[রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগতে সুপরিচিত নাম সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথের গানের গভীরে ডুবে থাকা মানুষটি এই সঙ্গীতের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছেন জীবনের পথ চলার আনন্দ।রবীন্দ্রগানের আলোকমাখা পথ ধরে হাঁটতে গিয়ে তিনি কিংবদন্তি শিল্পী সুবিনয় রায়কে শিক্ষক হিসাবে অনেক কাছ থেকে পেয়েছেন। সান্নিধ্যে এসেছেন রবীন্দ্রগানের স্বরলিপিকার শৈলজারঞ্জন মজুমদারের। আর এই ২০২১-এ সুবিনয় রায়ের জন্মশতবার্ষিকীতে আমরা ঋদ্ধ হয়েছি তাঁর সেই সংগীতময় আলোকযাত্রার সঙ্গী হয়ে।শিল্পী সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়ের কখনও হাতে লেখা,কখনও বা মুখে বলা এই সঙ্গীতযাত্রার সাক্ষী থাকলেন নৃত্যশিল্পী প্রতিভা দাস। পড়ুন ২য় পর্ব ]
২য় পর্ব / প্রসঙ্গ শৈলজারঞ্জন ও অনান্য…
………………………………………………
প্রতিভা দাসঃ একাধারে বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ,রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষক,রবীন্দ্রগানের স্বরলিপিকার এবং রসায়ন বিজ্ঞানের শিক্ষক শৈলজারঞ্জন মজুমদারের রবীন্দ্রস্মৃতির কথা যদি আমাদের শোনান।
সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়ঃ আগেই বলেছি সুবিনয়দা ক্লাসে বিশেষ কথা বলতেন না। এমন কি নিজের সঙ্গীত শিক্ষার কথাও কোনোদিন বলেন নি। নিজের গরজেই খবর নিয়ে জানতে পেরেছি উনি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছেন শান্তিনিকেতনে, শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কাছে।শুধু উনিই নন, রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রায় সব দিকপাল শিল্পীরাই শৈলজারঞ্জনের ছাত্র; সবারই ইনি গুরু।রবীন্দ্রনাথ নিজে এনাকেই তাঁর সঙ্গীত শিক্ষার দায়িত্ব দিয়েছিলেন;শান্তিনিকেতনের বাইরে থেকে আসা গান পাগল এই মানুষটিকে তাঁর প্রাণের সঙ্গীত ভবনের অধ্যক্ষ করেছিলেন। তাই খুব ইচ্ছে করত মানুষটিকে একবার দেখতে।পরে জানলুম ইনি এখন কলকাতাতেই থাকেন,একবার প্রণাম করে আসার ইচ্ছে হত,কিন্তু ঠিকানা জোগাড় করতে পারিনি ।
তারপর হল এক বিপদ।কদিন থেকেই কানাঘুষো শুনছিলুম উনি আমাদের পাড়াতেই গান শেখাতে আসেন, একেবারে আমার বাড়ির দু’তিনটে বাড়ির পরেই, রসগোল্লা আবিষ্কারক কে সি দাশ কিংবা নবীনচন্দ্র দাশের বাড়িতে।সন্ধান করে জানলুম খবরটা ঠিক, ক্লাস নেন সপ্তাহে দু’ দিন করে। আনন্দে ভয়ে বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে গেল।
যেতেই হবে ওনার কাছে, কিন্তু ওই সব কিংবদন্তী ছাত্রছাত্রীদের গুরুর কাছে যাবো? আমি? সুবিনয়দা ছিলেন রাগী মানুষ,তার গুরুও শুনেছি পান থেকে চুন খসতে দেন না। ভয়ে ভয়ে বেশ কিছুদিন সময় চলে গেল ।
আমার বন্ধু,অশোক (অশোক রায়চৌধুরী) আমরা একসঙ্গেই সুবিনয়দার ক্লাসে ছিলুম, খুব বন্ধু ছিলুম আমরা।ওর সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা হল।ওরও ইচ্ছে শৈলজারঞ্জনের ক্লাসে যোগ দেওয়ার। এক বেষ্পতিবারে ও আমার বাড়ি এলো। আর প্রায় চ্যাংদোলা করেই নিয়ে গেল ওনার ক্লাসে।অশোকের কাছে চিরদিন ঋণী হয়ে থাকবো,ও জোর না করলে হয়তো কোনোদিনই সাহস করে উঠতে পারতুম না।
দুজনে গেলুম শৈলজদার ক্লাসে।তখন তাঁর ছিয়াশি বছর বয়েস,শতাব্দীর সমবয়সী তিনি।ছোটখাটো মানুষ,হাতে এস্রাজ,শরীরে কোনও ক্লান্তির চিহ্ন নেই।বিশাল ঘর,ভর্তি ছাত্রী তাঁকে ঘিরে,কয়েকজন ছাত্রও ছিলেন।
আমাদের দিকে চোখ পড়তে ইঙ্গিতে বসতে বললেন।তারপর একের পর এক গান। অকূল পাথারে পড়লাম যেন।সুবিনয়দার ক্লাসে দিনে একটা গানও সব সময় সম্পূর্ণ হত না।আর এখানে একদিনেই এতগুলো গান!পরে বুঝেছি সেই গানগুলোর সুরের কোথাও কোথাও কিছু মিল আছে, ওনার উদ্দেশ্য সুরের ওই কাজগুলো বিশেষ ভাবে অভ্যেস করিয়ে আয়ত্ত করিয়ে নেওয়া।
দুজন সিনিয়র ছাত্রী স্বরলিপি নিয়ে ওনার দুধারে বসত।উনি নিজে দেখতেন না স্বরলিপি।তবুও ধমক খেতে হত স্বরলিপি হাতে ছাত্রীদের- “ওই অক্ষরে শুদ্ধ ধা আছে,পা ধা নয়,আর কোন মাত্রায় আছে? মাত্রা মেপে মেপে গাইবে,স্বরলিপি হাতে নিয়ে ভুল গাওয়া অপরাধ,আর কখনোই আড়ে আড়ে গাইবে না,ওটা কলকাতার গাইয়েদের দোষ”৷
বুঝতে পারছিলুম স্বরলিপি না দেখলেও গানগুলি ওনার মুখস্থ৷ যে কোনোও গান শিখতে চাইলেই উনি সঙ্গে সঙ্গে শেখাতে আরম্ভ করতেন।
আমরা বিস্মিত,আনন্দিত।প্রথম দিন ক্লাসের পর ওনাকে প্রণাম করলুম।আমার জীবনে এই একজন একমাত্র মানুষ যিনি প্রতিনিয়ত কবির স্নেহ পেয়েছেন,পাদস্পর্শ পেয়েছেন।তাঁকে প্রণাম করে ধন্য হলাম আমরা।
আমাদের বললেন গুরুদেবের গান ভালো লাগে? ভালোবাসো তো? তাহলেই হবে।
আশ্চর্য,কোথায় শিখেছ,ডিপ্লোমা করেছ কি না,এ সব প্রশ্ন শুনতেই হল না।শান্তিনিকেতনে না গিয়েও শৈলজারঞ্জনের ছাত্র হয়ে গেলাম;ভাবা যায়!
পরে অনুভব করতে পেরেছি ব্যাপারটা।গান শিখলেই সবাই যে গায়ক হয়ে উঠবে এমন তো নয়।ওনার উদ্দেশ্য ছিল,কবির গানের হাবভাব চালচলন,যাকে বলে গায়কি,তা ধরিয়ে দেওয়া,এই গান নিয়ে স্বয়ং স্রষ্টার ইচ্ছে অনিচ্ছের কথা ছাত্রদের জানানো,ভালো শ্রোতা তৈরি করা।কারণ – শ্রোতারাই তো তাঁর গান শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখবে অথবা মারবে। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন- “তোমাদের গান যেন আমার গানের কাছাকাছি হয়,যেন শুনে আমিও আমার গান বলে চিনতে পারি।এখন এমন হয় যে,আমার গান শুনে নিজের গান কি না বুঝতে পারি না।মনে হয় কথাটা যেন আমার,সুরটা যেন নয়।নিজে রচনা করলুম,পরের মুখে নষ্ট হচ্ছে,এ যেন অসহ্য।মেয়েকে অপাত্রে দিলে যেমন সব কিছু সইতে হয়,এও যেন আমার পক্ষে সেইরকম।” কবির শেষ বয়েসের এই করুণ আবেদন গান শেখাবার সময় সব সময় মাথায় থাকত শৈলজদার; এ যেন তাঁর নিজেরই মনের কথা।
প্রফেশনাল শিক্ষক বলতে আমরা টাকা নিয়ে গান শেখানোর কথা ভাবি।ভাবনাটা ঠিক নয়, কমার্শিয়ালিজম্ আর প্রফেশনালিজম্ এক নয়।শৈলজদাকেই এই সঠিক অর্থে প্রফেশনাল শিক্ষক বলা যায়।ছাত্রছাত্রীদের বিশুদ্ধ গান তিনি তুলিয়েই ছাড়বেন,তবেই তাঁর শান্তি৷
তবে এ সব অনেক পরের উপলব্ধি। পরের কথা পরে। আপাতত গানের ক্লাসেই যাওয়া যাক।
শৈলজারঞ্জন এমন সব গান শেখাতেন তখন ভাবতাম – এগুলো কি রবীন্দ্রসঙ্গীত!’ কদম্বেরই কানন ঘেরি আষাঢ় মেঘের ছায়া খেলে,পিয়ালগুলি নাটের ঠাটে হাওয়ায় হেলে’- পরে গানের স্কুলগুলির সিলেবাসে দেখা যায় এই গান প্রথম বর্ষের অন্তর্ভুক্ত, অর্থাৎ সহজ গান।শৈলজদার শেখানোর পরে জানলুম এই আপাত সহজ গানের ব্যাপ্তি।
পিয়ালগুলি যেন নাটকের চরিত্র,হাওয়ায় দুলছে, যেন অভিনয় করছে।বসে বসেই উনি নাচের ভঙ্গিতে হাত আর শরীর দুলিয়ে অভিনয় করে দেখাতেন – এই নৃত্যভঙ্গিও ওনার গুরুদেবের কাছেই পাওয়া । শেখার পরে যখন আমরা সমবেত গাইতাম ক্লাসের মধ্যেই বয়ে যেতো আনন্দের ধারা । আপাত সহজ সরল গান তাঁর শেখানোর অভিনব পদ্ধতিতে সঙ্গে প্রায়ই তাঁর অভিনয়ে অসাধারণ হয়ে উঠত ।
‘ বুঝি বেলা বয়ে যায় কাননে আয় তোরা আয়, সাধ ছিল যে পরিয়ে দেবো মনের মতন মালা গেঁথে, ( আবার ) সাধ ছিল যে পরিয়ে দেব মনের মতন মালা গেঁথে ‘ এই দ্বিতীয় বারের সাধ, কোমল ধৈবত; ছিল- কোমল গান্ধার; মালা গেঁথে; তারার সা; এমন অবলীলায় বিশুদ্ধ ভাবে লাগাতেন – কথায় সুরে গানের মগ্নতায় ভরে উঠত বুক। ….. ‘ কই সে হল মালা গাঁথা কই সে এলো হায়, যমুনার ঢেউ যাচ্ছে বয়ে, বেলা বয়ে যায় …. ‘ শিখতে শিখতে আনন্দে চোখে জল এসে যেত।
আমি ভাবতাম- ছিয়াশি বছর বয়সেই যদি গানে এমন আবেগ তুলতে পারেন, তাহলে এনার গায়ক হয়ে উঠতেই বা বাধা কী ছিল? বাধা কিছুই নয়, ওনার জীবনলক্ষ্যই ছিল বিশুদ্ধ গায়কীতে ছাত্রছাত্রী তৈরি করে যাওয়া, রবীন্দ্রগানের গানের পরম্পরা গড়ে তোলা। সেই কাজেই নিজেকে সমর্পণ করেছেন আজীবন। বলেছেন- আমার সব আলো ধার করা, অনন্যসাধারণ একজনের আলোর সামান্যতম প্রতিফলন মাত্র।কতোখানি আলোকপ্রাপ্ত হলে কেউ একজন বলতে পারেন যে তাঁর নিজস্ব কোনো আলো নেই! রবীন্দ্রসঙ্গীত জগতের শ্রেষ্ঠ মানুষ তিনিই।
প্রতিভা দাসঃ ব্যক্তি শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে আপনি কেমনভাবে পেয়েছিলেন?
সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়ঃ একটা ঘটনা ঘটল,যা আমাকে শৈলজদার আরো অনেক কাছে পৌঁছে দিয়েছিল।
সল্টলেক থেকে শৈলজদাকে ক্লাসে আনতে গাড়ি পাঠানো হত, ওই বাড়িরই গাড়ি। ক্লাস শেষ হলে একজন সিনিয়র ছাত্র তার নিজের গাড়িতে শৈলজদাকে পৌঁছে দিতেন। যিনি নিয়ে যেতেন তার বাড়িও ছিল সল্টলেকে।
একদিন ফিরে যাওয়ার গাড়ি পাওয়া যায় নি, কোনো কারণে।মঞ্জুদি ( মঞ্জুলিকা দাশ), যিনি এই ক্লাসের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন,শৈলজদার ছাত্রী, সঙ্গীত রসিক তা বলাই বাহুল্য; ক্লাসের পরে সবাইকে বললেন আজ তো ফিরে যাবার গাড়ি নেই, আমি গাড়ির ব্যবস্থা করছি, ওনার সঙ্গে তোমরা কি কেউ যেতে পারবে? আমি তখন বেশ নতুন,কিন্তু সবাই ইতস্তত করছে দেখে বল্লুম- আমি যাবো।মঞ্জুদি বললেন – তাহলে তো ভালোই হয়,সঙ্গে কেউ একজন থাকা দরকার।
গাড়িতে ওঠার সময় একটু দ্বিধা করেই ওনার সঙ্গে পেছনের সিটেই ওনার পাশে বসলুম।গাড়ি চলেছে। উনি চুপ করে বসে আছেন।
কিছু কথা তো বলতে হয়,সারা রাস্তা চুপ করে থাকাটা কেমন ভালো দেখায় না ।
বল্লুম – শৈলজদা, আপনার এক ছাত্রের গান শুনলুম,সার্থক জনম আমার- বেশ লাগল। উনি বললেন ভালো লেগেছে? জানি নে তোর ধন রতন -ওই জায়গাটা কেমন গেয়েছেন তোমার মনে আছে? হ্যাঁ,মনে আছে। আচ্ছা, করতো! আমি সাহস করে গলা খেলিয়ে গমক লাগিয়ে,তান টান লাগিয়ে গাইলুম,যেমন গাওয়া হয়।উনি শুনে- অঃ করে একটা শব্দ করেই আবার চুপ। কিছুই বুঝতে পারলুম না,ভুল গেয়েছি তাই কি উনি কি রাগ করলেন! ভাবছি কী দরকার ছিল গান করার !
তারপর হঠাৎ- এরকম করে গাওতো! বলে,জানি নে তোর ধন রতন গেয়ে উঠলেন, খুব সিম্পল, বাউলের মতন, বেশ দ্রুত- দা দা দা ণা ণা র্সা র্ঋা ণা র্সা।মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন। এক ঝলকে যেন রবীন্দ্রনাথের গান গায়কী আবার আবিষ্কার করলুম,এই তো,এইই তো রবীন্দ্রনাথ ! এইই তো তাঁর ভালোবাসার স্বদেশ,তাঁর মা। অতো ঢং করে ইনিয়ে বিনিয়ে গাওয়ার দরকার কী। জীবন যে সার্থক হয়েছে, মা যে তাঁর নিজেরই, এই তো তার ভালোবাসার রূপ ! সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, পরিচিত জনপ্রিয় যে গানটি আমরা শুনি সেই গানের লয় তো জীবন-সার্থকতার কথা বলে না,থালা হাতে নিয়ে যেন ভিক্ষে করতে বেরিয়েছেন কেউ,গলায় করুণ সুর ,এরকম মনে হয়।কিন্তু এ তো ভিক্ষে চাওয়ার গান নয় !
কয়েকবার ওনার মতন করবার চেষ্টা করলুম।উনি বললেন- কঠিন নয় আবার সহজও নয়, গুরুদেবের গানের এই এক রহস্য।রেওয়াজ কোরো ।
ওনার বাড়ি এসে গেল। ঘরে পৌঁছে দিলুম,আমার মনের অবস্থার কথা ভেবেই যেন বললেন- একটু বসে যাও।বসলুম – কিন্তু মাথায় ঘুরছে ওই সুরটা – জানি নে তোর ধন রতন।বল্লুম- শৈলজদা এই সুরটা …
বললেন – বিবিদির স্বরলিপির সঙ্গে অনেকটাই মেলে। গুরুদেবের সঙ্গে শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলুম,এক অবস্থাপন্ন লোকের বাড়ির লনে বসে চা পর্ব চলছিল। অন্যেরা উঠে গেলে গুরুদেব আমায় বললেন – এখানকার মাটি লক্ষ করেছ? কীরকম শুকনো শুকনো তাই না। কোনও তুলনাই হয় না আমাদের বাংলাদেশের মাটির সঙ্গে, বলে উনি গেয়ে উঠেছিলেন এই গান,এই ভাবে, আমি ধরে রেখেছি।
এরপর থেকে আমার শুরু হল ওনার বাড়ি যাওয়া,মঙ্গল- বেষ্পতিবার ক্লাস,দুদিন,এমন কোথাও হয় না। আমি রবিবার করেও যেতে আরম্ভ করলুম; অর্থাৎ সপ্তাহে তিন দিন করে ক্লাস পেয়ে গেলুম।
ওনার কাছে দেরি করে যাওয়ার অনেকটাই পুষিয়ে নেওয়া গেছে এর ফলে । অন্য জায়গার মতো একদিন করে ক্লাস হলে চার বছরের মতো শেখার অভিজ্ঞতা লাভ হত , সপ্তাহে তিন দিন করে ক্লাস করতে পেরে প্রায় দশ বারো বছরের অভিজ্ঞতা লাভ করলুম । ক্লাসের বাইরেও অনেক প্রশ্ন । উনি পরম স্নেহভরে আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন ; বহুল প্রচলিত ভুলভাল জানা গান ঠিক করে দিতেন ।
একদিন আমি যেতেই বললেন – তাই তোমার আনন্দ আমার পর , গানের প্রথম লাইনটা করো তো । করলুম । উনি বললেন — আনন্দ ( ন্দ — দন্তের নয় দয় ) থেকে আমার পর অব্দি পুরোটাই শুদ্ধ রে তে রাখো , গেয়ে দেখিয়েও দিলেন । আমি করলুম , একবারেই পেরে গেলুম । বললেন — তুমি তো দেখছি ঠিক করে নিতে পারলে , কিন্তু একটি মেয়ে এসেছিল একটু আগে , ক্যাসেট বার করতে চায় । অথচ সারা দুপুর চেষ্টা করেও এই ভাবে রে লাগাতে পারল না । বার বার গান্ধার থেকেই রে তে গড়িয়ে আসছে । অথচ ক্যাসেট করবে ।
বাড়ি এসে স্বরলিপি খুলে দেখি , উনি যেভাবে বললেন ঠিক সেইরকমই আছে । একটি পরিচিত গান তবুও নতুন হয়ে উঠল । সেই থেকে গানটি আমার প্রিয় । এখনও কাউকে এইভাবে গাইতে শুনি না ।
এই গানটি পূজার গানে একটি বিপ্লব বলা যায় । সৃষ্টি না থাকলে স্রষ্টা অর্থহীন । আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে । এই ভাবটা উপনিষদে নেই , কবির নিজস্ব । এই ধারণাটি নিয়ে আইনষ্টাইনের সঙ্গে ওনার বিরোধ বেঁধেছিল । বিজ্ঞানীর বক্তব্য ছিল — স্রষ্টা সৃষ্টি নিরপেক্ষ । কিন্তু মানুষ না থাকলে স্রষ্টা আছে কি নেই , এ প্রশ্নই অবান্তর । বর্তমান বিজ্ঞান রবীন্দ্রনাথকে সমর্থন করে । কবিতায় বলেছেন – আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ , চুনী উঠল রাঙা হয়ে….
একদিন একটি প্রশ্ন নিয়ে গেলুম তাঁর বাড়ি । শৈলজদা , আনন্দধারা বহিছে ভুবনে গানটি কণিকা শিখেছেন কবির কাছে , তাই তো ?
উনি গম্ভীর হয়ে গেলেন । তারপর বললেন – তুমি কী করে জানলে ? মোহর কি একথা বলেছে ? বা , কোথাও কি এরকম কেউ লিখেছে ? তুমি পড়েছ ?
না , পড়িনি ।
তাহলে তুমি বললে কেন ?
সবাই এরকম বলে তাই জানতে চাইছি ।
ওঃ , সবাই বলে …. শোনা কথা …
তারপর চুপ । কষ্ট পেলেন বুঝতে পারলুম ।
একটু পরে বললেন — রমেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে সুরটা শিখেছে । আমি শেখাই নি ।
আমি বল্লুম — ৪৫ নম্বরে একটা স্বরলিপি আছে , ইন্দিরা দেবীর , সেটা অন্যরকম ।
উনি বললেন — আসল স্বরলিপি বীণাবাদিণী পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল , ১৮৮৭ সালে , করেছিলেন কবির জ্যোতিদাদা । ওটাই ফলো করা উচিত । আমার কাছে সেটা আছে ।
কী কাণ্ড ! স্বরলিপি নিয়েও এতো গোলমাল ! শান্তিনিকেতনেও ?
বল্লুম — জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্বরলিপিটা শেখাবেন শৈলজদা?
ঠিক আছে শেখাবো , ক্লাসে , সবার শেখা উচিত । এটিই এই গানের একমাত্র স্বরলিপি যা রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালে ছাপা হয়েছিল , অর্থাৎ কবির সম্মতি ছিল । এ ছাড়া অন্য স্বরলিপি আমি গ্রহণ করি না , শেখাইও না ।
পরের ক্লাসে উনি সবাইকে একটা করে ফটোকপি দিলেন জ্যোতিদাদার স্বরলিপির।শিখতে গিয়ে সবাই নাজেহাল ।
কোথায় মালকোশ? শুদ্ধ গান্ধার দিয়ে শুরু, তারপর কোমল রে, তীব্র মধ্যম, এমন কি পঞ্চমও ? এসব তো ওই রাগের বর্জিত স্বর ! সম্পূর্ণ অন্য গান,কিন্তু মালকোশের নির্যাস রয়েছে ঠিকই । শিখিয়ে না দিলে কি শেখা যায়? শিখিয়েছিলেন উনি,উনিই পারতেন ।
তারপর ২০০৩ এ,৬৪ নম্বর স্বরলিপি বেরল।তখন শৈলজদা নেই।দেখি এই স্বরলিপিটা রয়েছে, জ্যোতিদাদারটা।সম্ভবত শৈলজদাই পাঠিয়েছিলেন স্বরলিপি বিভাগে।কিন্তু অবাক কাণ্ড, সঙ্গে প্রচলিত গানের স্বরলিপিটিও প্রস্তুত করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেভাবে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় গেয়েছিলেন এবং সেটিই এই গানের স্বরলিপির প্রথমে রাখা হয়েছে।স্বরলিপি একজন জনপ্রিয় যন্ত্র শিল্পীর নাম দিয়ে।সেখানে লেখাও রয়েছে গানটি রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দেশিত সুর। রবীন্দ্রনাথের করা নয় এমন সুর এই প্রথম স্থান পেল স্বরবিতানে। জনপ্রিয় গান বলেই স্বরলিপি বিভাগ এই স্বরলিপি ছাপলেন,কেউ আপত্তি করলেন না।কিন্তু স্বরবিতানে কোন সুর আশ্রয় পাবে? খুব সহজ – যে সুর রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। অথচ ঘোরতর এই অন্যায়টি করলেন খোদ স্বরলিপি বিভাগ ।
এই অন্যায়ের ফলে এবার দাবী উঠবে দিনের শেষে ঘুমের দেশে নামক কবিতাটি থেকে অন্যের দেওয়া সুরটিও স্বরলিপিতে স্থান দেওয়ার। বোঝাই যাচ্ছে কিছুদিন পরে সেটিও ছাপা হবে- কিন্তু স্রষ্টার নিজের দেওয়া সুর ছাড়া অন্য কোনও সুর স্বরবিতানে স্থান পাবার কথা নয় । শৈলজদার জীবিতকালে এ কাজ করার সাহস হয়নি বিশ্বভারতীর। রবীন্দ্রনাথের গান এখন অভিভাবকহীন,অনাথ।এই অন্যায় রবীন্দ্রসঙ্গীতে অনধিকারীদের উৎসাহ যোগাবে ।
একেই বলে সরষের মধ্যেই ভূত ।
এখানে একটা কথা বলে রাখি। দিনের শেষে ঘুমের দেশে গানটি এবং সুরটি কবি অনুমোদন করেন নি, কবিতাটিকে স্থানও দেননি গীতবিতানে। কিছু লেখক-সাংবাদিক বিষয়টি গুলিয়ে দিয়েছেন।খবরের কাগজে বিভিন্ন সময়ে বারবার লেখা হয় গানটি অনুমোদন করেছিলেন কবি। অথচ গানটির সুরকার স্বয়ং শ্রী পঙ্কজ মল্লিক মহাশয় কিন্তু বলেন নি এ কথা। ঠিক কী ঘটেছিল তা যথেষ্ট সততার সঙ্গেই তিনি লিখে গিয়েছেন তাঁর ‘ আমার যুগ আমার গান’ বইটিতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা।শ্রোতারা কোনও বিষয়েই সাধারণত মূল বই পড়েন না, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত-চিন্তাও পড়েন না। শোনা কথা আর গালগল্পেই তাদের উৎসাহ।
আর একটা কথা বলা দরকার। ৬৪ নম্বর স্বরবিতানে এই গান নিয়ে একটি ‘সম্পাদকের টিপ্পনী’ আছে। কিন্তু কে যে সেই মহাপণ্ডিত সম্পাদক তার উল্লেখ কোথাও নেই স্বরবিতানে।
এ সব অবশ্য অনেক পরের কথা, স্মৃতিকথায় সবসময়েই এরকম আগে পরে হয়েই যায়। কিন্তু বলার কথাটা হচ্ছে – এই যে আমি সরাসরি শান্তিনিকেতনের কর্তৃপক্ষকে দায়ী করতে পারলুম, এটা আমার পক্ষে সম্ভব হত না,যদি না আমি শৈলজারঞ্জনের সান্নিধ্য লাভ করতুম।উনি চাইতেন তার ছাত্রছাত্রীদের রবীন্দ্রগানের ঘরের লোক করে নিতে,যাতে তারা পরবর্তী কালে সবরকম অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে।
সপ্তাহে দুটো দিন ক্লাসের পরেও রবিবার ওনার কাছে যাওয়াটা প্রায় নিয়মিত হয়ে গেল।
একদিন আমায় বললেন- তুমি এসরাজ শেখো কেমন! আমার এই এসরাজটা নিয়ে যাও। কিন্তু শিখবো কোথায়? উনি ঠিক করে দিলেন মাস্টারমশাই, শ্রী বিভুপ্রসন্ন সিনহা।আমাদের ক্লাসে বাজাতেন।শান্তিনিকেতনের লোক,বিখ্যাত অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাত্র, শ্রী নন্দলাল বসুর কাছে শিল্পকলা চর্চা করেছেন।আমার বাড়িতে এসে শেখাবেন।আমি প্রথম দিকে খুব দ্রুত উন্নতি করছিলুম এসরাজে । কিছুদিনের মধ্যেই উনি আমাদের পারিবারিক বন্ধু হয়ে গেলেন – আমার ছোট ছেলেমেয়েদের এসরাজদাদু । সোলার কাজের যিশু, দুর্গা নিজের হাতে বানিয়ে উপহার দিতেন আমার ছেলেমেয়েদের। নিজে হাতে বন্দিশ আর তানের স্বরলিপি লিখে দিতেন খাতায়, বিষ্ণুপুর ঘরের দন্ডমাত্রিক পদ্ধতিতে৷ যেমন পরিচ্ছন্ন তাঁর ব্যবহার তেমনি পরিচ্ছন্ন তাঁর হস্তাক্ষর। সেই খাতাটি যত্ন করে রেখে দিয়েছি।
শৈলজদা ওনার কাছে খবর নিতেন কেমন শিখছে ছাত্র। একদিন আমায় বললেন- শোনো, তুমি সুরঙ্গমা থেকে ডিপ্লোমাটা করে নাও, আমি ওদের বলে রেখেছি।বোধহয় চাইতেন আমি ওখানে শিক্ষকতা করি।পরীক্ষায় ভালোই ফল করেছিলুম, কিন্তু যে বছর রেজাল্ট বেরোল সেই বিরানব্বই সালেই উনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
যাই হোক, ক্লাস চলছে।পরিচিত গানের অসাধারণ সব সুর শিখছি । আঁধারে একেলা ঘরে মন মানেনা। দিনুঠাকুরের পুরনো স্বরলিপি শেখালেন, অপূর্ব অবিস্মরণীয়।
একবার আমরা আবদার করলুম- শৈলজদা, কৃষ্ণকলি শিখবো। বললেন বেশ তো, করো না, জানোতো সবাই। আমরা গান ধরলুম যেমন শুনেছি। উনি আমাদের থামিয়ে দিয়ে বললেন – এটা না, দিন্দার স্বরলিপিটা করো। ১৩ নম্বরে আছে। তারপর শেখালেন । শেখা কি সহজ ! কানের কাছে ভোঁ হয়ে আছে বহুশ্রুত জনপ্রিয় সুর৷ বেশ কয়েকদিন লেগেছিল গান তুলতে। মুক্তবেণী পিঠের পরে লোটে, বারবার গেয়ে দেখাচ্ছেন আর বলছেন- দেখো,কেমন কীর্তন। অপূর্ব লাগছিল।বেশ অনুভব করলাম যে একটা সম্পূর্ণ নতুন গান শিখলাম।
প্রতিদিন আমি হে জীবন স্বামী, দাঁড়াবো তোমারই সমুখে। কবির জীবিতকালের এই স্বরলিপিটিও এখন পরিশিষ্টে স্থান পেয়েছে। শেখাবার পর বললেন- আমি এই সুরটিই শেখাই, লোকে বলে ভুল শেখাচ্ছি। কথায় আছে না- দশচক্রে ভগবান ভূত ! এও সেই রকম ।
আমি বারবার ভাবতুম, এমন চমৎকার সব স্বরিলিপি, এগুলিকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে কেন ? কে দায়ী ? রাগ হত খুব। আবার নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতুম ওনার কাছে আসতে পেরে, স্বরলিপির ইতিহাস জানার সুযোগ পেয়ে।
সপ্তাহে সেই একটা অতিরিক্ত দিন আমায় অনেক কিছু দিয়েছে। একদিন কথা বলতে বলতে বললেন – গীতবিতানে গানগুলি কী ভাবে সাজানো রয়েছে লক্ষ করেছ ! গান বলতে আগে আমরা বুঝতাম এটা ধ্রুপদ কি না, এটা টপ্পা কি না, খেয়াল কি না, ঠুমরী কি না – গানের এই রকম সব বিভাগ। রবীন্দ্রনাথ গান ভাগ করলেন কী ভাবে? পূজা, প্রেম,প্রকৃতি,স্বদেশ। এটা রবীন্দ্রনাথ করলেন। ভেবে দেখো গান সম্পর্কে তাঁর ভাবনা চিন্তা কতটা মৌলিক, তোমাদের এখনকার ভাষায় যাকে বলো- বৈপ্লবিক,তাই না !
রবীন্দ্রনাথকে আর একরকম করে জানলুম সেদিন, আমার রবীন্দ্রসঙ্গীত চিন্তা সমৃদ্ধ হল, নিজেকে মনে হল জ্ঞানী।ওনাকে প্রণাম করে বল্লুম- শৈলজদা, সত্যিই এরকম করে আমি কোনোদিন ভাবিনি।
গান শেখানো আর গান নিয়ে আলোচনাই ছিল তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস৷ সেই সূত্রে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভাবনা ধরিয়ে দিলেন; স্বয়ং স্রষ্টার আশা-আশঙ্কা চাওয়া-না-পাওয়া নিয়ে ভাবনা। হাতে ধরিয়ে দিলেন এই সঙ্গীতের ধর্মগ্রন্থ “সঙ্গীতচিন্তা”। অবাক বিস্ময়ে আমরা দেখলাম – সঙ্গীত নিয়ে এমন কোনও প্রশ্ন নেই যার উত্তর এই ধমগ্রন্থে নেই। অথচ দুঃখের কথা- সেই সব প্রশ্ন ঘুরে ফিরে উঠে আসে এখনও । শিল্পীর কি স্বাধীনতা নেই? আমি কি গানটি এই ভাবে শুরু করতে পারিনা? আমি কি একটু তানালাপ করতে পারিনা? এসব প্রশ্ন দিলীপকুমার রায় করেছিলেন কবিকে, উত্তরও পেয়েছিলেন,শেষ জীবনে নিজের ভুলের স্বীকৃতিও জানিয়ে গেছেন।তা সত্ত্বেও সাধারণ গায়কের তথাকথিত”স্বাধীন চিন্তার” বিরাম নেই।
শৈলজদার মুখেই প্রথম শুনেছিলুম- কলকাতায় শুদ্ধ ধা নাই,রে নাই।স্বরের মাত্রাভেদ নাই।
এখন আমরা সবাই জানি সেই গল্প – শান্তিনিকেতনে কবির জীবনের শেষ বর্ষামঙ্গলের জন্যে ১৬ টি নতুন গান শৈলজদা আদায় করে নিয়েছিলেন কায়দা করে। তাঁর লেখার টেবিলে রাগ রাগিণীর নাম লিখে বই চাপা দিয়ে রেখে আসতেন।বেহাগ ইমন তান দেওয়া গান বাগেশ্রী… কপট রাগ দেখাতেন কবি আর নতুন একটি করে গানের জন্ম হত। সেসব গান সবই শিখিয়েছিলেন ক্লাসে,কিছু শিখেছি সুবিনয়দার কাছে।
‘বাউল’,’কীর্তন’ কথা দুটি লিখে রেখে আসার সূত্রে পাওয়া গেল” পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে” গানটি।এসব গান শেখার স্মৃতি ভোলার নয় ।
মনে আছে সুরটা একটু ধাতস্থ হবার পর উনি লয় বাড়ালেন ।
ধীরে ধীরে ডান হাতের ছড় চঞ্চল হয়ে উঠছে,এসরাজের তারে আঙুল ওঠানামা করছে দ্রুতবেগে।
কখনও শুধু ছড় দিয়েই সুরের ওঠানামা দেখিয়ে দিচ্ছেন।আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখছি সেই দৃশ্য ।
যা না চাইবার তাই আজি চাই গো…. যা না পাইবার তাই কোথা পাই গো
কী সুর! কী অসাধারণ মীড়! ওপরের মধ্যম লাগাচ্ছেন অবলীলায়,ওই বয়সে,স্রেফ আবেগে, ভালবাসায়।আমরাও সব জড়তা কাটিয়ে উঠে গলা ছেড়ে গাইছি।
মাঝে মাঝে উনি ‘এইই’ বলে হাঁক পাড়ছেন, মাঝে মাঝে পাগলা হাওয়া বলার আগে ।
“এ ই ই পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে …… এ ই ই পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে… ”
প্রশস্ত ক্লাসঘরে যেন উদ্দাম পাগল হাওয়া বইছে।
যা পাওয়া যায় না এমন উদাত্ত আহ্বানে তাকে চাইবার এতো সুখ জানা ছিল না।
এ আনন্দের স্বাদ আগে পাইনি।
আমরা সবাই তখন বলরামের চ্যালা হয়ে গেছি,সুরে মাতাল…..
পরে বলেছিলেন – এ গান কলকাতার লোক গাইবে আমি বিশ্বাস করি না।
সত্যিই,এ গানের কতরকম বিকৃতি হয়েছে কলকাতায়,আমরা দেখেছি৷
তবে আমরাও শহরের লোক; উনি যত্ন করে শিখিয়েছিলেন আমাদের ।
একজন শহরের ছেলেকে রবীন্দ্রগানের প্রাকৃতিক পরিবেশে নিয়ে যেতে পারতেন তিনি। গীতবিতানের সব গানই যে অপূর্ব সুন্দর,এই বোধ তাঁর ক্লাসে হাজির থাকার এক অসামান্য প্রাপ্তি।
গান পরিবেশন একটি শিল্প আমরা জানি।গান শেখানোও যে একটি শিল্প হতে পারে, শৈলজদার কাছে না গেলে জানা হত না ।
এরকম আর একটি গান শেখার স্মৃতি আমি শেয়ার করবো ।
গানের ক্লাসে একবার খুব হতাশ হয়ে শৈলজদা বলেছিলেন , বিশেষ করে মেয়েদের উদ্দেশ্য করে – প্রেম কথাটা তোমরা ঠিক করে উচ্চারণই করতে পারছ না ।
গানটি ছিল- এই যে তোমার প্রেম ওগো হৃদয়হরণ । শব্দটিতে কীর্তনের প্রেমের দ্বিধাহীন পরিশীলিত আবেগ আনতে পারছিলুম না আমরা । বুঝতে পারিনি , এ আমাদের সাধারণ প্রেম নয়- এ প্রেম রবীন্দ্রনাথের , যা আসলে চরাচর পরিব্যাপ্ত এক প্রেম চেতনা । এই যে পাতায় আলো নাচে সোনার বরন / এই যে মধুর আলসভরে মেঘ ভেসে যায় আকাশ’পরে / এই যে বাতাস দেহে করে অমৃতক্ষরণ — দিগন্ত ছোঁয়া এই তাঁর প্রেম । গানটি অবশ্য প্রেম নয় , পূজা পর্যায়ের ৷ আমরা জানি , পূজা আর প্রেম এই দুটি বিন্দুকে খুব কাছাকাছি এনে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ , আকাশ আর মাটি যেমন প্রকৃতির দিগন্তে মিশে যায় ।
বলছি আগেই যে , রোব্বারের ওই একটা অতিরক্ত ক্লাস আমায় অনেক কিছু দিয়েছে ।
একদিন হঠাৎ আমার গান শুনতে চাইলেন — শোনাও তো একটা গান ।
আমার একটা প্রিয় গান , আমার মনে হত সুবিনয়দার গাওয়া এই গানটিই যেন শ্রেষ্ঠ , খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি , কতো রাত তাই তো জেগেছি …. খুব মন দিয়ে গাইলুম ।
উনি চুপ । আমি ভাবছি প্রশংসা করবেন ।
হঠাৎ বলে উঠলেন — তুমি গান গাইছ কেন ?
বুঝুন , কী বলি ! বল্লুম — ভালোবাসি তাই গাই , আর কিছু নয় ।
সে তো বুঝলুম , কিন্তু তোমার গান লোকে শুনবে কেন ?
বুঝতে পারছেন তো , আমার নাজেহাল অবস্থা চলছে , বুঝতেই পারছিনা কী বলতে চান । তারপর বললেন — লোকে সুবিনয়ের ক্যাসেট কিনে বাড়িতে বসে শুনবে , তুমি গাইছ কেন ?
ঠিক বলেছিলেন । তখন আমি হাঁ করলেই সুবিনয়দা । আমার গানের নিজস্বতার কথা ভাবিই নি আগে । এ ব্যাপারে আমাকে সচেতন করেছিলেন তিনিই ।
এরপরেও বললেন — এই যে তুমি গাইলে – খেলাঘর , কী ভাবে গাইলে ! রে রধা পা -। , গাইলে তো ! ওটা হবে – রে ধা পা -। । খেলাঘর – সোজা রে থেকে ধা । করো তো !
দু’তিনবার চেষ্টা করলুম ওনার সামনে , পারলুম না । বাড়ি এসে স্বরলিপি দেখলুম — আবারও উনিই ঠিক ।
প্রতিভা দাসঃ শেখানোর ব্যাপারে খুব আন্তরিক ছিলেন, তাই তো!
সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়ঃ একবার শৈলজদার রাগ দেখেছিলাম। কোনো একটি গান শেখার পর ক্লাসের একটি মেয়ে হঠাৎ বলে উঠেছিল- এই গানটা মোহরদি তো এরকম করে গান নি! সেদিন দেখলুম তাঁর অগ্নিশর্মা মূর্তি – এখানে এসেছ কেন? মোহরের কাছে শেখো গে যাও,বেরিয়ে যাও ক্লাস থেকে।
ক্লাস নিস্তব্ধ। অতজন ছাত্রছাত্রীদের সামনে এ ভাবে বকুনি খেয়ে মেয়েটি সারাক্ষণ বসে বসে কেঁদেছিল। আমরা ভেবেছিলুম ও বোধহয় আর ক্লাসে আসবে না। কিন্তু এসেছিল, নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিল। শৈলজদাও এ বিষয়ে আর কিছু বলেন নি।
শৈলজদার স্নেহও পেয়েছি অনেক। আমার পুত্র তখন সবে স্কুলে,মেয়ে আরও ছোট।ওদের জন্মদিনে অন্য কোথাও না নিয়ে গিয়ে আমি শৈলজদার কাছে নিয়ে যেতুম,সপরিবারেই যেতুম। খুশি হতেন উনি।ওদের গান শুনেছিলেন।ছেলে গেয়েছিল- এই আকাশে আমার মুক্তি। উনি আদর করে বললেন- ওরে বাবা! এই বয়সেই জীবন আহুতি দেবে !
বললেন কে শিখিয়েছে গান? তোমার নামটি তো খুব সুন্দর(পুত্রের নাম অন্বয়)।মেয়ে গেয়েছিল- ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে- বাঃ,তোমার গান শুনে আমার ছোট্ট মোহরের কথা মনে পড়ছে৷ তোমার নামটিও তো ভারি চমৎকার! শ্রুতি! খুব গভীর এর মানে,বড়ো হয়ে বুঝবে।
এক রবিবার বিকেলে গেছি।উনি যেন একটু অবাক হয়ে বললেন- তুমি আজ এলে যে!আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম।
বল্লুম- আমি তো রবিবার করেই আসি শৈলজদা!
উনি বললেন – কিন্তু রবিবার তো কেউ কারুর বাড়ি যায় না।নিজের বাড়িতেই থাকে।
বুঝুন আমার অপ্রস্তুত অবস্থা৷ কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।ফিরে যাবো! উনি কি আমার ওপর কোনো কারণে অসন্তুষ্ট! এই সব ভাবছি।
তারপর উনিই আমাকে উদ্ধার করলেন।দেখছো না রাস্তাঘাট ফাঁকা… সবাই এই সময় টিভি দেখে, বাইরে বেরয় না।
উফফ! ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন। সত্যিই সেই সময় বাংলা দূরদর্শনে বিকেলবেলায় বাংলা সিনেমা দেখানো হত। টিভিতে তখন বাংলা প্রোগ্রাম বেশি হত না। তাই রবিবারের বিকেলটা কেউ ছাড়তো না।
আমি বল্লুম- ও! ওইসব ন্যাকা ন্যাকা ছবি দেখা মানে সময় নষ্ট। যদি ইংরিজি বা হিন্দি সিনেমা হত, তাও ওই সব সিনেমার মধ্যে…. (আমি আর ঠিক কথাটা খুঁজে পাচ্ছি না, বলতে চাইছি – একটা বোল্ডনেস বা ওই ধরনের কিছু থাকে)।
উনি বোধহয় ভাবলেন আমি ঠিক শব্দটা বলতে লজ্জা পাচ্ছি…
বললেন- হ্যাঁ,সেক্স …..
আমি তো হতবাক ….
প্রতিভা দাসঃ এতদিন ধরে ওইরকম একজন ব্যক্তিত্বের কাছে গান শিখেছেন, কোনও বিশেষ অনুভব,অভিজ্ঞতা হয় নি?
সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়ঃ আসলে উনি আমাকে মনে মনে বন্ধু করে নিয়েছিলেন, এখন ভাবতে ভালো লাগে। রবীন্দ্রনাথও, যাদের স্নেহ করতেন তাদের সঙ্গে প্রায়ই ঠাট্টা করতেন, ঠাট্টাকে তিনি বলতেন’রগড়’;
ওনার”যাত্রাপথের আনন্দগান” যারা পড়েছেন তারা জানেন।ওগো সাঁওতালি ছেলে গান নিয়ে রগড়,এপ্রিল ফুল নিয়ে রগড়,সব লিখে রেখে গেছেন উনি।
এবার ঢালা গানের প্রসঙ্গে আসি।রবীন্দ্রনাথের ঢালা গান বাংলা গানে এক পরম সম্পদ।এ সব গানের স্বরলিপিতে নির্দেশ আছে- বিশেষজ্ঞের কাছে শিক্ষনীয়।আমরা পেয়েছিলুম সঙ্গীতভবনের অধ্যক্ষকে।
এসো শরতের অমল মহিমা।এই গানটি শৈলজদার কাছে পেয়েছিলুম কিন্তু গানের ক্লাসে নয়। সে গল্প রবীন্দ্রগানের ঘরের লোকের কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ , কিন্তু লেখা নেই কোথাও। ক’জনই বা মনে রেখেছে !
তখন সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিক।গানের ক্লাস শেষ হয়েছে।দাস বাড়ির ক্লাস হ’ত। বিশাল বাড়ির চওড়া সিঁড়ি দিয়ে নামছি, শৈলজদাসহ আমরা। শেষ ধাপে এসে জানা গেল বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে,এখন বেরনো সম্ভব নয়৷ প্রশস্ত চাতালের একটি শোফায় বসে পড়লেন শৈলজদা।আমি আর কয়েকজন তাঁকে ঘিরে রইলাম। কিন্তু শুধুই কি অপেক্ষা! না, তা নয়,গান,গানের কথা তিনি বলতে শুরু করলেন – “এই যে ঢালা গান,কলকাতায় সব গায়, কেমন যেন লাগে, কেমন ঝিমিয়ে পড়া গান। ঢালা গানের রসটা এখানে পাইনা”। তারপর ওখানে বসেই গাইতে শুরু করলেন এসো শরতের অমল মহিমা। সঙ্গে এসরাজটি অবধি নেই, খালি গলায় সুর দুলতে দুলতে ওপরে উঠছে, বিকশিত হচ্ছে অমল মহিমা। তিনি নিজেও বিমোহিত।এসো হে,ধী-রে …. বরাভয় মুদ্রায় শৈলজদার হাত ওঠানামা করছে; অপূর্ব দৃশ্যই শুধু না, ঢালা গানের স্বরূপ আমার মনের মধ্যে স্থায়ী আসন পেতে নিচ্ছিল,সে এক স্মরণীয় দিন।
নির্দিষ্ট ক্লাসের বাইরেও একটি অমূল্য চিরস্থায়ী গান উপহার দিলেন,একমাত্র শৈলজদার পক্ষেই সম্ভব ছিল তা। সার্থক জনম আমার – গানটির কথা মনে পড়ে গেল।তাই বলি আমি প্রফেশনাল শিক্ষক হিসেবে এনাকে ছাড়া আর কাউকে দেখিনি।
আর একটি গান শেখার স্মৃতি জানাই।যে সব গান রবীন্দ্রনাথ নিজে গেয়েছেন,আমাদের বলতেন, ওইগুলিই প্রকৃত রবীন্দ্রসঙ্গীত।শান্তিকেতনের শিল্পীরাই এই সব গান গেয়েছেন অন্যভাবে।এ নিয়ে খুব দুঃখ করতেন,অথচ এরা সবাই সঙ্গীতভবনের ছাত্রছাত্রী।
রবীন্দ্রসঙ্গীত জগতের শ্রেষ্ঠ মানুষটি খুব একা হয়ে গিয়েছিলেন শেষ জীবনে৷ বলতে ভালোবাসতেন- আমি ছাত্রধনে ধনী,অথচ তাঁর নামকরা ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ ছিল না আর, কবির গান নিয়ে তাঁর আপোসহীন মনোভাবের জন্যেই।
একদিন ওনাকে বলেছিলুম- আপনি চলে গেলে এমন ঢালা গান তো উঠেই যাবে। উনি বলেছিলেন- কেন,আমি কি কিছুই দিয়ে যেতে পারলুম না!
রবীন্দ্রগানে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া মানুষটিকে হয়তো কিছুটা বোঝাতে পারলুম।
ওগো কাঙাল আমারে কাঙাল করেছ আরো কি তোমারো চাই, অন্ধজনে দেহ আলো মৃতজনে দেহ প্রাণ,রবীন্দ্রনাথের গাওয়া এসব গান আমাদের শিখিয়েছিলেন। কবির গায়নে শ্রুতির অনায়াস প্রয়োগ লক্ষ করতে বলেছিলেন তিনি।শৈলজদার স্বরলিপিতে শ্রুতির প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায়। এ নিয়ে একজন রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ,রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে তাঁর অনেক বই আছে,ব্যাঙ্গ করেছিলেন আমার কাছে।এমন কি বলেছিলেন এরকম কথা-রবীন্দ্রনাথের গলায় তো সুর লাগতো না,সেই যেখানে যেখানে লাগতো না সেখানে তোমার শৈলজদা রে দুই,ধা দুই করে দিয়েছেন।সেই থেকে তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আর নেই।শ্রুতিস্বর অনুভব করার মতো কান নিয়ে সবাই জন্মান না, শ্রুতি স্বরগুলিকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ” আমাদের স্নায়ুতন্ত্র”। স্নায়ুতন্ত্র বিকল হয়ে পড়লে একটি মানুষ নিজেকেই আর চিনতে পারেন না। কিন্তু শুধু শৈলজারঞ্জন নয়, দিনুঠাকুরের স্বরলিপিতেও আমরা শ্রুতি স্বরের অস্তিত্ব দেখতে পাই,ওই বিশেষজ্ঞের চোখে সেটা পড়ে নি।
সে যাই হোক,অন্ধজনে দেহ আলো- শেখাবার সময় সে এক কাণ্ড।তন্ময় হয়ে শেখাচ্ছেন,যেন পুজোয় বসেছেন।হাতে এসরাজ,তানপুরা মধ্যমে,আমরা মন্ত্রমুগ্ধ।হঠাৎ” আ প্রভু ” সুরের এইখানে এমন একটা মোচড় দিলেন,একটা কাতর প্রার্থনা,প্রায় আর্তনাদের মতো… হঠাৎ একটা কান্না উঠে এলো আমার গলায়,যেন কণ্ঠনালীতে আটকে রইল।আড় চোখে চেয়ে দেখি অশোকের দুচোখ ছাপিয়ে গেছে তখন,অন্যদের অবস্থাও তাই।সবাই মিলে কাঁদতে সেদিন ভালো লেগেছিল আমাদের।
এর পরের পর্ব (৩য়) – প্রসঙ্গ দেবব্রত বিশ্বাস, পীযুষকান্তি ও অনান্য
[রবীন্দ্রগানের পরম্পরায় পড়ুন ১মপর্ব ] https://galpersamay.com/2021/04/14/%e0%a6%b0%e0%a6%ac%e0%a7%80%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%97%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a6%ae%e0%a7%8d%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a7%9f/
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।