অনেক সময় অনেক কারণেই মানুষ তাঁর নাম হারিয়ে ফেলেন। আমার ঠাকুমাকে তো জ্ঞান হওয়া ইস্তক শুনছি সবাই ডাকে – ব্যালার মা । বেলা আমার বড় পিসির নাম। আর এই বেলাই লোকমুখে ব্যালা।
গল্পে শোনা, আমার ঠাকুমা তাঁর ছেলেপুলেদের নিয়ে সেই মেঘনা নদীর পার ছেড়ে গোয়ালন্দগামী স্টিমারে চেপে বসেন ১৯৫৮ সালে, তারপর ট্রেনে দর্শনা ও এ বাংলার বানপুর হয়ে শিয়ালদহ এসে পৌঁছন। বাবার জেঠামশাই গেছিলেন আনতে। চলে তো এলেন । এপাড়া ওপাড়া হয়ে শ্রীরামপুরে এসে উঠলেন পাকাপাকিভাবে। তাঁর ভাষায় থিতু হলেন। দেশভাগ হয়ে গেল যে! কী আর করেন। তাই ঘটিবাটি সব গুছিয়ে দিলেন পাড়ি।
চটের বস্তায় গোছগাছ করেছিলেন টুকিটাকি কত্ত জিনিস ; কতকগুলি কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি, মা লক্ষ্মীর একখানা বাঁধানো ছবি, এমনিধারা আরো কত কী! একটা ছোট বেঁটে মোটা হ্যারিকেন বা তাঁর ভাষায় হারিকেনও এনেছিলেন। ষাটের দশকের শেষভাগে জন্মানো এই আমিও পড়েছি ওই হারিকেনের আলোয়। ঠাকুমার কাছেই আমার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু। কোন বই নয় মুখে মুখেই পড়াতেন স্বরে অ, স্বরে আ। একটু টেনে টেনে কেমন একটা ঝিমধরা সুরে, যা আজো আমার কানে বাজে।
আমাদের ছোটবেলায় বেশ একটা কুটকুটে গরম পড়ত। ঘামাচি হত সারা গা জুড়ে। হ্যাঁ ঘামাচি, rashes নয় । ঘামাচিই বলত সবাই। খুব কুটকুট করত। জামা তুলে পিঠ পেতে বসতাম পিসিদের কাছে। ছোট্ট ঝিনুক দিয়ে ঘামাচি বধ! উফ কী আরাম!
আমি তো পড়তাম কলোনির স্কুলে। কারণ দাদুভাই তো কলোনির লাগোয়া জমি কিনে ঘর করেছিলেন। শুনেছি তখন এ বঙ্গের মানুষ কলোনির লাগোয়া জমি বিক্রিবাট্টা করে দিয়ে সুবিধামতন কোনো জায়গায় চলে যেতেন। বাঙালদের সম্পর্কে তাঁদের ধারণা ছিল বেশ একটু অন্যরকম। তাদের পাশে থাকতে একটু আপত্তি ছিল মনে । অবশ্য পরে এই ধারণার অনেকটাই পরিবর্তন হয়। তো যাইহোক, আসল কথায় আসি। একমাস গরমের ছুটি পড়ত স্কুলে। সেই নির্জন গরমের দুপুরটা নানানভাবে কাটাতাম। বন্ধ ঘরে বিশেষ থাকতে হত না। সূর্যের পশ্চিমে ঢলার অপেক্ষাটুকু। তারপর উঠোনে এসে কিৎ কিৎ খেলা বা বেশ করে আমের আচার খাওয়া চলত। ছোটভাইয়ের বন্ধুরাও দুপুরে খেলতে আসত। আমাদের বাড়ির মধ্যে দিয়ে মাঝে মাঝে ভাইয়ের বন্ধুরা শর্টকাট পথ বানাত। আমাদের উঠোন তারপর বড় গলি ছেড়ে, পিছনের সরু নালাটা ছোট্ট লাফ দিয়ে পার হয়ে, বাপ্পাদের বাড়ি বা চন্দনদের বাড়ির উঠোন পেরিয়ে দিব্বি দু-নম্বর কলোনির দিকে চলে যেত।
ঠাকুমা কপালে চোখের ওপর বা-হাত রেখে বলতেন – আমাগো উঠানডা কি রাস্তা পাইসস? ওরা কোন পাত্তা দিত না। কেউ কেউ মুচকি হাসত। কেউ কেউ আবার বলত – ঠাকুমা আমি বুচুক। বাপ্পার ভাই।
– ঠিক আসে, তবে মনে রাখিস, এইডা আমগো উঠান। এইয়া কইয়া দিলাম।
আমাদের পুকুরপাড় ঘিরে খানকতক আমগাছ ছিল। ঠাকুমা একটা ফেলে দেওয়া ছাতার কাঠের বাট হাতে নিয়ে বসে বসে আম পাহারা দিতেন। কোন হালকা শব্দ হলেই বলতেন,
– ক্যাডায় রে?
মাঝে মাঝে লাঠিটা মাটিতে ঠুকতেন। মৃদু একটা ঠক করে আওয়াজ হত। খুব সুন্দরী ফর্সা ছোটখাট শীর্ণদেহী মানুষ ছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর মনে ছিল অদ্ভুত জোর। আমি কিৎকিৎ খেলা থামিয়ে একটু হাসতাম।
সে সময় গ্রামবাংলার প্রায় প্রতিটি পাড়ারই একটা অদ্ভুত সৌন্দর্য ছিল। সবারই বাড়িতে একটা উঠোন ছিল । আর ছিল বিস্তর গাছপালা। আম, কুল , নারকেল আর সুপারি গাছ তো একটা করে থাকতই। কাত হওয়া সূর্যের আলো যখন সুপুরিগাছের ডাল ভেদ করে উঠোনে নামত, বেশ একটা জাফরিকাটা ছায়া পড়ত নীচের উঠোনে। আমি ওই ছায়ার ওপরে দাঁড়িয়ে নিজের গায়ের দিকে তাকাতাম। আমার গা বেয়ে আলোছায়া খেলে বেড়াত। তার সঙ্গে আমিও খেলতাম। কত কথা যে বলতাম আপন মনে। আমার সাদা টেপজামা হত চিত্রবিচিত্র! ঠাকুমা ডাক দিতেন
– বইন। কর কী? ছায়ার লগে খেলতে নাই।
– কেন? কী হইব?
– আপদ বিপদ হইব।
আপদ-বিপদ এক ভয়ংকর বস্তু। এটুকুই কেবল বুঝতাম। এরপর সন্ধে নামত। ও পাড়ার সব বাড়ি থেকেই কাসর, ঘন্টা ও শাঁখের আওয়াজ পেতাম। গরু বাছুর রওনা দিত বাড়ির দিকে, সঙ্গে থাকত সে বাড়ির কোন কিশোর বা বধূ। হ্যাঁ, ওপাড়ার বউরা যত্ন করে হাঁস মুরগি গরু ছাগল পুষতেন। এতে সংসারে সুসার হয় – বলতেন ঠাকুমা। প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই কুকুর ও বিড়াল পোষা হত। এতে সুখ ছিল। ছিল ফেলে আসা প্রিয় পোষ্যের মায়ামাখা স্মৃতি। মাঝে মাঝে ঠাকুমার গা ঘেঁষে বসতাম। তাঁর দুই চোখের পাশে বার্ধক্যের যে রেখাচিত্র ছিল তাতে চুঁইয়ে পড়ত হাসি। এ হাসি ভোলার নয়। আমি ভুলিনি।
আমাদের তুলসিতলার পাশে বড়কাকু ইঁট দিয়ে একটা ছোট্ট ঘর তৈরি করেছিলেন। ওই ঘরে সন্ধেবেলায় একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা হত। ওই ঘরটাকে ঠাকুমা বলতেন ‘হরির থান’। তুলসিতলা আর হরির থানে প্রদীপ জ্বালা মানেই এবার পড়তে বসতে হবে। হারিকেনের আলোয় শুরু হত দুলে দুলে পড়া। সামনের বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে হারিকেন ঘিরে বসতাম। আমাদের দুলে দুলে পড়ার দুলুনির ছবি পড়ত মাদুরে। আধিভৌতিক সে সব ছবি। আমাদের বারান্দার পাশে যে নিমগাছটা ছিল তার ছায়াও কেমন ভেঙে ভেঙে দুলত আমাদের তিন ভাইবোনের গায়ে, তা কেবল তাঁরাই জানবে আমার মতন যারা হারিকেনের আলোয় পড়েছে। মাঝে মাঝে কাঁচে কালি পড়ত। ছোটপিসি বা বড়পিসি কেউ হারিকেন বদলে দিয়ে যেত। ফুঁ দিয়ে আলো নিভিয়ে কাঁচ ঠাণ্ডা হতে দিত। তারপর ঘুঁটের ছাই আর পুরনো কাপড় দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার ঝকঝকে করে দিত সেই হারিকেনের চিমনির কাঁচ। ঠাকুমা বলতেন – আধ্যেক চান্দের মতন কইরা সইলতার মাথা কাইট্যা দিস। তাইলে আর কালি পড়ব না, কেমুন।
এই সময় সেই পেটমোটা বেঁটে যেটাকে আমরা ছোট হারিকেন বলতাম, সেটা জ্বালিয়ে কেউ আমাদের সামনে রেখে দিতেন। এই হারিকেনটা আমার ঠাকুমার সঙ্গে দেশ ছেড়ে আসার সময় ওই পোটলাপুটলির কোনো একটায় ছিল।
আমি তখন ক্লাস টুয়ের এক নাক চ্যাপ্টা বালিকা। ঠাকুমার ভাষায় – নাক বোঁচা চোখ ভাসা , বইন আমার দেখতে খাসা । সেই ক্লাস টুয়ের এই আমি, কেমন হারিয়ে যেতাম। ওই হারিকেনের মোটা কাঁচের গায়ে আমি সেই মেঘনার পারে বালাপুর গ্রামের কোন শ্যামাপোকার লেপ্টে থাকা মৃতদেহ খুঁজে বেড়াতাম। পাট পাতার বড়া দিয়ে মাখা ঠাকুমার শাশুড়িমায়ের ভাত খাওয়ার দৃশ্য দেখতে পেতাম। যেন হারিকেনের আলোছায়ায় তিনি দুলছেন। দুলতে দুলতেই তিনি ভাত খাচ্ছেন। তিনি হাসছেন। এরপর আচমকাই নিজের সহজ পাঠ দ্বিতীয় ভাগের পাতায় আবার ফিরে আসতাম। চতুর্থ পাঠে হঠাৎ যেন থমকে যেতাম , “তাঁর ঘরে সুন্দর দেখে ফুলদানি রেখো। তাতে কুন্দফুল থাকবে আর আকন্দ থাকবে।” একথা স্বয়ং কবি লিখেছেন। কিন্তু ফুলদানিতে আকন্দ ফুল ভালো লাগবে? কাকে যে জিজ্ঞেস করি!
রাত বাড়তে থাকে। দেয়ালে আমাদের ছায়া ঘুমে ঢুলতে থাকে। আধো ঘুমে যেন দেখতে পাই সেই মেঘনার পাড়ে বসে কোনো নিলু চাচা তৈরি করছেন কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি। দাদুভাই তদারকি করছেন। সেই পিঁড়িতে বসেই তো আমি এখন খাই। বড়পিসি বলছে – ওরে বড় করে হাঁ কর। আমি আধোঘুমে ভাত গিলে নিই। ঢুলতে ঢুলতে একবার সেই বালাপুর গ্রাম, আর একবার সেই সহজ পাঠের দ্বিতীয় ভাগ ছেড়ে হারিকেনের গায়ে লেপ্টে থাকা মৃত শ্যামাপোকার কাছে ফিরে আসি। এখানেই আমায় থিতু হতে হবে। ঠাকুমা বলেন – মন স্থির কর বইন। থিতু হও। পড়ালিখা শিখতে হইব। এ ছাড়া তো আমাগো আর কিছুই করণের নাই। কী জানি আজো কি পেরেছি থিতু হতে? জানি না তো! নাকি আজও দুলছি সেই ছোটবেলার মাদুরের ওপরে পড়া হারিকেনের ছায়ার মতন।
Tags: ভিন্নতর আলাপ, রূপা সেনগুপ্ত, শ্যামাপোকা
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।