15 Jun

স্নানযাত্রা

লিখেছেন:নন্দিতা সিনহা


দুম দুম করে পিঠে গোটা কতক কিল বসিয়ে দিল বিধু । তার সঙ্গে তারস্বরে চিৎকার – বার্লি জোটে না দুধ খেতে এসেছে । বেরো বলছি, বেরো, চোখের সামনে থেকে দুর হয়ে যা । দম আটকে যাওয়া কান্নাটা এবার তীক্ষ্ন স্বরে বেরিয়ে এলো ।  আবার মারবে বলে তেড়ে যেতেই দেড় বছরের বড় দিদি মতি দৌড়ে এসে ছোঁ মেরে ভাইটাকে কোলে নিয়ে দে দৌড় । একেবারে বাইরের রাস্তায় । যেখানে সাঁ সাঁ করে বাস, ট্যাক্সি, অটো ছুটছে । সে সব দেখায় আর ভোলাতে থাকে ভাইকে । দুধ বাজে, দুধ খেতে নেই । দুধ খেলে পেটে পোকা হবে । এই এত্তো বড় বড় পোকা …….

চুলা থেকে ভাতের হাড়িটা নামিয়ে কড়াটা বসালো । বাবুদের বাড়ি থেকে কপির পাতা, আলুর খোসা নিয়ে এসেছে । কয়েকটা পটল জলবসা বলে মাসিমার চোখ এড়িয়ে পলিপ্যাকেটে দিয়ে দিয়েছে বৌদি । ইশারা করে দেখিয়েছে বিধুকে । বিধু সেগুলো কোঁচড়ে ভরে নিয়ে এসেছে ।

আজকাল পেটেরটা বড় জ্বালাতন শুরু করেছে । খলবল খলবল করে পেটের ভেতর । কড়াতে বেশি করে জল দিয়ে আনাজ কটা দিয়ে থালা চাপা দিয়ে চাটাই টা টেনে একটু গড়িয়ে নিল । বড় যত্নে পেটে হাত বোলাতে বোলাতে চোখে জল ভরে এলো । ফটিকটাকে নিয়ে মতি কোনদিক পানে গেল কে জানে….এখনো এলো না তো ।   দাওয়ার একপাশে বসে একমনে কঞ্চি ছুলছিল মতির বাবা । দাওয়াতে এসে বললো – সকাল সকাল ফটকে টাকে মারলি কেন রে বিধু ?

– তোমার ছেলের দুধ খাবার বায়না হয়েছে । সাতদিন হলো জ্বরটা ছাড়ছে না । বার্লি করে দিলুম তা নাকে কাঁদতে শুরু করে দিলো ।   – তোর বুকের দুধই তো দিতে পারতিস একটু । ভরা পোয়াতি, দুধ তো এয়েছে ।                                                                              – না, তাতে তেনার মন উঠবে না । তিনি বোতলের দুধ খাবেন । তার সোয়াদ বেশি ভালো ।                                                           – তা সে সোয়াদ ফটকে পেলো কি করে ?                                                                                                                       – বাবুদের ছেলের বোতলে তো বেশিরভাগ দিনই দুধ থেকে যায় । আয়া মিনতি সে টুকু ঢুক করে খেয়ে নিয়ে বোতল ধুয়ে ফেলে । সেদিন বোতল ধোয়ার আগে খোকাকে চান করাতে গেছিলো । আমি মাসিমার ঠেঙে চেয়ে নিছিলুম দুধ টুকু ।                                                 – কেতাথ্থ করেছিলে ।

পেটেরটা বড় লাফাচ্ছে । কড় গুনে হিসেব কষলো বিধু । শ্রাবণ মাসটা পোয়াবে না বোধ হয় । গতবছর ও এমনদিনে পটাইটা ঘর জুড়ে ছিল । কি দামাল দুরন্তই না হয়েছিলো সেই চার বছর বয়েসেই । সবসময় দ্যাখ, দ্যাখ । তখন তাদের এই কলোনিতে নতুন এনে বসিয়েছে । কে বসিয়েছে কে জানে ? সরকার ? না পোমোটার ? না কনটেকটার কে জানে ! শুধু তার কয়েকদিন আগে দলবল নিয়ে, পুলিশ নিয়ে কারা সব এলো, মিটিং ফিটিং হলো । তারপর বললো – এ বস্তি উচ্ছেদ হবে । ওমা ! সে আবার কেমনধারা কতা । শয়ে শয়ে মানুষ আছে ইখেনে সংসার করছে …….., উচ্ছেদ হবে বললেই হলো ? তা তারা বললে – এখানে নাকি ফেলাইওভার হবে । মস্ত মস্ত সব রাস্তা হবে । ইখেন থেকে পনেরো মিনিটে এয়ারপোট, আধ ঘণ্টায় রাজারহাট । তারা তো হেসে বাঁচে না । রাজা আছে নাকি দেশে একুন যে রাজার আবার হাট বসবে । তা তারা শুনলে না । তবে হ্যাঁ, পাটির কিছু লেতা লড়েছিল বটে । পুনরবাসন দিতে লাগবে বলে সে কি হুজ্জুতি । তাপ্পর মাস ছয়েকের মধ্যে তাদের একানে এনে ফেললে । ঝুপড়ি বানিয়ে দিলে, আগের থেকে মন্দ নয় ।

ছেলেপুলান গুলোর হুজ্জুতি তকুন দেখে কে ? তাপ্পর তাদের বস্তি ভাঙা হলো । ইয়া বড় বড় সব গাড়ি এসে গুইড়ে দিলো । সে যায়নি কো ওসব দেখতে । নন্টে, পাতু ওরা যেত সব । মতির বাবা ও একদিন একদিন গে দেখে আসতো । তাপ্পর একদিন পটাইও গেলো বাবার সাথে । তকুন মাটি খুঁড়ে সব মস্ত মস্ত লোহার খাঁচা বসাইছিল । বাপের হাত ছেড়ে আরো কাছে ঝুঁকে দেখতে গিয়ে ঝপাং করে …..

খপর পেয়ে মুনিব বাড়ি থেকে আছাড়ি পাছাড়ি দৌড়ে এসে দেখে, তাদের কলোনিতে যেন মেলা বইস্যে গেছে । আর পটাই যেন সবার মাঝে ঘুমাইছে । সারা গায়ে মুখে কাদা । তার এতাল বেতাল কান্নার মাঝে মতির বাপ তাকে বলেছিল, কাঁদিস নে বিধু । তোর পটাইরে আমি ফিরাই দেব ।

বিধু খলবলানো পেটে হাত রাখে হেথা হোথা – আমার পটাইয়ের পানা দামালই হবে । তর সইছে না যেন পেটের মধ্যে । ফেলে তোরে পাইলে যেতে কে বলেছিল রে পটাই ? মা গো মা শীতলা, মঙ্গলচণ্ডী বাছারে ভালো রেখো ।  সেদিনই রায় গিন্নি তাকে দেখে ডেকে বলেছে,  – বিধু তুই কি আবার পোয়াতি ?                                                                                                                                     লজ্জায় ঘাড় নেড়েছিল সে ।

রায় গিন্নি খরখর করে বলে ওঠে- সামলাতে পারিস না । একটা জলে ডোবে, একটা জ্বরে ভোগে, বারোমাস এক ফোঁটা দুধ দিতে পারিস না, আর তোদের ঘরেই যেন মা ষষ্ঠীর কৃপার বান ডাকে । আমার দু দুটো বউমা, দুটো কেই বাঁজা হতে হয় ! জলের মতো খরচা চিকিৎসায়, তবু একটাও পোয়াতি হয় না গো !                                                                                                                              বিধু সেদিনই মা ষষ্ঠীর পুজো দিয়ে কালো কার পড়েছে কোমরে ।

দুপুরে তেল ছড়ানো তরকারি আর ভাত চেটে পুটে খেলো সবাই । মতি কোথা থেকে শুনেছে ছানযাতরায় এবারে কলকেতার দল আসবে নাকি যাতরা করতে । খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলো –ছানযাতরা কবে বাবা ?                                                                       – এই তো সামনে হপ্তা ।  ফটিক এক মনে থালা চাটছে । সকালে মা মেরেছে বলেই হয়তো দুপুরে আর বার্লি না দিয়ে চাট্টি ভাত দিয়েছে ফটিককে । সে থালাটা মুখের কাছে এনে জিভটা যতটা বেরোয় বার করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে থালা চাটছে একমনে । হপ্তা শব্দটা নতুন তার কাছে । সে থালাটা নামিয়ে জিজ্ঞাসা করলো- হপ্তা মানে কি রে দিদি ?                                                                                               তার বাবা তাকে বুঝিয়ে দিতে সে দিদিকে বললো – আমাকে ছানযাতরা দেখতে নিয়ে যাবি তো ?                                                       – খবরদার বলছি । দুজনের একা একা যাবে না । লোকে থই থই করবে সেখানে ।                                                                           এরপর তিন-চার দিন ধরে মতি আর ফটিকের শান্তি নেই । কতো আলাপ আলোচনা, একদিন পাড়ার বেচুদার হাতে পায়ে ধরে দু ভাই-বোন টোটোতে উঠে পড়ে । স্নানপিড়ির মাঠে, জগন্নাথ মন্দিরে ঘুরে বেড়ায় । অনেক তথ্য সংগ্রহ করে । কিন্তু যে খবরটা ফটিককে আকুল করে তোলে তা হলো, জগন্নাথদেবকে নাকি দুধ দিয়ে স্নান করানো হয় । বালতি বালতি ঘড়া ঘড়া দুধ ।                              – সেখান থেকে একটু দুধ চাইলে দেবে না দিদি ?

পরম মমতায় ভাইটার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় মতি । তার মা বলেছে সে ছ’ বছরের হলেই ঠিকে কাজে নিয়ে যাবে মা তার    সাথে । তারপর কিছুদিন দেখে শুনে শিখে নিলে আর একটু বড় হলেই, কোনো ফ্যেলাটে কাজে লাগিয়ে দেবে । তখন সে পাগল ভাইটাকে কোটোর দুধ কিনে দেবে ।

স্নানযাত্রার দিন সকাল থেকে আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা । ফটিকের বাবা কঞ্চির ফুলদানি, পুতুল, পাখি, লণ্ঠন যা যা বানিয়েছে তা নিয়ে সকাল সকাল রওনা দিল স্নানপিঁড়ির মাঠের দিকে । সকাল থেকেই লোক ভাঙতে শুরু করে । একটু বেলা হতেই জমে ওঠে মেলা । ফটিকের মা যাবার সময় বলে গেল – মতি ক্ষার কেচেছি । মাঠে শুকুত দেওয়া  আছে । মেঘ কালো হয়ে গেলে নে আসিস । আমি তাড়াতাড়ি কাজ সেরে তোদের মেলাতে নে যাবো ।

ফটিকের সকাল থেকে উত্তেজনার শেষ নেই । সে বাবার সাথে যাবার বায়না ধরেছিল । বাবা একসময় রাজিও হয়ে যায় । কিন্তু বিধু বলে, তুমি কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে । দামাল ছেলে কোন দিকপানে চলে যাবে । তোমার সাথে একবার একজন তো গেছিলো । তুমি পেরেছিলে তাকে বাগাতে ? দরকার নেই । আমি ফিরে নে যাব খন ।

ফটিক সকাল থেকে খালি ঘর আর বার করছে । তাদের কলোনির নন্টে, মিঠা, পাতু সবাই সকাল থেকেই চানপিঁড়ির মাঠে চলে গেছে । কখন যাবে সে ! এগারোটার বড় সাদা হলুদ বাসটাও তো তাদের কলোনি কাঁপিয়ে চলে গেল । একবার দিদিকে বললো- চল না দিদি আমরা মেলাতে যাই ।   দিদি বলেছে, খবরদার না, মা পিটিয়ে শেষ করে দেবে ।  কিন্তু ফটিকের আর তর সয় না । যদি জগন্নাথের চান হয়ে যায় । সে পরশুদিন একটা গোটা বোতল রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছে । তাতে জল ভরে দেখেছে বোতলটা ফুটো নয় । সে ওই বোতলটাতে দুধের পেসাদ ভরে আনবে । চাইলে নাকি দেয় ওরা । কিন্তু যদি চান শেষ হয়ে যায় ? যদি দুধ না পায় আর……  আকাশের ও আজ মেঘের কি দশা । যদি বিস্টি নামে তবে তো সব দুধ জলে ধুয়ে যাবে ।

ফটিক দুবার তিনবার একাই বেড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছে । কিন্তু মতি সবসময় চোখে চোখে রাখে তার ছোটো ভাইটাকে । হঠাৎ খুব জোরে মেঘের ডাকে চমকে উঠলো তারা দু ভাই বোন । ঘরের ভেতর থেকে বাইরের আলো অন্ধকার বোঝা যায় না । দুজনে চটের পরদা তুলে বাইরে এসে দেখে কালো মেঘে ঢেকে গেছে আকাশ । মতি এক ছুট লাগালো মাঠের দিকে । কয়েকটা মাত্র সেকেন্ড । তারপর ফটিকও দৌড় লাগালো উল্টোদিকে চানসিঁড়ির মাঠের পানে ।

দেড়ঘণ্টা ধরে ভিড়ের মধ্যে তুমুল খোঁজাখুঁজির পর ফটিকের বাবাকে কেউ বুদ্ধি দিয়েছিলো, ভলেনটিয়ার পুলিশের কাছে যেতে । তা পুলিশের ঘোষণাও হয়ে গেছে এর মধ্যে বার কুড়ি । কিন্তু কেউ ফটিকের কোনো খবর দিতে পারছে না । পরিচিত যাকেই দেখছে তাকেই ওরা জিগ্যেস করছে, হ্যাঁ গো আমাদের ফটিক কে দেখেছো ? কলোনির ছেলে, জোয়ান, বউ, যে যেখানে ছিল সবাই ঘোষণাটা শুনে জড়ো হয়েছে একসাথে । যে যেদিকে পারছে খুঁজে দেখছে । হঠাৎ মতির মাথায় চট করে একটা ভাবনা এসে গেল । আমি একটু আসছি মা – বলে পা বাড়াতেই বিধু ওর হাতটা চেপে ধরলো, আঁতকে উঠে বললো – তুই আর একলা যাসনি কো । চল আমিও যাই ।    মতির মনে পড়ে সেদিন ফটিক বলেছিল – হ্যাঁরে দিদি, ওই বালতি বালতি ঘড়া ঘড়া দুধ কোথায় যায় ?                                             – লোকে পেসাদ নেয় কিছু, আর বাকিটা ওই পেছন দিকের নালা বেয়ে মন্দিরের পেছন দিক দিয়ে গিয়ে পুকুরে মিশে যায় ।                  মতি মায়ের হাত ধরে টানতে থাকে ভিড় ঠেলে । ভিড় কমতে কমতে জনশূন্য । তারপর ডোবা, আর বড় বড় আম কাঁঠালের, শিরীষের কালো কালো ঘন ছায়া ।                                                                                                                                        – ওদিক পানে কোথা যাস মতি ?   মতির নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে । কোনো কথা বলে না । শুধু মায়ের হাত ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে চলে আসে লোকজনের চোখের আড়ালে । ঘন গাছে ঢাকা জায়গাতে দিনের বেলাতেও আলো ঢোকে কম । তার ওপর আকাশে আজ কালো মেঘ । মন্দিরের পেছনে বাঁধানো নালা শেষ হয়ে মাটির নালা শুরু হয় যেখানে, সেখানে পৌঁছে থমকে দাঁড়ায় মা, মেয়ে ।                       একটা বোতল ভর্তি দুধ পাশে রাখা । মাটিতে শুয়ে পড়ে জিভ দিয়ে দুধ চেটে চলেছে ফটিক বাহ্য জ্ঞান শূন্য হয়ে । মতি চিৎকার করে ডাকতে যায় । হাত চেপে ধরে বিধু ।  ওদের মা মেয়ের নিঃশব্দ চোখের জলে তখন তাদের স্নানযাত্রার পালা ।

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ