15 Jun

ইনবক্স

লিখেছেন:হাসান হামিদ


রাত আড়াইটা নাগাদ মোবাইলের স্ক্রিন জ্বলে উঠলো।

পাশ ফিরে হাতে নেয়ার চেষ্টা করলাম। অচেনা নম্বর থেকে ম্যাসেজ, এতো রাতে। পড়ার জন্য বারান্দায় চলে যাওয়া দরকার। পাশেই মুন্নী ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে। এয়ারকন্ডিশন চলছে ঘরটায়। তবু ঘেমে নেয়ে আছে মুন্নী। ও ভীষণ ক্লান্ত। মুন্নী আমার স্ত্রী। আমাদের বিবাহিত জীবনের প্রায় ছ’বছর আমরা পার করে ফেলেছি। ওর সাথে আমার সম্পর্ক এখনকার অন্য দশটা দম্পতির তুলনায় ভালো। আমাদের কোনো সন্তান নেই। এই একটি বিষয় ছাড়া মুন্নীর কোন অতৃপ্তি বোধ হয় নেই এই সংসারে।

আমরা এখন যে বাসাটায় আছি, বেশ পুরোনো ধাচের। এসেছি আজ এগারো দিন। এর আগের বাসাটায় বিয়ের পর থেকে প্রায় অর্ধ যুগ কাটিয়েছি। স্বাভাবিক ভাবেই বাসাটা ছাড়তে মন চায়নি। কিন্তু বাসাটা নতুন করে ডেভেলপার কোম্পানিকে দিয়ে দিয়েছেন মালিক। অগত্যা আমাদের নতুন বাসা খুঁজতে হলো। বেশি বেগ অবশ্যি পেতে হয়নি। তুলনামূলক সহজেই এই বাসাটা পেয়ে গেছি। এ বাসায় যেদিন আসি সেদিনের ঘটনাটা আগে বলি।

বাসা বদলের ঝক্কি ঢাকা শহরে কতটা তা ভোক্তভোগী ছাড়া কেউ কল্পনা করতে পারবে না। অফিস থেকে দুদিনের ছুটি নিয়েছি। এই আগেই বাক্স পেটরা সব গুছিয়ে রেখেছি। নির্ধারিত দিন সকাল সকাল চলেও এসেছি। সব গুছিয়ে খুব ক্লান্ত হয়ে দুজন চা বানিয়ে খেয়েছি। মুন্নী বলছিলো, পেঁয়াজ নেই।

আমি পেঁয়াজ কিনতে নিচে নামলাম। আচ্ছা, এই ফাঁকে বাসার একটু বিবরণ দিয়ে নিই। বাসাটা বেশ পুরানো। আর এমন বলেই আমার বেশি পছন্দ হয়েছে। দু তলা বাড়ি। আমরা ভাড়া নিয়েছি দুতলার তিনটা ঘর। নিচ তলা খালিই পড়ে আছে। মালিক বললেন, পছন্দমতো মানুষ না পেলে   ভাড়া না দেয়াই ভালো। তাই কয়েক মাস খালিই পড়ে আছে। আমাদের বেশি পছন্দ হবার আরেকটি কারণ এ বাড়ির প্রশস্ত ছাদ। বারান্দাগুলো বেশ বড়। স্নান ঘর বিশাল আকারের। এক কথায় এক দেখাতেই আমাদের পছন্দ হয়ে যায়। তাছাড়া ভাড়াও তুলনামূলক কম।

পেঁয়াজ কিনতে নিচে নেমে দেখি, কয়েক গজ দূরেই একটা দোকান। আমি গিয়ে দোকানির কাছে পেঁয়াজ চাইলাম। দোকানি মনে হয় বেশ পুরানো। এ এলাকায় অনেক দিন আছেন। দোকানের অবস্থান ও আসবাব দেখে বোঝা যায়, এর বয়স চল্লিশের কম নয়। দোকানি এ এলাকায় আমাকে এর আগে দেখেননি। পেঁয়াজের ব্যাগ আমার হাতে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি এখানে নতুন? কিছু মনে করবেন না। এখানে যারা থাকেন, আশেপাশের সবাই আমার চেনা। আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না তাই।

আমি হেসে বলি, জি, আমি এ এলাকায় নতুন। ওই বাড়ির দু তলায় ভাড়া নিয়েছি। হাত তুলে বাড়িটা দেখাই আমি।

দোকানি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললেন, কোন বাড়িটায়?

আমি বাড়ির দিকে আঙুল তুলে দেখাই।

দোকানি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি জানেন এ বাড়ির- বলেই থেম গেলেন। আমি বললাম, থামলেন কেন? কোন সমস্যা?

উনি মাথা নাড়িয়ে বললেন, না না, ঠিক আছে।

আমি দাম মিটিয়ে চলে আসি। আসতে আস্তে ভাবি, কী বলতে চাইলো দোকানি। এ বাড়ির কথা শুনেই বা এমন বিস্মিত হবার কী আছে? তাছাড়া আমি অলৌকিক কিছুই বিশ্বাস করি না। পরদিন অফিসে গিয়ে কাজের চাপে দোকানির এসব কথা বেমালুম ভুলে যাই।

নতুন সংসার না হলেও বাসা গুছানোর আরও অনেক বাকি। মুন্নীকে সব বুঝিয়ে আমি অফিসে যাবার জন্য বের হয়ে যাই। অফিসে দু দিন পর আসায় অনেক কাজও জমে ছিল। কাজ করতে করতে কখন সময় যাচ্ছিল টের পাইনি। দুপুর নাগাদ মুন্নী ফোন করে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, তাড়াতাড়ি বাসায় এসো। আমার ভয় করছে। কে যেন বাথরুমে বসে আছে।

আমি হেসে দিই। বুঝতে পারি, মুন্নী ফান করছে। কিন্তু মুন্নীর কান্না শুনে তখনই বাসার দিকে রওয়ানা হই।

বাসায় গিয়ে দেখি মুন্নী বসার ঘরে শুয়ে আছে।

সে একেবারে স্বাভাবিক, কিছু হয়েছে বলে মনে হয় না আমার। মুন্নীকে জিজ্ঞেস করি, কী হয়েছে বলো তো?

মুন্নী হাসতে থাকে। এই হাসির দুটো অর্থ আছে। এক, সে ব্যাপারটা হালকা করার চেষ্টা করছে; দুই, এ নিয়ে আর কিছু বলতে চাচ্ছে না। কিন্তু দুটো অর্থই বিপজ্জনক। আমি তাই ওর হাত ধরে বললাম, তুমি কান্না করছিলে কিছুক্ষণ আগে, কোনো সমস্যা?

ও উত্তর না দিয়ে উল্টো আমায় জিজ্ঞেস করে, চা খাবে?

আমি এবার বুঝতে পারি, যাই ঘটুক ও ব্যাপারটা আড়াল করতে চাইছে। তাই আর এ নিয়ে কিছু বলি না। চা দিতে বলে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাই। এরপর প্রতিদিনের মতো রাতের হাবার খেয়ে শুয়ে পড়ি আমি। মুন্নী কী একটা মুভি দেখছিলো। এরপর আর কিছু মনে নেই। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়ে যাই। গত কয়েকদিন ধরে বেশ খাটা খাটনি গেছে। খুব ক্লান্ত হয়ে ছিলাম আগে থেকেই।

রাত কয়টা বাজে ঠিক খেয়াল নেই, তবে বেশ রাত; সম্ভত তিনটার দিকে একটা গোঙানির মতো আওয়াজে ঘুম ভাঙে আমার। আমি শোবার ঘরে লাইট না জ্বালিয়েই বারান্দায় যাই। ফিনফিনে অন্ধকার। ঝাপসা একটা ঘুমোট আলো আসছে পাশের ল্যানপোস্ট থেকে। সিগারেট ধরাই একটা। কয়েক টান দিতেই আবার শব্দটা কানে আসে। আর বিস্ময়ের সবচেয়ে বড় কারণ হলো শব্দটি আসছে আমাদের ফ্ল্যাটের কোনো একটা রুম থেকে।

আমি প্রায় দৌড়ে ভেতরে প্রবেশ করি। না, শব্দটা নেই। কিছু কি শুনেছি? হয়তো! বাথরুমের দরজার দিকে এগিয়ে যাই। খোলা দরজা। ভেতরে ঢুকে আমি চিৎকার করে ওঠি। একটা লোক কোমডে বসে আছে। আমাকে দেখে অপ্রস্তুত ভাবে হাসছে।

লোকটির বয়স চল্লিশের কম নয়। মুখে দাড়ি, যার কয়েকটি আবার সাদা হয়ে গেছে। নোংরা জামা কাপড় পড়া। চোখ লাল হয়ে ফুলে আছে। আর তার গা থেকে আসছে পচা একটা গন্ধ।

আমি দৌড় দিয়ে বেড রুমে যাই। দেখি মুন্নী নেই। খাটে শুয়ে আছে সেই লোকটা। এবার আমি মূর্ছা যাই। মেঝেতে পড়ে যাই। আর কিছু মনে নেই।

আমার যখন জ্ঞান আসে, অথবা ঘুম ভাংগে তখন সকাল আটটা। চৈত্র মাস। কড়া রোদ ঘরের ভেতরে উঁকি দিচ্ছে। ব্যাপসা গরম। আমি খাটে শুয়ে আছি। তবে মুন্নী পাশে নেই।

কিন্তু কয়েক মিনিটের মাথায় মুন্নী ঘরে ঢুকে। ওর হাতে চায়ের কাপ। আমার দিকে এগিয়ে দেয়। আমি পাশে রাখতে বলি। আমি বুঝতে পারছি না, রাতে আসলে কী হয়েছিলো। মনে করার চেষ্টা করলাম। রাতে আসলে কিছু ঘটেছিল কিনা সেটাই বুঝতে পারছি না। মুন্নীকে কি নলা যায়? ও কি হাসবে?

চায়ে চুমুক দিতে দিতে মোবাইলটা হাতে নিই। হুম, ম্যাসেজটা এখনো আনরিড।

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ