আমার বাল্যবন্ধু গোরক্ষনাথ সেন ওরফে গোরার সাথে আপনাদের পরিচয় ঘটে নি। সে ডিটেকটিভ হতে চায়। ঘরময় বাংলা-ইংরেজী গোয়েন্দা গল্পের বই। সারাদিন সে ওসব নিয়েই চর্চা করে। সংসারে তার খাওয়া-পরার দুশ্চিন্তা করতে হয় না। বছর দুয়েক হল, চাকরীর পরীক্ষা দেওয়ার নাম করে সে একটা ঘর ভাড়া নিয়েছে বাড়ি থেকে সামান্য দূরে। সেখানে একা-ই থাকে। বাড়িতে বলেছে যে এতে নাকি পড়াশোনার সুবিধা হয়, কিন্তু আসল মতলব হচ্ছে নিজের অদ্ভুতুড়ে কান্ডকারখানা নির্বিরোধে সুসম্পন্ন করা। সেই সব কারবারে আমি হচ্ছি ওর সঙ্গী।
আমি সুমিত, আর্টিস্ট মানুষ। নিজের বাড়ি এই শহরেই, কিন্তু দিনের কিছুটা অংশ গোরার ভাড়া করা ঘরটাতেই কাটিয়ে থাকি। গোয়েন্দা গল্প আমিও একটু-আধটু পছন্দ করি। এরকম আরও ছোটোখাটো মতের মিল আছে অনেক জায়গাতেই। অমিল-ও আছে, তবে সেসব বড় কথা নয়। গোরা আমাকে নিজের সাগরেদ ঠাউড়েছে, সে হামেশা-ই বলে, ‘প্রোফেশানাল গোয়েন্দা হওয়ার পরে তুই-ই আমার তোপসে হবি রে!’
আমি হাসি। শুধু ‘তোপসে’ কেন, কখনও ‘অজিত’, কখনও ‘ওয়াটসন’ — আমি কে নই? ও যখন যেটা খুশি সেই নাম ধরে আমায় ডাকে। কিছু বলি না। ছোটোবেলা থেকে যেসব গল্প পড়ে বড় হলাম, নিজেকে ওই সামান্য সময়ের জন্যও তাদের একটার অংশ বলে ভাবলে বেশ অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। সত্যিকথা বলতে কি, আজও যে সব চরিত্ররা আমার খুব ফেভারিট, মনে মনে সাংঘাতিক জীবন্ত — গোরার দৌলতে নিজেকে তাদের মধ্যে একজন হিসেবে মনে করতে খুব খারাপ লাগে না। একটা অসম্ভবকে সম্ভব বলে সন্দেহ হয় — মনে হয়, সে’সব পুরোনো দিনগুলো বোধহয় হারিয়ে যায় নি …… ভেবে দেখুন, বেশ থ্রিলিং ব্যাপার কিন্তু!
গোরার সঙ্গে বেশ কয়েকটা অভিযান পার করে ফেলেছি, আরও হয়ত করব। আজকেরটা বলতে গেলে আমাদের প্রথম। একটু আলাদা-ও। কেন এমন বলছি, সেটা বুঝতে হলে পুরোটা পড়তে হবে।
শীতকাল আসলে গোরাকে আটকানো সবচেয়ে কঠিন। ঘরে থাকতেই চায় না। বিশেষত, দুপুরের দিক থেকে-ই তার উসখুসানি শুরু হয়ে যায়। আমাকে ফোন করে বলে, ‘কাল বেরো, একটু গোয়েন্দাগিরি করে আসি!’ আমার সময় হয় না সব দিন। শীতের মোলায়েম দুপুরে কলেজ স্ট্রিট চত্বর, হেঁদুয়া পার্ক বা নর্থ কোলকাতার গলিঘুঁজি ঘুরতে মন্দ লাগে না, কিন্তু ও বললেই যেতে পারি না। ও ব্যাটা-ও নাছোড়বান্দা, আমায় না পেলে একা-একাই বেড়িয়ে পড়ে ট্রেনে-বাসে চেপে। এরকম দিনগুলোতে সন্ধ্যেবেলায় ওর বাসায় গিয়ে ওকে পাওয়া-ও যায় না সেইজন্য। অন্য সময়েও এমন হয়, তবে শীতে একটু বেশী-ই। অনেকটা বয়স্কদের বাতের মত ব্যাপার।
ঘটনাটা গত বছরের। ঠিক ধরেছেন, শীতকাল। ডিসেম্বরের প্রথম দিনগুলো পার করে শীত সবে আড়মোড়া ভাঙছে। এর মধ্যে কয়েক সপ্তাহ গোরার দেখা পাই নি। শণি-রবি ছাড়া সময় হয় নি এই ক’দিন, কিন্তু তাও গিয়েছিলাম। প্রতিবার-ই গিয়ে দেখি তালা মারা। যাই হোক, সেদিন তখন দুপুরবেলা। লেপের ভেতরে সেঁধিয়ে বসে জানালা দিয়ে চুঁইয়ে আসা উত্তুরে হাওয়ার ভেতরে তরুণ-তরুণীরা আসন্ন মেলাসমূহের আমেজ এবং বাচ্চারা পিঠে-পুলির গন্ধ টের পাচ্ছে। অনেকে আবার ট্রিপের প্ল্যান কষছে। দূরের এবং আশেপাশের সোনালী রোদ-মাখা বাড়িগুলোর ছাদের রেলিঙে রং-বেরঙের সোয়েটার, কার্ডিগান, কাঁথা দেখা যাচ্ছে। প্রুসিয়ান ব্লু আকাশের কনট্রাস্টে যেন ঝুলন্ত কিছু ম্যাজেন্টা, পিংক আর সাদা লিফলেট। সাথে দূরের আর কাছের কিছু সবুজ গাছের পাতার উঁকি-ঝুঁকি। এক প্রাক-বিকেল কুঁড়েমির অবকাশে আমিও এতসব রঙের ভেতরে আশ্চর্য কিছু কম্বিনেশান ভেবে ফেলছি — এমন সময় গোরার ফোন।
“একি?! … আরে, বেরো একদিন!!!” — এটা ওর আদেশ না উপরোধ, ঠিক বুঝলাম না।
উত্তরে বললাম, “ আগে বল তুই আছিস কি? … শালা, তিন দিন গেলাম, দরজায় তালা …”
গোরা বলল, “আরে হ্যাঁ, ওই গিয়েছিলাম একটু বিশেষ কাজে … সেটা নিয়েই তো দিন কেটে গেল আর কি …”
বললাম, “ওহ! যাক গে, তা বল কোথায় যাবি? … আগে-ই বলে রাখছি, বেড়াতে যাওয়া হবে না আমার। পকেট খাঁ খাঁ করছে …”
— “আহা! … দিন-দিন তুমি একটি নিতান্ত গবেট তৈরী হ’চ্ছ, অজিত! … সে’সব নয়। একটি বিশেষ কাজে যাব, তুমিও চল। দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ কলেজ স্ট্রিট …”
শুরু হয়ে গেছে। প্রিয় পাঠক, আমি সুমিত থেকে ‘অজিত’, ‘তোপসে’ বা ‘ওয়াটসন’-এ নামান্তরিত হলে-ই বুঝে নেবেন যে গোরা তার জোনে চলে গিয়েছে। এবার ফেলুদা-ব্যোমকেশ-শার্লকের পুঁই-চচ্চড়ি হল বলে!
শীতের দিনে কলেজ স্ট্রিট … ওহো! ভাবলেও ভালো লাগে! … তা-ই একবাক্যে ‘না’ করতে পারলাম না।
— ‘কি করবি গিয়ে? … বই-টই কিনবি নাকি?’
গোরা হাসল। বলল, “আরে, বাবা-কে তো ওই ঢপ-টাই মেরেছি! তিনশো টাকা-ও বাগিয়েছি … সে ঠিক আছে, অবশ্য বই একটা নেওয়ার কথা আছে, তবে সেটা ঠিক …… তাছাড়া বই না পেলে অন্তত কেজিখানেক খাতা কিনলে-ই বা কি আছে! … কিন্তু … সর্বোপরি কিছু বিশেষ কাজ …”
— “কি কাজ?”
— “কাল বলব। আপাতত বলতে গেলে, খুব বিশেষ … কিছু বিশেষ কাজে কাল … বিশেষ …” বারবার ‘বিশেষ’ শব্দটার উপর জোর দিতে লাগল গোরা। টেনে টেনে বলছে কথাটাকে। ফাজলামোর অষ্টোত্তরশতঢং!
— “হ্যাঁ, বিশেষ তো বটেই! …আসল কথা-টা বল না! মেয়ে-ফেয়ে দেখবি আর টাইমপাস করবি — এই তো?!”
— “আরে ছি ছি, তৌবা তৌবা!” ভাঁড়ামো আনলিমিটেড চলতে-ই লাগল, “তুমি দেখি খুব-ই অশ্লীল হয়ে পড়ছ অজিত! … মনে হচ্ছে, কিছুদিন বাদে তুমিও নন্দদুলালবাবুর মত মাকড়সার রস চেটে বটতলার চটিবই লিখতে বসবে … ইসস … ছি ছি ছি ……”
আর এ’কথায় কাজ নেই। ঈশ্বরের ফোকোটিয়া জীব, হাতে অঢেল সময়। ফালতু বকে-ই চলবে। সেই চক্করে আমার আইডিয়া গুম হয়ে যাবে। তাই ডাইরেক্ট খেললাম, “সেই …… যাক গে, কবে যাবি? … কাল হবে?”
— “কাল তো … শুক্রবার ……… না, পরশু! শনিতে-ই হউক! দিবা তিন ঘটিকা গতে …”
— “মার্কেট বন্ধ হয়ে যাবে তো! শণিবার দুটোর পরে …”
— “চল না! সেটিং আছে।”
— “বুঝেছি। টিকিট স্পনসর করবি। আমি টাইমলি দু’ নম্বরে থাকব।”
— “তথাস্তু।”
— “আর হ্যাঁ, দেরী করবি না বলে দিলাম …”
গোরা ততক্ষণে ফোন রেখে দিয়েছে। আমার কথাটা শুনল বলে মনে হল না। … শুনলেও বা কি আর হত? …
ভাবলাম, ‘বিশেষ কাজ’ … হুম! …… জানা আছে! …… সেদিনের বাকী বিকেলটায় আর্টের চিন্তা আর জমল না।
ট্রেনে সিট পেয়েছিলাম কপাল জোরে। পাশাপাশি নয়, মুখোমুখি। আশেপাশে কিছু তাস-পেটানো পাবলিক জুটে গিয়েছিল, তারা এমন ব্যস্ত ছিল খেলায় যে ধারে-কাছে বোমা পড়লে হয়ত একবার আড়চোখে দেখে নেওয়ার কষ্ট করতে পারে মাত্র।
কয়েক দফা ‘দাদা, একটু চেপে বসুন’ –এর পরে একটু পোক্ত হয়ে বসা গেলে গোরা একটা কাগজ আমার হাতে ধরিয়ে দিল। চারকোনা একটু ময়লা-ধরা কাগজ। আমি সেটার দিকে ভালো করে না তাকিয়ে-ই বলে বসলাম, ‘এটা কি বে?’ ও বলল, “এটা … একটা এনক্যাশেবল ভাউচার বলতে পারিস। পড়ে তো দ্যাখ …’’
কাগজে কালো ডট পেনের কালিতে একটু বাঁকা-বাঁকা অক্ষরে চারটে লাইন লেখা ছিল।
“বিদেশিনীর সমস্ত নাম
লেখা বাংলার অক্ষরে,
ছোটো কিলোমিটার যেতে-না-যেতেই
শেষ তন্ত্রের পাঁচ পরে।”
“কি এটা? কবিতা লিখছিস নাকি?” বলেছিলাম আমি।
চোখে-মুখে একটু মেকি গাম্ভীর্য এনে গোরা উত্তর দিয়েছিল, “উঁহু … মগজাস্ত্র প্রয়োগ কর তোপসে, মগজাস্ত্র …”
এর পরে আর কথা এগোল না। হাতি-ঘোড়া কিছুই বুঝলাম না, কিন্তু কাগজটা ভাঁজ করে বুক পকেটে-ই রেখে দিলাম। পরের স্টেশনে গাড়ি চলে এসেছিল ততক্ষণে। এক পাল লোক ট্রেনে উঠে আমাদের মাঝে এসে ‘হিউম্যান ওয়াল’ বানিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। একটু-আধটু রন্ধ্র দিয়ে মাঝে-মধ্যে যেটুকু চোখে পড়েছিল তাতে দেখেছিলাম, উদাস অথচ চিন্তাবিহীন চোখে জানালার বাইরে চেয়ে রয়েছে গোরা। হাওয়ায় কয়েকটা চুল উড়ে চলেছে ওর …
ট্রেনের কামরা থেকে লাফ মেরে শিয়ালদহ স্টেশনের চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে নামতে নামতে রোদের রং বদলে গেছে দেখলাম। চারপাশে একটা সূক্ষ্ম ধোঁয়ার কয়েকখানা রোঁয়া উড়ে বেড়াচ্ছে হাওয়ায় হাওয়ায়। অসংখ্য লোকের ভেতর দিয়ে আমরা দুইজন এগিয়ে চললাম ঠিক যেন বর্ষার কোনো ঠিকানাবিহীন খর ধারায় দু’-একটা খড়কুঁটো ভেসে চলে। আমি গোরাকে বললাম, “যাবি-টা কোথায়?”
গোরাকে ইতিমধ্যেই একটা ছানার পোঁটলাওয়ালা লোক পেছন থেকে ধাক্কা মেরে চলে গেছে। সে ওই লোকটাকে গালাগাল দেওয়ার ফাঁকে বলল, “কলেজ স্ট্রিটে-ই ঘুরব একটু … তারপরে কিছু বিশেষ কাজে ……… অ্যাই, দেখে চলতে পারো না শালা, আমায় বলছে আবার …”
চেনা পথে কলেজ স্ট্রিটে আসতে বেশীক্ষণ লাগল না। সূর্যসেন স্ট্রিটের ভিড়টা অন্যান্য দিনের মতই ডায়নামিক মনে হল। একটা চলমান ছবি। সবাই সবাইকে দেখছে, কিন্তু তারপর এক পলকের জন্যও মনে রাখছে না। ভালো ব্যবস্থা। আমার হিসেবে দেখেছি, যাবতীয় মানসিক বেদনার পিছনে একটা না একটা মনে-রাখা দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো দিন, কোনো লোক, কোনো ঘটনা — কিছু একটা জিনিসের ইলংগেটেড মনে-রাখা বা মনে মনে ধরে থাকা … এই যে নীল কার্ডিগান আর হলুদ সালোয়ারের মেয়েটা একটা বাজনার দোকানে দাঁড়িয়ে ঝুলন্ত এক গিটারের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা ডেনিমের জ্যাকেট পরিহিত ছেলেটার দিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেল, সে কতক্ষণ মনে রাখবে ওকে? আর রাস্তার অন্য পাশে দাঁড়ানো লাল-কালো কটসউলের জামা পরা আরেকটা ছেলে যে ওই মেয়েটার-ই দিকে তাকিয়ে রইল একটানা সেটা থেকে খুব বেশী হলে একটা কবিতা বা গান তৈরী হতে পারে, ব্যস। কয়েকটা মুহূর্তের সমাবেশমাত্র, ‘তারপর’ বলে কিছু-ই নেই। তাই নয় কি? ……
— “কিছু বুঝলে অজিত?”
প্রশ্নটা পাশ থেকে এসেছে। কনটেক্সট না বুঝেই বললাম, “অ্যাঁ, কি বুঝব?”
— “ওই চারটে লাইন … বলছি, ওগুলোর মানে বুঝলি কিছু?”
কপাল! … বললাম, “ঘন্টা! কিন্তু বুঝতে হবে নাকি? …… আধুনিক কবিতা পড়ার দায় পাঠকের সেটা জানতাম, আবার বুঝতেও হয় ?!”
— “ওটা কবিতা নয়।”
— “তাহলে?”
— “সংকেত। ওটার উত্তরে একটা জায়গার নাম আছে। সেটা বলতে হবে। ভাব, ভাব …”
কেন বলতে হবে, কার সংকেত, গোরাকে কেন দিয়েছে — এসব প্রশ্ন করার আগে-ই গোরা একটা দোকানের সামনে থেমে গেল। আমিও থামলাম। বই-এর দোকান। কিন্তু বেশ বড়। দোকানের দিকে তাকাতে-ই দেখলাম, সেটার ভেতরে যে তিনজন লোক তখন বসে ছিলেন তাদের মধ্যে একজন আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছেন আর হাত নাড়ছেন। আমাদের চেনে নাকি লোকটা? গোরার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সে-ও বেশ কাঠ-কাঠ একটা হাসি হাসছে।
হাসাহাসির পালা সংক্ষিপ্ত চলল। গোরা দোকানে ঢুকে পড়ল এবং সাথে সাথে প্রশ্ন করল, “আরভ নেই?”
যে লোকটা হাসছিল সে হাসতে-হাসতে-ই বলল, “আরে, ও এখানে আসবে কেন? ও তো নিজের দোকানে!”
— “ও হো! আমি ভাবলাম, ও হয়ত দিনে বসে এখানে …”
— “না, না! জান’-ই তো, ভাই-এর ঝোঁক কত বিশাল! … না হলে বংশের কারবার ছেড়ে ……”
কিছুক্ষণ এসব-ই চলল। গোরাদের বাক্যালাপ যখন প্রায় শেষ হয়ে আসছে, সে-ই সময় একটা বয়স্ক লোক দোকানের ভেতরে ঢুকে পড়লেন। ময়লাটে সাদা পাঞ্জাবি আর ঢলঢলে পায়জামা পরা, বাঁ কাঁধে কাপড়ের সাইড ব্যাগ। গায়ের রং মাঝারি, চোখে কম দামের কিন্তু হাই-পাওয়ারের চশমা, মাথায় মস্ত টাক, বয়স কম-সে-কম পঞ্চান্ন-ষাট। হাবেভাবে খুব ব্যস্ততা রয়েছে, ছটফটানি রয়েছে। কিন্তু কিসের একটা কুণ্ঠাতে যেন সেটা কিছুটা সংযম মানতে বাধ্য হয়েছে। চেহারায় একটা চিন্তা আর অসুস্থতার ছাপ ও আমার নজরে আস’ল।
ভদ্রলোক দোকানে ঢুকতেই প্রথমে গোরার সেই পরিচিত লোকটির মুখ একটু কালো হয়ে গেল। তারপরে একটা বিরক্তির ভাব ফুটে উঠল তাতে। তিনি বলে উঠলেন, “ওহো … এসে গেছেন? … আরে, এই তো দিয়ে গেলেন! এত তাড়াতাড়ি হয়? … দেখা হয় নি দাদা, আপনি পরের মাসে আসুন প্লিজ, পরের মাসে …”
বয়স্ক লোকটার কুণ্ঠাভাবটা আরও যেন স্পষ্ট হয়ে এল। খুব মিহি আর গুটিয়ে-নেওয়া গলায় বললেন, “বলছি যে, আমায় মাফ করবেন … আগের দিন যে পাণ্ডুলিপিটা দিয়ে গিয়েছিলাম, তাতে না দু-একটা ভুল ছিল! আমি পরে দেখলাম, জানেন … আজ ফ্রেস করে এনেছি, একটু যদি ……” এই বলে একটা প্রমাণ সাইজের কাগজের রোল-করা বান্ডিল এগিয়ে দিলেন ভদ্রলোক।
“এ’ কার্তিক, একটু নে তো বাবা বান্ডিলটা …” খুব তেতো গলায় বললেন গোরার সেই পরিচিত লোকটা। বলামাত্র একটা ‘বেশী-পাকা’ টাইপের দেখতে ছোকরা এসে প্রৌঢ় লোকটির কাছ থেকে কাগজগুলো নিয়ে ভেতরে চলে গেল। লক্ষ্য করলাম, ছেলেটার মুখে একটা চাপা হাসি, যেন জেনে-বুঝে রঙ্গ করছে।
লোকটা কাগজগুলো দেওয়ার পরে একটা শ্বাস ছাড়লেন। স্বস্তির হয়ত। তারপর নরম গলাতে অনুরোধের মত বললেন, “ও … আর বলছিলাম কি … কবি হিসেবে নামটা মনোতোষ সিংহ হবে, আগেরটায় সিনহা …”
“পরের মাসে, পরের মাসে আসুন … সব হবে… পরের মাসে …” মালিক যেন এঁকে তাড়াতে পারলে বাঁচেন।
লোকটা আর দাঁড়ালেন না। কেমন কালো একটা মুখ নিয়ে নমস্কারের ভঙ্গিমা করে বেরিয়ে গেলেন।
“লোকটা কে, দাদা?” গোরা প্রশ্ন করল।
দোকানের মালিক জবাবে একটু হাসলেন, তারপর বললেন, “আরে আর ব’ল না! পাগল, আস্ত পাগল! প্রতি মাসে আসে, কবিতার বই ছাপাবে বলে। ও-ও নাকি একজন কবি! বোঝো ঠ্যালা … ”
— “তারপর?”
— “আর কি? … পাবলিশার্স হিসেবে নাম আছে আমাদের ভাই, যার-তার বই ছাপলে কি চলে? বললেই হল!”
— “তাহলে ‘না’ বলে দিন না!”
— “বহুবার বলেছি, কাজ হয় নি। বারবার আসে! … তাই এই পন্থা নিতে হল। যখন-ই আসে, পরের মাসে আসতে বলে কাটিয়ে দি-ই। ফের আসলে ফের ভাগাই। আমি নাহলে অন্য কেউ … এভাবেই চলছে, হে হে …”
খারাপ লেগেছিল, কিন্তু কিছু করার নেই। এরকম তো হয়ে-ই থাকে।
এরপরে কিছু মামুলি খেঁজুরে-আলাপ টাইপের কথা হল। সেসব বিশেষ মনে রাখার মত নয়। রাখি-ও নি। কিন্তু আন্দাজ পেয়েছিলাম যে এই লোক আর তার সেই ‘ভাই’ আরভের সাথে গোরার পরিচয় বেশ জোরদার।
দোকান থেকে বেরোতেই সেটার প্রমাণ পেয়ে গেলাম। গোরা মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “যত্তসব ইউজলেস লোকজন! … ভুলেই গেছিলাম দোকানটার কথা। না হলে অন্য পথে আসা যেত … টাইম নষ্ট! চিনেও ফেলেছে মাইরি! … এখন মুখোমুখি হয়ে গেলে হ্যা-হ্যা করে হাসলে কিছু তো বলতেই হয় … ধুর! … আর তাছাড়া কপালও দ্যাখ, ব্যাটা ওই সময়-ই তাকিয়ে বসেছিল রাস্তার দিকে …” গোরার গজগজানি চলল অনেকক্ষণ। এক সময় আমি বললাম, “আরভ কে রে?”
গোরা আমার দিকে বিস্মিতের মত তাকাল, তারপর বলল, “সেকি! ভুলে গেলি? … আরভ দত্তরায়, ভুলে গেলি?”
“আরভ দত্তরায় … আরভ …… ও হো! …” মনে পড়ল বৈকি! আরভ তো আমাদের সাথে কলেজে পড়ত। গোরার সাথে ভালো ভাব ছিল, গোরা তো ওর বাড়িতেও গিয়েছে বলে মনে পড়ল। স্ট্রিম আলাদা ছিল বলে আমার সাথে কোনদিন-ই খুব গভীর দোস্তি হয় নি, তাই …… আরে, তাই তো! ওদের তো বড় আর পুরোনো পাবলিশিং হাউজ ছিল বলে শুনেছিলাম … হ্যাঁ হ্যাঁ …
কথাগুলো গোরাকে বলতেই সে যা যা বলেছিল তার সারাংশ এই যে — হ্যাঁ, এ সে-ই আরভ। সে নাকি আচমকা অনুভব করে যে তার পাবলিশিং-এ কোন ইনটারেস্ট নেই, তার প্যাশান ‘অ্যান্টিকস’। কলেজ স্ট্রিটের-ই এক জায়গায় সে নাকি তার একটা ছোট ‘আউটলেট’ করেছে বছরখানেক আগে। বাড়ির ছোট ছেলে বলে কেউ খুব বেশী বাঁধা দেয় নি, ‘বংশের কারবার’ এখন দেখে আরভের বাবা আর দাদা, মানে যার সাথে একটু আগেই আমরা বকমবাজি করে আসলাম … তা গতমাসে হঠাৎ এই আরভ নাকি গোরার সাথে যোগাযোগ করে কিছু ‘বিশেষ’ কাজে এবং আরভের সে-ই দোকানে, সরি, ‘আউটলেট’-এ যাওয়াটা আমাদের মেইন কর্মসূচী।
“তা সেই ‘বিশেষ’ কাজটা কি?” প্রশ্ন করলাম এক সময়।
— “বলব। কিন্তু তার আগে ওই চারটে লাইনের অর্থ বল। ক্লু হচ্ছে, একটা জায়গার নাম ওটা। ”
— “সে তো অগুনতি জায়গা আছে পৃথিবীতে। যে কোন জায়গাই হতে পারে। ওভাবে বলা যায় নাকি?!”
— “আহা! … ফেমাস জায়গা … অনেকে-ই ঘুরতে যায়। ফেলুদার তো গল্প-ও আছে একটা-দুটো ওখানকার পটভূমিতে …… ভাবতে থাক, ভাবতে থাক …”
এম জি রোডের ভিড় সামলে পকেটের কাগজটা আরেকবার সাবধানে বের করলাম। পড়লাম চারটে লাইন। কিন্তু বিশেষ কিছুই বোঝা গেল না। সবচেয়ে গোলমাল তো প্রথম লাইনটাতেই। ‘বিদেশিনীর সমস্ত নাম’ … মানে কি? কোন বিদেশিনী তাই জানা নেই, তো তার আবার সমস্ত নাম! গোরা জাত-লম্পট, বিদেশিনী জোটানো খুব বড় কথা নয়, কিন্তু সেটা কে না জেনেই তার সম্পূর্ণ নাম কি জানা সম্ভব? … অবশ্য এটা গোরার কোন পরিচিত বিদেশিনীর ব্যাপারে আদৌ বলা হচ্ছে কিনা সেটাও জানা নেই। অন্য কেউ কাগজটা দিয়ে থাকলে ব্যাপারটা তেমন না-ও হতে পারে ……তার উপর ‘ছোট কিলোমিটার’! কিলোমিটার তো স্ট্যান্ডার্ড ইউনিট বলে স্কুলে পড়েছি, তার আবার ছোট-বড় হয় নাকি? … শেষে আবার তন্ত্রের কথা রয়েছে … গোরা কি তান্ত্রিকের খপ্পরে পড়ল নাকি? কিছুই বলা যায় না ……… নাহ, কিছুই আসছে না মাথায়! …
কাগজটা আর নিজের কাছে রেখে লাভ নেই। গোরাকে দিয়ে দিলাম। ও সেটা যখন নিজের পকেটে চালান করতে লাগল তখন আরেকবার জিজ্ঞেস করলাম, “ভাবছি … কিন্তু, কাজটা কি সেটা এখন বলবি কি?”
— “ওহ ওয়াটসন, ওয়াটসন, ওয়াটসন! … হ্যাভ পেশেন্স … বিশেষ, কিছু বিশেষ কাজ, খুব বিশেষ ……”
আরভের ‘আউটলেট’-টা প্রায় আর্মহার্স্ট স্ট্রিট পোস্ট অফিসের কাছে। খুব বড় নয়, কিন্তু খুব সুন্দর করে সাজানো। ইতিমধ্যেই অন্ধকার নেমেছে। তাই আলোর রোশনাই খুলেছে ভালো। লাইটের ডিজাইনটা খুব ফাইন। দামী রেস্টুরেন্টের মত সফট একটা আলো, খুব উজ্জ্বল নয়। বনসাই অর্কিডের ঝুলন্ত টবওয়ালা কাচের দরজা ঠেলে দোকানের ভেতরে ঢুকতেই টের পেলাম কেমন একটা খুব মৃদু তেল-পোড়া টাইপের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে হাওয়ায়। হালকা আলোতে সাজানো অ্যান্টিকগুলো থেকে যেন আলাদা একটা আভা বেরিয়ে আসছে। ভেতরেও একটা অর্কিডের টব ঝুলছে, দুটো উইন্ড চাইম-ও ঝুলছে সেটার পাশে।
আমরা ঢুকতেই আরভ হাসতে হাসতে এগিয়ে এল। চিনতে পারলাম। একটু মোটা হয়েছেচ আর চোখে চশমা নিয়েছে — এই-ই যা। ও আমাকে চিনতে পারল। ভালো অভিনেতা হলে আলাদা কথা, কিন্তু আমাকে দেখে খুশি হয়েছে বলেই মনে হল।
এক’থা-সে’কথার পরে আরভ একসময় গোরাকে বলল, “এনেছিস তো? … সলভ হয়েছে?”
গোরা একগাল হেসে বলল, “হয়েছে বলেই তো মনে হয় …… একটা পেন দে তো …”
আরভ খুব দ্রুত একটা পেন এগিয়ে দিল গোরার দিকে। জামার পকেট থেকে সে-ই কাগজটা বের করে পেন দিয়ে খসখস করে কি একটা লিখে সেটাকে পেনসমেত আরভকে ফিরিয়ে দিল। আরভ কাগজটা চোখের কাছে নিয়ে দেখে নিল এক সেকেন্ড। তারপর একটু অবাক হয়ে গোরাকে বলল, “অ্যা?! … এইটুকু? এই জায়গা?”
গোরা উত্তর দিল, “হুম। আমার এটাই ধারণা। কাগজটা নিয়েই যাস। দ্যাখ না, ট্রাই কর।”
আরভ একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। এটার মর্মার্থ মনে হল এই যে ‘ট্রাই’ করা ছাড়া অন্য উপায় আপাতত নেই আরভের কাছে। কিন্তু ব্যাপারটা কি?
আরভ-ই কথা বলল প্রথম, “বেশ … এবার একটু বুঝিয়ে দে। মানে, কিভাবে ডিকোড করলি …… বলা যায় তো না, সেই ব্যাটা যদি এক্সপ্লেনেশান চায়? কি বলব? …”
গোরা বলল, “বলছি। কিন্তু তার আগে তুই এই তোপ … না, মানে এই সুমিতকে একটু আমাদের এই খেলাটার ইতিহাসটা একটু খুলে বল … সংক্ষেপে …”
“শিওর”, বলল আরভ, “তুই জানিস না আমি জানতাম না সুমিত … বলছি শোন তাহলে ……
তুই নিশ্চই দেখেছিস যে কলকাতা, এমনকি তোদের মফঃস্বলেও কিছু বিদেশি ঘোরা-ফেরা করে। অনেকে স্যোসিওলজির কাজ করে, কারও এনজিও, কেউ আবার প্রোজেক্টে কাজ করতে আসে। কিন্তু এদের একটা বড় অংশ, মানে যারা এই কলকাতা চত্বরে ঘোরে, তারা হচ্ছে ট্যুরিস্ট … তো গত মাসের শেষের দিকে এরকম-ই একজন মাঝবয়সী ফরেনার টুরিস্ট একদিন আমার দোকানে এসে হাজির। বলল, সাউদার্ন ফ্রান্স-এর লোক। যাই হোক, সে এসে অ্যান্টিক্স দেখতে লাগল। দেখে মনে হল, জিনিস কিনবে বলেই এসেছে, পয়সাওয়ালা। এটা-সেটা দেখতে দেখতে সে হঠাৎ আমায় বলল যে ভারতে বিদেশী আগমনের পরের দিকের ফ্রেঞ্চ শাসক ডুপ্লে-র সিলমোহর আছে কি না। আমি বললাম, না, নেই। সে ফের বলল যে আমি আনিয়ে দিতে পারব কিনা। আমাকে বলতেই হল যে ওই জিনিস আমার কালেকশানে নেই, আসার কথাও নেই। তখন সে একটা খুব ইন্টারেস্টিং বেইট দিল আমাকে। শোন কথাটা …
বলে কিনা, ভবানীপুরের একটা লোকের নাকি এরকম একটা দোকান আছে। সেখানে সে ওই ডুপ্লে-র সিলমোহর দেখেছে। নিজে-ই কিনে নিত, কিন্তু সেই দোকানের মালিক নাকি পাগল, এমন দাম হেঁকেছে যেটা নাকি অ্যাবসার্ড বললেও কিছুই বলা হয় না। এবার আমি যদি কোনোভাবে ওই জাতের সিলমোহর আনিয়ে দিতে পারি, লোকটা আমায় হাজার পাউন্ড পর্যন্ত দিতে রাজি আছে। ভবানীপুরের দোকানটার ডাইরেকশান দিল, সাথে এটাও বলল যে, সে নিউ ইয়ার অবধি কলকাতায় আছে, যাওয়ার আগে একটা হোটেলের নম্বরও দিয়ে গেছে। ব্যবস্থাও করতে পারলে আমি যেন ফোন করি …
জানিস-ই তো, আজকের দিনে অ্যান্টিক্সের ব্যবসার খরিদ্দার হাতে গোনা। সারা বছরে হাতে-গোনা মাল বিক্রি হয়। নিলামের-ও আর সেই বাজার নেই …… এমন পরিস্থিতিতে পাঁচশো পাউন্ডের অফার ………
আমি লোক পাঠালাম ভবানীপুরে। খরিদ্দার সাজিয়ে। সে এসে খবর দিল, লোকটার ওটা দোকান ঠিক না, ব্যক্তিগত সংগ্রহ। পাবলিকের জন্য ওপেন শুধু নয়, কেউ চাইলে এবং সাধ্য থাকলে জিনিস কিনতে-ও পারে। কিন্তু চাপ অন্য জায়গায়। লোকটা সত্যি-ই বদ্ধ পাগল। নেশাগ্রস্ত-ও হতে পারে। বয়স অনেক, কিন্তু সোজা পথে সহজে বাঁকানো যাবে না। বাঁকা পথ নেওয়ার কোন মতলব আমাদের নেই-ও … তো যাই হোক, আমার পাঠানো লোক ডুপ্লের সিলমোহরের দাম জিজ্ঞাসা করতেই সে-ই লোক বলে কিনা আড়াই লাখ টাকা। আমার বাজেট ছিল পঞ্চাশ-ষাট হাজার … তা সে-ই লোক দামাদামি করেও যখন সুবিধা করতে পারল না, তখন সে একটু অন্য পন্থা নিল। বলা হয় নি, যাকে পাঠিয়ে ছিলাম সে এমনিতেই ইতিহাসের স্টুডেন্ট ছিল একসময়ে, তার উপর আমার কথা শুনে ডুপ্লে-র উপর কিছু পড়াশোনা করে গিয়েছিল … কমিশনের ব্যাপার আছে তো …
অন্য পন্থা হচ্ছে, দোকানের মালিকের সাথে ইতিহাসের চর্চা আরম্ভ করা। ইমপ্রেস করার চেষ্টা। চেষ্টা যে ব্যর্থ হল তা বলা যাবে না। কারণ, কিছুক্ষণ ডুপ্লে-র পিন্ডি চটকানোর পরেই একটা অদ্ভুতুড়ে, লুন্যাটিক, অসম্ভব, অভাবনীয় অফার এল বুড়ো লোকটার তরফ থেকে। বলে কিনা, পনের দিনের ভেতর একটা ধাঁধার সমাধান করে দিতে পারলে সে নাকি সত্তর হাজার টাকায় ওই সিলমোহর ছেড়ে দেবে! … হ্যাঁ রে, সত্যি! কত বড়মাপের ছিটিয়াল ভাব একবার … আমার লোক অফারটা নিয়ে নেয়। এই চারটে লাইন হচ্ছে সেই ধাঁধাঁটা। লোকটা হিন্ট দিয়ে বলেছিল, এটার জবাব নাকি তার খুব প্রিয় একটা নেটিভ আর পরিচিত ট্রাভেল ডেস্টিনেশানের নাম। আর এটাও বলেছিল যে পনের দিনের পরে আসলে এই অফার আর ভ্যালিড থাকবে না। কাগজের পিছনে দ্যাখ, ডেট মারা আছে …”
আরভ কাগজটা এগিয়ে দিল আমার দিকে। সে-ই কাগজটা। এবার আমি চার লাইনের উলটো দিকের পাতায় দেখলাম, সত্যি-সত্যি-ই ডেট লেখা আছে। সাতাশে নভেম্বর। আজ নয়-ই ডিসেম্বর। মানে কাল-ই …
গোরা এবার বলল, “এরপরে আরভ আমার সাথে যোগাযোগ করে। কারণ প্রফেশনাল লোক দিয়ে এসব করাতে গেলে বাড়তি পয়সা, প্রাইভেসি দুটোই কমপ্রোমাইজ হবে। আর আমি তো ট্যালেন্টেড-ই ……”
গোরা-আরভ হাসতে আরম্ভ করল।
একটু পরে আরভ বলল, “এবার তুই ব্যাখ্যাটা দে …”
“দিচ্ছি …”, গোরা আরম্ভ করল, “ দ্যাখ, প্রথম যে জিনিসটা আমার কাছে সবচেয়ে অদ্ভুত লাগে সেটা হচ্ছে ‘ছোটো কিলোমিটার’। কিলোমিটার তো কিলোমিটার, ছোটো-বড় আবার কি! তারপরে ‘বিদেশিনীর সমস্ত নাম’। সেটাও কিম্ভুত। একটা জিনিস মাথায় এসেছিল, সেটা হচ্ছে, ‘তন্ত্রের পাঁচ’। এক জায়গায় পড়েছিলাম, তন্ত্রসাধনায় পঞ্চ ম-কার বলে একটা ফ্রেজ আছে। পাঁচটা ‘ম’। ‘তন্ত্রের পাঁচ’-এর অর্থ ওটার সাথে যুক্ত হতে পারে। কিন্তু আর সব ব্ল্যাংক ছিল …
পাঁচ-ছয়দিন আগে, পরীক্ষার জন্য ক্লাস সিক্স-এর একটা ইংরেজি ব্যাকরণ নিয়ে বসতে হয়েছিল ঝালাই মারার জন্য … এই দ্যাখো, হাসছে! ক্যালাবো না এমন …… যাই হোক, গ্রামার বই যে এত বড় ব্রেক-থ্রু দেবে আশা করি নি। কনটেন্ট পেজে গিয়ে চোখ আটকে গেল। প্রতিটা অধ্যায়ের ইংরেজি নামের পাশে ব্র্যাকেটে তার বাংলা তর্জমা করা আছে। Pronoun চ্যাপ্টারের পাশে দেখি লেখা ‘সর্বনাম’ … ”
আমি বললাম, “হ্যাঁ, তো সর্বনাম-ই তো … adjective হচ্ছে বিশেষণ, verb হল গিয়ে …”
— “ধুর ব্যাঙ, শোন না! … ‘সর্বনাম’ মানে কি? ‘সর্ব’-টাকে আলাদা করে ভাব একটু … ”
— “সব … সকল …… সমস্ত! … এই তো সমস্ত নাম!” আরভ রীতিমত উত্তেজিত হয়ে পড়েছে।
— “বিংগো!” গোরা বলল।
তাই তো! সর্বনাম মানে সমস্ত নাম — হতেই পারে! বেশ অবাক কিন্তু উদ্দীপ্ত হলাম।
গোরা বলে চলল, “এবার ঝামেলা হল বিদেশিনী। জেন্ডার তো ক্লিয়ার। ফিমেল। আচ্ছা, ‘বিদেশিনী’ বললে কি কি বৈশিষ্ট্যের কথা মাথায় আসে? … গায়ের রং-টা বাদ রাখ … ”
আরভ বলল, “আচ্ছা, রং বাদ দিলে … চুলের রং আলাদা, নীল বা কটা চোখের মণি … আর … আর ……”
“ইংলিশ স্পিকিং” দুম করে বলে বসলাম।
“সাবাশ তোপসে!” গোরা প্রায় লাফিয়ে উঠল, “কারেক্ট। ইংলিশ। তিনটে সূত্র পাওয়া গেল — ফিমেল, ইংলিশ ভাষা, সর্বনাম। এবার ‘লেখা বাংলার অক্ষরে’ … মানে কি হতে পারে? …”
আরভ, আমি দুজনে-ই চুপ। এ কেমন কথা?
গোরা বলল, “ কোন মহিলাকে বোঝানোর জন্য ইংলিশে ব্যবহৃত সর্বনাম হচ্ছে, She। এবার সেটাকে বাংলা অক্ষরে লিখলে হবে, ‘সি’। ‘দন্ত্য স’-তে হ্রস্ব-‘ই’ — সি। বিদেশী শব্দে ‘স’ ইউজ হয়, তাই ‘তালব্য শ’ বাদ দিলাম আর কি … ”
ভাবা যায়? এত কান্ডের পরে কিনা দেড়খানা অক্ষর! লোকটা তো উচ্চকোটির উন্মাদ দেখছি …
“তারপর?” আরভ বেশ মজা পেয়ে গেছে বুঝলাম।
“সি-এর ছাড়া বাকী অংশটা লুকিয়ে রয়েছে শেষ দুই লাইনের মধ্যে। একটা ক্লু এখনও হাতে রয়েছে, সেই ‘’পঞ্চ-ম”। সুমিত, আমরা যে ঠিকানা লিখি, তাতে pgs লিখি অনেক সময়। parganas লিখি না। কেন?”
বললাম, “সুবিধা। pgs তো parganas এর-ই abbreviation।”
— “abbreviation মানে কি? চলতি বাংলায় …”
— “ছোটো করে লেখা”
— “ঠিক। এবার কিলোমিটারকে যদি ‘ছোটো’ করে লিখতে হয় সেটার abbreviation কি হয়? ”
— “কি.মি.”
কথাটা বলে-ই একটা ক্রিকেটে ডাইরেক্ট হিট মারার মত ফিলিং হল। তাই তো! ‘ছোটো কিলোমিটার’ মানে তাহলে ‘কিমি’?! বাপ রে!
“এবার ফাইনাল ক্লু। ‘ছোটো কিলোমিটার যেতে-না-যেতেই / শেষ তন্ত্রের পাঁচ পরে।’ এতক্ষণে যা যা পেলাম সেগুলো সাজালে পাচ্ছি, কি এবং কিমি … ‘যেতে-না-যেতেই’ মানে যদি যাওয়া শেষ হতে-না-হতেই হয়, আর ‘তন্ত্রের পাঁচ’ এর সিগনিফিক্যান্স যদি হয় ‘ম’ তাহলে ……”
“সিকিম!” আমার মুখ দিয়ে আপনা থেকেই বেরিয়ে পড়ল এই অতি পরিচিত ট্র্যাভেল ডেস্টিনেশানের নামটা।
“এক্সেলেন্ট ওয়াটসন! এক্সেলেন্ট!” গোরাও প্রচন্ড খুশি হয়েছে দেখলাম। আরভ-ও হাঁ করে আছে। কিন্তু তার চোখ হেভি জ্বলজ্বল করছে। হাজার ওয়াটের আলো কেমন জানি না, তবে হাজার পাউন্ডের আলো সেদিন মনে হয় দেখেছিলাম।
ফেরার পথে গোরাকে আরভ সাকসেসফুল হলে কত কমিশন দেবে সেটা নিয়ে কথা পারল। গোরা একটা অদ্ভুত উত্তর দিল, “সে তো বলবই … তার আগে বল, তোর দাদার সাথে তোর রিলেশান কেমন? মানে, তুই কিছু চাইলে দেবেন কি উনি?”
— “কোনো চাপ নেই। একবার বললেই হয়ে যাবে। কিন্তু কেন? বই-টই লাগবে নাকি ফ্রিতে? নিশ্চিন্তে বল …”
— “কিছু অশ্লীল বই … খুব-ই অশ্লীল, শ্রীনন্দদুলালরচিত …… তার আগে কাল ফোনে জানা কি রেজাল্ট হল, তারপর বলব’খন …”
ফিরতি ট্রেনের কামরাতে আরেকটা আশ্চর্য যোগাযোগ আমার জন্য অপেক্ষা করেছিল। আমাদের বিপরীত দিকের একদম শেষের দিকে আমার কলেজ স্টিটে দেখা সেই নীল কার্ডিগান-পরা মেয়েটা বসে ঠোঙা থেকে চপ খাচ্ছিল। চোখ তার বাইরের দিকে, কোলের কাছে একটা বড় ব্যাগ। বইপত্র থাকার সম্ভাবনা প্রবল।
কিছুক্ষণ পরে গোরা আমার কানে কানে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলল। বলল, “একটা কাজ করবি?”
বললাম, “কি?”
— “ওই মেয়েটাকে গিয়ে জিজ্ঞেস একটু কর না যে আমাকে এক কামড় আলুর চপ দেবে কি না!”
**********
পরের দিন সন্ধ্যের দিকে গোরা ফোন করেছিল। খুব যে রস পেয়েছে সেটা গলার আওয়াজেই বুঝেছিলাম।
বলেছিল, “কাজ সাকসেসফুল! রয়েল বেংগল রহস্য সমাধান হয়ে গেছে। আরভ জাস্ট জানাল।”
— “বাহ! কমিশন যা পাচ্ছিস, কফিহাউসের একটা ফিস কবিরাজি হবে নিশ্চই … ”
— “বাপের তিনশো টাকা পড়ে আছে রে শুয়োর … ওতেই কবিরাজী হয়ে যাবে …”
— “তা কমিশন কত হল? লাভের দুই পার্সেন্ট ?”
— “হতে পারে। পাবলিশিং কস্টের ব্যাপারে আমার জ্ঞান নেই অত।”
— “মানে?”
— “মানে কিছুই না … টাকার বদলে আরভকে বলেছি ওর দাদার থেকে একটা কাজ আদায় করতে। ও প্রমিস করেছে যে হয়ে যাবে …”
— “কি কাজ?”
— “আসছে পয়লা বৈশাখে একটা কবিতার বই ছাপাব। ওদের পাবলিশিং হাউজ থেকে। বুঝলি?”
— “সর্বনাশ! তুই লিখেছিস?”
— “না না”
— “তাহলে? লেখক কে?”
— “শ্রীযুক্ত মনোতোষ সিনহা … সরি, মনোতোষ সিংহ ……”
ডিসক্লেইমার : গোরা একটি প্রায় ৯৫ শতাংশ বাস্তব চরিত্র।
Tags: গল্প, গোরা গোয়েন্দা, পূষন
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।