১
ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের হলঘরটার থেকে অনিরুদ্ধ বেরিয়ে আসতেই বিতান আর অচ্যুত প্রায় দৌড়ে গেলো ওর কাছে ।
দরজার পাশে রাখা টুলটায় বসে জুতো পরতে পরতে অনিরুদ্ধ যে ইশারা করলো তার অর্থ হয়, এখানে নয় বাইরে গিয়ে সে সব বলছে ।
আইসিইউয়ের বাইরের এনক্লোজারের কাঁচের দরজাটা ঠেলে বেরিয়ে এসে তিনজনে হাসপাতালের তিনতলার করিডোর দিয়ে হাঁটতে লাগলো ।
বিতানের বিহ্বল মুখচোখে রাত্রি জাগার ক্লান্তি আর অজানা আশঙ্কার ছাপ ছেয়ে রয়েছে ।
বাকি দুজনের অনিরুদ্ধ আর অচ্যুতেরও প্রায় একই অবস্থা ।
তিনজনের মধ্যে অনিরুদ্ধকে কমবেশী স্টেডি দেখাচ্ছে ।
এটা ওর হাসপাতাল, এখানেই ও ডাক্তারি পড়ছে, ফোর্থ ইয়ার ।
কাল মাঝরাতে বিতানের মা হার্ট এট্যাক-এর সব লক্ষণ নিয়ে এখানে ভর্তি হয়ে গেছেন ।
তিনবন্ধুতে রাতভর দৌড়োদৌড়ি করে এই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ওঁকে নিয়ে এসেছে ।
অনি এখানেই ছাত্র থাকায় সুবিধা হয়েছে অনেক ।
পাঁচ বছর আগে বিতানের বাবার হঠাৎ অসময়ে চলে যাবার পর এইবার নিয়ে তিনবার বিতানের মা হার্টের অসুখের উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন ।
লম্বা করিডোরের শেষে কাঁচের দরজার পরে একটা ছোট খোলা ছাদ, সকালের রোদে ঝলমল করছে ।
সেখানে পৌঁছে অনিরুদ্ধ বললো,
-‘স্যার মাসিমা কে ভালো করে দেখেছেন । দুবছরের আগের ফাইল আর ইসিজি ইকোটাও দেখলেন । কি বলবেন সেটা আমি অবশ্য আগেই আন্দাজ করেছিলাম । মাসীমার হার্টের অবস্থা তো এমনিতেই ভালো নয় । এখন একটা মডারেট এট্যাক হয়েছে । বাহাত্তর ঘন্টা না কাটলে কিছুই পরিষ্কার বোঝা যাবে না, সেটাই বললেন আমাকে । তবে এখন পর্যন্ত সব কিছু স্টেবল আছে ।’
বিতান ব্যাকুলভাবে বলে উঠলো, ‘তুই জিজ্ঞাসা করলি না তোর স্যারকে, মা ভালো হয়ে যাবে তো ?’
অনি কিছু বলার আগেই অচ্যুত বলে উঠলো,
-‘বাবু, তোকে বলছি তো মাসির এখন কোনো বিপদ নেই । এটা একটা ফাঁড়া কেটে যাবার মতো । আরও একমাস বৃহস্পতি কুম্ভ রাশিতে থাকছে । এসময় বিমলা মাসির…।’
অচ্যুতের কথার মধ্যেই বিরক্ত গলায় অনিরুদ্ধ বলে উঠলো,
-‘অচ্যূতানন্দ, তোর এই দৈববাণীগুলো হসপিটালের এরিয়ার মধ্যে বিতরণ করিস না তো । আমরা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন, মানে হার্ট ডিজিজের প্রবলেম হ্যান্ডেল করার চেষ্টা করছি…বুঝছিস সেটা ? না কি কুম্ভরাশিতে বেস্পতি…যত্তসব !’
বিতান অচ্যুতের দিকে কাতর ভাবে তাকাতেই অচ্যুত বলে উঠলো,
-‘ঠিক আছে, ঠিক আছে । আমি কিছু বলছি না ।’
-‘হ্যাঁ এখন একদম বলবি না । শুনি তো তোর কথা…শুনি না ? যখন বোর ফিল করি, রিল্যাক্স করতে ইচ্ছে হয়, তখন তো শুনি !’
এতো দুশ্চিন্তার মধ্যেও বিতান একটু হাসির ভাব করে অচ্যুতের দিকে তাকালো ।
-‘এখন চল, ক্যান্টিনে গিয়ে কফি আর কিছু খেয়ে নিই । তারপর তোরা দুজনে বাড়ি ফিরে যা । পরে বিকেলে আবার আসিস ।’
বিতান আবার অনিরুদ্ধের দিকে তাকাতেই ও বলে উঠলো,
-‘শোন বাবু, স্যারকে ঐরকম ভেগলি তো আমি জিজ্ঞেস করতে পারি না, তোরা পারিস । এখন আমাদের এখানে কিছু করার নেই। আমার আর তোর ফোন নাম্বার দিয়ে এসেছি । দরকার হলেই ডেকে নেবে । আমি এখন কিছুক্ষণ আছি লাইব্রেরিতে । আমার বারোটা থেকে এনাটমি ক্লাসও আছে। আমি বাড়ি ফিরে আবার এসে যাবো । এখন চল তো, ক্যান্টিনে চল।
তিন বন্ধু ক্যান্টিনের দিকে হাঁটতে লাগলো ।
#
অনিরুদ্ধ, বিতান আর অচ্যুত তিনজন সেই ছোটবেলা থেকে একেবারে গলায় গলায় বন্ধু ।
এক পাড়া, এক স্কুল, তবে মাধ্যমিকের পর তিনজনের পড়াশোনার লাইন তিনদিকে বেঁকে গেছে ।
মেডিক্যাল এন্ট্রান্সে ভালো ফল করে অনিরুদ্ধ বা অনি, ডাক্তারি পড়ছে মেডিক্যাল কলেজে ।
চোখের সামনে জীবনের শুরু আর শেষ দেখতে দেখতে, আর মানবশরীরে বিভিন্ন হরমোনের কারসাজি জানতে জানতে তার বিজ্ঞানমনস্ক মন দিনে দিনে আরও প্রখর যুক্তিবাদী হয়ে উঠেছে ।
তাই ট্র্যাডিশনাল ভট্টাচার্যি পরিবারের ছেলে অচ্যুতের সঙ্গে তার লেগে যায় যখন তখন ।
অচ্যুত এম এ পড়ছে সংস্কৃত নিয়ে ।
তবে অনির সঙ্গে লেগে যাওয়ার জন্য সেটা বিশেষ কোনো ব্যাপার নয় ।
সবরকম আধিদৈবিক আর আধিভৌতিক বিষয়ে অচ্যুতের প্রচুর আগ্রহ।
এসব বিষয়ে অবশ্য বিস্তর পড়াশোনাও করে সে ।
অনিকে, বিতান ওরফে বাবুকে, জন্মান্তরবাদের ব্যাপার-স্যাপার বিজ্ঞানের মোড়কে বোঝানোর জন্য এক্সট্রা সেন্সরি মেমরি আর এক্সট্রা সেন্সরি পারসেপশনের ব্যাখ্যা টেনে নিয়ে আসে অচ্যুত ।
কিন্তু অধিকাংশ আলোচনাই অমীমাংসিত থেকে যায় ।
কারণ প্রায় সব তর্কের শেষদিকে অনি মুচকি হেসে জানায় যে আত্মার অবস্থানটা শরীরের ঠিক কোন জায়গাটায় সেটা গ্রে-র তেরোশো পাতার বইতে এখনো সে খুঁজে পায়নি !
পেলেই নাকি সে অচ্যূতানন্দের সব যুক্তি নির্বিবাদে মেনে নেবে ।
ভীষণ বিরক্ত হয়ে অচ্যুত আলোচনায় ভঙ্গ দেয় ।
ওর বিরক্তি দেখে অনিরুদ্ধ আর বিতান দুজনেই হাসতে থাকে ।
আর ওদের দুজনের মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে কিছুক্ষণ পরেই অচ্যুতও সে হাসিতে যোগ দেয় ।
অনিরুদ্ধ আর অচ্যুতের মাঝখানে আছে বিতান, প্রকৃতিতে স্থিতধী ।
কিন্তু পিতার অসময়ের মৃত্যুতে আর মায়ের পরপর অসুস্থতার কারণে ইদানিং সে মানসিকভাবে বেশ কিছুটা বিচলিত হয়ে থাকে ।
সম্পন্ন ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে বিতানের তার কাকার সঙ্গে পারিবারিক প্রিন্টিংয়ের ব্যবসায় যোগ দেওয়ার মন একেবারে নেই ।
তাই ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে গ্রাজুয়েট হওয়ার পর ও সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসার জন্যে তৈরী হচ্ছে ।
বিতানের বাবা চলে যাওয়ার পর তার বিধবা মা যেন বেশী করে আঁকড়ে ধরেছেন একমাত্র সন্তানকে ।
কোনো কোনো সময়ে সেই ব্যাপারটা বিতানের কাছে বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়ায় ।
যেমন কোনো কারণে বাড়ির বাইরে থেকে বিতান যদি মা-র মোবাইল ফোনের জবাব দিতে না পারে তাহলে বিমলা ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েন ।
এজমালি বাড়ির অন্য অংশে কাকার পরিবার ।
বেশ কয়েকবার বাবুর ফোনে নো রিপ্লাই বা নট রিচেবল পেয়ে বিমলা ভয় পেয়ে ছুটে গেছেন দেওরের কাছে ।
ব্যাপারটা কখনো কখনো বেশ এমব্যারাসিং হয়ে গেছে বিতানের কাছে ।
কারণ কাকা বৌদির আকুলতা দেখে তখন হয়তো ফোন করেছে কোচিং সেন্টারের মালিকের অফিসে ।
আর সে ভদ্রলোক ক্লাসের মধ্যে এসে বিতানকে বাড়িতে তক্ষুনি ফোন করতে বলেছেন ।
মা-র হার্টের অবস্থা ভেবে বিতান মা-কে বিশেষ কিছু বলতেও পারে না ।
অনিরুদ্ধ বারবার করে বলে দিয়েছে, মাসীমার মাইওকার্ডিয়াল ইস্কিমিয়া আছে, যে কোনোরকম উত্তেজনা বা স্ট্রেস ওঁর পক্ষে মারাত্মক হতে পারে ।
২
কাস্টমারদের ভীড়ের মধ্যে কনুইয়ের ধাক্কা থেকে খাবারের ট্রেটা বাঁচাতে বাঁচাতে অনি ফিরে এলো ওদের টেবিলে ।
দুপুরের এই সময়টায় বৌবাজার স্ট্রিটের এই সিসিডিটাতে প্রচুর ভিড় হয় ।
কমবয়েসী ছাত্রছাত্রীদের ভিড়টা বেশী ।
যদিও অনেকটা জায়গা নিয়ে এই আউটলেটটা, কিন্তু দিনের মধ্যে সবসময়েই প্রায় সবকটা টেবিল ভর্তি থাকে ।
অনির মনে আছে একবছর আগেও এখানে একটা ফার্ণিচারের অন্ধকার অন্ধকার গুদাম ছিল ।
আজ সেই জায়গায় একটা ঝকঝকে কফি স্ন্যাকসের রেঁস্তোরা ।
খাবারের ট্রে টেবিলে নামিয়ে অনি প্রথমে চিজকর্ন স্যান্ডউইচটা আলাদা করে অচ্যুতকে দেখিয়ে দিলো ।
টেবিলে গতানুগতিক পুরোনো আলোচনা বেশ পেকে উঠেছে ।
তিনজনেরই মনমেজাজ এখন ভালো, নির্ভার ।
কারণ দিন পনেরো হাসপাতালে কাটিয়ে মাসখানেক আগে বিতানের মা বিমলা দেবী বাড়ি ফিরে এসেছেন ।
তিনি ওষুধ আর পথ্যবিশ্রামের কঠোর নিয়মের মধ্যে থাকলেও বিতান এখন অনেকটা চিন্তামুক্ত ।
চব্বিশ ঘন্টা মায়ের দেখভাল করা গায়ত্রীমাসী মা-কে ভালোভাবেই সামলাতে পারছে ।
আজকের তর্কাতর্কির টপিক হচ্ছে, প্ল্যানচেট জিনিসটা কি…বুজরুকি… নাকি, ব্যাপারটা সত্যি ঘটে ।
চিকেন স্যান্ডউইচে কামড় দিয়ে অনিরুদ্ধ ঠাট্টার গলায় বললো,
-‘বাবা অচ্যূতানন্দ, তোমার যুক্তিতে যদি প্ল্যানচেট ব্যাপারটা সত্যি সত্যি হয় বলে মেনে নিই, তাহলে তো প্রথমেই আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয় । ভুত মানতে হয় । তারপর বেম্মদত্যি, পেত্নী, মামদো, শাকচুন্নি, সব পরপর লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে ! এ বলবে আমায় দেখো ও বলবে আমায় দেখো ।
অচ্যুত উত্তেজিত ভাবে কি একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলো, তার আগে বিতান বলে উঠলো,
-‘শোন, অনেকদিন আগে আমাদের বাড়িতে প্ল্যানচেট নিয়ে একবার কথা হয়েছিল, সেটা বলি তোদের। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর কথা হচ্ছিলো মনে আছে। বাবা তো খুব হেসে সব কথা উড়িয়ে দিয়েছিলো । মা-র খুব অস্বস্তি হচ্ছিলো এটাও মনে আছে । মা কেবল বলছিলো রাত্তিরবেলা এসব আলোচনা এখন তোমরা বন্ধ করো । আর কাকা কি বলেছিলো জানিস ? সেটা খুব ইন্টারেস্টিং !’
অচ্যুত এবার আগ্রহের গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘কি বলেছিলো তোর কাকা ?’
-‘কাকা ঘটনাটা শুনেছিলো তার শ্বশুরের কাছ থেকে । শ্বশুরের বন্ধুরা মিলে নাকি একবার প্ল্যানচেট করেছিল । তো, প্ল্যানচেটের একটা বোর্ড হয় না ? সেই বোর্ডে সেবারে নাকি আত্মার ছড়াছড়ি হয়ে গিয়েছিল । সে একবার শাহজাহান আসছে, একবার তৈমুর লং, পরক্ষণেই ডিএল রায়, বঙ্কিম, তারপরই আবার মার্টিন লুথার কিং ।’ বলে বিতান হাসতে লাগলো ।
অনিরুদ্ধ এমন জোরে হো হো করে হেসে উঠলো যে কয়েকজন মাথা ঘুরিয়ে এদিকে তাকালো ।
অচ্যুত ওদের ঠাট্টায় একটু থতিয়ে গেলেও দমে না গিয়ে বললো,
-‘তাহলে রবীন্দ্রনাথ ?’
#
-‘রবীন্দ্রনাথ কি !’ আপাদমস্তক রবীন্দ্রভক্ত অনিরুদ্ধ ভুরু কুঁচকিয়ে জিজ্ঞেস করলো ।
গলায় জোর দিয়ে অচ্যুত বললো,
-‘পড়বি না কিছুই, কিন্তু তর্ক করবি ! অমিতাভ চৌধুরীর লেখা রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা বইটা খুলে দ্যাখ, রবীন্দ্রনাথ প্ল্যানচেট করতেন, আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন ।
অনি আর বিতান দুজনেই বইটা পড়েনি বোঝা গেলো । বিতান জিজ্ঞেস করলো,
-‘কি লেখা আছে ? রবীন্দ্রনাথ প্ল্যানচেট করেছিলেন ?’
-‘করেছিলেন শুধু নয়…প্রায়ই করতেন । প্রিয় ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ মারা যাওয়ার পর প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে করতেন । সে ব্যাপারে উনি লিখেছেনও । তোদের কি মনে হয়..রবিঠাকুর মিথ্যে কথা, মানে যেটা নিজে বিশ্বাস করেননি, তা নিয়ে লিখতে পারেন ?’
অনিরুদ্ধ তক্ষুণি উত্তর খুঁজে না পেয়ে চুপ করে থাকলো ।
বিতান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, তাকে থামিয়ে দিয়ে অচ্যুত আবার বললো,
-‘অনি, প্ল্যানচেট নিয়ে আমি অনেক দেশী বিদেশী বই পড়েছি । অনেক বিশ্বাসযোগ্য মানুষ যা লিখেছেন তা এতো সহজে উড়িয়ে দেওয়া যায় না ।’
এতক্ষণে অনিরুদ্ধ একটু সামলে নিয়েছে । সে একটু জেদের গলায় বললো,
-‘সে যে যাই বলুক বা লিখুক, বাংলা বা ইংরেজিতে,আমি নিজে যতক্ষণ না ঠিকঠাক প্রমাণ পাচ্ছি, ততক্ষণ আমি তোর দলে নেই অচ্চু । বিজ্ঞানের ছাত্র আমি, এক্সপেরিমেন্ট, অবজারভেশন, ইনফারেন্স, পিরিয়ড ।’
অচ্যুত এক মুহূর্ত দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো । তারপর বললো,
-‘ঠিক আছে । তাহলে তাই করি আমরা । করবো আমরা প্ল্যানচেট । অনিকে আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করানোর জন্য আমাকে সেটাই করতে হবে । আমি কিনে আনবো প্ল্যানচেট বোর্ড । আমরা তিনজন আছি, মিনিমাম তিনজনই দরকার ।’
বিতান চুপ করে শুনছিল। একটু সন্দিগ্ধ গলায় বললো,
-‘কিন্তু অচ্চু…তুই বলছিস বটে…মানে, ভয়ের কিছু নেই তো ? আমার কিন্তু…।’
অনিরুদ্ধ বিতানকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
-‘কি ভয়ের কথা ভাবছিস তুই ? ও কিছু প্রমাণ করতে পারবে না, তুই নিশ্চিন্ত থাক ।’
অচ্যুত অনির দিকে স্থির চোখে এক মুহূর্ত তাকিয়ে তারপর ঠান্ডা গলায় বললো,
-‘কাকে ডাকবো সেই আত্মার কথাও আমি ভেবে নিলাম । ভেরিফিকেশনের সুবিধার জন্য এমন একজনকে ডাকবো, যাঁকে আমরা সবাই রীতিমতো চিনতাম । এখন বাবুর যদি আপত্তি থাকে তাহলে অবশ্য…।’
বিতান অবাক হয়ে বললো,
-‘আমার আপত্তি ! মানে ? আমি কেন…।’
-‘বাবু, আমরা মেসোমশাইকে…মানে তোর বাবার আত্মাকে প্ল্যানচেটে ডাকবো।’
৩
বিমলাদেবীর ডান হাত থেকে স্ট্রাপটা খুলতে খুলতে অনিরুদ্ধ বললো,
-‘তোমার সিস্টোলিক প্রেসারটা আজও ওপরে দেখাচ্ছে মাসি । পাল্স রেটটাও বেশী রয়েছে । পুরো সপ্তাহটা দেখছি লাগাতার তোমার সিস্টোলিকটা বেশী চলছে । কেন বলো তো ? ওষুধগুলো ঠিক সময়মতো খাচ্ছো তো ? দাঁড়াও, আমি একবার গায়ত্রীমাসীকে জিজ্ঞাসা করছি । নাকি খুব টেনশন করছো সবসময় ?’
-‘ না- রে অনি, তোকে অতো গোয়েন্দাগিরি করতে হবে না । ওষুধ আমি ঠিক সময়ে খাই। তুই যেমন বুঝিয়ে দিয়ে গেছিস ।’
বিমলাদেবী অনিরুদ্ধর দিকে তাকিয়ে সস্নেহে বললেন ।
কৈশোরে মাতৃহীন অনিরুদ্ধের এ বাড়িতে এবেলা-ওবেলা অনায়াস যাতায়াত, অনেক স্বজন-সুলভ আদর । বিশেষ করে বিমলাদেবীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু অনিরুদ্ধের মা-র অকাল মৃত্যুর পর তিনি ওকে দ্বিতীয় ছেলের মতো ভালোবাসেন ।
বিমলা আবার বললেন,
-‘তুই টেনশনের কথা বলছিস ? টেনশন তো আছেই বাবা…বাবুটাকে নিয়ে । ঘরের প্রেসের ব্যবসা সে দেখবে না, সরকারি চাকরি করবে । চাকরি পাকা হলেই আমাদের অংশটা কাকাকে বিক্রি করবে বলেছে । এখন পরীক্ষাটায় যদি ও পাস না করতে পারে…’
অনিরুদ্ধ বললো,
-‘তুমিও যেমন ! আকাশ থেকে দুশ্চিন্তা পেড়ে আনছো ! বাবুর মতো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট…আমি তোমাকে বলছি আই এ এস ও একবারে ক্লিয়ার করবে । শুধু তাই নয়…প্রথম দুশো জনের মধ্যে ওর নাম থাকবে । তুমি মিলিয়ে নিও ।’
ঠিক এই সময় বিতান ঘরে ঢুকলো, বাইরে কোথাও গিয়েছিলো বোধহয়, হাতে একতাড়া কাগজ ।
ঘরে ঢুকে আলোচনার গতি আন্দাজ করে হেসে বললো,
-‘কখন এলি ? মা কি বলছে রে, আমি পাশ করতে পারবো না, এই তো । ছাড়তো, ও দুবেলা শুনছি ! পজিটিভ ভাইব-এর কোনো ওষুধ থাকলে বলে দিয়ে যা ! আমি দুবেলা পাক্কা খাওয়াবো নিয়ম করে ।’
অনি হেসে উঠলো । বিমলা স্মিতমুখে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকলেন ।
বিতান টেবিলের ওপরে রাখা প্রেসার মাপার যন্ত্রটা দেখে বললো,
-‘আজ প্রেসার কত দেখলি ? নেমেছে একটু ?’
-‘সে নামমাত্র । দু-চার পয়েন্ট এদিক ওদিক সবসময়েই হতে পারে । ওটা কোনো ইন্ডিকেশন নয় । দেখি, স্যারকে বলি, এক সপ্তাহ টানা বেশী রয়েছে সিস্টোলিক প্রেসার, যদি ওষুধ বদলে বা ডোজ চেঞ্জ করে দেন । তুমি আবার সিঁড়ি ভাঙছো না তো ?’ শেষ কথাটা অনিরুদ্ধ বিমলা দেবীকে বললো ।
বিতান বলে উঠলো, ‘না না, সে রাস্তা বন্ধ করেছি রে । আমাকে কিছু বলার থাকলে আগে সোজা সিঁড়ি দিয়ে উঠে চলে আসতো আমার ঘরে । এবারে হাসপাতাল থেকে ফেরার আগেই কলিং বেল করে দিয়েছি । সাবিত্রী মাসিকে ডাকে একবার বেল বাজিয়ে । দুবার বাজালে আমি নীচে চলে আসি….পাক্কা ড্রিল !’
অনি প্রেসারের যন্ত্রটা গুছিয়ে ব্যাগে তুলছিলো । মাথাটা তুলে চোখের ভেতর দিয়ে হেসে বললো,
-‘ভেরি গুড । আমি এখন চলি রে বাবু, বাড়িতে গিয়ে খেয়েই বেরোতে হবে, ক্লাস আছে টানা দুঘন্টা । সন্ধেবেলা মধুদার দোকানে আসিস । আমি গেলাম মাসি ।’
অনিরুদ্ধ তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলো ।
বিতানও ঘর থেকে বেরোবার উদ্যোগ করছে এমন সময় বিমলা ডাকলেন, ‘বাবু । ‘
বিতান ঘুরে তাকাতে বিমলা ইশারা করে দেওয়ালের দিকে দেখালেন ।
বিতান দেখলো দেওয়ালে টাঙানো বাবার ছবিটা একটু হেলে রয়েছে ।
বিতান ছবিটা সোজা করে দিয়ে থেকে বেরিয়ে গেলো ।
#
পুরো উত্তর আর মধ্য কলকাতায় খুঁজে খুঁজে শেষে মৌলালিতে ‘আদি অকৃত্রিম তন্ত্র ও দৈবসামগ্রী বিপণি’ নামের একটা ছোট্ট ভ্যাপসা অন্ধকার দোকানে অচ্যুত একটা প্ল্যানচেটের বোর্ড পেয়ে গেলো ।
রুদ্রাক্ষের মালা ও সিঁদুরচর্চিত ললাটের অধিকারী দোকানীর কৌতূহলী চোখ আর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দাম মিটিয়ে খবরের কাগজে জড়ানো প্যাকেটটা নিয়ে অচ্যুত তাড়াতাড়ি দোকান থেকে বেরিয়ে এলো ।
সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের পার্কের রেলিং টপকে একটা বেঞ্চে বসে কাঁধের ঝোলাটা থেকে কাগজের প্যাকেটটা বার করলো অচ্যুত ।
এতদিন ছবিতে দেখেছে, এবার হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলো একটা সত্যিকারের প্ল্যানচেট বোর্ড ।একটা বড়ো পানপাতার আকৃতির কালো রঙের পালিশ-করা কাঠের বোর্ড, আট-দশ ইঞ্চি মতো লম্বা চওড়া আর ইঞ্চি খানেক মোটা ।
উল্টোপিঠে তিনটে কোণার দিকে গর্ত করে তিনটে চকচকে স্টিলের বল চাকার মতো আটকানো আছে যাতে বোর্ডটা কোনো সমতল জায়গায় সোজা করে পেতে রাখলে যেকোনো দিকে নড়েচড়ে যেতে পারে ।
পানপাতার মাথার দিকে একটা এফোঁড়-ওফোঁড় গর্ত, গর্তের মাথায় একটা ক্লিপের মতো আটকানো আছে ।
ওই গর্তটার মধ্যে পেন্সিল ঢুকিয়ে আটকিয়ে দিতে হয় ।
প্ল্যানচেটে আত্মা এসে তার বক্তব্য ওই পেন্সিলের মাধ্যমে কাগজের ওপরে বোর্ডকে সরিয়ে সরিয়ে লিখে জানায় । অচ্যুত দেখেশুনে বোর্ডটা প্যাকেটের মধ্যে রাখবে, এমন সময় তার চোখ পড়লো উল্টোদিকে পেস্ট করা একটা ছোট্ট স্টিকারের ওপর, লেখা আছে ‘মেড ইন চায়না’ !
#
ট্রামের দরজায় দাঁড়িয়ে মাথাটা বাড়িয়ে বিতান দেখতে চেষ্টা করলো ট্রাফিক জ্যামটা কতটা লম্বা ।
প্রায় মিনিট পনেরো নট নড়নচড়ন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ট্রামটা ।
হাতিবাগানের কোচিং সেন্টার থেকে সন্ধ্যেরাতে কখনো সখনো কলেজ স্ট্রিট যাওয়ার দরকার পড়লে ট্রামে যাওয়াটাই পছন্দ করে বিতান ।
গদাইলস্করি চালে গেলেও মিনিট পনেরোর মধ্যে পৌঁছে যায় বইপাড়ায় ।
ব্যস্ত কলকাতার ধীরগামী যানে বসবার সিট পেয়ে যায় প্রায় প্রত্যেক বারই ।
আর ট্রামের জানলার ধারের ওই একানে সিটগুলো বিতানের বরাবরের পছন্দ ।
কিন্তু আজকে এমন লম্বা জ্যাম লেগেছে কেন ভাবতে লাগলো বিতান ।
আটটা বেজে গেছে । এবার আর বেশী দেরি হলে তো বইয়ের দোকানগুলো এক এক করে বন্ধ হয়ে যাবে ।
বিশেষ করে গুমটি দোকানগুলো, যেখানে সবরকম কম্পিটিটিভ পরীক্ষার বই পাওয়া যায় ।
নাঃ, এই বিবেকানন্দ রোডের মোড় থেকে জোরে হাঁটলে মিনিট পনেরোর মধ্যে কলেজ স্ট্রিট পৌঁছে যাবে, ভাবলো বিতান ।
‘জ্যাম এক্ষুণি কেটে গেলেও ঢিকঢিক করে চলে ট্রাম তার আগে পৌঁছতে পারবে না ।
বই খুঁজতে কিছু সময় তো লাগবেই তারপর বাড়ি পৌঁছতে আরও আধঘন্টা, উঁহু,বেশ দেরি হয়ে যাবে ।’
এই সব ভাবতে ভাবতে বিতান ট্রাম থেকে নেমে জোরপায়ে হাঁটা লাগালো ।
গায়ত্রী খাবার দেবে কিনা জিজ্ঞেস করে যাওয়াতে বিমলা কথামৃত থেকে চোখটা তুলে ঘড়ির দিকে তাকালেন ।
‘ওহ, নটা বেজে গিয়েছে । কিন্তু বাবু তো এখনও ফিরলো না ।’
ঘড়ি দেখার পর বিমলা চিন্তায় পড়ে গেলেন, বুকের ভেতরটা কেমন আনচান করতে লাগলো ।
কোচিং সেরে বাড়ি ফিরতে বাবুর এতো দেরী কেন হবে ভাবতে শুরু করে দিলেন তিনি ।
‘সাড়ে সাতটায় তো বাবুর কোচিং সেন্টার বন্ধ হয়ে যায় । হাতিবাগান থেকে ট্রাম বা বাস ধরে সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের স্টপে নেমে গলির ভেতর দিয়ে হেঁটে আসতে বড়ো জোর দশ মিনিট লাগে ।’
কোচিং থেকে কোথাও গিয়ে দেরিতে ফেরার ব্যাপার থাকলে নিশ্চিত বাড়িতে ফোন করে দেয় বিতান ।
‘কিন্তু এতোক্ষণেও তো বাবুর কোনো ফোন আসেনি ।’
বিমলা বালিশের পাশে রাখা ফোনটা তুলে বাবুর নাম্বারটায় কল করলেন ।
ফোন সুইচ অফ । বিমলা আরও চিন্তায় পড়ে গেলেন ।
‘কিছুই হয়তো নয়, ফোন সুইচ অফ থাকতেই পারে । হয়তো ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছে । হয়তো বাবু কারুর বাড়িতে নেই, রাস্তায় আছে তাই চার্জার ব্যবহার করার সুযোগ পায়নি ।’
কিন্তু বিমলার মনের গতি এখন আর সাধারণ পথে চলে না ।
এবার হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর থেকে এই ব্যাপারটা প্রায়ই হচ্ছে ।
মনের মধ্যে কোনোরকম চাপ বিমলার শরীরের জন্য যে ভীষণ ক্ষতিকারক হতে পারে বিতান বা অনিরুদ্ধ বার বার বুঝিয়ে বিশেষ কোনো ফল হয়নি ।
গায়ত্রী বোধহয় রান্নাঘরে খাবার গরম করতে ব্যস্ত ।
বিমলা কলিং বেলটা বাজিয়ে গায়ত্রীকে ডেকে তাঁর চেয়ারটা সদর দরজার পাশে দিতে বললেন ।
ডাক্তারের নিদান মেনে সময়ে খাওয়া শোওয়া এখন থাকুক, বিমলা দরজার পাশে বসে থাকবেন এখন , বাবু যতক্ষণ না বাড়ি ফিরছে ।
#
একটা গুমটি দোকানে ইন্ডিয়ান ইকোনমি আর মডার্ণ হিস্ট্রির বইদুটো উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে বিতানের চোখটা হঠাৎ হাতের ঘড়িটার দিকে যেতেই ও চমকে উঠলো ।
‘ইসস, সোয়া নটা বেজে গেছে । আগেই বাড়িতে গায়ত্রীমাসিকে একটা ফোন করে দেওয়া উচিত ছিল ।’
তাড়াতাড়ি পকেট থেকে ফোনটা বার করতেই আবার ধাক্কা, ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে ফোন বন্ধ হয়ে আছে ।
কখন থেকে যে ফোনটা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে জানতেও পারেনি বিতান ।
‘সর্বনাশ । দেরি দেখে মা এতক্ষণে নিশ্চয়ই ফোন করেছিলো । ফোন বন্ধ দেখে আরও দুশ্চিন্তা করতে থাকবে ।’
বিতান তাড়াতাড়ি দুটো বই দোকানীর হাতে দিয়ে বললো,
‘এই দুটো নিচ্ছি । কত হলো বলুন তো । আমার তাড়া আছে ।’
দাম মিটিয়ে ব্যাগের মধ্যে বই ঢুকিয়ে নিয়ে বিতান তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলো কলেজ স্ট্রিট ধরে ।
বাটা-র পাশের রাস্তা দিয়ে ঢুকে যাবে ভাবলো বিতান ।
জোরে হাঁটলে মিনিট কুড়ির মধ্যে নিশ্চয়ই বাড়ি পৌঁছে যেতে পারবে ।
‘এতক্ষণে মা-র তো খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ার কথা । আমার এতো দেরী দেখে কি করছে কে জানে ।’
ভাবতে ভাবতে বিতান তাড়াতাড়ি পা চালালো ।
৪
অচ্যুত বলেছে শনিবার অমাবস্যার রাতটা প্ল্যানচেট করার পক্ষে সব থেকে প্রশস্ত ।
তাই আজ রাতে বিতানের বাড়ির দোতলায় তার ঘরে প্ল্যানচেট করা হবে ঠিক করা হয়েছে ।
বেশ কিছুটা আলোচনার পর বিতান রাজি হয়েছে তার বাবার আত্মাকে প্রথমে আহ্বান করার কথায় ।
নানারকম যুক্তি দিয়ে অচ্যুত বন্ধুদের বুঝিয়েছে এতে কারুর কোনো ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই ।
ঠিক হয়েছে বিমলা রাতে খেয়ে শুয়ে পড়ার পর রাত সাড়ে নটা নাগাদ প্ল্যানচেট করা হবে ।
গায়ত্রীমাসীকে বিতান বলে দেবে ওর খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে খেয়েদেয়ে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়তে ।
দিনক্ষণ ইত্যাদি ঠিক হয়ে যাবার পর অচ্যুত বেশ গম্ভীর ভাব নিয়ে রয়েছে এই দুদিন ।
তবে অনি তার মনোভাব বিশেষ বদলিয়েছে বলে মনে হয়না ।
যদিও প্ল্যানচেটের বোর্ডটা দেখবার পর বেশ কৌতূহলী হয়ে সেটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো অনি ।
দু একটা প্রশ্নও করলো অচ্যুতকে ।
গম্ভীরভাবে অচ্যুত সেসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পর হাসতে হাসতে অনি বললো,
-‘তা তুই অমন গম্ভীর গম্ভীর মুখ করে কথা বলছিস কেন ? তুই কি স্বামী অভেদানন্দ ?’
বিতান একবার অচ্যুতের দিকে তাকিয়ে অনিকে জিজ্ঞেস করলো,
-‘স্বামী অভেদানন্দ কে রে ?’
-‘তুই ওকেই জিজ্ঞেস কর না !’ অনি আবার মুচ্কি হেসে জবাব দিলো ।
এবার বিতান অচ্যুতের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে সে সামান্য উত্তেজিত গলায় বললো,
-‘ঠাট্টা করছে অনি, বুঝতে পারছিস না বাবু ! মৃত্যুর পরে আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে সব থেকে প্রামাণ্য বই লিখেছেন স্বামী অভেদানন্দ, ‘মরণের পরে’ । অনেক সত্য ঘটনা লিখেছেন বইটাতে । তুই না মানলে কি এসে যায় ।’
শেষ বাক্যটা রাগের গলায় অচ্যুত বললো অনিরুদ্ধের দিকে তাকিয়ে ।
অনি হাসতেই থাকলো ।
#
নীলরংয়ের নাইট ল্যাম্পটা জ্বলছে বিতানের ঘরে ।
হালকা একটা নীলাভ আলো ছড়িয়ে পড়েছে সারা ঘরে ।
জান্লা দুটোর ভারী পর্দাগুলো পুরো টেনে দেওয়া ।
ঘরের দরজাটা হালকা করে ভেজিয়ে দিয়েছে অচ্যুত ।
নইলে সামনের সিঁড়ির আলোটা ঘরের মধ্যে চলে আসছিলো ।
অচ্যুত বলেছে আধো অন্ধকার পরিবেশ মনঃসংযোগ করতে সাহায্য করে ।
সারা বাড়িটা নিস্তব্ধ হয়ে আছে । নীচের তলায় কোনো সাড়াশব্দ নেই ।
একটু আগেই বিতান নীচে থেকে ঘুরে দেখে এসেছে, মা, গায়ত্রী মাসি, যে যার ঘরে রয়েছে ।
বিমলাদেবীর চোখ বন্ধ ছিল, বোধহয় ঘুমিয়েই পড়েছেন ।
রোজকার মতোই ঘরে ছোট টেবিলল্যাম্পটা জ্বলছে ।
ওটা জ্বলবে সারারাত ।
বিতানের বাবা চলে যাবার পর থেকে বাবা-মা-র শোওয়ার ঘরে ওই ব্যবস্থা ।
তিন বন্ধু এখন বিতানের পড়ার বড়ো টেবিলটা ঘিরে চেয়ারে বসে আছে ।
অচ্যুতের কথামতো পড়ার টেবিলটা খালি করে বিতান তার ওপর দুটো ফুলস্কেপ কাগজ জুড়ে বিছিয়ে দিয়েছে । কাগজের মাঝখানে রাখা হয়েছে সেই প্ল্যানচেটের বোর্ড ।
বোর্ডের শীর্ষবিন্দুর গর্তের ভেতর দিয়ে গেছে একটা পেন্সিল, আটকানো আছে বোর্ডের ওপরের ক্লিপের সাথে ।
চারিদিক শব্দহীন, শুধু দেওয়ালে টাঙানো ঘড়িটা টিকটিক শব্দ করে যেন এই ঘরের মধ্যের তিনটে মানুষের হৃদয়স্পন্দনের জানান দিচ্ছে ।
পাশের গলির কুকুরটার মাঝে মাঝে উচ্চৈস্বরে ডাকটাও কিছুক্ষন ধরে আর শোনা যাচ্ছে না ।
এমন পরিবেশে অনিরুদ্ধের কথাও বন্ধ হয়ে হয়ে আছে ।
অবশ্য বড়ো আলোটা নিভিয়ে দেবার সময়েই অচ্যুত দুজনকেই চুপ করে থাকতে বলেছে…সামান্য কথাও মনঃসংযোগে অত্যন্ত ব্যাঘাত ঘটাবে ।
একটা বড়ো মোমবাতি জ্বালিয়ে টেবিলের কোণায় ভালো করে বসিয়ে দিলো অচ্যুত ।
ঘরের মধ্যে বাতাসও গতিহীন ।
এখন তিন বন্ধুর ভারী নিঃশ্বাসের হাওয়ায় মোমবাতির শিখাটা নড়েচড়ে দেওয়ালে শরীরী মানুষের ছায়ায় এক অশরীরী অতিপ্রাকৃত পরিবেশ রচনা করতে শুরু করলো ।
সেই আধো আলোছায়ার মধ্যে অচ্যুতের ফিসফিস স্বর ভেসে এলো,
-তোরা ডানহাত মুঠো করে কেবল কড়ে আঙ্গুলটা বোর্ডের কোণাতে হালকা করে ছুঁইয়ে রাখ । তারপর মোমবাতির শিখার কেন্দ্রের দিকে পলকহীন চেয়ে থেকে একমনে মেসোমশাইয়ের কথা চিন্তা কর ।’
একটু পরেই নিস্তব্ধ ঘরে ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ ছাড়িয়ে হঠাৎ প্ল্যানচেটের বোর্ডটা ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করলো ।
অচ্যুত একটা অদ্ভুত কাঁপা কাঁপা ঘড়ঘড়ে ক্ষীণস্বরে বললো,
-‘মেসোমশাই, আপনি কি এসেছেন ?’
–‘না না, আমার হাতটা কাঁপছে রে।’ বিতান ফিসফিস করে বললো ।
একটা খুকখুক করে আওয়াজ শোনা গেলো…অনির হাসি চাপার আওয়াজ ।
সঙ্গে সঙ্গে অচ্যুত তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বড়ো আলোটা জ্বেলে দিলো ।
তারপর অত্যন্ত বিরক্ত গলায় বললো,
‘ এরকম ভাবে হবে না। অনি, সিরিয়াসলি মনঃসংযোগ কর । আমাদের মধ্যে একজনও যদি ডিসট্রাক্টেড থাকে তাহলে কিন্তু…’
-‘না না, আমি এবার ঠিক কনসেনট্রেশন বাড়াবো । ইন ফ্যাক্ট, আমার তো বেশ মজাই…’
অচ্যুত কড়া চোখে অনিরুদ্ধের দিকে তাকাতেই ও চুপ করে গেলো ।
অচ্যুত কি যেন ভাবছিলো । এদিক ওদিক তাকিয়ে বিতানকে বললো,
-‘বাবু, মেসোমশাইয়ের একটা ছবি পাওয়া যাবে রে ? ওতে কনসেনট্রেশনের অনেক সুবিধে হয়…বইতে লিখেছে।’
-‘আছে একটা, মা-র ঘরের দেওয়ালে । নিয়ে আসবো ? খুব সাবধানে নিয়ে আসতে হবে…মার্-র ঘুম আবার ভেঙে না যায় ।’
মিনিট তিনেকের মধ্যেই বিতান বাবার ছবি নিয়ে ফিরে এলো ।
অচ্যুত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বিতানের দিকে তাকাতেই ও হাত নেড়ে ইঙ্গিতে জানালো সব ঠিক আছে ।
একটা চেয়ারের ওপর বিতানের বাবার ছবিটা বসিয়ে অচ্যুত এবার মোমবাতিটা ছবির সামনে বসিয়ে দিয়ে বড়ো আলোটা আবার নিভিয়ে দিলো ।
ঘরের মধ্যে আবার ছায়া ছায়া আধো আলো পরিবেশটা ফিরে এলো ।
তিনজনের আঙ্গুল বোর্ডের ওপর, চোখ ছবির দিকে ।
ছবির মধ্য থেকে রজতাভ মল্লিক হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন ওদের দিকে ।
ঘরের মধ্যে সম্পূর্ণ নৈঃশব্দ, কেবল দেওয়াল ঘড়ির টিকটিক শব্দ ।
এমন সময় নাইট ল্যাম্পটা নিভে গেলো ।
আজকাল রাত্তিরবেলায় এই অঞ্চলে কখনো কখনো খুব কম সময়ের জন্য পাওয়ার কাট হচ্ছে ।
কিছুক্ষন এইভাবে কাটার পরই ঘরের বাইরে থেকে ‘বাবু’ বলে ডাক দিয়েই বিমলা দরজাটা খুলে ভেতরে এসে দাঁড়ালেন ।
সিঁড়ি ভাঙার পরিশ্রমে একটু হাঁফাচ্ছেন, তাঁর হাতের টর্চের আলো এদিক ওদিক পড়তে লাগলো ।
বিমলা বলতে শুরু করলেন, ‘বাবু, বেলটা তো বাজছে না। তোর বাবার ছবিটা যে কোথায়…’
বলতে বলতেই তাঁর হাতের টর্চের আলো আর চোখ চলে গেলো চেয়ারে বসানো ছবিটার ওপর ।
তারপর ছবির সামনের মোমবাতি আর প্ল্যানচেট বোর্ডের ওপর চোখ পড়তেই বিমলা আর্তনাদ করে উঠলেন,
-‘এ তোরা কি করছিস ! কি সর্বনাশ করছিস বাবু…এ কি করছিস তোরা…’
এটুকু বলেই বিমলার কথা বন্ধ হয়ে চোখ বুজে এলো, তিনি টলতে লাগলেন ।
বিমূঢ় অবস্থাটা কাটিয়ে তিনজনই ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে ।
এই সময়েই নীল আলোটা আবার দপ করে জ্বলে উঠলো ।
‘মা’ বলে একটা জোরে ডাক ছেড়ে বিতান ঝটিতি গিয়ে বিমলাকে জড়িয়ে ধরলো ।
বিমলা বিতানের হাতের ওপর এলিয়ে পড়লেন ।
অচ্যুত দৌড়ে গিয়ে ঘরের টিউব লাইটটা জ্বালিয়ে দিলো ।
অনিরুদ্ধ আর বিতান ধরাধরি করে বিমলার নিস্পন্দ শরীরটা সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে নিয়ে এসে তাঁর নিজের বিছানায় শুইয়ে দিলো । পেছনে পেছনে অচ্যুত নেমে এলো ।
উত্তেজিত কথাবার্তার আওয়াজ পেয়ে গায়ত্রী চলে এসেছে বিমলাদেবীর ঘরে ।
অনি তাড়াতাড়ি হাঁটু মুড়ে বসে বিমলা দেবীর ডান হাতটা তুলে নাড়ি দেখতে শুরু করলো ।
বোধহয় নাড়ির স্পন্দন ঠিকমতো না পেয়ে ছটফট করে বিমলার ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো, দুচোখের পাতা সরিয়ে সরিয়ে দেখলো ।
তারপর মাথায় হাত দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো ।
বিতান এতোক্ষণ উৎকণ্ঠার চোখে অনির পরীক্ষা করা লক্ষ্য করে যাচ্ছিলো ।
এখন ব্যাকুলভাবে অনিকে ধাক্কা দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো,
-কি রে…কি দেখলি ! বল আমাকে…বল আমাকে অনি…কোনো কথা বলছিস না কেন তুই ?’
অনিরুদ্ধ মুখ না তুলে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে হাহাকারের মতো বলে উঠলো,
-‘মাসি আর নেই রে বাবু…তোকে ছেড়ে, আমাদের ছেড়ে মাসি চিরদিনের মতো চলে গেছে ।’
বিতান একবার বিহ্বলভাবে মা-র নিথর দেহের দিকে তাকালো ।
তারপর খাটের ওপর মা-র পায়ের কাছে বসে পড়ে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো ।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল গায়ত্রী, সেও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ।
আর ঘরের মাঝে বিমূঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো অচ্যুত ।
একটা বড়ো পরিবারের মধ্যে থাকলেও চোখের সামনে মৃত্যু দেখার অভিজ্ঞতা তার নেই ।
বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সে একবার বিমলা মাসির সদ্যোমৃত দেহের দিকে, আর একবার ক্রন্দনরত বন্ধুদের দিকে তাকাতে থাকলো ।
হঠাৎ অনিরুদ্ধ দাঁড়িয়ে উঠে কেমন বিকৃত গলায় বলে উঠলো,
-‘যত নষ্টের গোড়া এই প্ল্যানচেট । হ্যাঁ, এই প্ল্যানচেটের জন্যই মাসির ম্যাসিভ হার্ট এট্যাকটা হলো । অচ্যু-র কথায় সায় দেওয়াটাই আমাদের ঘোরতর ভুল হয়েছে । আমি যাচ্ছি, ওই বোর্ডটাকে যদি আমি এক্ষুণি জ্বালিয়ে না দিই তো, আমার নাম..।’
বিতান বা অচ্যুত কিছু বলবার আগেই অনি ছিটকে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে দৌড়ে গেলো ।
ঘরের মধ্যে বিতান আর গায়ত্রী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে।
প্রথম ধাক্কাটা কাটিয়ে অচ্যুতের মনের মধ্যে একটা গভীর অপরাধবোধ কাজ করতে শুরু করছে ।
এমন সময়ে হঠাৎ দোতলা থেকে একটা অব্যক্ত চিৎকার ভেসে এলো, অনির গলার আওয়াজ ।
এমন অবর্ণনীয় সে আওয়াজ যে মুহূর্তের জন্য শোক ভুলে বিতান অচ্যুতের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
-‘এ তো অনির গলার আওয়াজ..দোতলা থেকে ! ও তো আমার ঘরে গিয়েছিলো । এমন করে কেন চিৎকার করে উঠলো ও !’
সিঁড়ির ধাপগুলো প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে পার করে ওরা দুজন দোতলায় বিতানের ঘরে পৌঁছলো ।
ঘরের মাঝখানে অনিরুদ্ধ দাঁড়িয়ে, বিস্ফারিত চোখ, হাতে ধরা প্ল্যানচেটের বোর্ডটা থরথর করে কাঁপছে ।
দুজনে ঘরে ঢুকতেই কোনো কথা না বলে অনি হাত দিয়ে টেবিলের ওপরে রাখা কাগজটা দেখিয়ে দিলো ।
কাগজটা আর সাদা নেই ।
পুরো কাগজটা জুড়ে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
অ নি ভু ল ব লে ছে রে বা বু আ মি তো তো কে ছে ড়ে যা বো না য খ ন ই ডা ক বি ত খ ন ই চ লে আ স বো
Tags: গল্প, মা, সিদ্ধার্থ সান্যাল
email:galpersamay@gmail.com
ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায় on April 20, 2021
রুদ্ধশ্বাস গল্প। শুরু করলে ছাড়া যায়না। লেখক পাঠককে টেনে নিয়ে গেছেন শেষ লাইন পর্যন্ত।
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।