[রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগতে সুপরিচিত নাম সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথের গানের গভীরে ডুবে থাকা মানুষটি এই সঙ্গীতের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছেন জীবনের পথ চলার আনন্দ। রবীন্দ্রগানের আলোকমাখা পথ ধরে হাঁটতে গিয়ে তিনি কিংবদন্তি শিল্পী সুবিনয় রায়কে শিক্ষক হিসাবে অনেক কাছ থেকে পেয়েছেন। সান্নিধ্যে এসেছেন রবীন্দ্রগানের স্বরলিপিকার শৈলজারঞ্জন মজুমদারের। আর এই ২০২১-এ সুবিনয় রায়ের জন্মশতবার্ষিকীতে আমরা ঋদ্ধ হয়েছি তাঁর সেই সংগীতময় আলোকযাত্রার সঙ্গী হয়ে। শিল্পী সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়ের কখনও হাতে লেখা,কখনও বা মুখে বলা এই সঙ্গীতযাত্রার সাক্ষী থাকলেন নৃত্যশিল্পী প্রতিভা দাস। পড়ুন ৩য় ও শেষ পর্ব ]
৩য় ও শেষ পর্ব / প্রসঙ্গ জর্জ বিশ্বাস,পীযুষকান্তি ও অনান্য…
প্রতিভা দাসঃ অনেকেই বলেন স্বরলিপি হল কাঠামো। এ বিষয়ে আপনার কী মত ?
সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়ঃ ঠিকই তো বলেন, কাঠামোই তো ! কিন্তু কাঠামো বলে যদি অবহেলা করা বোঝাতে চান, তাহলে আমি একমত নই। কাঠামো থেকেই তো রূপের আদল পাওয়া যায় । প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীদের কঙ্কাল অর্থাৎ কাঠামো থেকেই তো জানা গেছে তারা দেখতে কেমন ছিল, হাবভাব স্বভাব চরিত্র কেমন ছিল ।আবার মানুষের কাঠামো ওদের মতো নয়। সঙ্গীত-শিল্পের কাঠামো হ’ল স্বরলিপি।স্বরলিপি-শিক্ষাও গুরুমুখী । শৈলজদা লিখেছেন – স্বরলিপি থেকে গান তুলতে জানলে তা ঠিকই হয়, কেউ ভালো তুলতে পারে, কেউ পারে না; যেমন কেউ বই ভালো পড়তে পারে আবার কেউ পারে না ।স্বরলিপিতে এই গানের গায়কীর ইঙ্গিত আছে। সঙ্গীতভবনের সিলেবাসে স্বরলিপি পাঠ রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। চিঠি পড়ার মতো করে স্বরলিপি পড়তে জানতে হবে – বলতেন তিনি।অনান্য গীতিকারদের গানের মতো কবির গান যে এলোমেলো হয়ে যায়নি আজও, তার অন্যতম প্রধান কারণ এই স্বরলিপি।
প্রতিভা দাসঃ জর্জ বিশ্বাস,পীযুষকান্তি সরকার থেকে শুরু করে হাল আমলের কেউ কেউ অন্যভাবে রবীন্দ্রনাথের গান গাইছেন। এটা কি রবীন্দ্রগানের চর্চাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে বা করছে ? নাকি উল্টোটা?
সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়ঃ রবীন্দ্রনাথের গান তো অন্যভাবে গাওয়া যায় না ! গাইলে সেটা রবীন্দ্রসঙ্গীত থাকবে না। এই প্রবণতা বাঙালির আছে বলেই তিনি শান্তিনিকেতনে গুরুমুখী সঙ্গীত শিক্ষার প্রচলন করে গেছেন – গুরু শিষ্য পরম্পরায় গায়কী বজায় যাতে থাকে – এ কারণেও সবসময় স্বরলিপি করে রাখার কথা ভেবেছেন ।তাঁর বিখ্যাত উক্তিটি মনে করুন – আমার গানে আমি এমন কোনো ফাঁক রাখিনি যা অন্যেরা ভ’রে দিলে আমি কৃতার্থ হব ।
জর্জ বিশ্বাস সম্পর্কে সুবিনয় রায়ের মন্তব্য আগেই করেছি ” আমার পছন্দের গায়ক নন”। কেন সুবিনয়দা একথা বলেছিলেন বুঝতে আজ আর অসুবিধে হয় না- ওনার গানে ডিটেলস্ এর বড়োই অভাব, অভাব গায়কীর। অসাধারণ ছিল দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠস্বর, ব্যারিটোন ভয়েস যাকে বলে, তাতেই ওনার শ্রোতারা মুগ্ধ হন । সুন্দর কণ্ঠস্বর সুন্দর রূপের মতো, সহজেই আকর্ষণ করে। কিন্তু গুণহীন রূপ নিয়ে আমরা কী করবো ? যারা মুগ্ধ তারা যে সব গানের লোক তা নয় । অনেকেই কবি সাহিত্যিক, খেলোয়াড়, কেউ বিজ্ঞানী, অবসরে যারা গান শোনেন ।এখানে ওনার নিজের লেখা থেকে একটু পড়ে শোনাই –
” আমি তো গান শিখিনি, তাই নিজের মতো করে জনমনোরঞ্জনের চেষ্টা করতাম । মনের মতো গান বেছে নিয়ে গায়কীর ঢংয়ে রংচং লাগিয়ে গেয়ে বেড়াই। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল অরাবীন্দ্রিক , অতিনাটকীয় , অর্কেষ্ট্রার জগঝম্প ইত্যাদি । এরা অবশ্য শ্রোতাসমাজের নিতান্ত সংখ্যালঘু।সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রোতা পশ্চিমবঙ্গে এবং বিদেশেও, বিশেষত ইংল্যাণ্ড ও আমেরিকায়, প্রচুর আছেন যাঁরা রবীন্দ্রসাহিত্যের ধারও ধারেন না, কিন্তু আমার অজানা কোনও কারণে তাঁরা প্রবলভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীতবিলাসী।তাঁরা আমাকে অকুণ্ঠ ভালোবাসা দিয়েছেন,সম্মান জানিয়েছেন।”( মনের কথা – দেবব্রত বিশ্বাস,অন্য প্রমা- শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি,২০১০)। লক্ষ করুন –“ যারা রবীন্দ্রসাহিত্যের ধারও ধারেন না” তারাই ওনার মুগ্ধ শ্রোতা, নিজেই লিখেছেন ।
প্রতিভা দাসঃ কিন্তু তাহলে ওনার এই বিপুল জনপ্রিয়তা কি শুধু কণ্ঠস্বরের কারণেই ?
সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়ঃ শুধু কণ্ঠস্বর না।সামাজিক কারণও আছে। এ ব্যাপারে নাট্যকার ব্রাত্য বসুর ভাবনাচিন্তা তুলে ধরছি৷ “আমার ধারণা, তথাকথিত বাঙাল’দের মধ্যে দেবব্রত বিশ্বাসকে নিয়ে একটা গভীর অভিনিবেশের ব্যাপার ছিল।দেশভাগের যন্ত্রণা, ছিন্নমূল মানুষের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা, উদবাস্তু মানুষের সংগ্রাম ও পরিশীলন দেবব্রতর কণ্ঠে ফুটে উঠত। সেজন্য বাঙাল ঘরে দেবব্রত ছিলেন বেশি সমাদৃত”। (অন্য প্রমা- শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি,২০১০)।
এরপর শারদীয় প্রতিদিনের ২০১৯ এর সংখ্যায় উনি লেখেন (আমার অভিনয়, আমার অভিনেতা) “দেবব্রত বিশ্বাসের প্রায় ৪০ বছরের জীবৎকালে ( ১৯৩৮–‘৭৯ ) তাঁর জীবন রক্তাক্ত হয়েছিল তিনটি আয়ুধ তথা ত্রি-শূলে।প্রথমত, রাজনীতির সঙ্গে বা গণনাট্য সংঘের সঙ্গে তাঁর যুক্ত হওয়া এবং অচিরেই সেখান থেকে বিচ্ছিন্নতা নামক শূলে বিদ্ধ হওয়া। দ্বিতীয়ত, জর্জ বিশ্বাসের অকল্পনীয় জনপ্রিয়তা,তাঁর সমসাময়িক কিছু পেশাদার শিল্পী তথা বন্ধুদের ভিতর এক অসূয়ার জন্ম দিয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত বাড়তে বাড়তে বিশ্বভারতীর ফতোয়ায় রূপান্তরিত হয় এবং তৃতীয়ত, গণমাধ্যম বা খবরের কাগজের আনুকূল্য সম্পর্কে “ মাইনরিটি আর্টিস্ট এর যে স্বাভাবিক অভিমান থাকতে পারে, তাই দ্রবীভূত হয়ে তাঁর আত্মজীবনীতে প্রতিফলিত হয়েছিল৷”
এই হ’ল বিপুল সংখ্যক জনগনের ধারণা, প্রধানত আবেগ, আর তার থেকেই এই বিপুল জনপ্রিয়তা ।এই প্রসঙ্গে একটি বাস্তব তথ্য আপনাদের জানিয়ে রাখি – বিশ্বভারতী দেবব্রত বিশ্বাসের গান বন্ধ করে দেয় নি।গানের সঙ্গে সঙ্গতিহীন যন্ত্র ব্যবহারে আপত্তি জানিয়েছিল।দেবব্রতবাবু তার প্রতিবাদে রেকর্ড করা বন্ধ করে দেন।গায়ক দেবব্রতবাবুর মূল লক্ষ ছিল শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের দিকে।ওনার উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল।গায়কদের উদ্দেশে ওনার উপদেশ ছিল এইরকম- তুমি একজন গায়ক,মানে তুমি একজন বোলার,শ্রোতা হচ্ছেন ব্যাটসম্যান।তোমার কাজ যেমন তেমন করে হোক শ্রোতার উইকেট ভেঙে দেওয়া; অর্থাৎ শ্রোতাদের মুগ্ধ করা,জনপ্রিয়তা অর্জন করা ।অথচ রবীন্দ্রনাথ কী বলছেন ? সঙ্গীত কোনও মনোরঞ্জনের উপকরণ নয়, তা আমাদের মনের সুর বেঁধে দেয়, জীবনকে এক অভাবনীয় সৌন্দর্য দান করে ।
পীযূষবাবুর গান গাইবার পটুত্ব ছিল।কিন্তু উনি যে গান শেখেন নি সেটা ওনার গান শুনলেই বোঝা যায়।গানের কিছু শব্দ জায়গায় জায়গায় অর্থহীনভাবে টেনে রাখতেন, সম্ভবত নতুনত্ব আনবার চেষ্টা,সেটা মানায় নি।দেবব্রতবাবুর মতো ওনারও মূল লক্ষ ছিল জনপ্রিয়তা অর্জন। আমার সঙ্গে ওনার আলাপ ছিল।আমি ওনাকে শৈলজাদার কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, কারণ ওনার সম্ভাবনা ছিল। উনি যেতে রাজি হন নি।বলেছিলেন- আমি প্রতিষ্ঠানের লোকের কাছে যাই না।দুর্ভাগ্য ওনার,উনি জানতেন না যে, রবীন্দ্রসঙ্গীত-জগতে শৈলজদার মতো প্রতিষ্ঠান-বিরোধী অথচ বিশেষজ্ঞ,আর কেউই ছিলেন না।
প্রতিভা দাসঃ সিনেমায় রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার নিয়ে আপনার কী বক্তব্য।
সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়ঃ রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন তাঁর গান সিনেমায় বাজুক। তাঁকে দেশবাসী কবি হিসেবেই জানত। কিন্তু তিনি যে উৎকৃষ্ট গানও রচনা করতে পারেন,সেটা সবাইকে জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সিনেমায় নিজের গান শুনে খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন (যাত্রাপথের আনন্দগান – শৈলজারঞ্জন মজুমদার ) । গান গাইতে জানলেই যে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া যায় না সেটা তিনি অনুভব করেছিলেন। বুঝেছিলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মতো তাঁর গানও গুরুমুখী।তখনই সঙ্গীতভবন স্থাপনের চিন্তা মাথায় আসে।সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।গুণী পরিচালক হলে অসুবিধে নেই।কিন্তু হালফিল কোনো সিনেমায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার হয়েছে জানলে ভয় করে।এলার চার অধ্যায় নামের ছবিটায় বিখ্যাত মাঝে মাঝে তব দেখা পাই গানের বিকৃত রূপ দেখলুম, শুনলুম।শান্তিনিকেতন থেকে পাস করা রবীন্দ্রভারতী থেকে পাস করা শিল্পীরাও ওই ভাবে গাইছেন এই গান। ক্রমশ অবাক হতেও ভুলে যাচ্ছি আমরা। সিনেমায় রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যাপারটা তাই এখন ভয়ের।
প্রতিভা দাসঃ আপনি কি হারমোনিয়াম বাজিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার বিরোধী ?
সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়ঃ অবশ্যই বিরোধী, কারণ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এর বিরোধী ছিলেন।সেই প্রথম যুগে লিখেছিলেন – সৌভাগ্যক্রমে তখনও আমাদের সঙ্গীতরাজ্যে বক্স হারমোনিয়ামের মহামারি কলুষিত করেনি হাওয়াকে।শেষ জীবনেও একই কথা – তখন হারমোনিয়াম আসেনি এ দেশের গানের জাত মারতে … কলে টেপা সুরের গোলামি করিনি। ১৯২১ সালে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার সময় থেকে যন্ত্রটি আশ্রমে স্থান পায়নি। সঙ্গীতভবনে হারমোনিয়াম বাজেনি। তাই শান্তিনিকেতনেই থেকে যাওয়া শিল্পীরা( যেমন কণিকা, নীলিমা, শান্তিদেব ঘোষ)- কেউ যন্ত্রটি বাজাতে পারেন না,কারণ বাজাবার সুযোগ পান নি।শৈলজারঞ্জন ঝড়ের মতো হারমোনিয়াম বাজাতে পারতেন।ওখানে গিয়ে দেখেন যন্ত্রটির ব্যবহার নেই।বলেছেন- সেই থেকে জীর্ণ বস্ত্রের মতো ওটি বর্জন করেছি, জীবনে আর ছুঁইনি।
যন্ত্রটি গানের সঙ্গে ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত কে সমর্থন জানিয়েছিলেন স্বয়ং ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। আমাদের সঙ্গীত শাস্ত্রে ভৈরবের আরোহে কোমল ধা একটু চড়া,অবরোহে কোমল।আবার ভৈরবের কোমল রে আর মারোয়ার কোমল রে এক নয় ; মারোয়ার কোমল রে একটু তীব্র। শ্রুতির তফাত- রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন স্নায়ুতন্ত্র। একটা তার যন্ত্রের দিকে ভালো করে লক্ষ করলে দেখবেন, সা থেকে শুদ্ধ রে- এর মধ্যে অনেকটা জায়গা আছে। তার মধ্যের একটা জায়গায় আছে কোমল রে। হারমোনিয়ামে এই কোমল রে টি আছে। কিন্তু এ ছাড়াও কোমল রে থেকে সা, আবার কোমল রে থেকে শুদ্ধ রে এর মধ্যেও জায়গা রয়েছে তার যন্ত্রে,এখানেও আছে সুর, এই সুরগুলিই শ্রুতির সুর,যা ভারতীয় সঙ্গীতের প্রাণ ৷ আগেই বলেছি – ভৈরবের কোমল রে আর মারোয়ার কোমল রে এক নয়। কিন্তু কলে টেপা যন্ত্রে এই সুরগুলির অস্তিত্ব নেই।
শুধু একটিমাত্র কোমল রে একটিমাত্র কোমল ধা নিয়ে রাগরাগিণী গাইলে বা শেখালে রাগরাগিণীর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য লোপ পাবে, এখন তাইই হচ্ছে । আগেই বলেছি – রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে শ্রুতি স্বরের প্রয়োগ করেছেন। সুতরাং হারমোনিয়াম বর্জন করবেন সেটা স্বাভাবিকই ছিল। আমাদের কণ্ঠটি তো কলে টেপা যন্ত্র নয়- সেখানে পূজার প্রেমের প্রকৃতির রাগ অনুরাগ খেলা করে, সুর এক স্বর থেকে আরেক স্বরে গড়িয়ে যেতে চায়। ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সুযোগ্য পুত্র সঙ্গীতগুণী শ্রী কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও তাঁর ‘উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অবক্ষয়’ বইটিতে হারমোনিয়াম ব্যবহার না করার রবীন্দ্রনাথের সিদ্ধান্তকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন ।
শুধু “সঙ্গীত-চিন্তায়” নয়, হারমোনিয়ামের প্রতি কবির বিরক্তির সাক্ষ্য আছে তাঁর যোগাযোগ, চার অধ্যায় উপন্যাসেও।শৈলজারঞ্জন হারমোনিয়াম ছুঁতেন না, ছাত্রদেরও সেই ভাবে শিক্ষা দিয়েছিলেন।কিন্তু তাঁর ছাত্ররা কেউই তাদের গুরুর কথা শোনেনি। তারা সব বিখ্যাত শিল্পী,পেশাদার।এক অখ্যাত অপেশাদার আমিই বোধহয় একমাত্র ছাত্র যে রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে আর শৈলজারঞ্জনের নির্দেশ মেনে চলেছি। আমার ছাত্রছাত্রীদেরও সেভাবেই শেখাই।শুধু তানপুরার সঙ্গে গলা সুরে মেলানোর আনন্দই যে আলাদা, আমি চাই তারাও সেটা উপলব্ধি করুক ।
প্রতিভা দাসঃ কপিরাইট উঠে যাবার পরেও আপনার মনোভাব বদলায়নি,কিন্তু কেন ?
সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়ঃ ভালো বলেছেন,অনেকেরই ধারণা রবীন্দ্রসঙ্গীতের কপিরাইট উঠে গেছে।এটা ভুল। কপিরাইট বলতে কী বোঝায় সেটা ভালোভাবে বুঝতে হবে।কপিরাইট হ’ল সোজা বাংলায় যাকে বলে রাইট টু কপি।একটা আইন।রবীন্দ্র রচনাবলী থেকে কপি করার এই অধিকারটি এতদিন ছিল বিশ্বভারতীর।এখন সেটা আর নেই। অর্থাৎ অন্য অন্য পাবলিশাররাও রবীন্দ্র রচনাবলী ছাপতে পারেন,অর্থাৎ কপি করতে পারেন।ঠিক আছে। কিন্তু কপি ওফ হোয়াট? কপি অফ অরজিনালস। মূল রচনাই বজায় রাখতে হবে অর্থাৎ কপি করতে হবে, না হলে তো সেটা রবীন্দ্ররচনাবলী থাকবে না, তাই না ? অন্যেরা তাদের রচনাবলীর প্রচ্ছদ বদলাতে পারেন, বিশেষজ্ঞদের দিয়ে উৎকৃষ্ট সূচনা- প্রবন্ধ লেখাতে পারেন,এই পর্যন্তই। কিন্তু কবিতা গল্প উপন্যাস নাটক-একই থাকবে, নাম এবং পাত্রপাত্রীও একই থাকবে, না হলে আমরা সে রচনাবলী কিনব কেন?
রবীন্দ্রসঙ্গীত অর্থাৎ স্বরবিতানের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই থাকছে।শিল্পের কপি রাইট কখনোই শেষ হয়ে যায় না।মনে করুন- বিখ্যাত মোনালিসা ছবিটার কথা। অপূর্ব একটা হাসি ছড়িয়ে আছে মুখমণ্ডলে। অথচ হাসির উৎস খুঁজে পাওয়া যায় না। ওটাই শিল্প। এখন কেউ যদি মনে করেন হাসিটি ঠিকভাবে বোঝা যাচ্ছে না, তিনি নিজের তুলি দিয়ে ঠোঁট ফাঁক করে দাঁতগুলো বার করে দিলেন।পারেন কি ? অজন্তা ইলোরার ছবি দেখতে কেউ ব্যাগে করে রঙ তুলি নিয়ে যান না।এখানে এই রঙটি মানাচ্ছে না ভেবে নতুন রঙ লাগাতে পারেন না৷ পারেন কি ? শিল্পের কপিরাইট কখনোই শেষ হয়ে যায় না।বাখ বেথোফেন মোজার্টের করা সুর বিকৃত করার কথা কেউ ভাবতেই পারে না। কিন্তু আমরা বাঙালিরা পারি৷ আমাদের আছে স্বরলিপি না মেনে চলার অধিকার।তাঁর গানে আমরা উল্লাল্লা উল্লাল্লা লাগিয়ে দিয়েছি।সোচ্চার প্রতিবাদ খুব একটা হয়নি ।
প্রতিভা দাসঃ এখনও বহু মানুষ রবীন্দ্রনাথের গান শুনেই জীবনের প্রেরণা,এগিয়ে চলার রসদ, বেঁচে থাকার আলো খুজে পান। আপনার মতে রবীন্দ্রগানের মধ্যে এমন কী আছে যা মানুষকে এমন প্রেরনা দেয়?
সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়ঃ ঠিকই তো। তাঁর গান আমাদের জীবনের রসদ আবার প্রেরণাও।তিনি রসদ যোগাচ্ছেন দু ভাবে।একটা অর্থনীতির দিক দিয়ে,আর একটা বেঁচে থাকার আনন্দের দিক দিয়ে।তাঁর গান একটা বিরাট সংখ্যক জনগণের আয়ের উৎস।শান্তিনিকেতনের রিক্সাওয়ালা থেকে শুরু করে, ওখানকার দোকান, হোটেল মালিক – সবাইকেই অর্থের জোগান দিয়ে আসছেন রবীন্দ্রনাথ।বছরে যতো বই ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয় তার আশি ভাগই হয় রবীন্দ্রনাথের অথবা তাঁর ওপরে লেখা বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ। তাঁর গানের ওপরেই তো কতো কতো বই এখনও লেখা হচ্ছে। ছাপাখানায় যাঁরা কাজ করেন,বই বাঁধাই এর কাজ করেন যাঁরা,গানের এই যে এতো যন্ত্র বানানো হচ্ছে, অনেকটাই প্রধানত তাঁর গানের জন্যেই৷ যাঁরা এসব যন্ত্র বানান,এসব যন্ত্র যাঁরা বাজান, তাদের আয়ের উৎস রবীন্দ্রনাথ; একটা বিশ্ববিদ্যালয় মানে বিশাল সংখ্যক মানুষের যোগদান কর্মসংস্থান; তাঁর নামে দুটো বিশ্ববিদ্যালয় – সবাইকেই বেঁচে থাকার রসদ যোগাচ্ছেন সেই একজন রবীন্দ্রনাথ।কী আছে রবীন্দ্রনাথের গানে! জীবন থেকে বাদ দিন রবীন্দ্রনাথের গান; দীনহীন হয়ে যাবে আমাদের সংস্কৃতি-জগত।
নিখিলের আনন্দধারায় ধুইয়ে দাও
মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ধুইয়ে দাও….
এ গান যখন গাই,যখন শুনি,তখন বুকের মধ্যে অন্য একটা আমি, আমারই বিশুদ্ধ উন্নততর রূপের সন্ধান পাই না কি? সারা গীতবিতান জুড়েই ছড়িয়ে আছে এমন আনন্দময় আহ্বান;যেন সত্যের আনন্দরূপ …।তাঁর পূজার গান আমাদের কোন মন্দিরের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় না,এই নিখিল বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের আমিও একজন অংশীদার,এ কথা জানিয়ে দেয়। তাঁর প্রেমের গানে চাওয়া পাওয়ার অংশটা প্রায় নেই,দিতে না পারার বেদনা আছে।প্রেম পর্যায়ের শেষ গানে জানিয়েছেন –
আমার মনে কেবলই বাজে /তোমায় কিছু দেওয়া হল না যে …
ব্যর্থতার এই রাজকীয় রূপ,এই ঐশ্বর্যের সন্ধান,আমরা এর আগে পেয়েছি কি ?
প্রতিভা দাসঃ রবীন্দ্রগান চর্চায় আপনি দীর্ঘদিন নিয়োজিত। আপনি একটি রবীন্দ্রগান চর্চা কেন্দ্রও গড়েছেন। এই কেন্দ্রের মূল উদ্দেশ্য কী?
সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়ঃ আমার গুরুদের কথা বলেছি।আমি সেই প্রাচীন(এবং অত্যন্ত আধুনিক) সঙ্গীতভবনের শিক্ষাধারায় দীক্ষিত।গুরু-শিষ্য পরম্পরায় সেই চর্চা বজায় রাখাই আমার উদ্দেশ্য। আমাদের ” কথা ও সুর – রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুশীলন/অনুসন্ধান ” সংস্থায় কিছু সদস্য আছেন।এতক্ষন যা সব বকবক করলুম – ওদেরও এই সব কথাই বলি।
পড়ুন এই সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব( ক্লিক করুন) – https://galpersamay.com/2021/04/14/
পড়ুন এই সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্ব(ক্লিক করুন) – https://galpersamay.com/2021/05/09/
Tags: প্রতিভা দাস, সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।