে পৌঁছানো গেল মেডলা ওয়াচ টাওয়ারে। রুন, বাপন সবার আগে দৌড়ে উঠতে শুরু করলো। দূরে শুকনো লম্বা ঘাসের মধ্যে দিয়ে একটা গণ্ডার দুটো শিশু গণ্ডারকে নিয়ে চলে যাচ্ছে গভীরে। একশ মিটারের মধ্যে দুটো ময়ুর পেখম মেলে দাঁড়িয়ে আছে। দূরে সরু মূর্তি নদী বয়ে যাচ্ছে। একটা হাতি নিয়ে একজন মাহুত নদী পেরিয়ে খুব ধীরে এদিকেই আসছে। বেশ কিছু ফটো তোলা হোল। চারিদিক খুব দ্রুত অন্ধকার হয়ে এলো।
গাড়িগুলো যেখানে পারকিং করা ছিল সেখানে একটা মঞ্চ আছে। সেই মঞ্চে Tribal Dance এর ব্যবস্থা আছে। পুরুষ নারী কোমর ধরে মাদল বাজিয়ে নাচ করছে। শ্রুতি আর রুন নৃত্যশিল্পীদের সাথে পা মেলাতে থাকলো। এদিকে ভীষণ ঠাণ্ডা বাতাস বওয়া শুরু হল। সবাইকে কফি আর বিস্কুট দিয়ে যায়। এত অন্ধকার চারিদিকে, পাশের মানুষকেও আর দেখা যাচ্ছে না। আশেপাশে অনেকেই লেপার্ডের কথা বলছে। তাড়াতাড়ি গাড়িতে বসা হোল। গাড়ি হেড লাইট বন্ধ করে এগোতে থাকে অল্প গতিতে। কারোর মুখে কোন কথা নেই। সকলেই টেনশনে জিপ্সির রেলিং শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার হুশিয়ারি দেয়, ‘আপনারা চুপ থাকুন। তিন দিন আগে এই সময় আমার গাড়ির সামনে লেপার্ড পরেছিল। এদের মতিগতির ঠিক নাই। বিরাট সেয়ানা মাল। অবশ্যি আমরা বহুত ডরাই বাইসনকে। একবার যদি গাড়ির সামনে দাঁড়ায়, প্রাণডা নিয়ে মেন গ্যাটে পৌঁছানো ঝামেলা। ‘
সুনীলের পা কাঁপছে আবার। পেছন ঘুরে তাকাতে পারছে না। কানের পাশে যেন কোন হিংস্র প্রাণীর নিঃশ্বাস পড়ছে। রুন, বাপন দুজনেই সুনীলের হাত, কোমর শক্ত করে ধরে আছে। ওরা যে সুনীলকে অবলম্বন করতে পারে, এই ভাবনা ছিল কল্পনাতীত। আকাশটাও বেজায় অন্ধকার দেখাচ্ছে। দুপাশে তাকালে যেন মনে হচ্ছে কালো কাপড়ের ওপর কালো রঙ দিয়ে স্ট্রাইপ আঁকা। সুনীলের গাড়ি ফেরার সময়েও লাস্ট বেঞ্চার। গাড়ির গতিবেগ খুব বেশি হলে ঘণ্টায় কুড়ি কিমি। হেল্পার গলা নামিয়ে বলল,
সাপের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন ঝুনঝুন করে ?
সর্বনাশ। গাড়িতে উঠে কামরায় নাকি ? জিজ্ঞাসা করলো সুনীল।
উত্তরবঙ্গ তো সাপ, জোঁকের ডেরা। ভয় পাইলে চলবো না।
সাফারিতে যে প্রাণসংশয় থাকে, কেউ বলেনি তো আমায় ?
শুরু হোল তোমার ভয়ের ফিরিস্তি ! এমনিতেই আমার শ্বাস আঁটকে যাচ্ছে।
ড্রাইভার হঠাৎ গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল। চারিদিকে সম্পূর্ণ অন্ধকার, নিস্তব্ধ পৃথিবী।
মনোজ কাঁপা গলায় বলল, ‘ কি ব্যাপার ? গাড়ি দাঁড়াল কেন ?’
ড্রাইভার – সিধা দেখুন। কেউ মুখ খুলবেন না। একদম চুপ।
শ্রুতি – কি ওটা ?
রুন – আমাদের খেয়ে ফেলবে নাকি ?
সুচিত্রা – কি হবে এবার ?
বাপন ও রুনকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে কাঁপতে থাকে সুচিত্রা।
মনোজ – ও ড্রাইভারদা, হেল্পারদা কিছু করুন।
ড্রাইভার – চুপ দাঁড়ান। মারতে চান নাকি সব কডাকে ? একটা শব্দ না।
গাড়ি থেকে পঁচিশ ফুট দূরে দুটো আগুনের বিন্দু জ্বলজ্বল করছে। একটুও নড়ছে না। কয়েক মিনিট কাটল কয়েক বছরের মতো। গাড়িতে সবাই স্ট্যাচু হয়ে আছে। রুন মুখে হাত চেপে কাঁদছে। সুচিত্রাও কেঁপে উঠছে মৃত্যুভয়ে। এত ঠাণ্ডায় মনোজ ঘাম মুছে যাচ্ছে। সকলেই ভাবছে এই মুহূর্তে আলো দুটি ঝাঁপিয়ে পরবে। হেল্পার নিঃশব্দে বলছে – ‘ আর কতক্ষণ রে মামা, যা না বাপ এবার।‘ হঠাৎ আলো দুটো এগোতে শুরু করে। গাড়ির পেছনে দাঁড়ানো সবাই পেছন দিকে সরতে থাকে। বাপন জোরে কেঁদে ওঠে। সুচিত্রা ভগবানের নাম করতে থাকে। আলোদুটো এতটাই কাছে চলে আসে যে অন্ধকারেও বিরাট শরীরের আন্দাজ করা যাচ্ছে। গাড়িটা একটু নড়ে উঠলো।
আরে সুনীল, সুনীল ! তুই নামলি কেন ?
বাবা, বাবা, যেও না।
তুমি নামলে কেন ? বাঘের সাথে মারামারি করবে নাকি ?
বাবা, পালিয়ে এসো।
আরে স্যার, নামলেন কেন ? মরবেন যে এইবার। লেপার্ড আধমরা কাউরে রাখে না।
কাউকে তো এগোতেই হবে। আমি না হয় যাই। বাঘের মাসি যখন – বলল সুনীল।
জিপসির সামনে দাঁড়িয়ে সুনীল উজ্জ্বল চোখ দুটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকালো। দুজনের মাঝে হয়ত নয়-দশ ফুটের ব্যাবধান। সুনীলের চোখদুটিও জ্বলছে। সারাজীবনের অপমান, অবজ্ঞা, ভয়, বিদ্রুপ, ব্যর্থতা সব অন্ধকারগুলো দুটো বিড়াল চোখের আলোয় হারিয়ে যাচ্ছে। সুনীল উপলব্ধি করছিল পৃথিবীর টান বাড়ছে। ব্যক্তিত্বের ওজন সুনীলকে নতুন সত্ত্বা দিলো যেন। পা আর কাঁপছে না। হাতের তালুও চুলকোচ্ছে না। চারটে চোখ একে অপরকে ঠাণ্ডা যুদ্ধে হারানোর চেষ্টা করছে। জঙ্গলের যাবতীয় শব্দ থেমে গেছে। ভীষণ নীরবতা যেন বিরাট বিপর্যয়ের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। উজ্জ্বল চোখদুটি আরও এগিয়ে এলো। তারপর হঠাৎ ডানদিকে মুখ ফিরিয়ে সুনীলের পাশ দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে নেমে গেল। কয়েকটা বন টিয়া ডেকে উঠলো। জংলী কোন ফুলের মিষ্টি সুবাস চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। হেল্পার চিৎকার করে ডাক দিল, ‘ ও স্যার, ছুটা আসুন, এ যাত্রায় বাঁচে গেলেন। ‘ সুনীল পেছন ফিরে গাড়ির দিকে এগোতে থাকে। চোখ দুটো দিয়ে তখনও আগুন ঠিকরে বেরচ্ছে ।
Tags: অরিন্দম ঘোষ, এক বাঘের মাসি, গল্প
email:galpersamay@gmail.com
Jiban dutta on February 3, 2021
বাহঃ, দারুণ গল্প।
Jiban Dutta on February 3, 2021
দারুণ গল্প।
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।