15 Apr

দেওয়াল লিখন অথবা অন্য বসন্ত

লিখেছেন:পার্থ আচার্য


যা কিছু ঘটছে, ঘটে চলেছে তা যেন মণি বসাকের বিধবা বউয়ের মতোই সন্দেহজনক। আজকাল সব কিছুই কি সন্দেহের আশ্রয়েই বেড়ে উঠছে। প্রশ্নটা তারাপদকে করতে গিয়ে নিজের জড়তা টের পাচ্ছিল চৈতন্য। এই যে দিব্যি গেল ডিসেম্বরে একটা হাফসার্টে কাটিয়ে দিয়েছে সে – তা কি সন্দেহের বিষয় নয়? কী মাস এটা? মার্চ। ভোরে অনেককেই সে দেখেছে জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে ঘুরছে, কারও কারও আবার সোয়েটার। অনেকে তার মতো হাফ শার্ট, হাফ হাতা গেঞ্জি পরেও দিব্যি আছে। তা হলে আবহাওয়া ঠিক কী রকম? ডিসেম্বর থেকেই প্রশ্নটা ঘুরেছে তার মাথায়। শীত নাকি গরম? সন্ধ্যায় তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলে অলিভিয়ার ঘুরতে যাওয়ার বায়নার মতোই তা কি দোদুল্যমান? মেজদি সে সময় ফোনে জানিয়েছিল, দিল্লিতে নাকি সূর্যের দেখা নেই। দূষণ।

তারাপদ বলল, আপনে ওই দেওয়াল লিখনের বিষয়টা শুনছেন?

কোনটা? চৈতন্য কৌতূহলী হয়। এ বার আরও একটি ঘটনার কথা জানা যাবে। গত দশ বছরে এ ভাবেই আসা-যাওয়ার পথে তারাপদর কাছ থেকে জেনেছে নানা ঘটনার কথা। আগে রিকশা চালাতে বেদম হয়ে যাওয়ায় একনাগাড়ে বেশি কথা বলতে পারতো না। এখন তার রিকশাতেও মোটর বসেছে। সেই দ্রুততায় তারাপদ গল্পের ভাণ্ডারও বেড়েছে বোধ হয়।মণি বসাকের বিধবা বউয়ের কথা ওর কাছ থেকেই জেনেছিল চৈতন্য। বড় চাকরি করা মণি বসাক কোনও এক মাকড়সার জালে আটকে যাওয়া পোকার মতো কেন ঝুলে পড়েছিল তা নিয়ে আলোচনা কম হয়নি। তিনতলা বাড়ি, নতুন কেনা গাড়ি, স্ত্রী-কন্যাকে ছেড়ে এমন অকস্মাৎ মৃত্যুর পিছনে অনিবার্যভাবেই উঠে আসতে পারত ওর বউয়ের নামই। তবু এই সম্ভাবনাকে প্রশ্রয় দেয়নি কেউই। পুলিশও না। কানাঘুষো কিছু কিছু আলোচনা চাউর হয়েছিল ঠিকই, মৃত্যুর শোকে তা বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। যদিও মৃত্যুর দু’দিন পর সাদা চুড়িদারে মণি বসাকের বিধবা বউ যখন তারাপদর রিকশায় স্টেশনের পাশে একটি শপিং মলে যায় ও ফিরে আসে, যার দক্ষিণাবাবদ সদ্য বাতিল হতে যাওয়া একটি পাঁচশো টাকার নোট পেয়েছিল তারাপদ – তখন সে খেয়াল করেছিল সাদা চুড়িদার পরে থাকলেও মণি বসাকের বিধবা বউয়ের ঠোটটি ছিল গাঢ় লাল লিপস্টিকের আবরণে। তারাপদর কাছ থেকে সেই পাঁচশো টাকার হিসেব চায়নি। মৃত্যুর বিষণ্ণতার মাঝে অমন লাল ঠোট? তারাপদ কথাটা বলেই ফেলেছিল চৈতন্যকে। স্কুলে এক ক্লাসে পড়বার সময় কবিতা লিখত তারাপদ। বাংলার টিচার বাদলবাবু একদিন ধমকের সুরেই তারাপদকে বলেছিল, ওইসব কবিতা লিইখ্যা দিন কাটাইলে, ভবিষ্যতে বাপের মতো ভ্যান চলাইয়ায় খাইতে হইব তোরে। তাইই ঘটেছে তারাপদর জীবনে। চৈতন্যর মনে হয়েছিল, তারাপদ তার স্কুলের বন্ধু তারাপদ, যে তাকে ইদানীং কোনও এক অভিমানে আপনি বলে সম্বোধন করে – সে কোনও কবিতার ভিতর ঢুকে পড়েছে আবার। ভাগ্যিস এখানে বাদলবাবু নেই। না হলে আবার হয়ত নস্ত্রাদামু হয়ে তারাপদর ভবিষ্যৎ বাতলাতেন। তারাপদ তখন বলছিল কীভাবে সে মাছের আড়তদার বাবলুকে পটিয়ে সেই পাঁচশো টাকা ভাঙিয়েছিল সে কথা। এই একই অভিজ্ঞতার কথা তাকে শুনিয়েছিল বই দোকানদার তারক। তবে ওর দেখা লিপস্টিকের রং ছিল মেরুন।

চা দিতে এসে অলিভিয়া বলল, বাইরেটা দেখে এসেছ?

বাইরে?

হ্যাঁ। আমাদের বাড়ির দেওয়ালে।

কী?

দেখেই এস। আমি বাইরের আলো জ্বেলে দিচ্ছি।

দেওয়াল লিখনের কথা তারাপদ বলেছিল ঠিকই। তখন অতটা বোঝা যায়নি। চৈতন্যর মনে হয়েছিল হয়ত রাজনৈতিক দেওয়াল লিখনের কথা বলেছে তারাপদ। যে ভাবে এক একটা দেওয়ালের দখল নেয় রাজনৈতিক দলগুলি। পুরো দেওয়ালে চুনকাম করে লাল, নীল চিহ্নে লেখা থাকে ‘অল ওয়াল ফর…’। এর পর রাজনৈতিক দলের নাম, পার্টির প্রতীক। যারা এইসব লিখন এড়িয়ে থাকতে চান তাদের দেওয়াল অসমান অথবা ইংরেজিতে লেখা থাকে প্লিজ, স্টিক নো বিলস। শহরের নানা দেওয়ালে পেচ্ছাপের নিষেধাজ্ঞা জানাতে ঠাকুর দেবতার ছবি দিয়ে লেখা হয়, কোনও কোনও দেওয়ালে আবার পোসবার করিবেন না/করিলে জরিমানা হইবে লেখা থাকে। কিন্তু তা বলে এখানে, তার বাড়ির দেওয়ালে? হাসতে হাসতেই লেখাগুলি পড়ছিল অলিভিয়া বাঙালি ল্যাদখোর? মেট্রো থেকে নেমে দৌড়টা দেখেছিস কখনও? চৈতন্য দেখে লেখা দুটির লাইনের মাঝে নায়ক প্রসেনজিতের মুখ আঁকা। লেখা ও ছবির নীচে রাইট চিহ্ন দিয়ে লাইক মারবার ঢঙে কারা যেন সমর্থনও জানিয়ে গেছে।

এ সবের মানে কী?

আমি কী জানি। তবে একটা মজার কথা শুনবে…

কী?

আমাদেরটা তো তাও ভালো। মেঘাদেরটা শুনলে তুমিও লজ্জা পাবে।

কেন?

দোল আসছে না। মেয়েদের কাটা লাগানো অন্তর্বাসের ছবি এঁকে দিয়ে গেছে, কী অসভ্য ভাবো।

অফিসে রীতিমতো মিটিঙের ঢঙে আলোচনা চলছে। কচুরিতে হিঙের পুরের মতন সেই আলোচনায় ঢুকে পড়েছে সেও। ভৌগোলিক অবস্থানে এই অফিসের প্রায় সবারই বাড়ি আলাদা আলাদা জায়গায়। কারও কারও আবার বাড়ি নয়, ফ্ল্যাট। সে ফ্ল্যাট হোক বা বাড়ি, দরজায় পোস্টার সেটে, বাড়ির দেওয়ালে লেখা হয়েছে আজব আজব কথা। বোসদা বলল, আমারটা অ্যামেজিং নলেজের একটা অংশ। সেখানে লেখা আছে— ‘একটি আন্তজার্তিক এজেন্সির রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতীয় মিডিয়া হল বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ সংস্থা এবং এটি সবচেয়ে বেশি মানুষকে ভুলপথে চালিত করে।’

রাইট চিহ্ন ক ‘টা দেখলে ? তীর্থঙ্কর প্রশ্ন করে।

দুটো, তবে বাড়ি গিয়ে আমিও একটা রাইট দেব ভাবছি।

আমার বাড়িরটা বােধ হয় কোনও এক ব্যর্থ প্রেমিক লিখেছে। ম্যানেজার অপুর্বদাও যে কখন এই আলাচনায় ঢুকে পড়েছে তা খেয়াল করেনি কেউই।

কী স্যার? তীর্থ বিগলিত। অফিসে এই ছেলেটার প্রমোশনের পিছনে নিখাদ তেলের কথা এত দিন আড়লে বলেছে অনেকেই। না হলে বোসদার মতো সিনিয়ারকে ডিঙিয়ে সুপারভাইজার পোস্টে তীর্থ কীভাবে যায়? এ বার সেই তেলেই যেন কিছুটা জবজবে অপূর্বদা, প্রকাশ্যে। সে লিখেছে – ‘হোয়েন এভরিওয়ান ওয়াজ ফ্ল্যাটারিং অ্যাণ্ড জাম্পিং রিলেশানশিপস/সামওয়ান, সামহোয়ার অনেস্টলি কেপ্ট অ্যা প্রমিস…’  ইনক্রিমেন্টের পর অফিস মিটিঙে যে ভাবে কথা বলেন, অনেকটা যেন সে ঢঙেই কথাগুলি বলে গেলেন অপূর্বদা।

অফিস থেকে তাড়াতাড়ি কাটবার সুযোগ পায় চৈতন্য। কিছুটা সংশয়েও থাকে। এখন বাড়ি ফিরলে অলিভিয়া আর বুন্টিকে নিয়ে বের হতে হবে নির্ঘাৎ। কোথায় যাবে সে? আজ বাদে কাল ন্যাড়াপোড়া। পাড়ায় পাড়ায় পাতার স্তুপে পুড়বে বুড়ির ঘর। আলু পোড়ার গন্ধ ম ‘ম করবে। রেস্তোরায় চিকেন কাবাব পছন্দ হলেও, এমন অগ্নিকাণ্ডে শ্বাসকষ্ট হয়। স্টেশন চত্বরে পর পর বেশ কিছু রেস্তোরা, মল হয়েছে ঠিকই তবে অটো, টোটো, রিকশা গাড়ির জটে সেখানে যাওয়া আর একটা জটিল ধাঁধার ভিতর হারিয়ে যাওয়া একই রকম। রিকশা আর টোটোর দুই ইউনিয়নের দুই নেতা একই দলের হলেও, পরস্পরকে অভিযুক্ত করছেন অহর্নিশ। গঙ্গার দিকে আগে অনেকটা ফাঁকা জায়গা ছিল। এখন সেখানে একটাই পার্ক। পাঁচশো বছর কিংবা তারও আগের বেশ কিছু মন্দির। বাকি পুরো জায়গাটাই আবাসন প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণে। হাইওয়ের ওপাশটায় একটা বিনোদন পার্ক, রেস্তোরা, ক্লাবের পরিকাঠামোয় তৈরি হয়েছে ঠিকই, তবে তা খরচ সাপেক্ষ। বাকি যা আছে তা ওই নাচ, গানের পানশালা। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলে নিজেকে কলম্বাসের মতোই লাগে। একই সঙ্গে আবিষ্কার ও আধিপত্য দুইই চায় সে। চা দিতে এসে অলিভিয়া বলল, আজকের লেখাটা দেখেছ?

আজকেও লিখেছে নাকি?

হ্যাঁ। আজকেরটা আরও ভালো। অনেকগুলো রাইট চিহ্ন পেয়েছি আমরা। তলায় মন্তব্যও পড়েছে  বেশ কয়েকটা। মেঘাদের বাড়িতে আজ যে লিখেছে তার মা খুব অসুস্থ জানো।

কেন – কীভাবে বুঝলে?

সে লিখেছে – ‘মাই মাদার ইজ সিক/প্লিজ, প্রে ফর হার।’

শাল্লা!

ওমা একজনের মা অসুস্থ তাতে তুমি খেপছ কেন? জানো এ বার ভাবছি আমরাও লিখব। পরশুই তো দোল। কাল একটু তাড়াতাড়ি ফিরবে গো? তা হলে বুন্টির জন্য রং কিনবার পাশাপাশি লেখার জন্যও রং কিনে আনব আমরা।

এক সময় সক্রিয় রাজনীতি করা জহরদার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল বাজারে। এমনিতে এ লোকটাকে দেখলে দাঁড়াতে চায় না কেউই। কারখানা বন্ধের পর টানা দশদিন অনশন করেছিল। তার পর থেকেই লোকটার বয়স বেড়েছে যেন এক লাফে। সে কারখানার মালিক কবেই পাততাড়ি গুটিয়ে বিদেশ থেকে সরকারের সঙ্গে দরকষাকষির ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে, জহরদা তবু কারও পয়সার চা, বিড়ি পেঁদিয়ে অলীক এক বিপ্লবের ঢঙে কারখানার ভোঁ বাজাবেই। মাছবাজার থেকেই লুকোচুরি চলছিল। চৈতন্যকে সে ধরে ফেলল চা দোকানের সামনেই। অগত্যা পকেট থেকে টাকা বের করতে যায়, যদিও তার আগেই হাত চেপে ধরে জহরদা। চায়ের দরকার নেই। কথা আছে, চলো। জহরদার চোখ-মুখে অদ্ভুত এক আশ্চর্য এক রঙের মতো আলো।

কী? কিছুটা তফাতে এসে প্রশ্ন করে চৈতন্য।

তুমি কুম্ভকর্ণের গল্পটা জানো!

কুম্ভকর্ণ?

হ্যাঁ। জানো তো প্রকাণ্ড শরীরের অধিকারী রাক্ষস কুম্ভকর্ণ এক ভয়ঙ্কর কঠিন তপস্যায় বসেছিল, যা দেখে প্রসন্ন হয়েছিলেন স্বয়ং মহাদেব।

তাতে কী ?

আহা, শোনই না। প্রসন্নচিত্তে মহাদেব যখন তাকে বর দেব দেব করছেন, তখন। নিজেদের বিপদ বুঝতে পারছিলেন বাকি দেবতারা। দেবতা হলেও দেবাদিদেব মহাদেবের এই একটা খ্যাপাটে গুণ, যে যখন তপস্যা করে তাকে তুষ্ট করে যা চেয়েছে তাইই দিয়ে দিয়েছেন। তা নিজের ক্ষতি হলেও তো কুম্ভকর্ণকে বর দিতে যাওয়া মহাদেবকে তো আটকানো অসম্ভব। তা হলে উপায়? দেবতারা ছুটলেন বাগদেবী সরস্বতীর কাছে। তাকেই অনুরোধ করা হল, কুম্ভকর্ণ যখন বর চাইবে মহাদেবের কাছে, তখন তিনি যেন টুপ করে খসে পড়েন তার জিহ্বা থেকে। তা হলে আর কথা বলতে পারবে না সে। বেচার কুম্ভকর্ণ, সে এ সব কথা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি। মহাদেবের সামনে দাড়িয়ে যখন বর চাওয়ার পালা, তখন কোনও স্বরই বের হচ্ছে না তার গলা দিয়ে। সব কিছ জড়িয়ে পেঁচিয়ে শুধু ‘ঘু-ঘুউ’-এর মতো শব্দ বের হয়ে এল। মহাদেব ভাবলেন ঘুমের বর চাইছে কুম্ভকর্ণ। তিনি খুশি মনে সে বর দিয়েই ফিরে গেলেন।

বুঝলাম।

কিচ্ছু বোঝোনি। ভেবে দেখো কত বড় কন্সপিরেসি করেছিলেন দেবতারা। ওই কুম্ভকর্ণের জিহ্বার মতো আমাদের জিহ্বাও আজ বাক্যহারা। আমাদের জিভ খসে পড়েছে। আমরা তাই প্রতিবাদ করতে ভুলে গেছি।

কী যা তা বকছেন। যত সব ভাট শুরু করলেন সকাল সকাল।

ঠিকই বলেছি। আমাদের জিহ্বা খসে গেছে। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ কোনও অন্যায় – আমরা শুধু দেখি, শুনি। তবে দেওয়াল লিখনের বিষয়টা দেখেছ তো! ওরা কিন্ত চুপ করে নেই। কথা বলতে দেবে না — ঠিক আছে। এ বার দেওয়ালে দেওয়ালে ফুটে উঠবে বিপ্লবের কথা। রোজ। এ ভাবেই…

বক্তৃতার ঢঙে একভাবে চিৎকার করে কথাগুলো বলে যাচ্ছিল জহরদা। ভিড় বাড়ছে। সুযোগ বুঝে সেখান থেকে পালায় চৈতন্য।

অফিসের ছাদে বোসদা বলল অলিভিয়ার কথাটাই। ভাবছি শালা আমিও লিখব। কাল তো দোল। রং কিনে আনব।

কী লিখবেন?

যেগুলো বলতে পারি না। অনেক কথাই তো রয়েছে আমাদের। আমি তো ভাবছি ডিমানিটাইজেশন নিয়ে লিখব। আলোচনায় ঢুকে পড়েছে তীর্থঙ্কর।

আমি লিখব বাঞ্ছার বাপরে নিয়া। সারা জীবন স্কুলের চাকরি কইরা, লোকটা যে ক্যান মরতে ওইসব করল। টাকা ফেরত দিতে না পাইরা আমাগো ভালো মানুষ মাস্টার… এ বার আলোচনায় পালদা।

কেন আমাদের তাহের মণ্ডলের কথা বলি নাই তোমাদের! শালা পয়সার দেমাকে গোটা কবরস্থানটাকেই বিয়ে বাড়ি বানিয়ে ছাড়ল। পার্টির হেই অনুষ্ঠান ওই অনুষ্ঠানে টাকা দিয়া সে শালা ভিআইপি হইচে। ওর সব কথা এ বার লিখব। কুতুবউদ্দিনের এই অভিযোগ অবশ্য আগেও শুনেছে সবাই।

যদি ধরা পড়ি? স্বভাবসিদ্ধ ঢঙেই কিছুটা সতর্ক তীর্থঙ্কর।

ধরা কেন পড়ব! আমরা তো আর অফিসের দেওয়ালে ম্যানেজারের কুৎসা লিখছি না। যা লিখব তা বৃহৎ উদ্দেশ্যে। সংকীর্ণ স্বার্থের কথা ভেবে নয়। বোসদার খোচার রেশ ধরেই পাল্টা কথা জোড়ে পালদা — আমরা তো শালা লিখুম অন্যগো দেওয়ালে!

কিন্তু লিখবে কোন কালিতে? এবার যেন হুঁশিয়ারি দেওয়ার ঢঙে ভয়ও দেখায় তর্থঙ্কর।

আলোচনায় কোনও রঙই বাছা যায় না। লাল, নীল, কমলা থেকে হলুদ, বেগুনি, কালো। পালদা সবুজের কথা তুলতেই কুতুবউদ্দিনের ঠাট্টা, তোমাকে জেহাদি ঠাওরাবে। সব রঙই কোনও দল না হয় পাটির। চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার ভয়টাও ওখানেই। কিন্তু বাকিরা তা লিখছে? লিখছে, তবে তা নিছকই লেখার জন্য লেখা। উদ্দেশ্য নেই। অফিস থেকে বের হতে দেরি হয়ে যায়। নিজের সঙ্গে প্রশ্ন-উত্তরে চৈতন্য হঠাৎই বলে বসে – জিহ্বা খসে গেলে, আমরা বর্ণের হাত ধরি!

তারাপদ বলে, সবটাই কেমন যেন সন্দেহজনক লাগে। এই যে গাড়িটা চালাচ্ছি, এটা রিকশা নাকি গাড়ি। যখন চার্জ থাকে তখন গাড়ি, ফের চার্জ চলে গেলে রিকশা। শালা, চরিত্রটাই কেমন পাল্টে গেছে। আপনার-আমার স্কুলের বন্ধুত্বের মতো। আপনি যেমন বুঝতে পারেন না এটা কোন ঋতু। শীতকাল নাকি গরমকাল? আমিও তেমন গাড়িটা। তারাপদর কাছেই সে জানতে পারে মণি বসাকের বিধবা বউ সাদা চুড়িদারে নীল লিপস্টিকে বের হয়েছিল আজ।

রাতের খাবার টেবিলে বিরক্তি লুকায় না অলিভিয়া। নিজেকে আরও একবার অপদার্থ মনে হয় চৈতন্যর। অলিভিয়া জানায় সে নিজেই বাজার থেকে কিনে এনেছে রং। কিন্তু কী রং কিনেছে অলিভিয়া? কোনও বর্ণের! নিজের অস্বস্তি অলিভিয়াকে বুঝতে না দিয়ে রঙের কৌটোগুলি নিয়ে আসে চৈতন্য। খালি বালতিতে একের পর এক ঢেলে দেয় লাল, নীল, সবুজ, হলুদ… খাবার টেবিল পরিষ্কার করে কখন যে অলিভিয়া এসে দাঁড়িয়েছে। বুঝতে পারেনি। আর্তনাদের মতো শোনায় অলিভিয়ার স্বর – ও কী করলে?

বালতিতে তখন এক এক বর্ণের রং এর ওর ঘাড়ে, পিঠে মিলেমিশে একাকার। চৈতন্য, অলিভিয়া দু-জনেই হতচকিত হয়। সেই রঙগুলিই মিলেমিশে বালতিতে তৈরি করেছে অদ্ভুত বর্ণের আলো!

এই আলোটাকে বড় চেনা মনে হয়। কোথাও দেখেছে কি? বাজারে জহরদার। চোখে?

[ লেখকের অনুমতিক্রমে ‘রবিবারের গল্প’ গল্প সংকলন থেকে প্রকাশিত]

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ