স্বাধীনতার আগে
জালিয়ানওয়ালাবাগে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। এই হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে হিন্দু এবং মুসলমান দু-ই ছিল। হিন্দু এবং মুসলমান, মুসলমান এবং শিখদের আলাদা আলাদা ভাবে চেনার কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। তাদের চেহারা, তাদের মেজাজ, তাদের চাল-চলন এবং ধর্ম পৃথক হওয়া সত্ত্বেও, জালিয়ানওয়ালাবাগে আজ তাদের সবাইকে এক এবং অভিন্ন করে দিয়েছিল। তাদের হৃদয়ে একই উৎসাহ এবং উদ্দীপনা টগবগ করছিল। আর এই ধিকি ধিকি আগুনের উত্তপ্ত সমাজ ও সভ্যতার যে বন্ধুত্ব তাকে একসূত্রে গ্রথিত করে দিয়েছিল। তাদের হৃদয়ে বিপ্লবের এমন এক নিরন্তর স্রোতধারা প্রবাহিত হচ্ছিল, যে স্রোতধারা চারদিকের পরিবেশকে বিদ্যুতের ছটায় উদ্ভাসিত করে তুলেছিল। মনে হচ্ছিল এই শহরের বাজারের প্রতিটি পাথর, দালানকোঠার প্রতিটি ইট যেন এই নিস্তব্ধ পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত, যেন এক থর থর হৃৎকম্পনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর তা যেন প্রতিক্ষণ বলে চলেছিল : স্বাধীনতা স্বাধীনতা স্বাধীনতা!
জালিয়ানওয়ালাবাগে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। সেই ভিড়ের প্রতিটি মানুষ নিরস্ত্র, সবাই আজাদীর জন্যে উন্মাদ। তাদের হাতে লাঠি বা রিভলবার, ব্রেনগান বা স্টেনগান, হাণ্ডগ্রেনেড বা দেশী-বিদেশী কায়দায় তৈরি বোম — কোন কিছুই ছিল না। তারা ছিল সম্পূর্ণভাবে নিরস্ত্র, কিন্তু তাদের চোখে যে আগুন ঝরছিল তাতে ছিল ভূমিকম্পের প্রলয়ঙ্করী তেজ এবং উত্তাপ।
সাম্রাজ্যবাদী ফৌজের হাতে ছিল লোহার হাতিয়ার। আর জালিয়ানওয়ালাবাগের মানুষের হৃদয় তৈরি হয়েছিল ইস্পাতে-ইস্পাতে। আর তাদের রক্তে এমন এক পবিত্র তেজ সৃষ্টি হয়েছিল, যে তেজ শুধু মহান আত্মত্যাগ থেকেই জন্ম নিতে পারে। পাঞ্জাবের পঞ্চনদীর জল, তার রোমান্স, তার সাচ্চা প্রেম আর তার ঐতিহ্যময় বীরত্ব আজ প্রতিটি মানুষের প্রতিটি শিশুর প্রতিটি বৃদ্ধের জ্যোতির্ময় চেহারায় জ্বল জ্বল করছিল। আর এই সমুজ্জ্বল গরিমা তারা সেই মুহূর্তেই অর্জন করেছিল। এই সমুজ্জ্বল গরিমা একটি জাতির জীবনে এনে দেয় যৌবন – ঘুমিয়ে থাকা দেশকে তোলে জাগিয়ে। যারা অমৃতসরের এই ক্রোধ দেখেছে, তারা কখনও গুরুর এই পবিত্র নগরীর কথা ভুলতে পারবে না।
জালিয়ানওয়ালাবাগে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। আর এই হাজার হাজার মানুষের ওপর চলে গুলি বর্ষণ। তিন দিক থেকে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, শুধু একদিকে ছোট্ট একটা দরজা খোলা ছিল। এই দরজা ছিল জীবন থেকে মৃত্যুর দিকে প্রসারিত। হাজার হাজার মানুষ হাসতে হাসতে শহীদের মৃত্যু বরণ করল। স্বাধীনতার জন্যে হিন্দু মুসলমান এবং শিখ একজোট হয়ে হৃদয়ের খাজাঞ্চিখানা উজার করে দিল। আর পঞ্চনদীর বিস্তীর্ণ ধারার সঙ্গে আর একটি নদীর ধারা মিলিত হল। এ তাদের সম্মিলিত রক্তনদী — এ তাদের রক্তের উত্তাল নদী। এ নদী উত্তুঙ্গ তরঙ্গমালার আঘাতে আঘাতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
সমগ্র দেশের জন্যে পাঞ্জাব তার বক্তকে উৎসর্গ করল। কেউ কখনও এই বিস্তীর্ণ আকাশের নীচে আজ পর্যন্ত এমন ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতা ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম এবং ভিন্ন ভিন্ন মেজাজ একই রক্তে রাঙিয়ে উঠতে দেখেনি। এতে ছিল শহীদের রক্তের পাকা রঙ। এতে ছিল ঔজ্জ্বল্য, সৌন্দর্য স্বাধীনতার সৌন্দর্য, ……।
সিদ্দিক কাটরা ফতেহ খাঁতে থাকত। ওমপ্রকাশের বাড়িও কাটরা ফতেহ খাঁতে। সে অমৃতসরের এক বিখ্যাত ব্যবসায়ীর ছেলে। সিদ্দিক আর ওমপ্রকাশ পরস্পরকে ছেলেবেলা থেকেই জানত-শুনত। কিন্তু তাদের দু’জনের মধ্যে কোন বন্ধুত্ব ছিল না, কারণ সিদ্দিকের বাবা গরীব এবং চামড়ার ব্যবসা করত। আর ওমপ্রকাশের বাবা ছিল ব্যাঙ্কার এবং ধনী। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা পরস্পরকে জানত। তারা ছিল প্রতিবেশী। আর তারা দুজনেই জালিয়ানওয়ালাবাগে হাজির হয়ে একই জায়গায় দাড়িয়ে নেতাদের চিন্তা এবং ভাবনাকে তাদের হৃদয়ে ঠাই দিচ্ছিল। ঠাই দিতে দিতে তারা একেকবার পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি মিষ্টি হাসছিল — যেন ছেলেবেলা থেকেই তাদের কত বন্ধুত্ব কত পরিচিতি। তাদের অন্তরের কথা তাদের চোখের ভাষায় ভাস্বরিত হয়ে উঠেছিল — স্বাধীনতা স্বাধীনতা স্বাধীনতা।
যখন গুলি চলল, গুলি প্রথম এসে লাগল ওমপ্রকাশের কাঁধে। ওমপ্রকাশ মাটিতে পড়ে গেল। ওমপ্রকাশ পড়ে যেতেই সিদ্দিক বুকে তাকে দেখতে লাগল। সেই সময় একটা গুলি এসে সিদ্দিকের উরু এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল। তারপর সমানে বর্ষার ধারার মতো গুলি ছুটে আসতে লাগল। গুলির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রক্তের ধারা বয়ে চলল। শিখদের রক্ত মুসলমান এবং হিন্দুদের রক্ত মুসলমানদের সঙ্গে একাকার হয়ে চলল। যেন একটিই গুলি একই শক্তি একই চোখ এবং সবার হৃৎপিণ্ড ভেদ করে ছুটে চলেছে।
সিদ্দিক ওমপ্রকাশের ওপর আরও একটু ঝুকে দাড়াল। যেন সে তার সমস্ত দেহটা দিয়ে ওমপ্রকাশের ওপর ঢাল বানিয়ে রেখেছিল। তারা দুজনে- সে আর ওমপ্রকাশ — গুলির বর্ষণের মধ্যেই হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে একটা প্রাচীরের কাছে এল। প্রাচীরটা তেমন কোন উচু নয় যে লাফিয়ে পার হওয়া যায় না। কিন্তু লাফিয়ে পার হওয়ার সময় সিপাইয়ের গুলির নিশানার মধ্যে পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক ছিল। সিদ্দিক নিজের দেহটাকে প্রাচীরের সঙ্গে ঠেকিয়ে জন্তুর মতো চার হাত-পায়ের পাঞ্জা মাটিতে রেখে বলল, “প্রকাশ, খোদার নাম নিয়ে প্রাচীরের ওপর দিয়ে লাফিয়ে পার হও।”
গুলির বিরাম নেই।
প্রকাশ অনেক কষ্টে সিদ্দিকের পিঠের ওপর দাড়াল এবং লাফিয়ে পার হওয়ার চেষ্টা করতে লাগল।
শনশন করে একটা গুলি ছুটে এল।
সিদ্দিক নীচ থেকে বলল, “জলদি কর”।
সিদ্দিকের বলার আগেই প্রকাশ প্রাচীরের ওপারে লাফিয়ে পড়ল। জানোয়ারের মতো চার হাত-পায়ের ওপর ভর করেই সিদ্দিক চারদিক এক নজর দেখে নিল। তারপর সোজা হয়ে দাড়িয়ে এক লাফে প্রাচীরের ওপারে গিয়ে পড়ল। কিন্তু ওপারে পড়তে না পড়তেই আর একটা গুলি শনশন করে ছুটে এসে তার আর একটা পায়ে বিধল। সিদ্দিক প্রকাশের ওপর ছিটকে গিয়ে পড়ল। নিজেকে এক ঝটকায় সরিয়ে নিয়ে সিদ্দিক প্রকাশকে ওঠাতে গেল।
“প্রকাশ, তোমার খুব লাগেনি তো?”
সিদ্দিক দেখল, প্রকাশের দেহে কোন প্রাণ নেই। কিন্তু তার আঙ্গুলের হীরের আংটি তখনও জ্বলজ্বল করছে। তার পকেটে দু’হাজার টাকার নোট। তার উষ্ণ রক্ত মাটির পিপাসাকে নিবৃত্ত করছে। জীবনের গতি উচ্ছাস আবেগ আর সব কিছুই তার মধ্যে আছে — শুধু -সে নিজেই আর নেই।
প্রকাশকে উঠিয়ে সিদ্দিক বাড়িতে নিয়ে গেল। তার দুই উরু প্রচণ্ড ব্যথায় টনটন করছিল। হাটু থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে রক্ত ঝরছিল। আর হীরের আংটি যেন অনেক কথাই বলছিল। সবাই তাকে বুঝিয়েছিল। তাদের দুজনের আচার-বচার ধর্ম এক নয়। প্রকাশের সমাজ সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ অপরিচিত।
কিন্তু সিদ্দিক কারও কোন কথায় কান দিল না। সে তার বহমান রক্তধারা এবং প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে যে ছটফটানি তার ফরিয়াদও শোনেনি। সে তার নিজের পথেই পা বাড়িয়েছিল।
এ রাস্তা ছিল সম্পূর্ণভাবে নতুন। যদিও কাটরা ফতেহ খাই ছিল তার গন্তব্যস্থল। আজ যেন দেবদূত তার সঙ্গে সঙ্গে চলছিল। এক কাফেরকে আজ সে কাধে বয়ে নিয়ে চলেছিল। আর তার রক্ত এমন ভরপুর এবং সজীবতায় উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল যে কাটরা ফতেহ খাতে পৌছে সে সবাইকে ডেকে বলতে লাগল, “এই নাও হীরের আংটি, দু’হাজার টাকা আর শহীদের মৃতদেহ।”
কথা ক’টি কোন রকমে উচ্চারণ করে সিদ্দিক সেখানেই পড়ে গেল। আর সারা শহরের মানুষ দু’জনের জানাজা এমন সমারোহের সঙ্গে করল, যেন তারা দু’জন আপন ভাই।
কার্ফু তখনও শুরু হয়নি। কুচা রামদাসের দু’জন মুসলমান, একজন শিখ আর একজন হিন্দু মহিলা তরি-তরকারি কেনার জন্যে বাজারে আসে। গুরুদ্বারের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তারা সবাই মাথা হেঁট করে শ্রদ্ধা জানাল। তাদের খুব তাড়াতাড়ি ফেরার কথা। কার্য শুরু হওয়ার আর দেরি নেই। কিন্তু বাতাসে শহীদের রক্তের ডাক গুনগুন করে ঝংকার তুলছিল। বাজার করতে করতে এবং কথা বলতে বলতে তাদের দেরি হয়ে গিয়েছিল, বাজার করে তারা যখন ফিরছিল, তখন কাফু শুরু হওয়ার আর কয়েক মিনিট বাকী।
বেগম বলল, “চল, এই গলি দিয়ে বেরিয়ে যাই, কয়েক মিনিটে পৌছে যাব।”
“কিন্তু এদিকে তো গোরা সৈন্যের পাহারা বসেছে।” পায়রা বেগমকে বলল।
শ্যাম কাউর বলল, “গোরাদের কোন ভরসা নেই।”
জৈনব বলল, “মেয়েদের ওরা কিছু বলবে না। ঘোমটা টেনে পার হয়ে যাব। তাড়াতাড়ি চল।”
তারা চারজনই সেই গলি ধরে এগিয়ে চলল।
সৈন্যরা বলল, “এই ঝাণ্ডা — ইউনিয়ন জ্যাককে সেলাম কর।”
চারজনেই ঘাবড়িয়ে গেল এবং কিছু বুঝতে না পেরে ইউনিয়ন জ্যাককে অভিবাদন করল।
গলির এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত দেখিয়ে সৈনিকটি বলল, “হাঁটু গেড়ে বসে ঐ মাথা থেকে কুর্নিশ করতে করতে পার হও।”
জৈনব বিস্মিত হয়ে বলল, “হাঁটু গেড়ে আমি বসতে পারব না।”
“সরকারের হুকুম, হাঁটু গেড়ে বসে মাথা হেঁট করে ঘসটাতে ঘটাতে পার হতে হবে।”
শ্যাম কাউর ঝংকার দিয়ে উঠল, “আমি হেঁটে পার হব, দেখি কে রোখে ?”
শ্যাম কাউর টানটান হয়ে এগিয়ে চলল।
পাব শ্যাম কাউকে ডেকে বলল, “আরে দাড়াও, দাড়াও।”
গোরা সৈনিকটি বলল, “দাড়াও বলছি, না হলে গুলি করব।”
কিন্তু শ্যাম কাউর টানটান হয়ে হেঁটে চলল।
ঠাস্।
শ্যাম কাউর মাটিতে পড়ে গেল।
জৈনব আর বেগম একমুহূর্ত পরস্পরের দিকে তাকাল। তারপর তারা দু’জনেই হাঁটু ভেঙে চলতে লাগল।
গোরা সৈন্যটি আনন্দে গদগদ। সে ভাবল, সরকারের হুকুম কে অবজ্ঞা করবে।
জৈনব আর বেগম হাঁটু ভেঙে দু’হাত আকাশের দিকে তুলে ধরল। কিছুক্ষণের জন্যে নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেল। তারপর তারা দু’জনে সোজা উঠে দাড়াল এবং হেঁটে চলল।
গোরা সৈন্যটি কেমন একটু ঘাবড়িয়ে গেল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে তার মুখ রাগে লাল হয়ে উঠল। সে তার রাইফেল তাদের দিকে তাক করে ধরল।
ঠাস্, ঠাস্।
পারো কান্নায় ভেঙে পড়ল। আমাকেও মরতে হবে। কী বিপদেই পড়লাম। আমার স্বামী আমার সন্তান আমার মা-বাবা-তোমরা আমাকে ক্ষমা কর। মৃত্যু আমি চাই না, কিন্তু মরতে আমাকে হবেই। আমার বোনদের ছেড়ে আমি একা কীভাবে যাই ! পারে কাঁদতে কাদতে এগিয়ে চলল।
গোরা সৈনিকটি নরম সুরে তাকে বলল, “কান্নার কী আছে। সরকারের হুকুম মেনে হাটু গেড়ে এই গলি পার হয়ে যাও। তোমাকে কেউ কিছু বলবে না।”
গোরা সৈনিকটি নিজেই হাঁটু ভেঙে কীভাবে চলতে হয় দেখিয়ে দিল।
পারো কাঁদতে কাঁদতে গোরা সৈনিকটির একেবারে কাছে এল। সৈনিকটি বুক ফুলিয়ে দাড়িয়েছিল। পরে তার মুখের ওপর একগাদা থুথু ছিটিয়ে দিয়ে উল্টো মুখ হয়ে গলি পার হতে লাগল।
বুক টানটান করে পার গলির মাঝখান দিয়ে এগিয়ে চলল। গোরা সৈনিকটি হতবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। মুহুর্ত খানেকের মধ্যে হুশ ফিরে আসতেই পারোকে লক্ষ করে সে তার বন্দুক তাক করল। পাবনা ছিল তার বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল — সবচেয়ে ভীতু। কিন্তু আজ সে সবার সামনে এগিয়ে গিয়ে মৃত্যু বরণ করল।
পারে, জৈন, বেগম, শ্যাম কাউর ……
অন্তঃপুরের নারীরা …… পর্দানশীন নারীরা, তাদের বুকে স্বামীর সোহাগ আর তাদের সন্তানদের জন্যে মমতা-ভরা স্তন নিয়ে অত্যাচারের যে অন্ধকার গলি তা পার হয়েছিল-তাদের দেহ গুলিতে গুলিতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তাদের পা এতটুকু টলেনি। হয়তো সেই মুহুর্তে কারও ভালোবাসা তাদের আহ্বান করেছিল, হয়ত কোন কচি কচি হাত তাদের ডাকছিল, হয়তো কারও ঠোটে মিষ্টি মিষ্টি হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠছিল। কিন্তু তাদের রক্ত ডেকে বলেছিল, “না, মাথা হেঁট কর না। আজ শত সহস্র বৎসর পরে এই ক্ষণটি এসে সারা ভারতবর্ষকে জাগিয়ে তুলেছে — মেরুদণ্ড টানটান করে এই গলি পার হচ্ছে, মাথা উচু করে সামনে এগিয়ে চলেছে।” জৈনব বেগম পারো, শ্যাম কাউর, তোমাদের কে বলেছে এ দেশে সীতা নেই? কে বলেছে এ দেশে সীতা সতী সাবিত্রীর জন্ম হয় না? আজ কাদের পবিত্র রক্তে এই গলির প্রতিটি প্রান্তর উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে? শ্যাম কাউর জৈনব পায়রা বেগম — তোমরাই শুধু মাথা উচু করে এ গলি পার হওনি, তোমাদের দেশও আজ মাথা উচু করে এ গলি পার হচ্ছে। স্বাধীনতার উড্ডীন পতাকাও আজ এ গলি দিয়ে এগিয়ে চলেছে। আজকে তোমাদের দেশ তোমাদের সভ্যতা তোমাদের ধর্মের সর্বস্বীকৃত ঐতিহ্য জীবন্ত হয়ে উঠেছে। মনুষ্যত্বের শির আজ গৰে উন্নত হয়ে উঠেছে। তোমাদের রক্তের প্রতি রইল আমাদের হাজারো সেলাম।
পনেরোই আগস্ট, উনিশ শ’ সাতচল্লিশ। হিন্দুস্থান আর পাকিস্তান স্বাধীনতা কায়েম করল। উনিশ শ’ সাতচল্লিশের পনেরোই আগস্ট সারা হিন্দুস্তান জুড়ে স্বাধীনতার উৎসব পালন হচ্ছে। আর স্বাধীন পাকিস্তান আনন্দে স্লোগান দিয়ে চলেছে।
পনেরােই আগস্ট, উনিশ শ’ সাতচল্লিশ লাহোর দাউ দাউ করে জ্বলছে। আর অমৃতসরে হিন্দু মুসলমান এবং শিখ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বীভৎসতায় ডুবে গিয়েছে। ডুবে গিয়েছে তার কারণ, কেউ-ই পাঞ্জাবের জনসাধারণের কাছে জিজ্ঞেস করেনি, বছরের পর বছর ধরে তোমরা যেভাবে একসঙ্গে আছ সেভাবে থাকবে, না পৃথক পৃথক ভাবে থাকবে। যুগ যুগ ধরে পাঞ্জাবে স্বেচ্ছাচারিতা চলে আসছে, আর সেই স্বেচ্ছাচারীরা কেউ-ই একবারের জন্যে তাদের মতামত চায়নি। পরবর্তী সময়ে ইংরেজরাও এসে পাঞ্জাবে তাদের সাম্রাজ্যের ভিত স্থাপন করেছে। তারাও ভিত স্থাপন করতে গিয়ে ফৌজে পাঞ্জাব থেকে সিপাই আর ঘোড়া নিয়েছে। আর এর পরিবর্তে তারা পাঞ্জাবকে উপহার দিয়েছে শুধু খাল আর পেন্সন। পাঞ্জাবকে তারা থোড়াই জিজ্ঞেস করে এসব করেছে। এর পরে এসেছে রাজনৈতিক জাগরণ এবং এর সঙ্গে সঙ্গে এসেছে গণতান্ত্রিক চেতনা। এই চেতনার সঙ্গে সঙ্গে নেতারা ময়দানে উপস্থিত হয়েছেন। কিন্তু ফয়সালা করার সময়ে তারাও পাঞ্জাবের জনসাধারণকে একটি কথাও জিজ্ঞেস করেননি। একটা মানচিত্র সামনে রেখে এক কলমের আঁচড়ে তারা পাঞ্জাবকে দু’টুকরো করে দিয়েছেন। যে রাজনীতিবিদরা পাঞ্জাবের এই ফয়সালা করলেন তারা হচ্ছেন গুজরাটী আর কাশ্মিরী। তাই পাঞ্জাবের মানচিত্র সামনে ফেলে তার ওপর কলম দিয়ে দাগ কেটে একটা সীমারেখা টানা বিশেষ কোন মুশকিলের ব্যাপার ছিল না।
মানচিত্র একটা নগণ্য জিনিস। আট আট আনায় বা এক টাকায় পাঞ্জাবের মানচিত্র কিনতে পাওয়া যায়। আর সেই মানচিত্রের ওপর কালি দিয়ে একটা দাগ টেনে দেওয়া এমন কী কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এক টুকরো কাগজ আর একটা কলম। একটা কলম — যে কলম পাঞ্জাবের হৃদয়কে দু’টুকরো করেছে সে কীভাবে পাঞ্জাবের দুঃখ অনুভব করবে। তিন তিনটি ধর্মের মানুষ আছে পাঞ্জাবে। কিন্তু তাদের হৃদয় অভিন্ন। তাদের পোশাক তাদের ভাষাও অভিন্ন। তাদের গান তাদের খেতখামার এক। তাদের খেতের রোমান্টিক পরিবেশ, কৃষকদের পঞ্চায়েতি ব্যবস্থাও এক। এক অভিন্ন সভ্যতা, এক অভিন্ন দেশ, এক অভিন্ন জাতীয়তার স্বাক্ষর পাঞ্জাব মনে করিয়ে দেয়। তবে কি উদ্দেশ্যে তার গলায় ছুরি চালানো হল? কিসের জন্যে তার খামার শয়তানি অত্যাচার আর পাশবিক বর্বরতার আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া হল?
“আমরা জানতাম না …… আমরা দুঃখিত …… আমরা এই পাশবিকতার নিন্দা করছি।” এই অত্যাচার এই হাঙ্গামা এই অমানুষিক বর্বরতার যারা হোতা — যারা পাঞ্জাবের ঐক্যকে ধ্বংস করতে চেয়েছে আজ তাদেরই চোখে কুম্ভীরাশ্রু। পাঞ্জাবের সন্তানরা আজ দিল্লীর অলি-গলিতে, করাচীর হাটে-বাজারে ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছে। তার মেয়েদের সতীত্ব লুণ্ঠন করা হয়েছে। তার খেত উজাড় হয়ে পড়ে রয়েছে। হিন্দুস্থান আর পাকিস্তানের সরকার বলছে, শরণার্থীদের জন্যে তারা বিশ কোটি টাকা খরচ করেছে। এই বিশ কোটি টাকা। এক কোটি শরণার্থীর মাথাপিছু পড়ছে বিশ টাকা। আমাদের চোদ্দ পুরুষের জন্যে তোমরা অনেক কিছু করেছ। তবে, আমরা তো মাসে বিশ টাকার লস্যি খাই। কয়েকদিন আগেও হিন্দুস্থানের সমস্ত কৃষকের মধ্যে যারা ভালোভাবে থাকত, আজ তাদেরই তোমরা খয়রাতি দিচ্ছ।
তোমরা যারা গণতন্ত্রের ধারক এবং বাহক, তোমরা কি একবারের জন্যেও পাঞ্জাবের কৃষক ছাত্র খেতমজুর দোকানদার তাদের মা স্ত্রী আর কন্যাকে জিজ্ঞেস করেছ : এই নকশায় যে কালির আঁচড় টানছি সে সম্পর্কে তোমার মতামত কী? এ নিয়ে তাদের ভাবনার কী আছে! পাঞ্জাব যদি তাদের নিজের দেশ হত, তাদের দুঃখ এবং গান হত, তবে তারা অনুভব করত এ ভুলের পরিণাম কী। এ দুঃখ-কষ্ট কে সহ করবে!
এ দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষেই অনুভব করা সম্ভব, যে হীর-রহ্মার বিচ্ছেদ দেখেছে, যে সোনী আর মহিবালকে বিরহে ছটফট করতে দেখেছ, যে পাঞ্জাবের খেতে আপন হাতে গমের সবুজ সবুজ দানা ফলিয়েছে আর কাপাসের ফুলে ছোট চাঁদকে ঝিলিক দিতে দেখেছে। এসব রাজনীতিবিদরা কীভাবে এই দুঃখকে বুঝবে। ওরা যে গণতন্ত্রকামী রাজনীতিজ্ঞ।
এই ক্রন্দন — এই মৃত্যু তো শাশ্বত। মানুষ হিসেবে মাথা তুলে দাড়ানন এখনও অনেক দিন বাকী আছে। আর গল্পকারের গল্প ফাদার মধ্যে এমন কোন কারুকার্য নেই যে, তাকে জীবন জ্ঞান শিল্প বিজ্ঞান ইতিহাস দর্শন — এসব নিয়ে ভাবতে হবে। পাঞ্জাবের মৃত্যু হল, কি সে বেঁচে থাকল তাতে তার কী আসে যায়। মেয়েদের ইজ্জত গেল, কি থাকল; শিশুদের গলায় ছুরি চালানো হচ্ছে, না মমতামাখানো ঠোট তাকে চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিচ্ছে — এসব তার কাছে প্রয়োজনহীন ছাড়া আর কিছু নয়। এ সমস্ত কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে সে তার গল্প বলার জন্যে উৎসুক। এমন সব ছোট-মোট গল্প সে বলতে চায়, যে গল্প মানুষের হৃদয়কে আলোড়িত করে — উৎফুল্ল করে! এত বড় বড় গাল গল্প তার শোভা পায় না।
হাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। এখন তাই অমৃতসরের স্বাধীনতার কাহিনী শুনুন। অমৃতসরের কাহিনী — যেখানে জালিয়ানওয়ালাবাগ আছে। যেখানে উত্তর ভারতের সবচেয়ে বড় বাজার আছে — শিখদের সবচেয়ে পবিত্র গুরুত্বার আছে। যেখানে জাতীয় আন্দোলনে হিন্দু এবং শিখরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে একের পর এক বিরাট সংগ্রাম করেছে। আর তাই বোধহয় বলা হয়, লাহোর হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দুর্গ, অমৃতসর জাতীয়তার কেন্দ্রস্থল। সেই জাতীয়তার কেন্দ্রস্থল অমৃতসরের কাহিনী শুনুন।
উনিশ শ’ সাতচল্লিশের পনেরোই আগস্ট, অমৃতসর স্বাধীন হয়। প্রতিবেশী লাহোর তখন জ্বলছে। কিন্তু অমৃতসর স্বাধীন। অমৃতসরের প্রতিটি বাড়িতে দোকানে বাজারে তে-রঙা পতাকা পতপত করে উড়ছে। অমৃতসরের জাতীয় মুসলমানরা স্বাধীনতার এ উৎসবে সামনের সারিতে ছিল। কারণ স্বাধীনতার আন্দোলনেও তারা ছিল সামনের সারিতে। এ অমৃতসর শুধু আকালী আন্দোলনের অমৃতসর নয়। কিংবা ডাক্তার সত্যপালের অমৃতসরও নয়। এ অমৃতসর কিচলু আর এহসাম-উদ্দীনের অমৃতসর। আজকে সেই অমৃতসর স্বাধীন। আর তার জাতীয়তার সুগভীর পরিবেশে স্বাধীন ভারতবর্ষের স্লোগান গুঞ্জরিত হচ্ছে। অমৃতসরের হিন্দু মুসলমান শিখ সবাই আজ মুখরিত। জালিয়ানওয়ালাবাগের শহীদরা আজ জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
সন্ধ্যার সময় স্টেশনে যখন আলো জ্বলে উঠল, ঠিক তখন স্বাধীন হিন্দুস্থান আর স্বাধীন পাকিস্তান থেকে দুটি স্পেশাল ট্রেন এল। পাকিস্তান থেকে যে ট্রেন এসেছিল তাতে ছিল হিন্দু আর শিখ। আর হিন্দুস্থানথেকে যে ট্রেন পাকিস্তানে যাচ্ছিল তাতে ছিল মুসলমানরা। দুটো ট্রেনেই দু-তিন হাজার করে লোক ছিল। মোট ছ’-সাত হাজার লোকের মধ্যে মাত্র দু হাজারই তখন পর্যন্ত বেঁচে আছে। বাদবাকী সবাই মৃত। তাদের ধড় থেকে মাথা আলাদা। মাথাগুলো গাড়ির জানলায় সার করে ভালায় গেঁথে রেখে দিয়েছে।
পাকিস্তান স্পেশালে বড় বড় হরফে লেখা : “কীভাবে হত্যা করতে হয় তা পাকিস্তানের কাছ থেকে শেখ।” আর হিন্দুস্থান স্পেশালে হিন্দীতে লেখা : “প্রতিশোধ নেওয়া হিন্দুস্থানের কাছ থেকে শেখ।”
পাকিস্তান স্পেশালের দশা দেখে হিন্দু আর শিখরা উন্মাদের মতো হয়ে উঠল। “দেখ জালিমরা আমাদের ভাইদের সঙ্গে কী বেইমানী করেছে। হায়, ওরা হিন্দু আর শিখ শরণার্থী।”
হিন্দু আর শিখ শরণার্থীদের অবস্থা দেখে তারা ছটফট করতে লাগল। তারা শরণার্থীদের তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে রিফিউজি ক্যাম্পে পৌছে দিল। পৌছে দিয়ে হিন্দু আর শিখরা গাড়ির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আহত আর অর্ধমৃত এই শরণার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়াকে যদি আক্রমণ বলে অভিহিত করতে চান তবে তা আক্রমণ। এই আক্রমণে অর্ধেক মানুষের মৃত্যুর পর মিলিটারি আসে এবং অবস্থা আয়ত্তে আনে। গাড়িতে এক বৃদ্ধা বসেছিল। বৃদ্ধার কোলে ছিল তার শিশু নাতি। পথে তার ছেলের মৃত্যু হয়েছিল। ছেলের বউকে জাঠরা অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছে। আর তার স্বামীকে ভালা দিয়ে দু’টুকরো করেছে। বৃদ্ধা নিশ্চপ-নিথর হয়ে বসেছিল। তার ঠোটেও ব্যথার কোন কম্পন ছিল না। চোখের জলও শুকিয়ে গিয়েছিল। হৃদয়েও কোন কাতর প্রার্থনা নেই। তার যে বিশ্বাস, সেই বিশ্বাসে সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। এক নির্বাক পাথরের মূর্তির মতো সে এসেছিল। যেন সে বধির — অন্ধ। যেন সে অনুভূতিহীন এক
জরদগব।
কোলের শিশুটি তার দাদিকে বলল, “দাদি, জল।”
দাদি নির্বাক।
শিশুটি আবার বলল, “দাদি আম্মা, জল দাও।”
দাদি আম্মা শিশুটিকে বলল, “এখানে জল কোথায় পাবি, পাকিস্তান আসুক, জল দেব।”
শিশুটি তার দাদিকে জিজ্ঞেস করল, “দাদি, হিন্দুস্থানে কি জল নেই?’’
“না বাছা, আমাদের দেশে এখন জল নেই।”
শিশুটি তার দাদিকে আবার জিজ্ঞেস করল, “হিন্দুস্থানে কেন জল নেই দাদি? আমার যে খুব তেষ্টা পেয়েছে। আমি জল খাব। দাদি, জল। জল খাব।”
এক আকালী ভলান্টিয়ার সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। শিশুটির কথা শুনে সে রক্তবর্ণ দৃষ্টিতে শিশুটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কিরে, জল খাবি?”
শিশুটি মাথা কাত করে বলল, “হ্যাঁ।”
দাদি আম্মা ভয়ে আকালী ভলান্টিয়ারকে বলল, “না, না, ও আপনাকে কিছু বলেনি – ও কিছু চাইছে না। সর্দারজী, খোদার কাছে আজি করছি, ওকে ছেড়ে দিন। এ ছাড়া আমার আর কিছু নেই।”
আকালী ভলান্টিয়ার হেসে উঠল। সে পাদানি থেকে ফোটা ফোটা রক্ত তার করতলে তুলে শিশুটির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “তেষ্টা। পেয়েছে, না? খা। খুব সুন্দর রক্ত-মুসলমানের রক্ত।”
দাদি আম্মা এক ঝটকায় পেছনে সরে গেল। শিশুটি কাদতে লাগল। বাচ্চাটিকে তার পেছনে আড়াল করে দাদি আম্মা তাকে আঁচল দিয়ে ঢেকে দিল। আকালা ভলান্টিয়ার হাসতে হাসতে চলে গেল। দাদি আম্মা ভাবতে লাগল — গাড়ি কখন ছাড়বে। আল্লা, পাকিস্তানে কথন পেীছব।
একজন হিন্দু জলের গ্লাস নিয়ে এল। “নাও, একে জল খাইয়ে দাও।‘’
শিশুটি জলের গ্লাস নেওয়ার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল। তার ঠোট থরথর করে কাপছিল। চোখ দুটি যেন ঠিকরে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। তার দেহের প্রতিটি রােমকূপ তৃষ্ণায় ছটফট করছিল।
হিন্দুটি তার প্রসারিত হাতটি একটু টেনে নিল। টেনে নিয়ে বলল, “এ জলের দাম আছে। মুসলমানের বাচ্ছাকে মাগনা জল দেওয়া হয় না। এই এক গ্লাস জলের দাম পঞ্চাশ টাকা।”
দাদি আম্মা নম্রতার সঙ্গে বলল, “পঞ্চাশ টাকা! বাবা, আমার কাছে এক কানা কড়িও নেই। পঞ্চাশ টাকা আমি কোথেকে দেব।”
“জল …… জল …… আমাকে জল দাও। …… এক গ্লাস জল দাও …… দাদি আম্মা, দেখ আমাকে জল দিচ্ছে না।”
ট্রেনের অন্য একজন যাত্রী বলল, “দাও, ….. আমাকে দাও। এই নাও পঞ্চাশ টাকা।”
হিন্দুটি হাসতে লাগল, “পঞ্চাশ টাকা দাম তো বাচ্ছার জন্যে। তোমাকে দিতে হবে একশ’ টাকা। একশ’ টাকা দাও আর এই জল নাও।
“বেশ তাই হবে। এই নাও একশ’ টাকা।”
যাত্রীটি তাকে একশ টাকা দিয়ে এক গ্লাস জল নিল। নিয়ে ঢাকঢক করে খেতে লাগল ।
তাকে জল খেতে দেখে শিশুটি গলা ছেড়ে দিতে লাগল। “জল, জল, দাদি আম্মা জল দাও।”
মুসলমান যাত্রীটি ঢকঢক করে জল খেয়ে গ্লাসটি খালি করে চোখ বন্ধ করল। গ্লাসটি তার হাত থেকে ছিটকে ট্রেনের মেঝেতে পড়ে গেল। যে দু-এক ফোটা জল গ্লাসে অবশিষ্ট ছিল মেঝেতে পড়ল।
শিশুটি কোল থেকে ঝাপিয়ে সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। প্রথমে সে খালি গ্লাসটা চাটল। তারপর মেঝের ওপর যে দু-এক ফোঁটা জল পড়েছিল তা সে জিভ দিয়ে চাটতে লাগল। তারপর সে চীৎকার করে কাঁদতে লাগল, “দাদি আম্মা জল, জল দাও।”
সেখানে জল ছিল, আবার নেই-ও। হিন্দু শরণার্থীরা জল খাচ্ছিল। আর মুসলমান শরণার্থীদের প্রাণ তেষ্টায় কাতর। প্লাটফরমের ওপর সার সার কলসি ভর্তি জল। নল খোলা। মেথররা শৌচ কাজের জন্যে হিন্দু শরণার্থীদের জল দিচ্ছিল। কিন্তু মুসলমান শরণার্থীদের জন্যে কোন জল নেই। কারণ পাঞ্জাবের মানচিত্রের ওপর কালো মৃত্যুর একটা দাগ টানা হয়েছে। তাই গতকালের যে ভাই আজ সে দুশমন। গতকাল যাকে বোন বলে সম্বোধন করেছি, আজ সে আমাদের কাছে বেশ্যারও অধম। গতকালও যে মা ছিল আজ সে ডাইনী হয়ে গিয়েছে। আর তার সন্তান সেই ডাইনীর গলায় ছুরি চালিয়ে দিচ্ছে।
জল হিন্দুস্থান এবং পাকিস্তান দু’জায়গাতেই ছিল। কিন্তু আজ জল কোথাও নেই। কারণ চোখের জল যে শুকিয়ে গিয়েছে। আর এই দুটি দেশই আজ ঘৃণার মরুভূমি হয়ে গিয়েছে-ঝড়-ঝঙ্কায় কাফিল ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।
জল ছিল। কিন্তু সে জল আজ মৃগ মরীচিকার মতো। যে দেশে লস্যি আর দুধ জলের মতো প্রবাহিত হয়, আজ সেখানে জলের অভাব। আর তার সন্তান এক ফোটা জলের জন্যে কাতরাচ্ছে। কারণ সেখানে জল আছে আবার নেই-ও। পাঞ্জাবে পাচ পাঁচটি নদী বয়ে চলেছে, কিন্তু হৃদয়ের যে নদী সে নদী শুকিয়ে গিয়েছে। তাই জল আছে আবার নেই-ও।
এরপর এল স্বাধীনতার রাত্রি। দীপাবলিও এত রোশনাইতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে না। কারণ দীপাবলিতে শুধু প্রদীপের আলো জলে। কিন্তু আজকে বোমা ফাটছে — মেশিনগান চলছে। ব্রিটিশ রাজত্বে ভুলেও কোথাও একটা রিভলবার পাওয়া যেত না। কিন্তু স্বাধীনতার প্রথম রাত্রেই না জানি কোথা থেকে এত বোমা হ্যাণ্ডগ্রেনেড মেশিনগান ব্রেনগান স্টেনগানের গুলি ফুলঝুরির মতো ঝরতে লাগল। এসবই ব্রিটিশ আর আমেরিকান কোম্পানীর তৈরি। আর স্বাধীনতার প্রথম রাত্রেই তা হিন্দুস্থান এবং পাকিস্তানের অন্তস্থলকে এফেঁড় ওফোড় করে দিচ্ছে। লড়ে যাও বাহাদুররা, মর বাহাদুরের মতো। তোমাদের লড়াই-এর জন্য আমরা অস্ত্র তৈরি করব। শাবাস বাহাদুর, দেখ, যেন আমাদের গোলা বারুদের কারখানার মুনাফায় টান না পড়ে। বেশ ভালো হয় এমন জোর লড়াই চললে। চীনারা লড়াই করছে, হিন্দুস্থান পাকিস্তান কেন লড়াই করবে না। ওরাও এশিয়ান, তোমরাও এশিয়ার। দেখ, যেন এশিয়ার ইজ্জত নষ্ট না হয়। বাহাদুরা লড়াই চালিয়ে যাও। তোমরা লড়াই বন্ধ করে দিলে এশিয়ার চেহারা পালটে যাবে। আমাদের মুনাফা, আমাদের হিস্যা আমাদের নির্বিঘ্নের সাম্রাজ্য সংকটে পড়ে যাবে। বাহাদুররা জোর গড়ে যাও। আগে তোমরা আমাদের দেশ থেকে কাপড়, কাচের জিনিসপত্র, সেন্ট ইত্যাদি আমদানি করতে, এখন আমরা তোমাদের বোম এরোপ্লেন কার্তুজ পাঠাব। কারণ এখন তোমরা স্বাধীন।
সশস্ত্র হিন্দু আর শিখদের যৌথ বাহিনী মুসলমানদের বাড়ি-ঘরে আগুন লাগাচ্ছিল আর উল্লাসে জয়ধ্বনি দিচ্ছিল। আর মুসলমানরা ঘরে লুকিয়ে আক্রমণকারীদের ওপর মেসিনগান চালাচ্ছিল এবং হ্যাগুগ্রেনেড ছুঁড়ছিল।
স্বাধীনতা আর স্বাধীনতার পর তিন-চারদিন ধরে এই রকমের মোকাবিলা চলল। আর শিখ এবং হিন্দুদের মদত দেওয়ার জন্যে আশপাশের সমস্ত অঞ্চল থেকে দলে দলে আসতে লাগল। মুসলমানরা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে শুরু করল। বাড়ি-ঘর মহল্লা বাজার দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের বাড়ি-ঘরই বেশী পুড়ল। আর হাজার হাজার মুসলমান দল বেঁধে শহর ছেড়ে পালাতে লাগল। এরপর যা কিছু ঘটেছে তাকে ইতিহাসে অমৃতসরের হত্যাকাণ্ড বলে অভিহিত করা হবে।
কিন্তু অবস্থা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মিলিটারি আয়ত্বে নিয়ে আসে। হত্যাকাণ্ড বন্ধ হল সত্য। তবে হিন্দু আর মুসলমানরা আলাদা আলাদা ক্যাম্পে নিজেদের বন্দী করে রিফিউজি হল। হিন্দুরা নিজেদের ‘শরণার্থী আর মুসলমানরা নিজেদের ‘পনাহগুঁজি’ বলে অভিহিত করতে লাগল। তাদের উভয়ের ওপর একই দুরবস্থা নেমে এসেছিল। কিন্তু তাদের এই নাম তাদের অস্তিত্ব থেকে পৃথক করে দিয়েছিল — হাজার দুঃখ কষ্টেও যেন তারা আর এক জায়গায় মিলিত হতে না পারে। তাদের ক্যাম্পের ওপর কোন ছাদ ছিল না। কোন আলো বিছানা এবং শৌচাগারের ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু এক ক্যাম্পকে বলা হত হিন্দু আর শিখ শরণার্থীদের ক্যাম্প’ অটিকে মুসলমান মহাজরিনদের ক্যাম্প।
হিন্দু শরণার্থী ক্যাম্পে স্বাধীনতার প্রথম রাত্রেই এক অসুস্থ সন্তানের সামনে তার মা প্রচণ্ড জ্বরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময়েও সংগ্রাম করে চলেছিল। তারা পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে এসেছে। পনেরো জনকে নিয়ে ছিল এই সম্রান্ত পরিবার। পাকিস্তান থেকে হিন্দুস্থানে পৌছতে পৌছতে তারা মাত্র দু’জনই অবশিষ্ট থেকে গিয়েছে। আর এই দু’জনের একজন অসুস্থ — অন্যজন মৃত্যু পথযাত্রী।
পনেরো জনের এই কাফিলা যখন ঘর-বাড়ি ছেড়ে পথে বের হয়, তখন তাদের সঙ্গে বিছানা, বাসন-কোসন, কাপড় ভfত ট্রাঙ্ক, টাকা, গয়না আর বাচ্ছার একটা সাইকেল ছিল। তারা ছিল মোট পনেরো জন।
গুজরাওয়ালা পর্যন্ত আসতেই কমতে কমতে দশজন হয়ে গিয়েছিল। প্রথমে টাকা-পয়সা যায়। তারপর একে একে যায় গয়না এবং মেয়েদের ইজ্জত।
তারা যখন লাহোরে এসে পেঁছিল, তখন তাদের কাফিলায় আর মাত্র ছ’জন বেঁচে আছে। পথে কাপড়-চোপড়, ট্রাঙ্ক, বিছানাপত্র লুট হয়ে যায়। আর সাইকেল কেড়ে নিয়ে যাওয়াতে বাচ্চাটির মনে খুব দুঃখ হয়।
মোগলপুরা তারা যখন ছাড়ল, তখন মাত্র তারা দুজনই বেঁচে। মা আর ছেলে। আর অবশিষ্ট ছিল মাত্র একটা কম্বল। যে কম্বলটি মা জ্বরের জন্য গায়ে জড়িয়ে আছে। এখন, এই রাত্রির দ্বিপ্রহরে স্বাধীনতার প্রথম রাত্রে, মহিলাটি শেষ নিঃশ্বাস ফেলার অপেক্ষায় ছিল। আর তার সন্তান মায়ের শিয়রের কাছে নিশ্চুপ বসে জ্বরে আর শীতে থরথর কঁপছিল। আর কখন নিজের অজান্তেই তার চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিল।
মা শেষ নিঃশ্বাস ত্য:গ করলে, সে ধীরে ধীরে তার মার গা থেকে কম্বলটা টেনে নিল। এবং নিজের গায়ে জড়িয়ে ক্যাম্পের অন্য দিকে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পরে একজন স্বয়ংসেবক তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “ঐ …… ঐ দিকে যে মরে পড়ে আছে সে তোমার মা ?”
– “না, না, আমি কিছু জানি না, চিনি না ওকে।” ছেলেটি ভয়ে কাপতে কাপতে বলল। তারপর কম্বলটাকে আরও ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে সে স্বয়ংসেবকটিকে বলল, “ও আমার মা নয়, এই কম্বল আমার। এটা আমার-কম্বল আমি কাউকে দেব না। এ কম্বল আমার।”
চীৎকার করে সে বলতে লাগল, “না, ও আমার মা নয়। এটা আমার কম্বল। কাউকে আমি এ কম্বল দেব না। আমি সঙ্গে করে এনেছি … এ কম্বল আমি দেব না, কিছুতেই দেব না।”…
একটি কম্বল, একজন মা, একটি মৃত মনুষ্যত্ব। কে কোন্ দিন ভাবতে পেরেছিল, এমন এক কলঙ্কের গল্প আপনাদের কাছে আমাকে বলতে হবে।
মুসলমানরা যখন পালাতে লাগল, তখন লুটতরাজ শুরু হয়ে গেল। দু-একজন যারা সৎ মানুষ ছিলেন, তারাই শুধু লুটতরাজে যাননি।
স্বাধীনতার তৃতীয় দিন। আমি গলি ধরে বড় রাস্তার জলের কলে গরুকে জল খাওয়াতে নিয়ে চলেছি। এক হাতে বালতি, অন্য হাতে গরুর দড়ি। গলির মোড়ের কাছে মিউনিসিপ্যালিটির ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে গরুকে বেঁধে জল আনার জন্যে কলের দিকে পা বাড়ালাম। জল ভরে ফিরে এসে দেখি গরু উধাও। চারদিকে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলাম, কিন্তু কোথাও গরুটার হদিস পেলাম না। হঠাৎ সামনের একটা বাড়ির উঠোনে আমার চোখ গিয়ে পড়ল। দেখলাম উঠোনে আমার গরুটা বাঁধা রয়েছে। কোন দ্বিরুক্তি না করে সেই বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লাম।
বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই এক সর্দারজী বেশ তিরিক্ষি মেজাজে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “এই যে ভাই সাহাব, এখানে কেন ?”
বললাম, “সর্দারজী এ গরু আমার। এইমাত্র গরু বেঁধে আমি জল আনতে গিয়েছিলাম। আর …”
সর্দারজী মুচকি হেসে বলল, “আরে ভাই, তাতে কী হয়েছে, ভেবেছিলাম গরুটা কোন মুসলমানের। গরু আপনার হলে নিয়ে যান।”
বলতে বলতে সর্দারজী গরুর দড়ি খুলে আমার হাতে দিল।
গরু নিয়ে আমি যখন ফিরছি, সর্দারজী আবার আমার কাছে ক্ষমা চাইল, “মাফ করবেন, ভেবেছিলাম কোন মুসলমানের গরু বুঝি।”
ঘটনাটা বন্ধ সর্দার সুন্দর সিংকে বলতেই, তিনি সশব্দে হেসে উঠেছিলেন।
আমি তাকে বললাম, “আচ্ছা মজা তো, এতে হাসির কী আছে বলুন তো।” আমার কথা শুনে তিনি আরও জোরে হেসে উঠলেন।
সুন্দর সিং কমিউনিস্ট। তাই সাম্প্রদায়িকতা থেকে তিনি বহু ঊর্ধে। আমার বন্ধুদের মধ্যে যারা লুটতরাজে যাননি সুন্দর সিং তাদের মধ্যের একজন।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “ঘটনাটিকে কি আপনি সমর্থন করেন ?”
তিনি বললেন, “না, না, সেজন্যে নয়। হাসছিলাম তার কারণ, আজকে সকালে এমনই একটা ঘটনা আমারও ঘটেছে। হাল বাজার দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হল সামনের কাটাতে সর্দার সবো সিং থাকেন, একবার তার সঙ্গে দেখা করে যাই। পুরনো গদর পার্টির নেতা ছিলেন। নিজের গ্রামে তিনি তিন-চার শ’ মুসলমানকে আশ্রয় দিয়েছেন। ভাবলাম, দেখি তাদের কী হাল। কোন রকমে মুহাজিরিন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা।
“ভাবতে ভাবতে মহম্মদ রজাকের জুতার দোকানের (যে দোকানটা সম্প্রতি লুট হল ) সামনে গাড়ি দাড় করিয়ে কাটাতে ঢুকলাম। বৃদ্ধ সর্দারজী বাড়িতে ছিলেন না বলে কয়েক মিনিটের মধ্যে ফিরে এলাম। ফিরে এসে দেখি গাড়ি সেখানে নেই। আরে! এইমাত্র তো এখানে দাড় করিয়ে গেলাম। জিজ্ঞাসাবাদ করেও গাড়ির কোন হদিস মিললনা। ইতিমধ্যে হাল বাজারের শেষ প্রান্তে গিয়ে আমার চোখ পড়ল। দেখলাম, আমার গাড়ি সেখানে দাড় করানো। একটা জিপের পেছনে বাঁধা।
দৌড়তে দৌড়তে সেখানে হাজির হলাম। দেখলাম এক বিখ্যাত কংগ্রেসী কর্মকর্তা সর্দার – সিং জিপে বসে আছেন। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় চললেন ?”
তিনি বললেন, “নিজের গ্রামে যাচ্ছি।”
“এই মোটরটাও কি আপনার সঙ্গে গ্রামে যাচ্ছে।”
“কোন মোটরের কথা বলছেন? ও, যেটা জিপের পেছনে বাঁধা রয়েছে। এটা আপনার মোটর? আরে দোস্ত, মাফ করে দিন, এটা আপনার মোটর তা চিনতে পারিনি। মহম্মদ রজাকের দোকানের সামনে দাড় করানো ছিল, ভাবলাম কোন মুসলমানের গাড়ি। তাই জিপের পেছনে বেঁধে নিয়েছি। হা হা কী কাণ্ড। বাড়িতেই নিয়ে যাচ্ছিলাম বুঝলেন। ভালই হয়েছে, আপনি ঠিক সময় এসে পড়েছেন।
দড়ির বাঁধনটা খুলে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এখন ফের কোথায় যাচ্ছেন ?”
“এখন..? যাব কোথাও! কোন না কোন মাল ঠিকই জুটে যাবে।”
সর্দার সিং ছিলেন কংগ্রেসী কর্মকর্তা। একদিন তিনি খেসারত দিয়েছেন, রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্যে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ঘটনাটা আমাকে শুনিয়ে সুন্দর সিং বলছিলেন, “উঃ ব্যাধিটা এমন বিস্তার লাভ করেছে। — সৎ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবকরাও এই সংক্রামক ব্যাধি থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারেননি। এমন কি আমাদের যে পার্টিগুলো আছে, তার কর্মীদেরও একটা অংশ এই লুটতরাজ হত্যা বা ভাঙচুরে সামিল হয়ে গিয়েছে। এই মুহূর্তে যদি এসব বন্ধ করা না যায় তবে দুটো পার্টিরই ফাসিস্ট পার্টিতে পরিণত হতে খুব বেশী দিন লাগবে না। দু-চার বছরের মধ্যেই সেটা হয়ে যাবে।
সুন্দর সিংএর চেহারায় চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। আমি তার কাছ থেকে চলে এলাম। পথে খালসা কলেজ রোডে এক ধনী মুসলমানের বাড়ি লুট হচ্ছিল। আমার নাকের ডগা দিয়ে এক একা গাড়ি ভর্তি লুটের মাল নিয়ে যেতে লাগলো এবং মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমার চোখের সামনে সর্বত্র লুটপাট শুরু হয়ে গেল। শিখ আর হিন্দু যারা এই পথ দিয়ে যাচ্ছিল তারাও লুট করার জন্যে বাড়িগুলোর দিকে ছুটল। কিন্তু পুলিসদের বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে তারা প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেল।
পুলিশের কাছেও কিছু লুটের মাল আর একটা সিঙ্কের টাই ছিল। আর একটা কোটের হ্যাঙ্গারে মাফলার ঝুলছিল। লোকদের দিকে তাকিয়ে তারা হেসে বলল, “কোথায় যাচ্ছ? কিছুই আর নেই, সব আগেই সাফ হয়ে গেছে।” একজন ভদ্রলোক, দেখে আর্যসমাজের লোক বলে মনে হল, তিনি বাড়িটার দিকে ছুটে গিয়েছিলেন। ফিরে আসার সময় আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “দেখেছেন মশায়, দুনিয়া কেমন উন্মাদ হয়ে গিয়েছে।”
এক দুধওয়ালা যাচ্ছিল। দেখলাম, বেচারার ভাগে গোটা কয়েক বই পড়েছে। বই কটা নিয়েই সে হাঁটা দিয়েছে।
তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “বই নিয়ে কি করবে? পড়তে জান?”
“না, বাবু।”
“তবে যে বড় নিয়ে যাচ্ছ?”
বইগুলোর দিকে সে কুদ্ধভাবে তাকাল। তাকিয়ে বলল, “কি করব বাবু, যেখানেই যাই, দেখি আগে-ভাগেই ভালো ভালো জিনিস সব সাফ হয়ে গেছে। আমারই বদনসীব বাবু।”
সে আবার বইগুলোর দিকে কুদ্ধভাবে তাকাল। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছিল বইগুলো সে ছুড়ে ফেলে দেবে। কিন্তু তার সেই ভাব পালটে গেল। বলল, “মোটা মোটা বই আছে, উনুনে জ্বালানি করব। রাতের খাবার তৈরি করতে আর কাঠের দরকার হবে না।”
খুব ভালো ভালো বই ছিল। আরিস্টটল, সক্রেতিস, প্লেটো, রুশো সেক্সপিয়র — বিলকুল উনুনে গেল।
দিনের তৃতীয় প্রহরের দিকে হাট-বাজার নিস্তব্ধতায় হেয়ে যেতে লাগল। কার্ফু শুরু হবে। জলদি জলদি কুচা রামদাস থেকে বেরিয়ে পড়লাম। পথে গুরুদ্বার। গুরুদ্বারের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মাথা হেঁট করলাম। সামনেই অন্ধকার গলি। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের সময় হাঁটু ভেঙে এই গলি পার হতে বাধ্য করা হয়েছিল। ভাবলাম আজকে বরং এই গলি দিয়েই হেঁটে যাই। এ পথ দিয়ে যাওয়াই ঠিক হবে।
আমি গলির দিকে এগিয়ে চললাম।
গলিটি ছিল সরু। দিনের বেলাতেও প্রায় অন্ধকার। এই গলিতে আট দশ ঘর মুসলমান থাকত। মুসলমানদের সমস্ত বাড়িই লুট করা হয়েছে — জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। দরজাগুলো হাট করে খোলা, জানলাগুলো ভাঙা, কোন কোন বাড়ির ছাদ পুড়ে গেছে। গলিতে কেমন একটা নিস্তব্ধতা। রাস্তায় মেয়েদের লাশ পড়ে রয়েছে।
ফিরে যাওয়ার জন্যে সবে পা বাড়িয়েছি এমন সময় একটা গোঙানি শুনতে পেলাম। গলির মাঝখানে যে মৃতদেহগুলো পড়েছিল তার মধ্য থেকেই এক বৃদ্ধা ঘসটাতে ঘসটাতে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিল ! এগিয়ে গিয়ে আমি তাকে তুললাম।
“বাবা জল।”
অঞ্জলি ভরে আমি জল নিয়ে এলাম। গুরুদ্বারের সামনেই জলের কল ছিল।
“খোদা তোমাকে রহম করুক বাবা। তুমি কে ? — তুমি যেই হও না কেন খোদা তোমাকে রহম করুক। আমি এক মৃত্যু পথযাত্রী। বাবা, তুমি খোদার রহমতের কথা ভুলো না।”
আমি তকে ওঠাতে ওঠাতে জিজ্ঞেস করলাম, “মা তোমার কোথায় আঘাত লেগেছে?”
বৃদ্ধা বলল, “আমাকে উঠিও না। এখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে দাও — আমার ছেলের বউ আমার মেয়েদের মাঝখানে। তুমি। জিজ্ঞেস করছ, কোথায় আমার আঘাত লেগেছে? আঘাত, এই আঘাত যে খুব গভীরের, বাছা। এই ক্ষত যে হৃদয়ের অন্তস্থলে। খুব গভীর ক্ষত। এই ক্ষতের গভীরতা তোমরা কীভাবে মাপবে। জানি না, খোদা কেমন করে এদের ক্ষমা করবে।”
‘মা, আমাদের ক্ষমা করে দাও।”
বৃদ্ধা যে আমার কথা শুনতেই পেল না। সে আপন মনে বলে চলল, – “প্রথমে ওরা আমার স্বামীকে হত্যা করেছে, তারপর বাড়ি লুট করেছে। লুট করার পর টানতে টানতে আমাকে এই গলিতে নিয়ে আসে — এই পবিত্র গুরুদ্বারের সামনে। যে গুরুদ্বারকে আমরাও প্রতিদিন মাথা হেঁট করে শ্রদ্ধা জানাই। ওরা আমার ইজ্জত নিল, তারপর গুলি করল। বলল, আমি তো ওদের ঠাকুরমার বয়সী! তবু ওরা আমাকে রেহাই দিল না।”
ধীরে ধীরে সে আমার জামার আস্তিন চেপে ধরল : “তুমি কী জান এই অমৃতসর আমার শহর। যেমন মসজিদকে সেলাম করি, তেমনি প্রতিদিন এই গুরুদ্বারকে সেলাম করি। আমরা এই গলিতে হিন্দু মুসলমান শিখ সবাই একসঙ্গে ছিলাম। কত পুরুষ ধরে আমরা এখানে একসঙ্গে বসবাস করছি। আমরা পরস্পরকে ভালোবাসতাম, আমাদের মধ্যে ছিল প্রীতির সম্পর্ক। এখানে কোনদিন কিছু হয়নি।”
“মা, আমাদের ধর্মের লোকদের তুমি ক্ষমা করে দাও।”
“তুই জানিস আমি কে? আমি জৈনবের মা। জৈনব কে জানিস? জালিয়ানওয়ালাবাগের দিনে গোরা সৈনের সামনে দিয়ে মাথা এতটুকু হেঁট না করে সে এই গলি বুক টান করে পার হয়েছিল। নিজের দেশ আর জাতির ইজ্জতের জন্যে সে মাথা উচু করে এ গলি দিয়ে হেঁটে গিয়েছিল। এ সেই স্থান যেখানে জৈনব শহীদ হয়েছিল।
“আমি সেই জৈনবের মা। এত সহজে আমি তোদের ছাড়ব না। আমাকে উঠে দাঁড়ানোর জন্যে সাহায্য কর। আমি আমার লাঞ্ছিত আবরু, আমার পুত্রবধু আর কন্যাদের বেইজ্জতি নিয়ে লীডারদের কাছে হাজির হব। আমাকে তুই ধর। আমি তাদের বলব, আমি জৈনবের মা-আমি অমৃতসরের মা। আমি পাঞ্জাবের মা। তোমরা আমার কোল খালি করে দিয়েছ। এই বৃদ্ধ বয়সে আমার মুখে কালি ঢেলেছ। আমার যুবতী পুত্রবধূ আর কন্যাদের পবিত্র রক্তকে জাহান্নামের আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে দিয়েছ। আমি তাদের কাছে জিজ্ঞেস করব, এই স্বাধীনতার জন্যেই কি জৈনব তার প্রাণ উৎসর্গ করেছিল? আমি আমি জৈনবের মা। ……”
বলতে বলতে সে আমার কোলের ওপর ঢলে পড়ল। তার মুখ দিয়ে রক্তের ধারা অবিরাম গড়িয়ে পড়ছিল। কিছুক্ষণ পরে মা শেষ নিঃশ্বাস ফেলল।
জৈনবের মা আমার কোলে শেষ নিঃশ্বাস ফেলল। আমার জামায় তার রক্ত। জীবন থেকে মৃত্যুর দিকে আমি উকি দিতে লাগলাম। আমার মানসচোখে সিদ্দিক ওমপ্রকাশ আর জৈনবের গর্বিত মুখ ভেসে উঠল। শহীদরা বলল, আমরা আবার আসব। সিদ্দিক ওমপ্রকাশ …… আমরা আবার আসব, …… শ্যাম কাউর জৈনব পায়রা বেগম …… আমরা আবার আসব — আসব আমাদের সতীত্বের দৃপ্ততা, আমাদের নিষ্কলঙ্ক আত্মার মহান নিয়ে। আসব, কারণ আমরা মানুষ — এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির পতাকাবাহক। সৃষ্টিকে কেউ ধ্বংস করতে তার ইজ্জতকে কেউ নষ্ট করতে পারে না। সৃষ্টিকে লুণ্ঠন করা সম্ভব নয়। কারণ আমরা হচ্ছি সৃষ্টি, আর তোমরা হচ্ছ ধ্বংস। তোমরা জানোয়ার, তোমরা নিষ্ঠুর। তোমাদের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু আমরা মৃত্যুহীন। মানুষের মৃত্যু নেই – মানুষ অমর। মানুষ নিষ্ঠুর জ্বর নয়। মানুষের আত্মা সুন্দর, আনন্দময় — অনিন্দ্য।
Tags: অনুবাদ গল্প, অমৃতসর, কমলেশ সেন, কৃষণ চন্দর, গল্পের সময়
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।