(১)
সবাই বলে পটাই। এমনকি মেয়েরাও, নির্দ্বিধায়। পটাই আসলে কিন্তু কমরেড। পটাই-এর কেউ নেই। কিন্তু পার্টি আছে। কমরেড কথাটা শুনলে পটাইয়ের খুব হাসি পায়, শালা লাল পার্টির অফিস, চারদিক লালে লাল আর শালা বলে কিনা কমরেড! স্ট্রাইকারে খেলত পটাই। ফুটবলের স্পিরিটটা মন থেকে যায়নি। তাই এই মরা বাজারেও পার্টি অফিসটা আগলে পড়ে আছে। আড়ালে ওর দলের নেতারাই বলে — ও হল ওস্তাদ পটাই।
মিটিং, মিছিল, পোস্টারিং, গণঅবস্থান, বিক্ষোভ মিছিল যাই হোক না কেন পটাই সবার আগে । কটা ফ্ল্যাগে কটা ডাণ্ডা লাগবে, কটা পোস্টার কোন গলিতে সাঁটতে হবে, একশ পোস্টারে কত আঠা ঢালতে হবে — সব মুখস্থ। অবস্থান বিক্ষোভের চেহারা দেখে বলে দেবে ক’কাপ চা অর্ডার দিতে হবে। ইলেকশনের দিন কতটা চা কখন করবে, কতটা চা কিনতে হবে — পটাইয়ের কাছে এর হিসেব নেয় স্থানীয় থেকে জেলার নেতারা পর্যন্ত। কৌটো কালেকশনের কৌটো ধরে বলে দেবে কত টাকার মতো কালেকশন উঠল। পটাইয়ের এই সিক্সথ সেন্সের জন্যই পার্টির সর্বস্তরের নেতারা একডাকে পটাইকে চেনে। সবাই জানে প্রগতিশীল মোর্চার বুড়োশিবতলা পার্টি অফিসের প্রাণভোমরা হল কমরেড পটাই দাস। ভাল নাম একটা আছে বটে — শ্রীমান গণেশ দাস। কিন্তু ওই অঞ্চলের লোকজনের কাছে ও আসলে কমরেড পটাই দাস।
বুড়োশিবতলা পার্টি অফিসের বাঁপাশে যে গলিটা জলট্যাঙ্কের সামনে দিয়ে গিয়ে ডাইনে ঘুরে গেছে সেই রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে ডাইনে ঘুরলেই পটাইয়ের বাড়ি। মানে ছিল। এখন শুধুই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে জেগে থাকা দরমার ছাউনির একটা ঘর, ওই বাড়ির শেষ নিশানা — যার বাসিন্দা পটাই আর তার বিধবা মা। দলাদলির দলীয় ছকের বাইরে গিয়ে বলা যায় পটাইয়ের একটা অতীত জীবন ছিল। যেটাতে মোটামুটি সব হারানোর একটা চলতি গল্পই বেঁচে থাকে। ফাইনাল দিতে দিতে ফাইনালি ওর আর স্কুলের গণ্ডি পেরোনো হল না। দশজনের সংসার, বাবা জ্ঞান হওয়ার আগেই চলে গেছে। দাদারা সব আলাদা সংসার পাতায় মা এই পটাইকে নিয়েই ভাঙ্গা বাড়ি আগলিয়ে পড়ে ছিল । পাঁচ বাড়ি বাসন মেজে মেজে মায়ের মাজা গেল পড়ে। পড়ে থাকা বাড়িতে পটাই আর তার মায়ের এই ছোট্ট সংসারে প্রথমদিকে মেজদা আর সেজদা কিছু কিছু সাহায্য পাঠালেও পরের দিকে অন্য দায়িত্ব বেড়ে যাওয়ার অজুহাতে এই দায়িত্বে অব্যাহতি দিল। ফলে পটাই আর তার মায়ের অবস্থা আস্তে আস্তে হয়ে দাঁড়াল এক্সট্রা প্লেয়ারের মতন। সবাই এড়িয়ে যেতেই এগিয়ে এল রথতলা ক্লাবের ভবাদা। ভবাদাই ছিল রথতলা ক্লাবের অলিখিত সেক্রেটরি। ভবাদাই ওকে ভাবাতে শিখিয়েছিল — সব হারানোর বেদনা শুধু ওর নিজের না করে সবার করে নিতে হবে। নিজের বাড়ির রেকর্ডারে মাঝে মাঝে কবিতার আবৃত্তি শোনাত – “আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।” বছর চারেকের মধ্যে মায়ের মৃত্যুর পর পটাই কিভাবে রথতলা ক্লাব ছেড়ে পার্টি অফিসের হোলটাইমার হয়ে গেল সামান্য কিছু টাকার পারিশ্রমিকে আর ভবাদার বাড়িটাই হয়ে গেল পটাইয়ের রাতের ঠিকানা, তা পটাই আর ওর দলের চাহিদা যোগানোর গ্রাফিক্স সমীকরণে চিত্রিত করা যাবে না কারণ পটাই নাকি সর্বহারার শেষ আশ্রয়। একথা ওকে বুঝিয়েছিলেন দলের ভালমানুষ তাত্ত্বিকনেতা নকুলদা। নকুলদাই প্রতিদিন নানা গল্পের কথা শোনাতে শোনাতে ওকে শিখিয়েছিলেন, কিভাবে গড়ে উঠবে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র।
(২)
এহেন পটাই একদিন রাজ্যের ঝামেলার কাজ নিয়ে গণতান্ত্রিক মোর্চার অফিসের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ দেখা পেয়েছিল ওদের দেশের লোক বাবাইয়ের। বাবাই ওর গ্রামের অবস্থাপন্ন চাষির ছেলে। কাজের টানে শহরমুখো হলেও বাবাইয়ের রামপুরহাটের বাড়িতে সংসার আছে। বাড়ির কথাবার্তা আর গল্পগাছার ফাঁকেই পটাই জানতে চেয়েছিল, – তুই কবে থেকে এদের সাথে?
বাবাই বিড়িতে একটা লম্বা টান দিয়ে বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলেছিল, যবে থেকে এরা ক্ষমতায়। তবে আর মনে হয় বেশিদিন…। কথাটা শেষ হওয়ার আগেই ওদের চোখ আটকে গিয়েছিল পাশে দাঁড়ানো কৃষ্ণকায় দৈত্যাকৃতি চেহারার কেষ্টদার লোলুপ দৃষ্টির দিকে। কৃষ্ণদা সেই ধরনের নেতা, যাদের নাম, কামের উদ্দেশ্যকে সিদ্ধ করে ধর্মযুদ্ধ আর জীবনযুদ্ধের লড়াইকে কিছুকালের জন্য একসাথে এক পথে হাঁটিয়ে নিজের অস্তিত্বকে প্রবলভাবে জীবন্ত করে রেখে বাকিদের ঘুমন্ত স্বপ্নের পরাকাষ্ঠা বানায়–স্রেফ বুদ্ধির কারুকার্যে। এককথায় কাজের লোক কেষ্টদা। কেষ্টদার বুদ্ধির কাজের কারুকার্যকে কুর্নিশ করে তারই দলের নেতারা বলেন — আসলি ভোটের শিল্পী। পটাই জানে — এই ভোটের শিল্পীর শৈল্পিক নমুনা। এবারের ইলেকশনে ভবাদার সামান্য গা এলিয়ে খাটার সুযোগে ওদের এলাকায় ভোটের ঘুঁটি উল্টে রঘুনাথপুর বিধানসভায় এগিয়ে দিয়েছিল গণতান্ত্রিক মোর্চার সুকল্যাণ চৌধুরীকে। তাই গণতান্ত্রিক মোর্চার এই জেলার অলিখিত অধীশ্বর শ্রীকৃষ্ণকুমার দাস। দলের ছেলেদের কাছে যে কেষ্টদা আর নিন্দুকের রটনায় কলির কেষ্ট। সমস্ত দলের যাবতীয় শান্তিকে কিভাবে নিজের খাতেই বইয়ে দেন তা শুধু হোলটাইমার পটাই কেন ওর দলের ভোট মেশিনারি মাস্টার মাইন্ডরাও বুঝতে অক্ষম। একদিন ওর রাজনৈতিক গুরু ভবাদাকে জিজ্ঞেস করায় প্রথমে একটু থতমত খেয়ে নিজেকে সামলে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়েছিল, –‘ কেন রে? তোর ওকে নিয়ে এত আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে কেন বল তো? ওদের দলের এটাই দস্তুর। এই করেই তো মানুষকে বোকা বানিয়ে ওরা ক্ষমতায় এল। দেখলি তো? ‘দেখেছিস ,আমাদের কোনো নেতাকে কেষ্টর মতন এবেলা ওবেলা পোশাক বদলের পাশাপাশি সঙ্গিনী বদল করতে না গাড়ি বদলাতে? ইদানীং প্রায়ই ওকে নিয়ে নানা প্রশ্ন করছিস, কি ব্যাপার রে তোর? ওকি তোর সাথে যোগাযোগ করেছে নাকি?
পটাই বুঝেছিল, ভবাদা খেপচুরিয়াস। ওকেই পাল্টা সন্দেহের তালিকায় গেঁথে চুপ করিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী। চুপ করে গিয়েছিল আপাতত, দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের নীতি লঙ্ঘন করবে না বলে। এর কদিন বাদে এই ভবাদাই পটাইকে শ্রীকৃষ্ণকুমারের ডেরায় পাঠাল — তাদের দলের রাজ্যনেতা সত্যধরের মেয়ের একটা ফ্ল্যাট কেনার ব্যাপারে স্থানীয় শ্রীগণেশ এপার্টমেন্টের প্রোমোটার লক্ষ্মীশুক্লাকে একটু বলে দেওয়ার জন্য। সমস্তটা বলে ভবাদা বলল, তাড়াতাড়ি বলে আয়। রাজ্য অফিস থেকে ফোন এসেছিল। কথাটা শুনে পটাই প্রথমে একটু থমকেই গিয়েছিল। দলীয় নির্দেশ মেনে কাজটা যথারীতি পালন করলেও মন যেন বেলাগাম হচ্ছিল। বারবার। ওর চুপচাপ ভাব লক্ষ্য করে ভবাদাই সেদিন তুলল কথাটা , -শোন, রাজনীতিতে কোনো দলীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে মনে প্রশ্ন থাকলেও ক্ষোভ রাখতে নেই। দলেরই বা বলি কেন, দুনিয়ার সব সিদ্ধান্তই কি তোর মনের মতন হবে? আর দুর্নীতি দেখবার জন্য ওদের না থাকলেও আমাদের দলে নীতি নির্ধারক কমিটি আছে,শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটি আছে। দলীয় কর্মীদের সব কাজেই তাদের ভীষণ নজর। তাদের গুডবুকে যেমন কমরেড পটাই দাস আছে, তেমনি মনে রাখতে হবে তাদের ব্যাডবুকও তো আছে। এছাড়া দলের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে অনেক কিছুর সাথে সমঝোতা করতে হয় অনেক সময়। সেগুলো নিয়ে সব সময় প্রশ্ন করতে নেই। যদিও সত্যদা অনেক ওপরতলার নেতা, ওঁর বিষয় নিয়ে দলের মনোভাব তোর মতন সাধারণ কর্মীকে বোঝাবার কথাও নয়, তবুও তোকে নিজে হাতে গড়েপিঠে মানুষ করেছি তাই ভালবাসার খাতিরেই বলছি — সত্যদার মতন নেতাকে এই মুহূর্তে পার্টির খুব প্রয়োজন। এমনকী বিরোধীপক্ষেরও। আর ওঁর ডিভোর্স কেসটা নিয়ে প্রজাতন্ত্রী জনতা দল খুব ঘাঁটাঘাঁটি করছে। তাই সত্যদার প্রথম পক্ষের মেয়ের রেজিস্ট্রী বিয়েটা সেরে আমাদের এদিকে ফ্ল্যাট কিনিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর এ ব্যাপারে এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে কাছের লোক শ্রীমান কৃষ্ণকুমার আর তাদের দলের মাথারা। কারণ তারাও চাইছে প্রজাতন্ত্রী জনতাদলের হঠাৎ বাড়বাড়ন্ত আটকাতে। ফলে তারাও এখন সত্যের সহায়ক উপাদান হয়ে উঠতে চাইছে। তাই বৃহত্তর স্বার্থে তোর ক্ষুদ্র বিশ্বাসে একটু অবিশ্বাস জন্মালোই না হয় — জীবন অনেক বড় রে পটাই ,পরে বুঝবি। শুধু মনে রাখিস, দলীয় স্বার্থে কৃষ্ণনাম করতে করতে কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে কীর্তনিয়া হয়ে যাস না যেন। ভবাদার কথার বাঁকা ইঙ্গিতটা পটাইয়ের মনের ভেতরের কাদা পুকুরে বসে যেতে যেতে মনে করাল — গত বছরের অ্যানুয়ল কনফারেন্সের শেষ দিনের ঘটনাটা। সেদিন রাজ্যনেতাদের ফেরার গাড়ি বোঝাবার দায়িত্বে ছিল পটাই। এই সত্যদাই নিজের নির্ধারিত গাড়ি না নিয়ে টোটো চেপে পেছনের হাই-ওয়েতে গিয়েছিলেন নিজের গাড়ি আসবে বলে। একটা দুধসাদা বোলেরো এসে দাঁড়িয়েছিল। উনি উঠেও গিয়েছিলেন। এক ঝলকের দৃষ্টিতে পটাই দেখেছিল — তার বাড়ির লোকের নমুনা। বোলেরোর মাঝের সিটে বসে আছেন এক চুল খোলা সাদা শাড়ি পরা বছর চল্লিশের ছিপছিপে মহিলা, যার বুকের ওপরের আঁচলটা হয়তো বা পড়ে গেছে অথবা ফেলাই আছে। দড়াম করে দরজাটা মুখের ওপর বন্ধ করে গাড়িটা মিলিয়ে গিয়েছিল অন্ধকারে।
হঠাৎ ভবাদার ডাকে সম্বিত ফিরল পটাইয়ের। ভবাদা নরম গম্ভীর স্বরে বললেন—শোন পটাই, দলীয় সিদ্ধান্তে নিঃস্পৃহ থাকার কৌশল রপ্ত করতে হবে। এমনকি নেতৃত্ব গেলেও। আমাদের দলে তো তবু অনেক লিবারেশন দেওয়া হয়, এসব ব্যাপারে। ইনফ্যাক্ট গণতান্ত্রিক কাঠামোর প্রায় সব দলেই সমালোচনার সুযোগ থাকে, তবে নূন্যতম শৃঙ্খলার ধার ধারে না যারা তারাই যা ইচ্ছা চিৎকার চেঁচামেচি করে আর তাদের দলে নেতাদের ধুতি কাপড় ধরে টানাটানি করে, মারপিট করে। যেমন গণতান্ত্রিক মোর্চারা। সেখানে অতিসক্রিয়বাদী বিপ্লবী মুক্তমঞ্চের মতন সংগঠনের কর্মীদের নিঃস্পৃহতার নমুনা পরীক্ষার কথা শুনলে তোর বুকের রক্ত ছলকে উঠবে। নাম বলব না — সে যুগের এক অতিসক্রিয় আন্ডারগ্রাউন্ড নেতা নীচুতলার কর্মীদের থেকে নিঃস্পৃহতারও পরীক্ষা নিতেন মহিলা কর্মীদের নিজের ঘরে ডেকে পুরুষদের জানিয়ে।
কথাগুলো শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে যাওয়া পটাইয়ের মনে পড়েছিল, নকুলদার স্বগতোক্তি — বুর্জোয়া শব্দটাই আমাদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ।
(৩)
বাবাই দুদিন আগে রঘুনাথপুর স্টেশনে এসেছিল পটাইয়ের সাথে দেখা করতে। দেশওয়ালী লোগো কা মুলাকাত আর কী। চা-বিড়ির আড্ডায় রাজনীতি, দেশ, মানুষজন সবই যেমন ঘুরেফিরে আসে, তেমনি এল। তরল মনের হালকা ছেলে বাবাই। তবে মনটা ভাল। দেশে ঘরে মানুষজন আছে, ওর মতন সর্বহারা নয়। ফলে ব্যক্তিস্বার্থ দলীয়স্বার্থে উৎসর্গ করেনি। যখন যেমন, তখন তেমন। নিজেই দার্শনিক ব্যাখ্যা টানত, —- আমি জলের মতন। যে পাত্রে, যে তাপমাত্রায় রাখবে, সেই আকার নিয়ে নেব। ফলে পটাইদের দল ওকে তাড়িয়ে দিয়েছে না ও হাওয়ার টানে ঘুরে গেছে, তার সঠিক খবর কারও কাছেই নেই। বাবাই যে কোনো দলের ঘরে বাইরের খবর রাখে। ওদের গণতান্ত্রিক মোর্চা দলের ঘরে বাইরে একাকার হয়ে আছে গল্পের পাহাড়। সেই গল্পের পাহাড়ে সব নেতা কর্মীরা বেড়াতে গেলেও স্থায়ীভাবে বসবাস করে না কখনও। সব খবরের বেশিরভাগই নিজেদের বিরুদ্ধের খবর। তবে কখনও কখনও মিছিল হলে স্লোগানের তীর ছোড়া হয় — লক্ষ্যভেদ করা ইস্যুগুলোর বিরুদ্ধে। বেশ হল্লাহাটির মেজাজে বাইকের ফুরফুরে হওয়ায় ঘুরতে ঘুরতে বাবাইয়েরও রাজনৈতিক হাওয়ার গতিবিধিতে দখলদারি জন্মেছে। ফলে বুঝে নিয়েছে ক্ষমতা আর রাজনীতির সচল,সরল পাটিগণিতে চক্রবৃদ্ধি সুদের আয়ের জটিলতার অঙ্ক জীবনের অঙ্ককে ঘেঁটে দেবে। তার চেয়ে গিভ এণ্ড টেকের টেকনোলজির মাধ্যমে তাকে যে কারিগরী বিদ্যার শিক্ষা তার দলের নেতারা শিখিয়েছে তাতে একটু স্তাবকতার ছোঁয়া জুড়ে দিলে দ্রুত কোন ক্ষমতার দখল নিতে পারবে। আর তার এই চাওয়া পাওয়ার বুদ্ধির জোগানদাতা স্থানীয় সরকারি কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা বিশ্বরূপ সরকার আর তার ছেলে বুবাই যাদের সমস্ত কাজ সে এখন আপ্তসহায়কের মতন করে যায়।
বিশ্বরূপবাবুর ছেলের কথা যখন উঠল তখন পটাই বলল, – বুঝেছি, ‘হাওয়া মোরগ’এর ছেলে তো? বাধা দিল বাবাই—এতদিন ধরে রাজনীতি করছিস হাওয়া মোরগ না হলে কোন খুঁটিতে পতাকা বাঁধলে পতাকার উড়ান ভাল হবে বুঝবি কি করে?
পটাই বোঝে বাবাই কথাগুলো বলে খুব সরাসরি। ওরও তো নয় নয় করে চল্লিশ হল। এখনও সেই পার্টি অফিসেই পড়ে আছে। ভবাদাকে বললে বলে, পড়াশোনাটা তো করলি না। করলে না হয় বলা যেত।
বাবাই কত খবর দিল। পটাই জানতই না এসব। এখন নাকি সব থেকে বুদ্ধিমান বিপ্লবী মুক্তমঞ্চ। এরাই নাকি তলে তলে বুদ্ধি জোগাচ্ছে বাবাইয়ের বর্তমান দলের কেষ্টদের। ভবাদা অবশ্য একদিন মিটিঙে বলেছিল। কিন্তু পটাইয়ের কেমন গুলিয়ে যায়। দুটো ভিন্ন মেরু কিভাবে এক হয়? ভবাদাকে করা প্রশ্নটা ছুঁড়েছিল বাবাইকে। বাবাবি সিগ্রেটের পাউডারে গাঁজার পাউডার মিশিয়ে দিয়ে বলল, সবই পাওয়ার। পাওয়ারের জন্য পাওয়ারের সাধনা। অল ইজ ফেয়ার ইন ওয়ার এণ্ড লাভ।,জান না চাঁদু–বলে গাল টিপল পটাইয়ের। গাঁজাভরা সিগ্রেটটা তিনবার প্যান্টে ঠুকে ঠোঁটে তুলে আগুন ধরিয়ে লম্বা টানে চিমনির মতন ধোঁয়া ছাড়ল। চারপাশে তীব্র গন্ধে ম ম করে উঠল। বাবাই মাঝে মাঝে ইংলিশ ডায়লগ দেয়। হায়ার সেকেণ্ডারি পাশ করেছিল তো ও। পটাই বিড়ি খেলেও গাঁজার গন্ধটা একদম সহ্য করতে পারে না। সিগ্রেট লিডারেরা খাওয়ালে খায়। বাবাইয়ের মৌতাত এসেছিল। পা’টা দোলাচ্ছিল। বলল, দেখ সরকারি দল আর বেসরকারি দলের তফাৎ বুঝতে শেখ পটাই। অনেকদিন ধরে ওখানে লটকাচ্ছিস এবার বাধা দিয়েছিল পটাই, – না রে, দলকে ভালবেসেই আছি। প্লাস ভবাদা।
বাবাই অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে বলল, – তোকে দল বদলাতে কে বলেছে? আমি? তুই পাগল না পাঞ্জাবি? আমি নিজেই কদিন এদের সাথে আছি ঠিক নেই। প্রজাতন্ত্রী জনতার সুকুমারদা প্রায়ই ডাকছে। নানা রকম অফার দিচ্ছে। প্লাস এখানে বিপ্লবী মুক্তমঞ্চের রোহিতবাবুও তো ফাঁদ পেতেই রেখেছে। দেখি কী হয়! আমি নিজেই নিজের অবস্থান খুঁজছি আর তোর মতন মহারাজকে এখানে আনব কোন দুঃখে! এখন ওসব আদর্শের রাজনীতির দিন শেষ। যে যেখানে আছে, সেখানে থাকাই ভাল। শুধু একটু নিজেকে দেখার জন্য, একটু সরকারি দলের সাথে হুকিং বা সেটিং — যা করে সবাই। সেটা বুঝিস তো পটাই? তোর প্রাণের ভবাদাও সেটা করে। বলে পার্টির প্রয়োজনে। এটাই তোদের ডিসিপ্লিন। মাথায় রাখিস ভবাদারও তো বয়স হচ্ছে। তারপর? এই মোক্ষম ঘায়ে একটু খোঁচা দিলে পটাই একটু থতমত খেয়ে যায়।
পার্টির বেসরকারি চেহারার সবচেয়ে খারাপ অবস্থা এখন বোধহয়। যারা আসছে তাদের কোনো জায়গা নেই বলে। পটাই নিজেই এই কথাটা চুপ করে ভাবে মাঝে মাঝে। বাবাই সেই ঘায়ের জায়গাটা চুলকে দিল। সত্যি ভবাদা না থাকলে পটাইকে সামলাবেই বা কে? বউদির অসুস্থতা বাড়ায় আর মেয়ের বিয়ের পর বিদেশে চলে যাওয়ায় ভবাদা বেশ কিছুটা উড়ু উড়ু। এবারের ইলেকশনের পর থেকে আরও গা ছাড়া ভাব। সব বোঝে পটাই। ওর প্রতি ভালবাসা আগের মতই আছে। এই কদিন আগে লাখ দুয়েক টাকাও ওর সঙ্গে পোস্ট অফিসে জয়েন্ট নামে রেখেও দিয়েছে। বলেছে, রাখ, আমি না থাকলে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মীর পারিশ্রমিক কখনও না থাকলে খাবি কী? সত্যিই তো পটাই খাবে কী? প্রজাতান্ত্রিক জনতা দলের সাথে গণতান্ত্রিক মোর্চা তলে তলে হাত মিলিয়ে, যেভাবে বিপ্লবী মুক্তমঞ্চের বুদ্ধিতে চলছে তাতে ভবিষ্যতে পটাইদের প্রগতিশীল মোর্চার পক্ষে টিকে থাকাটাই কষ্টকর। বোঝে সব পটাই কিন্তু উত্তর নেই বলে সামনের অন্ধকার স্রোতে ভাসিয়ে দেয় চিন্তাভাবনাগুলোকে — যা হয় দেখা যাবে।
– কি-রে! চুপ মেরে গেলি যে বড়! সম্বিত ফিরল বাবাইয়ের ধাক্কায়। তোর বউ-বাচ্চার চিন্তা নেই। কিন্তু আমার চিন্তা আছে সংসারের জন্য। আর দুটো দলে প্রায় কুড়ি বছরের ওপর থেকে বুঝেছি আধুনিক রাজনীতিও একটা কেরিয়ার। এটা মানতে পারে না অনেক পুরনো নেতারা। বিশেষত যারা একটা বিশ্বাস নিয়ে দল করছে। আমিও প্রথম দিকে যখন তোদের ওখানে যখন ফ্ল্যাগ টাঙ্গাতাম, মিছিলে হাঁটতাম মনে হত সব বদলে দেব। এ পৃথিবীর শাসক হব আমরা। ও বাবা! পরে দেখলাম আমাদের বিশ্বাসে সুরসুরি দিয়ে আমাদের দাদারাই দিব্যি গোছাচ্ছে। আবার দাদাবাজিও ষোলআনা। আবার দাদাবাজি করাই যদি লক্ষ্য হয় তবে দাদাদের দলে মানে সরকারি দলে থাকাই ভাল। বিশ্বরূপ দত্ত সে কথাই বলে, যার নুন খাই – তার গুণ গাই। যখন তোরা ছিলিস তখন তোদের সাথে, এখন আবার আমাদের সাথে। আবার মুক্তমঞ্চের রোহিতদার সব অনুষ্ঠানে চাঁদা তুলে দেয়। প্রজাতন্ত্রী জনতা দলের সুকুমার তো এখন বিশ্বরূপদাকে রোজ ফোন করে। ঠিক খাপ খাইয়ে নিয়েছে নিজেকে। সরকারি চাকরি করে দুই ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে দুটো সরকারের সময় শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্বে থাকা মুখের কথা। তোদের নেতারা হাওয়া মোরগ, উভজীবী যা তকমাই দিক না কেন বিশ্বরূপ সরকার ইজ বিশ্বরূপ সরকার। আমার কাছে চিরজীবীর বিশ্বদর্শন।
থম মেরে যাওয়া পটাই রাত হয়ে যাওয়ার অজুহাতে উঠে পড়ল রাস্তায়। হাঁটতে হাঁটতে বিড়ি ধরাল। প্রিয় কুকুর লালু ল্যাজ নাড়তে নাড়তে তাকে ফলো করার মতন পিছু নিল। রোজই নেয়। মনে পড়ল একদিন পার্টির তাত্ত্বিক নেতা নকুলদা বলেছিল, – শোন পটাই, সমাজে পাতিবুর্জোয়াদের বাঁচিয়ে রাখে তাদের অনুগামীরাই। আর সর্বহারার শোষণ শব্দগুলোর ব্যাখ্যা আরো দরকার, কারণ শোষক শোষিতের প্রকৃত চেহারা এখনও অজ্ঞাত।
(৪)
কাজের ছেলে বাবাই, ওদের দলের লোকেরাই বলে। কারোর প্রয়োজনে বাবাই দরাজদিল। পটাইয়ের সাথে আলাপের পর থেকেই ওর প্রতি একটা টান তৈরি হয়েছে বাবাইয়ের। সর্বোপরি ওর দেশের লোক। পটাইয়েরও তাই।
সেদিন স্টেশনে আড্ডার পর পটাই বিশেষ কিছু না বলে চলে যাওয়ায় বাবাইয়ের মনটা ভাল ছিল না। ভাল ভাবে নেয়নি ব্যাপারটা। ফোনে ধরবার চেষ্টা করেছে। মিসড কল হয়ে গেছে।
আসলে পটাই নিজের ব্যাপারে কোন ভাল লাগা বিষয় হলেই নিজের মধ্যে ডুব দেয় কয়েকদিনের জন্য। ফোন তোলে না। যোগাযোগ কমিয়ে দেয় নিজে থেকেই। সবাই বোঝে না। ওর কিন্তু বাবাইকে ভালই লাগে। ওর সাতকূলে কেউ নেই, ফোনও করে না কেউ কস্মিনকালে। তবু তো বাবাই ওর কথা ভাবে। ফোন করে। নানা বিষয়ে দশ রকম কথা বলে। মতামত দেয়। বুদ্ধি পরামর্শ যোগায় নিজের লোকের মতন। তারপরে একই গ্রামের ছেলে। ছোটবেলা থেকে চেনে। এখনও গ্রামের সাথে যোগাযোগ আছে। এই তো লকডাউনের সময় প্রচুর সাহায্য গ্রামে দিয়ে এসেছিল ওই হাওয়া মোরগের ডানায় ভর করে।
এই খবরটা ওর মুখ থেকেই শুনেছিল ভবাদা। ভবাদা এখন আর পটাইকে খুব একটা সন্দেহের চোখে দেখে না,বাবাইয়ের সাথে কথাবার্তা বললে। আগে খুব করত। পেছনের গল্পটা ভারি মজার। ওদের বুড়োশিবতলার পার্টি অফিসের সংলগ্ন জমিতে বহুতল করছে দুই প্রোমোটর মোহন-বংশী। দুজনেই আসলে বাবাইয়ের দলের এম এল এ সুকল্যাণ চৌধুরীর লোক। যাইহোক, মোহন-বংশীর যুগলবন্দীতে ঠিক হল পটাইদের পার্টি অফিসটা নিয়ে নেবে। কারণ ওটা বেআইনি। হাইড্রেন সংলগ্ন রেলের জমিতে হলেও ওটা নাকি ওদের বহুতলের ওপেনিং আটকাচ্ছে। ভবাদা পার্টিসোর্স লাগিয়েও যখন কিছু করতে পারল না, পটাই ফোন লাগাল বাবাইকে। শুনে বাবাই সে নেতার মতন গলায় সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল — পেয়ে যাবি। কাল পরশুর মধ্যে সেটল হয়ে যাবে। বিশ্বরূপদাকে দিয়ে বলিয়ে দেব।
কথা অনুযায়ী কাজও হল তিনদিনের মাথায়। নতুন বহুতলের পিছন দিকে ছয় বাই দশ ফুটের ছোট একটা ঘর দেওয়ার চুক্তি করে গেল মোহন-বংশী। আর তারপর থেকেই ভবাদার কাছে বাবাই কাজের ছেলে। আর বিশ্বরূপ কাছের লোক হয়ে উঠল।
পটাই বুঝেও বুঝল না। বা প্রশ্ন করল না দলের কথা ভেবে। কিন্তু এটা বুঝল এবার একটু নিজের কথা বলার সময় বোধহয় এসেছে। গত সপ্তাহে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যেবেলা বৃষ্টি এল তেড়ে। নতুন ঘরে ভবাদা আর পটাই। কথাটা পারল পটাই, — ভবাদা একটা কথা ছিল।
– বল, বলে ফেল।
– বলছি অন্যভাবে নেবেন না।
– বল না, ভয় কিসের? ছোটবেলা থেকে আমার বাড়িতে মানুষ হলি, আমি নিজের বাপের মতন।
– বলছি, অনেক তো হল। এবার একটা কাজের খুব দরকার।
– কেন? বিয়ে করবি নাকি?
– না, আপনারও তো বয়স হচ্ছে? রাজনীতির যা অবস্থা তাতে ভবিষ্যতে…।
– শোন পার্টিতে তোর কথা আমি বলে রেখেছি, ওরাও তোকে গুডবুকেই রেখেছে।
– জানি, কিন্তু এখন তো খাওয়া দাওয়া, রাতে শোওয়া সবই তো আপনার বাড়িতে। তখন তো আর…
– বুঝলাম। কি চাস চাকরি? সময় থাকতে বললি না, তখন বললে একটা ফোনে হয়ে যেত। আর এখন তো আমাদের লোক কোথায়?
– কেন? বিশ্বরূপ?
-পার্টি মানবে না, অন্যভাবে নেব?
-কেন? ওর সাহায্যে এই যে মোহন বংশীর ফ্ল্যাটে পার্টি অফিস নিল। আপনি বললেন, সত্যিই খুব কাজের লোক না হলে এমন কাজ হয় না।
একটু চুপ করে ভবাদা বললেন, দূর বোকা, ওটা দলের ব্যাপার। এটা নিজের ব্যাপার। ব্যক্তিস্বার্থ এসে যাচ্ছে না? বাবাইয়ের সাথে মিশে মিশে এই সমস্ত বাজারি বুদ্ধি আসছে তোর!
পটাই মরিয়া, চুপ করে না থেকে প্রশ্ন করল, – তাহলে সেদিন যে বিশ্বরূপকে ফোনে বললেন, জেলার সুবিমলদার মেয়ের ফ্ল্যাটের মিউটেশনটা যেন না আটকায় একটু দেখো বিশ্বরূপ। আমরা এখন নেই। ওরা আমাদের কথা শুনবে না। তোমাদের কথা শুনবে, একটু দেখো। কিছু লাগলে…
-চুপ কর, কড়া গলায় ধমকে দিলেন ভবাদা। সব বিষয়ে প্রশ্ন করার অভ্যাস তোকে বাবাই শেখাচ্ছে যখন তখন বাবাইকে বল না সিভিক সার্ভিসে প্রচুর লোক নিচ্ছে তো, ওই করে দেবে। তারপর চলে যা ওদের দলে।
– না, ভবাদা। একটা চাকরি চাওয়ার মানে কি পার্টি ছাড়া, আর বাবাই নিজেই ওদলে সুবিধায় নেই। ও নিজেও খুঁজছে।
– তা হলে এক কাজ কর। ওর সাথেই যোগাযোগ রাখ। মনে হয় পেয়ে যাবি। আমিও দেখছি।
পটাই বুঝল নকুলদার শেষদিকের প্রশ্নগুলো কত মারাত্মক ছিল — রাজনৈতিক ক্ষমতার রসায়নে ক্ষমতা কিভাবে বদলে যায়।
(৫)
বাবাইয়ের ফোনে পটাই উত্তেজিত — চাপ নিস না। সব হয়ে যাবে। বিশ্বরূপদার কাছে আজ চল। কেষ্টদা আর সুকল্যাণদাকে আমি অলরেডি বলে রেখেছি। রঘুনাথপুর মিউনিসিপ্যালিটিতে ক্লাস ফোর স্টাফে ত্রিশ ঊর্ধ্বর আটটা লোক নেবে। জেনারেল সিট চারটে আছে। ভেতরের খবর। কোন অ্যাড যাবে না। ঠিক মতো অ্যাডজাস্ট করলে আমাদের দুজনের হয়ে যাবে। তারপর তোর জীবনের বাকিটা নিয়ে ভাবব।
এক নিঃশ্বাসে বাবাই বলে কিছুটা থামল। পটাই শুনছিল আর ভিতরে ভিতরে কিরকম ভাঙছিল। আনন্দ, ক্ষোভ, দুঃখ, সব মিলিয়ে কিরকম একটা জগাখিচুড়ী অবস্থা। ব্যাখ্যা করা মুশকিল। শুধু বলল, – আমাকে কি নেবে? একদম ছাপ মারা লোক আমি!
বাবাই একটা কাঁচা দু অক্ষর দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, — শোনো সাধুপুরুষ, গত মাসে সিভিক পুলিশে ত্রিশজন লোক নিয়েছে। পাঁচটা কেস তোদের দলের। প্রজাতন্ত্রী জনতা দলের চাপে সব এখন নরম নরম, মাখো মাখো। আর তোমার প্রাণের ভবাদাকে দিয়ে বলিয়ে রাখো সত্যদাকে। তোমার দলের সত্যদাই তো এখানকার শেষকথা। আমাদের কেষ্টদা থেকে সুকল্যাণদা তো আমাদের থেকেও তোমাদের সত্যদা বলতে অজ্ঞান। তোমাদের সত্যদার মেয়ের ফ্ল্যাট কিনিয়ে দিচ্ছে এখানে। তোর জন্য একটু বলুক না কেষ্টদাকে। বাবাইয়ের কথায় এমন একটা জোর থাকে যাকে অতিক্রম করা যায় না। বাবাইয়ের কথামতো কথা বলল পটাই ভবাদার সাথে। ভবাদা শুধু বলল, – ঠিক আছে। কথা বলব। হলে আমার আর কি? শুধু তুই একটু দূরে চলে যাবি। আর পার্টি অফিসে ধুনো জ্বালাবার কেউ থাকবে কিনা সন্দেহ। যা অবস্থা!
পটাই বাধা দিল, – কি যে বলেন? পার্টি ছাড়ব কোন দুঃখে? সব ছাড়তে পারি, পার্টি ছাড়তে পারব না।
-দেখ, হলে ভাল। উঠে পড়ল ভবাদা।
পরিকল্পনামাফিক বিশ্বরূপ সরকারের সাথে বাবাইয়ের সাথে গিয়ে দেখা করেছে। কেষ্টদা, সুকল্যাণদার সাথে বার কয়েক কথাবার্তাও বলেছে বাবাই। আবেদনপত্রও জমা পড়ল যথারীতি। নির্দিষ্ট দিনে ইন্টারভিউ হল। ওরা দুজন ছাড়াও আরও ত্রিশজন ছিল। তাদের মধ্যে দু-চার জন বাবাই পটাইয়ের পরিচিতও বেরোল। এরপর থেকে বাবাই প্রায় নিশ্চিত হয়ে পরবর্তী সব পরিকল্পনাগুলো জানাত পটাইকে। ফোনে যে সব কথা শুনতে শুনতে নকুলদার সেই অমোঘ বাণীগুলোর একটা কানে বাজত, – বিপ্লবী শব্দটার প্রতি প্রতিবিপ্লবীদের ভালবাসা মাপাটা খুব জরুরী।
[৬]
গতকাল রেজাল্ট বেরিয়েছে। জেনারেল চারটে সিটে চাকরি পেয়েছে বিশ্বরূপ সরকারের শালীর ছেলে, কৃষ্ণকুমার দাস বা কেষ্টদার অতি পরিচিতা বহ্নিশিখা দত্তের বর আর সত্য ধরের জামাইয়ের এক বন্ধু।এবং চতুর্থ আসনে সুকুমারদার বন্ধুর ছেলে।পটাই বুঝে গেল — দলের লোক কাজের লোক আর কাছের লোকের সংজ্ঞা।
মুষড়ে পড়েছে বাবাই। পটাইয়ের সাথে দেখা করতে এল বাবাই। ভকভক করে গাঁজা ভরা সিগ্রেটে টান দিচ্ছে। কড়া গন্ধে চারপাশ ম ম করছে।
– শালা, পুরো বোকা বানিয়ে দিল রে। কি করিনি ওদের জন্য। ঠিক আছে হিসেব বরাবর হয়ে যাবে। তা, তোর ভবাদা কি বলছে এখন? ধরেছিলি মালটাকে। কি বলছে দলের দায়িত্ব না দলের ইচ্ছা।
স্তব্ধ পটাই মুচকি হাসল। বলেছিলাম, কি হল গো?
বলল, – ওপরতলার সিদ্ধান্ত। বলেছে – পরে তোকে অন্যকোথাও দেখে-শুনে করে দেব।
বাবাই হাঁফাচ্ছে। চিন্তা কর – পরে দেখে-শুনে দিয়ে দেবে। তুই পার্টি অফিস আগলে পড়ে আছিস, আর সত্যদার পরিচিত যাকে দিল সে নাকি দলের সদস্যই ছিল না কোনদিন। ব্যাপারটা ভেবে দেখেছিস পটাই।
মিচকি হেসে পটাই বলল, – ভেবেই বলছি এবং বলেওছি। তা তুই কিছু বলিসনি তোদের মহামান্য নেতাদের?
-ভেবেছিস কি? ছেড়ে দেব? ফুঁসছে বাবাই, – গেছিলাম কাল রাতে কেষ্টর কাছে। গিয়ে দেখি বিশ্বরূপ সরকারও আছে। আমাকে দেখে একটু চমকে গেছিল। ছেলেদের ফিট করাই ছিল। ঢুকতেই দিল না। শুরু করলাম খেউড়। প্রথমে তিন চার অক্ষর। তারপর বাবা মাকে জড়ালাম। বেরিয়ে এল বিশ্বরূপ আর ওর ছেলে। কি বলল জানিস? বলল, -এখানে চেঁচাচ্ছিস কেন? বোকা নাকি? বিনে পয়সায় চাকরি হয়? নগদ ছ’লাখ নামিয়ে সবার মিলেছে। এটাই নিয়ম। জোগাড় কর, হয়ে যাবে। শুকনো কথায় কারও কিছু হয় না রে বোকা!
বললাম, – আগে বললেন না কেন?
বলল, – সব বুদ্ধি সবাইকে আগে শোনাতে নেই। যেখানে নিজের স্বার্থ জড়িয়ে। ঠেকে শিখতে হয় কিছু জিনিস। ঠাণ্ডা গলায় কথাগুলো বলেছিল রে। গা জ্বলে যাবে। বলছে, – কাজ নামানোর কায়দা শিখতে হবে নীচুতলায়। তবেই তো ওপরতলায় গেলে ব্যবহার করতে পারবি।
রাগ চাপতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম রে পটাই, – এখন কাজ নামানোর কথা বলছেন আর ভোটের কাজ ওঠানোর সময় আমরা? শুনে কী বলল জানিস? বলল, – নীচুতলার লোক হয়ে ওপরতলাকে ব্যবহারের চেষ্টা করতে গেছিস। ব্যবহৃত হয়ে গেছিস। সোজা হিসেব।
পটাই চুপ করে শূন্যদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে। মনে পড়ছে — দলে ওর অন্যতম প্রিয় মানুষ নকুলদার সেই বিতর্কিত মন্তব্য, যার জন্য দল থেকে বিতাড়িত হয়েছিল বছর আষ্টেক আগে নকুলদা দলের কিছু নেতার বিরোধিতা করে প্রকাশ্য সভায় বলেছিলেন – মনে রাখবেন, শ্রেণীশত্রুর চিহ্নিতকরণে সবার আগে প্রয়োজন দলীয় হরিজনদের গণভোট। এমন বেলাগাম মন্তব্যের জন্য শোকজের জবাবদিহি না দেওয়ায় সরতে হয়েছিল নকুলদাকে। লোকে বলে, সরিয়েছিলেন সত্যদা। ব্যাপারটা খারাপ লাগলেও ভবাদার নির্দেশে চুপ করে দেখেছিল পটাই।
আর তাই এতদিন পর গতকাল বিকেলে ফোন করেছিল নকুলদাকে। এখন একাই থাকেন,মেয়ের কাছে ।একটা মূক বধির শিশুদের উন্নয়ন মূলক সংগঠনের সাথে যুক্ত ।পটাইকে খুব ভালবাসতেন ।সব শুনে সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তোদের চেষ্টা করাটাই ভুল ছিল। তোদের মতন অনেকেই বোঝে না — ক্ষমতার অলিন্দে ইচ্ছা করলেই প্রবেশাধিকার পায় না দলীয় দলিতরা, তোরা সবাই যে দলীয় দলিত রে। যাদের জন্য কোনো দলেই নেই কোনো সংরক্ষণ নীতি; ন্যূনতম দলীয় স্বার্থে।
পরদিন পটাই স্রেফ দলিত চেতনার আবেগে লাগাম না টেনে পার্টি অফিসে হঠাৎ তুলেছিল নকুলদার কথা। মুহূর্তে বদলে গিয়েছিল এতদিনের পরিচিত ভবাদার রূপ। কেউ না থাকা অফিসঘরে চিৎকার করে উঠেছিলেন- ”তুই চুপ করবি!
[বানানবিধি/মতামত লেখকের নিজস্ব]
Tags: গল্প, দলিত, দেবাশিস মজুমদার
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।