তুমি অঞ্জলি ভরে আমাকে দিয়েছ ক্ষয়
আমি গ্রহন করেছি
ক্ষয়েছি একটু একটু করে…
দেখো শিলাবতী নদীতীরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে
রাঙা ফুল হয়ে ফুটে আছি…
শিলাবতী নদী। সেদিন সুশান্ত অত করে না বললে হয়তো পরিচয় হোত না নদীটির সঙ্গে । আমার তখন পূর্ণ যৌবন, চোখে সানগ্লাস। যা দেখি তাতেই ভালোলাগার রঙ। মেদিনীপুরের গড়বেতায় আমাদের প্রতি শনিবার বসতো চক্ষুশিবির । আমি বাঁকুড়া মেডিকেল থেকে আসতাম। দুপুর থেকে বিকেল অবধি রোগি দেখে সন্ধ্যের মুখে বাস ধরে খড়্গপুর, সেখান থেকে ট্রেন ধরে হাওড়া হয়ে বাড়ি ফিরতাম রাতে।
সেই শনিবার সুশান্ত আমাকে অনেক করে বললো – থেকে যান ডাক্তার বাবু আজকে। আমাদের বাড়িতে আপনি থাকবেন। কাল রবিবার আপনাকে শিলাবতী নদীর ধারে নিয়ে যাব। হেমন্তের শুকনো বাতাসে ওর অনুরোধ যেন ভালোলাগার পরশ নিয়ে এলো। ঐ বাতাসে আমি ভেসে গেলাম। ঠিক আছে তাই হবে।
আমি শিলাবতী দেখার আগেই সুদেষ্ণাকে দেখে ফেললাম। সুশান্তর দিদি। ঘন কৃষ্ণ আঁখিপল্লব। কালো মণিতে জল টলটল। ওটাই কি শিলাবতী ? বাঁকা ভ্রূ যেন নদীতীর। আমি ধাক্কা খেলাম। ভালোলাগার ধাক্কা।
সুশান্ত গড়বেতা আই ক্লিনিকের সর্বেসর্বা। প্রচার রোগী যোগাড়, অপারেশনের ব্যবস্থা সব কিছুই ও করে। বয়সে আমার থেকে চোটো হলেও কর্মঠ ও উৎসাহী। বিনয়ী ও পরপোকারী। সুদেষ্ণা আমারই বয়সী হবে। আমি যেন তার চোখেই দেখতে পেলাম শিলাবতীর স্থির জল। তার লাজুক ভঙ্গিমা রঙিন হয়ে আমার চোখে সানগ্লাস পরিয়ে দিলো। রাত্রে খেতে বসে নদীর গল্প শুনলাম। নদীতীরে ক্ষয়ের গল্প। সুদেষ্ণা বললো– সূর্যাস্তের আলোতে খোয়াইএ আগুন জ্বলে। যেন গনগনে আঁচ। তাই তো ওর নাম গনঘনি।
পরদিন বিকেলে চলে এলাম নদীতীরে। শহরের কোলাহল ছেড়ে যেন হঠাৎ এক বিশালত্বের মুখোমুখি হয়ে গেলাম। বিপুল , বিরাট…। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো কথাটি। মাইলের পর মাইল জুড়ে নদীতীরে লাল মাটির ভাস্কর্য। প্রকৃতির শৈল্পিক খেয়াল। আমি হারিয়ে গেলাম ঐ ভাস্কর্যে। ওই ভাস্কর্য কখনও দুর্গের চেহারা নিয়েছে, কখনও থাম ওয়ালা রাজবাড়ি, কখনওবা লক্ষনৌএর ভুলভুলাইয়া আবার কখনও থেমে থাকা ঝর্ণা। আমি সুদেষ্ণার চোখে চোখ রাখলাম। সুদেষ্ণা চোখ নামিয়ে নিলো।
— কেমন দেখছেন স্যার ? সুশান্তের কথায় যেন ঘোর কাটলো।
— বলিনি আপনাকে শিলাবতীর সৌন্দর্য ?
বলেছো, বলেছো তুমি সুশান্ত। কিন্তু একটা জিনিস বলোনি। তোমার সেই না বলা কথাটিও দেখলাম এবং অনুভব করলাম।
এমন সময় সুশান্তর পাড়ার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ও তার সঙ্গে কথায় ব্যস্ত হয়ে গেল। আমি এ সুযোগ ছাড়ি কেন ? আমি সুদেষ্ণাকে পাশে নিয়ে হাঁটতে লাগলাম। জীবনে প্রথম বার কোনো ভালোলাগার নারীর সঙ্গে স্বর্গীয় পরিবেশে পাশাপাশি। ওকে নিয়ে যাচ্ছিলাম কখনও দুর্গে, কখনও রাজবাড়িতে, কখনওবা থেমে থাকা ঝর্ণার পাশে। আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছিলাম ? নাকি ও আমাকে ? এ জায়গা তো ওরই হাতের তালুর মত চেনা। তারপর হাঁটতে হাঁটতে আমরা শিলাবতীর জলে এলাম। গোড়ালি জলে দাঁড়িয়ে আমি সুদেষ্ণার চোখের দিকে তাকালাম। ও কি কিছু বলবে ? কিছু কি বলতে চায় ও ? আমি কি কিছু বলবো ? কত কথা যে উড়ে যাচ্ছে আমাদের চোখের সামনে দিয়ে…। একসময় সূর্য অস্ত গেল। যাবার আগে যখন জায়গাটিকে রাঙিয়ে দিয়ে গেল, উনুনের গনগনে আঁচ টের পেলাম আমার দুকানে। সুদেষ্ণা বললো– বড় তাড়াতাড়ি সূর্যটা ডুবে গেলো।
নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। সুশান্তর ডাক শুনলাম– চলে আয় দিদি । সুদেষ্ণা গাঢ় কন্ঠে বললো– এবার ফিরে চলুন।
আমার চোখে লেগে রইলো গনগনি, শিলাবতী নদী এবং সুদেষ্ণার লাজুক হাসি। এই তিনটি জিনিস নিয়ে আমি ফিরে গেলাম পরদিন বাঁকুড়ায়। সুদেষ্ণা যাবার সময় বললো
— আবার আসবেন তো…।
তিরিশ বছর পরে আবার এলাম। একা। একাকী দাঁড়িয়ে আছি নদীতীরে। শিলাবতী এখনও সুন্দরী। লাল মাটির ক্ষয় এখনও মোহময়ী। আমি একদৃষ্টে খোয়াইএর দিকে তাকিয়ে থাকলাম আর মনে মনে বললাম–
জানি, তুমিও আসবে একদিন,
বলবে আহা কি সুন্দর
অন্তরে আমাকেই বসাবে তুমি
সেই দিনটির জন্য অন্তত…।
Tags: খোয়াই, গল্প, সুশোভন অধিকারী
email:galpersamay@gmail.com
Tridibesh Bandyopadhyay on January 25, 2022
চমৎকার গল্প। ভাল লাগার রেশ থেকে গেল।
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।