মধ্য সপ্তকের কোমল নিশাদের মতন ঢেউ খাচ্ছিল সায়ন নদীর জল। তার ওপর ফুরিয়ে আসা দিনের আলো। ঘনিয়ে ওঠা রাতের ছায়া। কয়েকটা জেলে মানুষ নিজেদের ভাঙা নাও মেরামত করতে ব্যস্ত কেবল। আরসব ঘাট খালি করে ফিরে গেছে অনেকক্ষণ হল।
অনসূয়া বসে আছে একা। তার যাবার তাড়া নেই। যায়গা আছে কী না কে জানে! সে বসে আছে যেরকম অনড় হয়ে বসে থাকে গাছ।
কার জন্য অপেক্ষা করো গাছ? সূর্যস্ত সূর্যদ্বয়ের দিকে তাকিয়ে তুমি কার কথা ভাবো? তোমার ধ্যানস্থ ভঙ্গি দেখে আমার চিরকাল ইচ্ছে হয়েছে পরজন্ম বলে যদি সত্যি কিছু থাকে তবে যেন গাছ হোই আমি।
আমি কে?
আমি মন কেমনের দেশ। কখনো পাখির মতন, কখনো ছায়ার মতন, কখনো গানের মতন, কখনো প্লাবন ডাকা নদীর মতন আমি মানুষর মনে গিয়ে বসি। তারপর সে আর নিজের মধ্যে স্থির থাকতে পারে না। পাড় ভাঙতে ভাঙতে নদী যেমন বদলে নেয় গতি তেমনি ভাঙা মানুষ প্রতিদিন নিজের থেকে পালাতে পালাতে বদলে ফেলে নিজের মুখ, মুখশ্রী, যা কিছু মাধুরি। আবার অন্য পাড়ে পলিও জমায়। সেখানে উর্বর হয়ে ওঠে মাটি। কেউ ভাঙার দিকে আটকা পড়ে থাকে। কেউ নতুন চরে ডিঙি ভাসিয়ে দেয়।
গাছ, তুমি এই এলোমেলো মনেদের শান্তি দেবে? তোমার অচঞ্চল ছায়ার আসনে বসতে দিয়ে তোমার স্থিতধী হবার ধ্যানমন্ত্র দেবে। প্রতিদিনের প্রার্থনায় এখন এইটুকু চাই আমি।
অনসূয়া বসে আছে, উন্মনা নদীর বুকে ঝুঁকে। পায়ে তার জলের নুপুর। যে পা আজ কিছুতেই সড়ছে না ফিরে যাবার দিকে। নদীর পাড় ঘেঁষে, ঘাসজমির ওপর অন্ধকার নৌকার সারি, তার মধ্যে তাকে আরো এক ভাঙা নৌকার মতোই দেখাচ্ছে এখন। কোথায় যেন ভেসে যাবার কথা ছিল তার! কার কাছে যেন নোঙর ফেলার ইচ্ছে ছিল এ জীবনে? কোন দ্বীপান্তর থেকে ভেসে আসা গানের জন্য তার আজও এমন নিঝুম অপেক্ষার বেলা কে সেসবের খবর রাখে? একা শুধু মন কেমনই জানে।
বহুকাল পর আজ একজনের আসার কথা ছিল। সময়ের আগেই এসেছিল সে। সময়ের অতিরিক্ত কাটিয়ে ফিরে গেছে। ফিরে যাবার আগে এক পলক পিছন ফিরে তাকিয়েছে মাত্র। কটা শুধু কথা বলতে চেয়েছিল মানুষটা। শেষ কথা গুলো বলার সময় কেমন থেমে আসছিল কন্ঠ। যেন এ কটা কাকলি ভিন্ন আর কিছুই বাকি ছিল না এ জীবনে। বলা হয়ে যেতে সে চলে গেল যখন একটা গান এসে বসেছে তার ফেলে যাওয়া শূণ্য আসনে। সেই গানের জন্যই আজ আর ওঠা হচ্ছে না অনসুয়ার।
গান তুমি কে হও ওর?
উত্তর আসে না কোন। শুধু একটা সুর ঘুরে ফিরে বইতে থাকে সন্ধেবাতাসে।
‘আমার জীবন নদীর ওপারে….’
প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় গাইতেন। এখনো গান। সন্ধে নেমে গেলে, যখন আমি মন কেমনের হাওয়া নিয়ে ঘরপায়রার মতন কোন একলা কুঠুরি পেয়ে ডানা মুড়ে বসি। শেষ গোধূলির সিঁদুরে রঙ নিবে গিয়ে সব নীল তারা ফুটে ওঠে দিগন্ত আকাশে, তখন ভেসে যাওয়া মেঘের আড়ালে গান করেন উনি।
‘আমি তরীটি বাহিয়া আসবো, তুমি চরণখানি বাড়ায়ো… আমার জীবন নদীর ওপারে..’
অনসূয়া যখন ছোট্টটি, তাদের যৌথ পরিবারের গোলগাল গিন্নিবান্নি ঠাকুমা নিজের কাজ ফুরনো অন্ধকারে নাতনিকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে এই গান মাঝে মাঝে গাইতেন আপন মনে। অনসূয়া টের পেত এই গানের কাছে গেলে চুলে বিলি কাটা ঠাকুমার আঙুলগুলো কেমন বদলে যেতে থাকে৷। বড় হয়ে যখন দেখেছে কিশোরী আমনকর সুরবাহার হাতে আলাপ করলে ওঁর আঙুল গুলোকে যেমন দোয়েল পাখি কিংবা বৃষ্টি আকাশের চাতক হয়ে যায় তেমনি ওই বয়সে বোঝা যেত ঠাকুমার আঙুলের চলনে কেমন করে এসে মেশে কলমিলতার কাঁপন, গভীর জলের মাছেদের ঘাই মারার তিরতিরে ঢেউ শুধু ওই একখানা গানের বেলায়।
ঠাকুমা যখন চলে গেল ফুল সাজানো গাড়ির থেকে লেলিহান আগুনের দিকে অনসূয়া তখন ক্লাস সেভেনের দুই বিনুনি। কদিন পরে স্কুলের কম্পিটিশনে গাইতে উঠে মা’র কাছ থেকে শিখে নিয়ে এই গানটাই গেয়েছিল মেয়ে। ঠাকুমা কোথাও থেকে শুনছিলেন নিশ্চয়। গান শেষ হতে হতে তার চোখের কোনের জলের কাছে তাই আলতো করে প্রহর শেষের আলো ছুঁইয়ে দিলেন কোন অলিক ঈশ্বর। আর ওমন কনে দেখা আলোয় অশ্রু মধ্যে তদগত এক কিশোরীর সুরের প্রেমে পড়ে গেল এক সহপাঠী ছেলে। মন কেমনের নদী তাকে বদলাতে থাকল সেই থেকে।
এর অনেকদিন পর গানের আর এক কম্পিটিশনে নবম শ্রেনীর অনসূয়া নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের এক স্নিগ্ধচেহারার সহপ্রতিযোগি কিশোরের গলায় ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’ শুনতে শুনতে আমাকে প্রথম যায়গা করে দিল তার জীবনে। সেদিন কী গেয়েছিল মেয়েটা মনে নেই। ঠিক ঠিক সুর লেগেছিল কিনা সে গানে একমাত্র বিচারক ছাড়া আর কারো মন ছিল না তাতে। আকাশ বাতাস চন্দ্র সূর্য ঝমঝম করছিল কিছু আগে গেয়ে যাওয়া কিশোরের গানের বিভায়। অনসূয়া বুকের মধ্যে অনুরনন শুনতে পাচ্ছিল
‘যেথা আমি যাই নাকো তুমি প্রকাশিত থাকো…’
অকুল নয়নজলে কিরনধারা ঢালার জন্য মনকেমনের নদী বইতে থাকল অনসূয়ার মনে।
তারপর অনেক পথ পার হয়ে এসেছে এরা সক্কলে। অনসূয়াকে পায়নি তার বাল্য প্রেমিক। অনসূয়া পারেনি সেই গানের ছেলের জীবনের ধ্রুবতারা হয়ে ওঠতে। সেই স্নিগ্ধ কিশোর অন্য কারোর জন্য মন কেমন পুষতে পুষতে কেমন করে অন্য মানুষ হয়ে গেল সে জটিল হিসেব এখন থাক। এদের সকলের মনকেমনের এক একটা নিজস্ব দেশ। সকলের মধ্যে এক একটা স্বতন্ত্র নদী। ভাঙনের আলাদা আলাদা ইতিহাস।
আজ এতদিন পরে এই বিকেল-নদীর কিনারে ইশকুল সহপাঠীর সাথে দেখা করতে এসে অনসূয়া প্রথম আবিষ্কার করল নিজেরই অজান্তে সে কারুর কান্নার আরাম হয়ে গেছে।
জীবন কত কিছু দেয়! আমরা শুধু না পাওয়াগুলোই দেখি। মনে করে রাখি। এখন অনসূয়ার ফুরনো যৌবন। ছেলে মেয়েদের কিশোর কোঠায় পা। ব্যস্ত স্বামীর যত্ন আত্তির একেনে সংসারে সে এখন গোলগাল গিন্নি। অভাব নেই, অশান্তি নেই, আপাতভাবে যা যা পেলে মানুষ সুখী হতে পারে সব আছে তার। শুধু গান কবে ছেড়ে গেছে তাকে।
গান তুমি কে হও অনসূয়ার? আমি প্রশ্ন করি রাতঝিঁঝিঁর স্বরে।
উত্তর আসে না কোন। শুধু আঁধার-নদীর বুকের ওপর অনসূয়ার দীর্ঘশ্বাস ভেসে বেড়ায়। গাছেরা নিথর হয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় উর্ধ্বতম তারাটির দিকে৷ নিহারিকার মধ্যে আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় গান..
‘দিনের আলোটি নিবে যাবে ওগো আঁধার আসিবে ঘিরে.. তুমি নয়নের কোনে সোহাগের দীপ জ্বালিয়ে রেখো হে ধীরে…’
ইশকুল বেলার যে ছেলেটিকে কোনদিন মনযোগ দেয়নি অনসূয়া, আজ সেই আবার গান এনে দিল তার মনে। হুড়মুড়িয়ে এনে দিল অনেকগুলো স্মৃতি। আর একটা বিশ্বাস। না পাওয়ার থেকে আমাদের পাওয়ার পাল্লা অনেকখানি ভারি।
সহপাঠী ছেলেটির এখন গভীর অসুখ। কনে দেখা আলোর যে গান সে একা একা বহন করেছে এতদিন সেই মন কেমনের দেশ ছেড়ে চলে যাবার আগে একবার সে বলে যেতে চেয়েছিল যে এতদিন যে কোন যন্ত্রণায় ওই একটা মুখের দিকে তাকিয়ে সে কীভাবে সহনীয় করে নিয়েছিল তার এই সংক্ষিপ্ত জীবন।
গান, তুমি কে হও এদের? গান, তুমি কতখানি? কার..? আমি উদিত চাঁদের ক্ষতর মতন ভেঙেচুরে প্রশ্ন করে উঠি।
আর এতক্ষনে জ্যোৎস্না স্রোতের মায়ার মতন কথা বলে ওঠে গান।
– আমি নির্জন এককের প্রেম। ছায়ার আসন। আমি আসলে মন কেমনের জমির ওপর ধ্যানস্থ সেই গাছ যার কাছে গেলে মানুষ নিজের মধ্যে একা একাই আবাদ হয়ে ওঠে। ফুলে ফলে ভরে ভরে যায়।
অনসূয়ার ফিরতি পথের পায়ের চিহ্নের ওপর পা ফেলে পা ফেলে চলছেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি, না অনসূয়া, নাকি এই রাত জ্যোৎস্নার নদী গুন গুন করে উঠছে বোঝা যাচ্ছে না… আমি টের পাই অনেক কালের অনেকগুলো একলা মন একসাথে বলে উঠছে
‘আমি তোমারে হারায়ে নিজে হারা তুমি এতটুকু হারায়ো, হারায়ো.. আমার জীবন নদীর ওপারে… এসে দাঁড়ায়ো, দাঁড়ায়ো…. আমার জীবন নদীর ওপারে….’
অব্যক্ত বেদনার মতো রাত গভীর হচ্ছে ক্রমশ।
Tags: ঋভু চৌধুরী, গল্প, জীবন নদীর ওপারে
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।