23 Jan

কারচুপি

লিখেছেন:শিলাজিৎ খাঁ


রমেনবাবু নিজের দামি হাতঘড়িতে সময়টা দেখলেন। ঠিক সন্ধ্যে ছটা। সাড়ে ছটা থেকে পড়ানো শুরু করতে হবে। ঠিক সন্ধ্যে সাড়ে ছটা। দেরি হলে মুশকিল। তবে এখনও কেউ এসে পৌঁছল না কেন? রমেনবাবু ভাবলেন, “যাক গে! দুজন এলে দুজনকে নিয়েই পড়ানো শুরু করে দেব।”

না, একটু ভুলই ভেবে ফেলেছিলেন তিনি। পাঁচ মিনিট পর থেকেই একাদশ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা আসতে শুরু করে দিল। ৩৫ জনের ব্যাচ। সপ্তাহে একদিন পড়ান, অন্যদিন অন্য ক্লাসের ছাত্ররা থাকে। তাই ঢিলেমি করা যায় না। তবে একাদশ বা দ্বাদশ শ্রেণীর বিরাট বড় সিলেবাসের ক্ষেত্রে দুদিন পড়ানোই ভালো। সেরকমই কিছু অনুরোধ করেছিল একদল ছাত্রছাত্রী। তবে রমেনবাবু কারোর অনুরোধ রাখেন না। তাঁর বিশ্বাস, তাঁর কাছে পড়ে অনেক ছাত্রছাত্রী জীবনে সাফল্য পেয়েছে। তাদের তো কোনোদিন কোনো অভিযোগ ছিল না। তাই নিজের বিশ্বাসেই অটল তিনি।

যাই হোক, ঠিক সন্ধ্যে সাড়ে ছটায় ৩৩ জন ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে তিনি পড়াতে বসলেন। প্রথমেই অবশ্য পড়া শুরু হল না, প্রথমে তিনি খুললেন তাঁর মাইনের খাতাটা। আজ মাসের প্রথম দিন, রমেনবাবুর ‘অ্যাডভান্স’ নেওয়ার দিন। প্রত্যেক ছাত্রকে এদিন গুরুদক্ষিণা দিতে হয়। রমেনবাবু এক-এক করে ছাত্রদের ডাকেন আর দক্ষিণা নেন। তিনি যেমন ঠিক সময়ে পড়ানো শুরু করেন, তেমনি ছাত্রছাত্রীদের কোনো বিষয়ে দেরি তিনি পছন্দ করেন না। কিন্তু যথারীতি দেবল আজ মাইনে আনতে ভুলে গেছে।

“পরেরদিন মনে করে আনবি। গত মাসেও দেরি করেছিলি। এরকম করলে পড়তে আসতে হবে না,” রমেনবাবু বলেন।

ঠিক ৬:৩৫ এ তিনি পড়াতে শুরু করেন। আর ঠিক ৬:৪০ এ ৩৪ নম্বর পড়ুয়ার আগমন।

“দেরি কেন?”

“স্যার, রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম ছিল।”

“ওসব অজুহাত আমি শুনতে চাই না, তাহলে বাড়ি থেকে আগেভাগে বেরোলি না কেন?”

“স্যার, স্কুল থেকে ফিরতেই তো সাড়ে ৫ টা বেজে যায়। আমার বাড়িটা তো স্কুল থেকে অনেকটাই দূরে।”

“ওসব আমায় বলতে আসবি না। আমি স্কুল থেকে এসে ঠিক সময়ে পড়াতে বসে যাই। আমি যখন পারছি, তখন তোর অসুবিধা কোথায়? আজ চলে যা। পরেরদিন আসবি। একটু শক্ত না হলে ছেলেরা বড্ড পেয়ে বসে।”

পরদিন সকাল। স্কুল যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন রমেনবাবু। স্ত্রীয়ের কাছ থেকে টিফিন ক্যারিয়ারটা ব্যাগে পুড়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। বাড়ি থেকে স্কুল তাঁর কাছেই। পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ।

পদার্থবিদ্যার শিক্ষক রমেনবাবু একাদশ শ্রেণীর ক্লাস টিচার। তাই প্রথম পিরিয়ডটাই তাঁর। এখানে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। রমেনবাবু টিউশনে যতটা পেশাদার, স্কুলে ঠিক তার উলটো। টিউশনে তিনি বাড়তি কথা বলতে পছন্দ করেন না। তবে স্কুলে এসে তিনি বন্ধুবৎসল হয়ে যান। ছাত্রদের সঙ্গে গল্প করতে করতে ক্লাস করাতে পছন্দ করেন আর একটা চ্যাপ্টারই অনেক গভীরে ঢুকে পড়ান। সিলেবাস শেষ হয় না ঠিকই, সে যাই হোক। ছাত্ররা তো অনেককিছু জানতে পারে।

তবে প্র‍্যাকটিকাল ক্লাসে তিনি আবার আগের মানুষটি হয়ে ওঠেন। পান থেকে চুন খসা একদম পছন্দ নয় তাঁর। এই তো আজ, সামন্তক একই জিনিস বারবার ভুল করছিল। তাই বেশ কিছু অপ্রিয় সত্য সহ্য করতে হল তাকে।

রমেনবাবুর সহকর্মী অজিতেশবাবু। তিনিও ফিজিক্স পড়ান আর রমেনবাবুর মত প্রচুর টিউশনি করেন। তবে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। বেশ কিছু দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীকে পড়ান তিনি। অজিতেশবাবু মনে করেন, সরকারের থেকে তিনি তো টাকা পাচ্ছেনই। তাই একটু সমাজসেবা করলে মন্দ কি?

পরের সপ্তাহে একাদশ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা আবার পড়তে এসেছে রমেনবাবুর বাড়িতে। শুরুতেই তিনি টার্গেট করলেন দেবলকে।

“মাইনে এনেছিস?”

“না, মানে…”

“আমি কোনো ‘মানে’ শুনতে চাই না। পয়সা দিতে পারিস না তো পড়তে আসিস কেন? পরেরদিন মাইনে নিয়ে তবে পড়তে ঢূকবি।”

“স্যার, মাইনেটাই কি সব?”

“মাইনে আনেনি আবার স্যারের সঙ্গে মুখে মুখে কথা। বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা এখুনি।”

দেবল বেরিয়ে গেল, একেবারেই বেরিয়ে গেল। আর ফিরে এল না রমেনবাবুর কোচিং ক্লাসে।

পরে অবশ্য দু-তিনবার অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন করেছেন দেবলের ব্যাপারে। দেবল ছাত্রটি পড়াশোনায় খুব মেধাবী। কোনোদিন তো স্কুল কামাই করে না। তবে এতদিন টিউশন পড়তে এল না কেন? রমেনবাবুর গলায় শোনা গেল আক্ষেপের সুর, “এক মাসের মাইনে মেরে দিল ছেলেটা।”

অবশেষে এগিয়ে এল প্র‍্যাকটিকাল পরীক্ষা। দেবল পড়াশোনায় যতটা ভালো, ততটাই ভালো প্র‍্যাকটিকালে। সত্যি, আজ ফিজিক্স প্র‍্যাকটিকালে ও যেন একটু বেশিই তৎপর। সবাই ওর খুব প্রশংসা করল। রমেনবাবু থেকে অজিতেশবাবু, কেউই বাদ গেলেন না।

দুদিন পর স্টাফ রুমে এই প্র‍্যাকটিকাল পরীক্ষারই খাতা মূল্যায়ন করছেন রমেনবাবু। প্র‍্যাকটিকাল পরীক্ষায় সব শিক্ষকই কমবেশি সাহায্য করেন ছাত্রদের। তারপরও দেখা যাচ্ছে, সবাই কমবেশি ভুল করেছে। ব্যতিক্রম শুধু দেবল। ওর খাতায় পেন ছোঁয়ানো গেল না। অজিতেশবাবু পাশেই বসে ছিলেন। তিনিও দেবলের কৃতিত্ব দেখে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছিলেন। একে তো তিরিশের কম দেওয়াই যায় না। কিন্তু রমেনবাবু পরীক্ষার খাতা, প্র‍্যাকটিকাল খাতা, মৌখিক পরীক্ষা – সব কিছু বিচার করে তিরিশে সাতাশ দিলেন।

অজিতেশবাবুর সামনে একদিনের ছবি ভেসে উঠল। সঠিক তারিখ মনে নেই; সেদিন রমেনবাবু উপহাস করে দেবলের নামে কী বেশ বলেছিলেন। কথাটা খুব একটা ভালো লাগেনি অজিতেশবাবুর। কিন্তু রমেনবাবুকে চটাতে তিনি একদম পছন্দ করেন না। তাই কিছু বলেননি।

খাতা দেখা শেষ। এবার প্রধান শিক্ষককে নম্বরের লিস্টটা জমা দিতে হবে। রমেনবাবু দিতেই যাচ্ছিলেন। কিন্তু অজিতেশবাবু আটকালেন। বললেন,”রমেন, দাও না। আমিই দিয়ে আসছি। তোমাকে যেতে হবে না।”

“ঠিক আছে, তুমিই দিয়ে এসো।”

অজিতেশবাবু কাগজটা নিলেন। পৌঁছেও দিলেন প্রধান শিক্ষকের ঘরে। তবে ছোট্ট একটা কারচুপি।

২৭ কেটে ৩০।

Tags: ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ