01 Oct

নষ্ট মেয়ের গল্প

লিখেছেন:অঞ্জন সেনগুপ্ত


“ হ্যাঁ রে হিয়া , তোর শরীর ঠিক আছে তো ?” লতা জানতে চায় ।

“ হ্যাঁ । কিন্তু হঠাৎ তুমি জানতে চাইছ কেন !” হিয়া অবাক হয়ে বলে ।

“ না, এ মাসে তো ঘরের পেছনের দড়িতে কিছু দেখলাম না ! তাই বললাম আর কি ।“

এমনিতেই তো সারাটা দিন মেয়েটার সাথে কথা হয় না । রোজ চারটার ট্রেন ধরতে হয় লতাকে  । হিয়া ঘুম চোখে দরজা খুলে দিয়ে আবার শুয়ে পড়ে । আর লতা বাড়ি ফেরে সেই সন্ধায় । যদিও অনেক কাজের মেয়েরা দুপুরেই বাড়ি ফিরে আসে । কিন্তু লতা একটা বাড়ির সাথে খাওয়ার চুক্তি করেছে । তাই ঐ বাড়ির দু’বেলার সব কাজ করে ফিরতে ফিরতে সন্ধা হয়ে যায় ।

হিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,” মা, এমন ঝামেলা কি প্রত্যেক মাসেই থাকবে ?”

লতা অবাক হয়ে বলে,” শোন মেয়ের কথা ! একে তুই ঝামেলা বলছিস হিয়া !মেয়েরা হচ্ছে মায়ের জাত । ফল দেওয়া গাছের মতো । আর এখানেই আমাদের সাথে ছেলেদের তফাত, বুঝলি ? এই সময়ে মেয়েদের খুব শিষ্টাচার মেনে চলতে হয় । এ সময় কোন মন্দিরে যাওয়া বা বাড়িতে সন্ধা প্রদীপ দেওয়া নিষেধ । কেউ না মানলে তার শরীরে পাপ লাগে । ঠাকুর রেগে যায় ।“

হিয়া মুখ বেঁকিয়ে বলে,” যাক বাবা, এ মাসটা অন্তত বাঁচা গেল ।“

মেয়ের কথা শুনে লতা বলে ,”সে কিরে হিয়া ! বাঁচা গেল মানে ! শুরুর পরে হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে সাথে সাথে ডাক্তার দেখাতে হয় । তবে হ্যাঁ, অনেক সময় একটু দেরিতেও হয় । কিছু লুকোবি না । আমাকে সব বলবি  কবে হল ।“

মায়ের এমন কথায় হিয়া অবাক হয় ! ও বুঝতে পারে না এতে ভয়ের কি আছে ! হবে না তো, হবে না ! এত হা-হুতাশের কি আছে ! যত্ত সব ভীতুর ডিম । মায়ের সবটাতেই শুধু ভয়, আর ভয়! কিন্তু এতে যে আমার খুব দুর্বল লাগে,মা তো তা বলল না !

 

দুই

 

লতা কি সত্যিই ভীতুর ডিম । আসলে ওরা তো জানে না, যেদিন লোকটা অন্য একটা মেয়ের হাত ধরে দুটো বাচ্চাকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল সে দিনটা কেমন ছিল ।কতটা ভয় পেয়েছিল লতা তা ওদের জানার কথা নয় । নিজের ভরা যৌবন নিয়ে,দুটো কচি বাচ্চাকে নিয়ে প্রত্যেকটা দিনই ছিল ভয়াবহ ! বিশেষ করে সন্ধ্যা হলেই ভয়টা যেন আরো জাপটে ধরতো । তখন পাখির মতো দুটো ডানা মেলে তার ভিতরে ওদের লুকিয়ে রাখতো সে ।আর উৎকর্ণ হয়ে থাকত কোন অজানিত ভয়ের জন্য । এ ভাবেই কেটে যেত রাতের পর রাত । কত কষ্ট করে যে দু ভাই-বোনকে এত বড়টা করেছে, তা ওরা জানবে কি করে ! অথচ ভয়টা আজো লতাকে ছাড়েনি । আর তাইতো ওদের জন্য এত চিন্তা । বিশেষ করে মেয়েটার জন্য । অথচ ও সেটা বুঝতে চায় না । ভাবে মা ভীতু । তাই সারা দিন কাজের শেষে বাড়ি ফিরে এসে লতা জিজ্ঞাসা করে, “ হ্যাঁরে হিয়া, কিছু হল ?”

হিয়া কোন উত্তর না দিয়ে শুধু মাথা নাড়ে ।

“স্কুল গিয়েছিলি ?” লতার গলায় উদ্বেগ ধরা পড়ে ।

“হ্যাঁ, তবে—“ হিয়া কিছু একটা বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যায় ।

লতা হাত-মুখ মুছছিল । হিয়া কিছু একটা বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যাওয়ায় লতাও বারান্দার দড়িতে গামছা ঝুলিয়ে হিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,” কি যেন একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলি হিয়া ! আবার কি কোন নতুন—- !”

“জানি না মা । তবে তিন বার বাথরুমে গিয়ে বমি করেছি । তেমন কিছু বের হয়নি । কিন্তু বার বার পেটটা গুলিয়ে উঠছিল ।“ হিয়া এটুকু বলে থেমে যায় ।

লতা একটু ভেবে নিয়ে বলে ,” নির্ঘাৎ তোর পেটে ফিতা ক্রিমি হয়েছে । ওটা যখন নড়াচড়া করে তখনই পেটটা গুলিয়ে ওঠে। তবে ফিতা ক্রিমি ভাল নয় । ওটা একবার মাথায় উঠলে আর রক্ষা নেই । তাই দেরি না করে বরং তোকে কালকেই হাসপাতালে নিয়ে যাব ।“

“কিন্তু তোমার বাবুদের বাড়ির কাজের কী হবে ?”

“সে না হয় আমি ফোন করে বলে দেব । আগে বলে দিলে ওরা আর আমার অপেক্ষায় বসে থাকবে না ।“ লতা ওর ঝোলা থেকে মোবাইলটা বের করে একে একে সবাইকে জানিয়ে দেয় যে, সে কাল কাজে যেতে পারবে না ।

 

তিন

 

সেই সকালে গিয়ে ফিরতে ফিরতে বেলা প্রায় বারোটা বেজে গেল । লতা একবার ভেবেছিল ডাল আর কলমি শাকটা করে যাবে। কিন্তু তা আর করা হয়নি । আসলে দূরতো আর কম নয় । দুবার ভ্যান পাল্টে যেতে হয়েছে । তারপর আবার বিশাল লাইন ! কিন্তু এখন রান্নাবান্না সব মাথায় উঠেছে ! ডাক্তারবাবু যা বললেন তাতে রান্নাতো দূরের কথা মাথায় যেন আগুন জ্বলছে ! অথচ ব্যাপারটার কোন গভীরতাই মেয়েটার মাথায় ঢোকেনি । সারাটা রাস্তাই ও অংকের ক্লাশ করতে পারেনি বলে দুঃখ করতে করতে এসেছে !

লতা ঘরে ঢুকে আগে দরজাটা ভেজিয়ে দেয় । তারপর দীর্ঘক্ষণ ধরে চেপে রাখা রাগটাকে আর সামলাতে না পেরে মুহূর্তের মধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়ে হিয়ার চুল ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দেয় । হঠাৎ এমন ঘটনায় হিয়া নিজেকে সামলাতে না পেরে মাটিতে আছড়ে পড়ে । লতা সাথে সাথে ক্ষীপ্ত বাঘিনীর মতো হিয়ার চুলের গোছা খামচে ধরে ওকে এলোপাথাড়ি মারতে থাকে ! হিয়ার শরীরের কোথায় লাগছে তা লতার খেয়াল নেই ! যেন একটা বিষাক্ত সাপ ছোবলে ছোবলে তার রাগ উগরে দিচ্ছে কোন শিকারীর উপর ! গোঙানীর মতো শব্দ করতে করতে লতা বলে চলেছে,”  বল হারামজাদী , এটা কবেকার ঘটনা ? কে তোর এতবড় সর্বনাশ করল তার নাম বল । তুই সারা গ্রামে শুধু নিজের মুখই নয় , আমাদের মুখও পুড়ালি । তোকে  নিজের হাতে খুন করে তবে আমিও লটকে যাব । এ মুখ আর লোককে দেখাব না । ছেলেটার তো লেখা পড়া হল না । ভাবলাম তোকে পড়িয়ে বরং মনের সাধ মেটাব । কিন্তু তুই তাও হতে দিলি না । কে তোর সর্বনাশ করল তার নাম বল – তাড়াতাড়ি নাম বল “।

হিয়া অদ্ভুত মেয়ে বটে ! এত মার খাচ্ছে অথচ মুখে একরাশ যন্ত্রনা নিয়েও টু শব্দটি পর্যন্ত করছে না ! ঐ সামান্য পলকা শরীরটাকে কাঠের মতো শক্ত করে রেখেছে ! অথচ লতা এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছে যে মেয়েটাকে মারতে মারতে এক সময় নিজেই ক্লান্ত হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে !

লতার হাতে যে এতটা জোর তা হিয়ার জানা ছিল না । অবশ্য তা জানবেই বা কি করে ! মা তো তার গায়ে কোন দিন হাতই দেয় নি ! কিন্তু মা আজ তাকে এতটাই মেরেছে যে হিয়া যতটা না ব্যথা পেয়েছে , তার চেয়ে অবাক হয়েছে

অনেক বেশি ! তাই এতটা মার সে মুখ বুঁজে সহ্য করেছে । তবু বলতে পারেনি সেদিনের সেই পাশবিক ঘটনাটা । এখনও ভাবলে হাত-পা রীতিমত ঠান্ডা হয়ে যায় ! চোখের সামনে আগুনের লেলিহান শিখা ছাড়া আর কিছুই সে দেখতে পায় না । তাই সে সব সময় এক অজানিত ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে  ।

তাই হিয়া ঘটনাটা মাকেও বলতে পারেনি  ।  কারণ সব সময় একটা  মৃত্যু ভয় তাকে তাড়া করে বেড়াত । বিশেষ করে সে যখন স্কুলে যেত বা রাস্তা দিয়ে একা একা বাড়ি ফিরত । মনে হত যেন একটা ছায়া হয়তো তাকে দূর থেকে লক্ষ করছে  । হয়তো এখুনি তার পথ আগলে দাঁড়াবে । কিন্তু সে এভাবেই অসহ্য যন্ত্রনার আগুনে পুড়ে খাঁক হয়ে একদিন কাঁদতে কাঁদতে পুকুর ঘাটে গিয়ে এক পুকুর জলের কাছে বলেছিল তার যন্ত্রনার কথা !আর সব উজার করে বলেছিল গ্রামের সবচেয়ে পুরনো বট গাছটাকে !

 

চার

 

বাড়িটা অদ্ভুত ভাবে সুনসান ! এমনটা কোন দিনই হয় না ! অন্তত বোনটাকে দাওয়ায় মাদুর পেতে পড়তে দেখা যায় । কূপির আলোয় চোখ জ্বালা করে বলে ও দিনের আলো থাকতে থাকতেই  স্কুলের  বেশি পড়াটা  সেরে রাখে । অথচ মিন্টু বুঝতে পারে না বোনটা আজ গেল কোথায় !

সারা দিন জনমজুরির কাজ করে অনেকের সাথে মিঠা পুকুরে স্নান  সেরে রোজকার মতো মিন্টু সবে মাত্র আঙিনায়

পা রেখেছে । অথচ এমন নিস্তদ্ধতা সে আগে কখনো দেখেনি ! এর পরে পরেই মা চলে আসে । তারপর চা করে । মিন্টু চা খেয়ে আড্ডা মারতে যায় । প্রায় নয়টা নাগাদ বাড়ি ফিরে সবার সাথে কিছু কথা , ভাত খাওয়া এবং তারপর ঘুম । ব্যস ! এটাই তার রোজনামচা । এবার  মিন্টু বার কয়েক হিয়ার নাম ধরে ডাকে । কিন্তু তবুও কোন সারা শব্দ না পেয়ে ঘরের দরজায় মৃদু  ঠেলা দেয় । বাইরের থেকে ঘরটা অনেক বেশি অন্ধকার । মিন্টু ওর প্যান্টের পকেট থেকে দেশলাই বের করে । রান্না ঘরের কুলুঙ্গি থেকে কূপি এনে ধরায় । এবার ঘরে ঢুকেই  মেঝেতে পর পর মা ও বোনকে শুয়ে থাকতে দেখে ও ভীষণ চমকে ওঠে । সাথে সাথে কয়েক পা পিছিয়ে যায় । ঠিক বুঝতে পারে না ওরা কেন মাটিতে শুয়ে রয়েছে  ! তাহলে কি ঘরে কেউ এসেছিল ! চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় । না, সব তো ঠিকই রয়েছে ।  তাহলে ওদের হলটা কি ! মিন্টু এবার ঝুঁকে পড়ে ভাল করে দেখে । মেঝেতে কোথাও কোন রক্তের দাগ নেই । তবু ইদানীং কিছুই বলা যায় না । এই তো সেদিন কিছু ধর্ষক শাশুড়ি ও বৌমাকে গণধর্ষণ করে গেল । ওরা এখন জামিনে ছাড়া পেয়ে দিব্বি পাড়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে । এতো এখন নিত্য দিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে । তাই মিন্টু এক অজানিত ভয়ের আশংকায় বার কয়েক জোরে মা-মা- বলে ডাক দেয় । আর এতেই কাজ দেয় । শুধু মা নয় , এক সাথে মা-মেয়ে দুজনেই  ধড়ফড় করে উঠে বসে ।

চোখের সামনে ছেলেকে দেখতে পেয়ে লতা আবার কান্না জুড়ে দেয় । বার কয়েক ঢোক গিলে কাঁদতে কাঁদতে বলে “আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে রে মিন্টু, সর্বনাশ হয়ে গেছে ।“

মিন্টু মায়ের সামনে বসে পড়ে বলে,” কী হয়েছে বলবে তো ? তখন থেকে শুধু কেঁদেই চলেছ । কি রে হিয়া , ঘরে কেউ এসেছিল ? তোদের  কী কেউ মারধর করেছে ? “

এবার লতা বার কয়েক হেঁচকি তুলে কান্না থামিয়ে বলে ,”ওসব কিছু নয় রে বাবা , ও সব কিছু নয় । তার চেয়েও অনেক বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে রে মিন্টু । এতে আমাদের মান- সম্মান সব কিছু ধুলায় মিশে গেছেরে মিন্টু । আমরা গরিব হতে পারি কিন্তু এ পাড়ায় এতদিন মাথা উঁচু করে হাঁটছিলাম  । এবার আর তা হবে নারে মিন্টু , আর হবে না । আজ  আমাদের অহংকার করার মতো আর কিছুই বাকি থাকল না  ।“

ব্যাপারটা যে  মিন্টু একেবারেই বোঝেনি তা নয় । তাই এবার হিয়াকে উদ্দেশ করে বলে ,” ব্যাপারটা  ঠিক কী  হয়েছে তুই বলতো হিয়া ? আর কখনই বা ঘটলো ?” হিয়া কোন উত্তর না দেওয়ায় মিন্টু রেগে গলা চড়িয়ে আবার বলে,”  কিরে আমার কথা কানে গেছে ? যা ঘটেছে তা ঠিক ঠাক বল । “

লতা প্রায় টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”  ওর কি কিছু বলার মতো মুখ আছে রে মিন্টু । নিজের মুখ তো পুড়িয়েছে , সেই সাথে আমাদেরও । কি জেদী মেয়েরে বাবা ! এত মার খেয়েও মুখে রা কাটল না !আজ যদি ডাক্তারের কাছে না যেতাম তাহলে তো জানতেই পারতাম না যে ও তলে তলে এত বড় একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে ! “

“কিরে হিয়া বল ছেলেটি কে ? ঘটনাটা কবেকার ? “মিন্টু এক লাফে দাওয়ায় নেমে চালে গোঁজা হাঁসুয়াটা নিয়ে আবার হিয়ার মুখোমুখি দাঁড়ায় । সামান্য আলো আধাঁরিতেও হাঁসুয়াটা চকচক করে ওঠে । হিয়ার ছোট শরীরটা থরথর করে বার কয়েক কেঁপে ওঠে । ও রীতিমত ভয় পেয়ে যায় ।

মিন্টু আবার হুঙ্কার দিয়ে বলে ,”কোন শালা তোর এত বড় সর্বনাশটা করল তার নামটা শুধু একবার আমাকে বল । শালার মাথাটা যদি না নামাতে পারি তাহলে আমার নাম মিন্টু দাস না ।“

হিয়ার গলা শুকিয়ে যায় । ও বার কয়েক  ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিয়ে  কাঁপতে কাঁপতে বলে,”ওর নাম বললে আমাদের সবাইকে পুড়িয়ে মারবে বলেছে । আমি সেই ভয়েই আজো কাউকে ওর নামটা বলিনি ।“

“আরে রাখ ওর পুড়িয়ে মারার গল্প । আগে শালা আমার হাত থেকে তো বাঁচুক, তারপর না হয় পুড়িয়ে মারবে ।“ মিন্টু রাগে কাঁপতে থাকে ।

লতা এবার মেয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,” বল না হিয়া , নামটা বলে দে না । আজ হোক বা কাল হোক নামটা তোকে তো বলতেই হবে । তাহলে যে এত বড় অন্যায়টা করে গেল তার নামটা এখন বলতে তোর  অসুবিধাটা কোথায় !”

হিয়া মাথাটা নীচু করে ঘৃণায় মুখটা বিকৃত করে বলে , “ মধু  !”

লতা ও মিন্টু একসাথে চমকে ওঠে। মিন্টু রাগে গড়্গড় করতে করতে বলে, “ কোন মধু ?  অঞ্চল প্রধান জিতেন সর্দারের ছেলে ?”

হিয়া কোন উত্তর না দিয়ে শুধু মাথা নাড়ে ।

“তাহলে তুই এতদিন ঐ বদমাসটার নাম বলিসনি কেন ? ওকে বাঁচাতে চাইছিস ?” লতা চোয়াল শক্ত করে বলে ।

মিন্টু সাপের মতো হিসহিস করে বলে ,” মা, আমি একটু আসছি  । “

লতা ছেলের মতলব বুঝতে পেরে সাথে সাথে দরজা আগলে বলে ,” তুই কোথাও যাবি না মিন্টু । এখন মাথা গরম করার সময় নয়  ।  এমন একটা উটকো ঝামেলার মধ্যে আবার খুন খারাপি হলে আমরা কি আর বাঁচব ? পুলিশ তো আর গরিবের কথা শোনার জন্য বসে নেই । সবার আগে আমাদের তুলে নিয়ে হাজতে ভরে দেবে । তবে একটা কিছু তো করতেই হবে  । এটা কবে কার ঘটনা বলতো হিয়া  ? “

হিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলে ,” সেদিন গ্রামে ফুটবল ম্যাচ চলছিল । তাড়তাড়ি স্কুল ছুটি হয়ে  যাওয়ায় আমিও বাড়ি চলে আসি । কিন্তু ঐ বদমাসটা যে আমার পিছে পিছে আসছে  তা আমি টের পাইনি । আমি ঘরে ঢুকে বই-খাতা রাখার সাথে সাথে——“

লতা মিন্টুর হাত থেকে হাঁসুয়াটা নিয়ে বলে্‌ ,” মিন্টু ,আমাদের যা সর্বনাশ হওয়ার তা তো হয়েই গেছে । তাই ব্যাপারটা বরং থানায় জানিয়ে রাখা ভাল । তবে তোর পরিচিত কাউকে ব্যাপারটা জানাবি কিনা সেটা ভেবে দেখ । মনে রাখিস , যার বিরুদ্ধে নালিশ করব সে কিন্তু অঞ্চল প্রধানের ছেলে  ।“

ঘরের আলো-আঁধারি থেকে লতা ও মিন্টু রাস্তায় এসে দাঁড়ায় । কিছু পরে হিয়াও ভয় পেয়ে ঘরের বাইরে চলে আসে । বাইরের অন্ধকারটা তখনও অতটা গাঢ় হয়নি । ও দাওয়ার খুঁটি ধরে বসে পড়ে । আর তখনই আঙিনার দক্ষিণ কোণের নিম গাছটা থেকে একটা পেঁচা সামনের ঝোপ থেকে ছোঁ মেরে একটা ইদুর তুলে নিতে চায় । কিন্তু ব্যর্থ হয় । ইদুরটা যে আহত হয়েছে তা ওর চলে যাওয়ায় পাতার একটানা খসখস শব্দ থেকেই  হিয়া বুঝতে পারে । ঐ ইদুরটার জন্য মায়া হলেও হিয়ার এই ভেবে ভাল লাগল যে  অত ছোট প্রাণীটাও একা একাই উঠে দাঁড়িয়েছে । হয়তো এবার সে নিজের খাবারটা নিজেই জোগাড় করে নিতে পারবে ।

 

পাঁচ

 

থানা যে গরিব ও অসহায় মানুষের জন্য নয়,তা জানলেও লতা এই মুহূর্তে ভুলে গিয়েছিল । মনে পড়ল,যখন প্রায় ঘন্টা খানেক তাদের থানার বারান্দায় বসিয়ে রেখে বাবুরা নিজেদের  মধ্যে হাসি মস্করা  করছিল । এভাবে বহুক্ষণ অপেক্ষা করার পর যখন দেখা গেল এরা তবু বসে আছ, তখন বাধ্য হয়ে ওদের ডাক পড়ল মেজ বাবুর ঘরে ।

ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতেই মেজ বাবু ওদের আপাদমস্তকে ভাল করে চোখ বুলিয়ে ইশারায় জানতে চাইলেন ব্যাপারটা কী !

লতা আমতা আমতা করে বার কয়েক ঢোক গিলে বলল , “আঁজ্ঞে, দারোগা বাবু , আমার মেয়েটাকে  একজন নষ্ট করে দিয়েছে  ।“

মেজ বাবু মাথা নীচু করে একটা বড় খাতায় কলম ছুঁইয়ে রেখে বলেন ,” নষ্ট যখন করেই দিয়েছে তখন আমরা আর কী করতে পারি বল ? নষ্ট হওয়ার আগে এলে না হয় একটা ব্যবস্থা করা যেত ।  তা মালটা কে ? কোথায় থাকে ? “

“অ্যাঁজ্ঞে, আমাদের পূব পাড়ার ছেলে ।“  লতা বলে ।

“তুমি কি নিজের চোখে মেয়েকে নষ্ট হতে দেখেছ ? তখন ওর মনের অবস্থাটা কেমন ছিল তা বলতে পার ? “ মেজ বাবু  মুচকি হেসে জানতে চান ।

“সব কিছু কি নিজের চোখে দেখার প্রয়োজন হয় দারোগা বাবু ? তাছাড়া  আমি ওর মা । আমি কি আর বুঝতে পারব না ।“  লতার গলায় একটা কাঠিন্য প্রকাশ পায় ।

“তখন বাড়ি ছিলে না ? “ এবার মেজ বাবু তার মোটা খাতা থেকে মাথা তোলেন ।

“ আ্যাঁজ্ঞে না দারোগা বাবু । আমি শহরে বাবুদের বাড়িতে কাজ করি । সেই ভোরে যাই আর ফিরি সন্ধায় । আমি থাকলে কি আর ঐ শয়তানটাকে ছেড়ে দিতাম ।“ লতার গলা থেকে একরাশ ক্রোধ ঝরে পড়ে ।

কলমটা বার কয়েক টেবিলে ঠুকে মেজ বাবু বলেন , “তাহলে তোমার বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায় বললে , তাই না ?”

লতা মুখে কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়ে ।

“ বাঃ ! তাহলে তো এটা ধরে নেওয়াই যায় যে ছেলেটা তোমার অনুপস্থিতিতে অনেক বারই বাড়িতে এসেছে । মাত্র একবার এল আর সাথে সাথে তোমার মেয়ে নষ্ট হয়ে গেল, এ তো হতে পারে না  ! নাকি তোমার মেয়ে আজ বিপদে পড়েছে বলেই তুমি থানায় ছুটে এসেছ । কোনটা  সত্যি সেটা বল । “ মেজ বাবু লতার চোখে চোখ রাখেন ।

লতা আঙুলে আঁচল পেঁচাতে পেঁচাতে ভাবে ,সত্যিই  তো ,ছেলেটা মাত্র একবার এল আর অমনি হিয়া পেট বাঁধিয়ে বসল , তাই বা হয় কি করে ! হিয়া ওর কাছে কিছু লুকোচ্ছে না তো ! দারোগা বাবুর যুক্তিটা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো না । তাহলে ছেলেটা কি অনেক দিন ধরেই যাতায়াত করছিল ! কিন্তু মন কিছুতেই এটা বিশ্বাস করতে চাইছে না । কারণ হিয়া কখনও মিথ্যা কথা বলে না । ও মিথ্যাবাদী নয় । আর এটা পাড়ার অনেকেই জানে । ছোট থেকেই ও ‘হ্যাঁ’কে হ্যাঁ আর ‘না’কে না বলে এসেছে । আবার দারোগা বাবুর কথাটাও একেবারে ফেলে দেওয়া যায় না ।

লতাকে এতক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে মেজ বাবু সামান্য গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন ,” কী হল ? চুপ করে আছ যে । মেয়েটা কতটুকু নষ্ট হয়েছে তা  বললে না তো ?”

লতা কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে থাকে । তারপর আমতা আমতা করে বলে ,         ” অ্যাঁজ্ঞে , দারোগা বাবু , আজ মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার বাবু বললেন ও নাকি দু মাসের পোয়াতি ।“

“অ্যাঁ , বল কি ? তা মেয়ের  বয়স কত ? “ মেজ বাবু বেশ চমকে ওঠেন ।

“অ্যাঁজ্ঞে দারোগা বাবু, এই সবে বার পার করল । কেলাস  সিক্সে পড়ে । প্রত্যেকবার কেলাসে প্রথম হয় । “

লতা হয়তো আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ,কিন্তু মেজ বাবু হাতের ইশারায় ওকে থামিয়ে দিয়ে ভূরু কুঁচকে  বলেন  “ বার বছর বয়সেই প্রেগন্যান্ট ! হাউ ইট ইজ পসেবল ! অবশ্য বিদ্যাসাগর মহাশয় নাকি তার মায়ের মাত্র বার বছর বয়সেই হয়েছিলেন ! কিন্তু সে তো পুরনো কালের ঘটনা । এখন এমনটা আবার হয় নাকি ! তুমি কেমন মা , যে ডাক্তার বাবু বললেন তবে তুমি বুঝতে পারলে ! আগে মেয়ের ভাব গতি দেখে বুঝতে পারনি ?”

“আমার একটু খটকা লেগেছিল বলেই তো আজ ডাক্তার বাবুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম । ডাক্তার বাবুর কথা শুনে তো আমার মাথা ঘুরে গেছে !” লতা বারকয়েক মাথা নেড়ে কপালে হাত দেয় ।

মেজ বাবু মিন্টুকে দেখিয়ে বলেন ,” এ ছেলেটি কে ?”

“এ আমার ছেলে । মিন্টু । আমার এই একটা ছেলে আর একটা মেয়ে । এই নিয়েই বাবু আমার গরিবের সংসার । ও তো বাড়িতে থাকে না । সেই সকালে লোকের জমিতে জন মজুরি খাটতে চলে যায় আর আসে সেই সন্ধায় । বলতে গেলে মেয়েটাই বাড়িটা আগলে রাখে  ।“

মেজ বাবু এবার তার টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা সিগারেট বের করে ধরায় । পর পর বেশ কয়েকটা  মৃদু টান দিয়ে টেবিলে টোকা মেরে বলেন ,”  তা সেই ছেলেটি কে ?”

“ওর নাম হল মধু – মধু সর্দার বাবু  । বাড়ি পূব পাড়ায় । “ লতা মেজ বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে ।

“আরে এভাবে বললে হয় নাকি ! মধু সর্দার তো আরো থাকতে পারে । কার ছেলে তা বলতে হবে । তা না হলে আমরা খুঁজবো কি করে ।“ মেজ বাবু এবার সিগারেটে টান দিয়ে  রিং ছাড়েন ।

“অ্যাঁজ্ঞে দারোগা বাবু ওকে না চিনলেও ওর বাবাকে সবাই চেনে । ও হল অঞ্চল প্রধান জিতেন সর্দারের ছেলে ।“ লতা এটুকু বলে থেমে যায় ।

মেজ বাবু আয়েস করে আরো কয়েকটা রিং ছাড়তে যাচ্ছিলেন । কিন্তু অঞ্চল প্রধান জিতেন সর্দারের নাম শুনেই বেদম বিষম খেলেন । তারপর কাশতে শুরু করেন । মাথাটা চেয়ারের পেছনে এলিয়ে দিয়ে আন্দাজে টেবিল হাতরে জলের

গ্লাসটা তুলে  নেন । একটু  চুমুক দিয়ে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে “সরি” বলেন । এবার শরীরটাকে টান করে সোজা হয়ে বসে বলেন ,” আমার শরীরে কয়টা মাথা আছে বল তো ?”

লতা  বুঝতে পারে না এ কথার কি উত্তর হতে পারে । তাই একটা অস্বস্তি নিয়ে ঠায় বোকার মতো মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে ।

মেজ বাবু আবার বলেন ,”  কী হল , কোন উত্তর দিলে না যে ? একটার বেশি দুটো মাথা দেখতে পাচ্ছ কি ? নিশ্চয়ই না । থাকলে তো দেখতে পাবে । তাহলে কেন আমি সাধ করে আমার মাথাটা খোয়াতে যাব বলতে পার ? তুমি যার নাম বললে তার নামে বাঘে-গরুতে একই ঘাটে জল খায় । তখন কেউ কাউকে দেখতে পায় না । মাঝখান থেকে আমি কোন ব্যবস্থা নিলে নির্ঘাৎ সান্টিং খেয়ে যাব । কোন শালাই আটকাতে পারবে না । তারচেয়ে একটা কথা বলি শোন , তা হল ওরা বাচ্চা ছেলে-মেয়ে । খেলতে খেলতে ঘটে যাওয়া সামান্য ছোট ঘটনাকে বরং তোমরা নিজেরাই মিটিয়ে নাও । এসবের জন্য থানায় এসে রিপোর্ট লেখানোর কোন দরকার নেই । এসব করলে মেয়েটাকে নিয়ে শেষে টানাটানি হবে । সে এক কেচ্ছা-কেলেঙ্কারীর ব্যাপার । তার চেয়ে যদি চাও তাহলে আমি প্রধানের সাথে কথা বলে কিছু টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করে দিতে পারি । এখন বাড়ি যাও । “

“তাহলে আমাদের কেসের কি হবে ? “এবার মিন্টু জানতে চায় ।

“কি আবার হবে । কেস হবে না । কাল বরং নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ব্যাপারটা মিটিয়ে নাও । তোমারা হলে গরিব মানুষ । তোমাদের না আছে অর্থ বল , না আছে লোক বল । কেস করলে তোমরা পেরে উঠবে না । তাই বলি ডাঙায় থেকে  কেন বাঘের সাথে লড়াই করতে যাবে । এরাই তো এখন সরকারের ডান হাত- বাঁ হাত ! তাই আমরাও  তোমার কথার থেকে ওদের কথাকেই বেশি গুরুত্ব দেব । তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি । কিন্তু আমারও কিছু করার নেই  । “ মেজ বাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান ।

লতা ও মিন্টু থানার চৌহদ্দি ছাড়তে না ছাড়তেই  অঞ্চল প্রধান জিতেন সর্দারের মোবাইলে পাগলু বাজতে শুরু করে । প্রধান একবার নম্বরটা দেখে নিয়ে তাড়াতাড়ি বলে ,” কী ব্যাপার মেজ বাবু ! হঠাৎ এমন অসময়ে আপনার ফোন ! না,না , এত তাড়াতাড়ি কি বিছানায় যাবার উপায় আছে । টানা তিন মাস তো নাওয়া-খাওয়ার কোন উপায় ছিল না । এ তো আপনার অজানা নয় । হ্যাঁ-হ্যাঁ , আপনাদেরও তো একই অবস্থা । রাজ্যের পুলিশকে অবজ্ঞা করলে কি হয় তা তো এবার সবাই দেখতেই পেল  । ঐ দিল্লিওয়ালা একেবারে ভির্মি খেয়ে গেছে । উনি ভেবেছিলেন এটা বুঝি বিহার-উত্তর প্রদেশ । আরে আমাদের মাথা যে আরো উর্বর তা ওনার জানা ছিল না । ভোট কী ভাবে করাতে হয় তা আমরা বেশ ভালই জানি । এর জন্য আপনাদের শুধু শুধু ধন্যবাদ দেব না । অবশ্যই পুরস্কৃত করব । যথা সময়ে মনপসন্দ জিনিসও পেয়ে যাবেন । হ্যাঁ -হ্যাঁ বলুন-বলুন । “ প্রধান তার মোবাইলটাকে কানের সাথে ঠেসে ধরে । ঘরে আরো লোক থাকায় শেষে বাধ্য হয়ে বারান্দায় চলে যায় । গলাটাকে যতটা পারা যায় খাদে নামিয়ে বলে,” ভাল করেছেন ওদের এফ আই আর করতে না দিয়ে । আমি জানি আপনার সে দক্ষতা আছে । ব্যাপারটাকে ম্যানেজ  করে নিন  । সবে মাত্র মন্ত্রী সভা গঠন হয়েছে  । তারমধ্যে এটা একটা উটকো ঝামেলা । আমার এখন পাগল পাগল অবস্থা । আমার অঞ্চলে ভোটের ফল সামান্য খারাপ হয়েছে  । জানি এবার গলা টিপে ধরবে । ওনার যা মুখের ভাষা তা আমাদের কানকেও লজ্জা দেয় । হ্যাঁ-হ্যাঁ আপনারাও তা বিলক্ষণ জানেন  । তাই বলছিলাম কাইন্ডলি ব্যাপারটাকে ম্যানেজ করে নিন । আপনারটা কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি । ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না । শুনুন মেজ বাবু , আপনি আমার সবই জানেন । আপনাকে কিছু লুকোই না । তাই বলছি , আমার এই ছেলেটাকে নিয়ে বড় চিন্তায় আছি । ও এর আগেও এমনটা ঘটিয়েছে । তবে এবারের মতো নয় । মেয়ে দেখলেই ছুক ছুক করে । তা ভাবছি যত তাড়াতাড়ি পারি ওর বিয়েটা দিয়ে দেব । তাহলে যদি অন্তত ছেনালিপনাটা কমে । হ্যাঁ-হ্যাঁ আমি দেখছি ওরা কত টাকা নিলে মুখ বন্ধ রাখবে । আর আমি বরং সালিশি সভার মাথাদের সাথে একবার কথা  বলে নেই, আমি আপনাকে পরে জানাব। পারলে একবার না হয়  ঘুরে যাবেন । আপনাকে দেখলে ওরাও একটু— হ্যাঁ-হ্যাঁ,  রাখছি , গুড নাইট  ।”

 

ছয়

 

সালিশি সভা বসলে গ্রামের লোকের মধ্যে একটা অদ্ভুত উৎসাহ দেখা যায় । পালাগান বা যাত্রা দেখার মতো তাড়াতাড়ি হাতের কাজ সেরে তারা হাজির হয় । আসলে বিনা পয়সায় এমন মুচমুচে কেচ্ছা-খেউড় শুনতে কারই না ভাল লাগে । আসলে এটাও ওদের কাছে একটা বিনোদন । তাই সভা শুরুর আগে থেকে অনেকেই আশে-পাশের গাছের ডালে উঠে বসেছে  মজা দেখার জন্য । বিশেষ করে গ্রামের ছেলে-ছোকরারা ।

জিতেন সর্দার অঞ্চল প্রধান হতে পারে কিন্তু মোড়লের ডাকা কোন সালিশি সভাকে সে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে পারে না । তাকে ডাকলে আসতেই হবে । তাই সে ছেলে মধুকে নিয়ে হাজির হয়েছে ।

সভার শুরুতেই মোড়ল বলল ,” আমাদের কাছে একটা নালিশ জমা পড়েছে , যাতে লেখা আছে যে আমাদের অঞ্চল প্রধান জিতেন সর্দারের ছেলে মধু ঐ একই পাড়ার কনকলতা দাসের মেয়ে হিয়ার সাথে বাজে কাজ করেছে । তাতে সে এখন পোয়াতি   । তারা  এই অন্যায়ের  বিধান চায়  ।“

মোড়লের কথা শেষ হতে না হতেই প্রধান তার ডান হাতটা উঁচু করে বলল –, “এই মোড়ল ,তুমি এবার একটু থাম হে । তা ঐ কনকলতা দাসটা কে আছে ? “

মোড়ল প্রধানকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য বলল ,” কনকলতা হল বিনোদবিহারী দাসের প্রথম পক্ষ ।“

“হ্যাঁ-হ্যাঁ বুঝে গেছি – বুঝে গেছি । সারা গ্রাম জানে যে ঐ বিনোদের চরিত্রের কোন ঠিক নেই । ঘরে বউকে রেখে ওর যাতায়াত ছিল ঐ সব ছেনালি পাড়ায় । এখন তো শুনেছি ওদেরি কাকে নিয়ে নাকি থাকে । তার মেয়ের শরীরে তো একই রক্ত বইছে , নাকি ? তাহলে সে আর কতটা ভাল হবে বল  । তাছাড়া আমার ছেলেকে তো তোমরা সবাই চেন  । এমন ছেলে এ তল্লাটে আর কয়টা আছে শুনি ? তাই বলছিলাম—“

এবার ঐ সভা থেকে একজন বলে ওঠে ,” ওহে মোড়ল , এ সালিশি সভাটা কে ডেকেছে , তুমি না প্রধান ? দোষি পক্ষের কথা পরে শোনা হবে । তুমি সভা চালাও  ।“

অনেকেই এই কথাকে সমর্থন করে । তাই মোড়ল এবার  প্রধানের দিকে তাকিয়ে বলে ,” আমি যে অভিযোগ পেয়েছি  তা আমি পড়েছি । কিন্তু ঘটনাটা আরো ভাল ভাবে না শুনলে বিচার করা যাবে না । তাই আমি আবেদনকারী  কনকলতাকে বলব সে যেন  ঘটনাটা পুরো বলে ।“

কনকলতা দাস মোড়লের ইশারায় উঠে দাঁড়ায় । শুকনো গলাটাকে ঢোক গিলে ভিজিয়ে নেয় । তারপর বলে,   “আমার মেয়ে হিয়া কেলাস সিক্সে পড়ে  । পত্তিবার সে পত্থম হয় । যেদিন আমাদের গেরামে ফুটবল হচ্ছিল সেদিন ইস্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে যায়  । ও বাড়ি আসার পথে একটা চ্যাংড়া ওর পিছে পিছে আসছিল । ও দেখতে পায়নি । কিন্তু ঘরে ঢুকতেই ঐ চ্যাংড়াটা ওর সাথে জোর করে বাজে কাজ করে । মেয়েটা ভয়ে কাউকে বলতে পারেনি  ।“

কিছু লোক সাথে সাথে চিৎকার করে ওঠে , “ আরে ঐ চ্যাংড়াটার নাম বল – নাম বল –।“

কনকলতা একবার সভায় উপস্থিত প্রধানের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলে –,”ঐ চ্যাংড়াটার নাম হল মধু সর্দার । প্রধান জিতেন সর্দারের ব্যাটা  ।“

মোড়ল ভূরু কুঁচকে বলে ,” শুনলাম তোমরা নাকি গতকাল নালিশ জানাতে থানায় গিয়েছিলে ? তা এতদিন আগেকার ঘটনা জানাতে এত  দিন পড়ে থানায় গেলে কেন ? আমাদের আগে জানালে না কেন  ?”

“ঐ যে বললাম ভয়ে ।“ লতা বলে ।

“তা কিসের ভয় শুনি ।“  মোড়লের পাশ থেকে একজন বলে ওঠে ।

তৎক্ষণাৎ প্রধান বলে ওঠে –, “মোড়ল, তুমি কেমন মোড়ল শুনি ! তোমার অনুমতি ছাড়াই কে ফোঁড়ন কাটে    হে ? “

মোড়লের অস্বস্তি হয় । কারণ আজ সকালেই প্রধান তাকে ডেকে পাঠিয়েছিল । মোড়লকে পুরো একশো দিনের কাজ দেবে বলেছে । তবে হ্যাঁ , এই সভায় সে তো আর একা নয়  । বাকিদেরও বলার অধিকার রয়েছে । অবশ্য শেষ সিদ্ধান্তটা সেই নেবে  । তাই সে কনকলতাকে বলার জন্য ইশারা করে ।

লতা ভাবছিল সে ব্যাপারটা বলবে কিনা ।  কিন্তু এখন না বললে সে বলবেই বা কখন । হাজার হোক গ্রামের মাথাদের ব্যাপারটা শোনা উচিত । তাই সে বলে, “জিতেন সর্দারের ছেলে শাসিয়ে ছিল যে এই ব্যাপারটা কেউ জানলে রাতে ঘরে আগুন লাগিয়ে সবাইকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হবে । সেই ভয়েই আমার মেয়ে এতদিন কাউকে এমনকি আমাকেও কিছু বলেনি । কিন্তু এখন তো আর না জানিয়ে উপায় নাই ।“

“কেন , উপায় নাই কেন ? “ মোড়ল জানতে চাইল ।

এমন সময় প্রধান গলা খাঁকাড়ি দিয়ে বলে –,” আমিও লাইনে আছি হে মোড়ল । আমাকে দু-চার কথা বলার সময় দাও।“

এবার মোড়ল গলা চড়িয়ে বলে , “ চিল্লিয়ে কোন লাভ নাই । আমাকে তো সব্বার কথাই শুনতে হবে , নাকি ! তাছাড়া আমার সবই মনে আছে । তোমার কথা ভুলি নাই  ।“  মোড়ল আবার লতাকে ইশারা করে বলার জন্য ।

“আসলে দিন দুয়েক আগে ডাক্তার বাবু বলল যে আমার মেয়ে নাকি পোয়াতি । প্রায় দু মাস হল । তারপরেই সব জানতে পারলাম । এখন গেরামের মাথারাই সব শুনে বিচার করুক অন্যায়টা কার । “ লতা মোড়লের দিকে তাকায় ।

এবার প্রধান মোড়লের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই গলা চড়িয়ে বলে ,” এর সবটাই মিথ্যা । বিরোধীরা আমাদের ফাঁসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে । সেদিন আমার ছেলে আমার পাশে বসে আগাগোড়া খেলা দেখেছে । তারপর আমার সাথেই বাড়ি ফিরেছে । সাথে ওর বন্ধুরাও ছিল ।“

মিন্টু এতক্ষণ ধরে একটাও কথা বলেনি । কিন্তু এবার সে প্রধানের কথা শুনে  বলে ,” কি বললেন আপনার ছেলে আপনার পাশেই বসে খেলা দেখছিল । সে তো হতেই পারে । তার আগেই তো ও ঘটনাটা ঘটিয়ে ফেলেছে । তারপরে ভাল ছেলের মতো বাপের পাশে বসে খেলা দেখেছে । যাতে কেউ ওকে সন্দেহ না করে । আর বিরোধী দল বলছেন কাকে ? এ গ্রামে তো সব ভোটই একটা দলই পেয়ে আসছে । তাহলে বিরোধীরা এল কোথা থেকে ? যদিও বা দু-এক ঘর থাকেও তাহলে কি তাদের মা-বোনদের সাথে এমন ঘটনা ঘটাতে হবে ? তারা কি আপনার ছেলের হাতের খেলার পুতুল নাকি ? মোড়ল আমরা এর ন্যয্য বিচার চাই  ।“

বেশ কিছুটা সময় অনেকগুলো মাথা প্রায় ঠোকাঠুকি করে বসে রইল । এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি ! গ্রামের ছেলে গ্রামেরই একটা মেয়েকে শুধু ধর্ষণই করেনি , মেয়েটি গর্ভবতীও হয়েছে । কাজটা যে আদৌ ভাল হয়নি তা সবাই এক বাক্যে মেনে নিয়েছে । কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে অন্য জায়গায় । সে তো আর যার তার ছেলে নয়  । স্বয়ং প্রধানের ছেলে । এই ব্যাপারটা বিচারের সময় যেন সবার মাথায় থাকে । এর পরে একশো দিনের কাজ রয়েছে । যতটুকু ছিঁটে ফোটা পাওয়া  যাচ্ছিল,রায় বিপক্ষে গেলে তা নাও মিলতে পারে । আবার বিচারটাও যেন বিচারের মতোই হয় , সেটাও মনে রাখতে হবে । সিদ্ধান্ত নেবার আগে এ কথাটাই মোড়ল সবাইকে মনে করিয়ে দিল ।

মোড়লের গলা খাঁকাড়িতে এতক্ষণ ধরে যারা নিজেদের মধ্যে গল্প করছিল,বিড়ি খাচ্ছিল , তারা এবার নড়েচড়ে  মেরুদন্ড সোজা করে বসে । কারণ এবার মোড়ল তার মতামত জানাবে  ।

সভার গুঞ্জন আস্তে আস্তে প্রশমিত হয়ে এলে মোড়ল বলে ,”আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা হল গ্রামের একটা ছেলে আর একটা মেয়ে যে ঘটনা ঘটিয়েছে তা আমাদের গ্রামেরই লজ্জা । কাজটা মোটেই ঠিক হয়নি । দুজনেই বাচ্চা ছেলে-মেয়ে । ওরা একেবারে কৌ্তুহল বশতই এমনটা ঘটিয়ে ফেলেছে । জেনে বুঝে

করেনি । কিন্তু এর সাথে গ্রামের ইজ্জৎ জড়িয়ে রয়েছে । তাই সালিশি সভা দুটি বিধানের কথা ভেবেছে । একটা হল , এই ঘটনার জন্য দোষি সাব্যস্ত হয়েছে মধু সর্দার । ওকে দু হাজার টাকা জরিমানা করা হল । ও ঐ টাকা দেবে কনকলতা দাসকে । আর দ্বিতীয়টা হল , গ্রামের ইজ্জতের কথা ভেবে কনকলতার মেয়ে হিয়া তার পেট খসিয়ে ফেলবে । এর সব খরচ দিতে হবে মধু সর্দারকে । এ ব্যাপারে কনকলতার  কিছু বলার থাকলে সে বলতে পারে  ।“

কনকলতা উঠে দাঁড়িয়ে বলে ,” এ বিধানে এখন আমি কিছুই বলতে পারব না । আমার মত দেওয়াটা ঠিকও হবে না  । আমার মেয়ের সাথে কথা না বলে কোন সিদ্ধান্ত জানান সম্ভব নয়  । তবে মেয়ে কি বলে তা আমি মোড়লকে পরে জানিয়ে দেব  ।”

 

সাত

 

বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হিয়ার হঠাৎ মনে হয় ছেলেরা ধর্ষণ করলে তা ভুল করে হয়ে গেছে বা ছোট ব্যাপার বলা হয় কেন ! কই  কোন গ্রামে তো এমন ঘটনা  শোনা যায় না যে কোন মেয়ে কোন ছেলেকে জোর করে ধর্ষণ করেছে ! তাহলে মেয়েদের দিকেই সব সময় আঙুল ওঠে কেন ! বাগদি পাড়ার কমলিকে যারা ধর্ষণ করে মনসা তলায় ফেলে রেখে গেল কই তাদের তো কিছু হল না ! বরং তারা দিব্বি মিটিং -মিছিল করে পাড়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ! কিন্তু তাদের তো এখন জেলে থাকার কথা । অথচ কমলি লজ্জার হাত থেকে বাঁচার জন্য ফাঁসি দিল । তাহলে যারা গরিব , অসহায় তাদের কথা শোনার কি কেউ নেই ! তাই এই সালিশি সভা ও পুলিশের উপর হিয়ার কোন আস্থা নেই । হিয়া বুঝে গেছে যে ওরা রয়েছে বড় লোকদের জন্য , গরিবদের জন্য নয়  ।

এমন সময় বাইরের পলকা বাতার দরজাটা খোলার শব্দ হল । লতা – মিন্টু বাড়ি ঢুকলে ওদের বড় বিধ্বস্ত দেখায় । হিয়া মনে মনে প্রমাদ গোনে ।

লতা থপ করে দাওয়ায় বসে খুঁটিতে হেলান দেয় । আঁচলে মুখ মোছে । হিয়া তাড়াতাড়ি রান্না ঘর থেকে এক ঘটি জল এনে মাকে দেয় । লতা এক আঁজলা জল নিয়ে চোখে মুখে দেয়  । তারপর ঢক ঢক করে খেয়ে মিন্টুর দিকে এগিয়ে দেয় ।

এমন কঠিন অথচ বাস্তব নিশ্চুপতা হিয়ার ভাল লাগে না । ও ভীষণ উদ্বেগ নিয়ে জানতে চায় ,” মা, সালিশি সভা কী বিধান দিল  ।“

লতা সারা মুখে একরাশ তাচ্ছিল্য নিয়ে বলল ,” কী আবার দেবে । ওদের দু হাজার টাকা জরিমানা দিতে বলল । আর তোকে বলল পেট খসিয়ে ফেলতে । তার খরচও ওরা দেবে  ।“

“না, কক্ষনো না  । “ একটা চিল চীৎকার দিয়ে হিয়া আঙিনায় থপ করে বসে পড়ে ।

ব্যাপারটা বুঝে নিতে ওদের একটু সময় লাগে । তারপর ধাতস্ত হয়ে লতা বলল ,” কেন ! না কেন ? পেট খসাতে যত খরচ লাগবে সব তো ওদেরই দিতে হবে । এটাই সালিশির বিধান । “

“না ,এ বিধান আমি মানি না । আমি তা হতে দেব না ।“ হিয়ার গলা দিয়ে একটা গোঙানীর মতো শব্দ বেরিয়ে আসে !

“মা তো ঠিকই বলেছে হিয়া । ওরা যখন সমস্ত খরচ খরচা দেবে বলেছে তখন না করছিস কেন ? তাছাড়া এই কলঙ্ক নিয়ে তুই গ্রামে এরপর আর মুখ দেখাতে পারবি ? আমরা পারব ? রাস্তায় , পুকুর ঘাটে লোকের টিটকারি শুনতে হবে না ? ওদের মুখের উপর কোন উত্তর দিতে পারবো ? তাছাড়া যে আসবে সে তো মাথায় কলঙ্ক নিয়ে জন্মাবে । অথচ

ওর কোন দোষ নেই । পরে ও তোকে বড় হয়ে দোষারোপ করতে পারে । তারচেয়ে বরং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ পাপ বিদায় করে দে । তারপর আবার পড়াশুনোয় মন দে । দেখবি তোর ভালই হবে ।“  মিন্টু এভাবেই বোনকে বোঝায় ।

মিন্টু থামতেই লতা ওর জেদী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ,” হিয়া , দাদার কথাটা একবার শোন মা । আমরা গরিব । আর ও হল প্রধানের ছেলে । ওরা যে কোন সময় আমাদের ক্ষতি করতে পারে । ওদের হাতেই এখন ক্ষমতা । দেখলি না প্রধানের নাম শুনেই থানার দারোগা বাবু আমাদের নালিশ জানাতে দিল না  । এমনিতেই আমাদের সংসার কীভাবে চলে তা তো তোর অজানা নয় । তোর জেদ শুধু তোকেই নয়,  সাথে আমাদেরও মারবে । এত সব জেনে বুঝেও তুই বলছিস  যে খালাস করাবি  না । জেদের বশে এমন সিদ্ধান্ত নিস না হিয়া  ।“

“মা, তুমি একজন মা হয়ে এ কথা বলতে পারলে ! তোমার মেয়েকে তুমি খুনি বানাতে চাইছ ! একটা নিষ্পাপ প্রাণকে হত্যা করা কি পাপ নয় মা ? “ হিয়ার গলা ক্রমশই ভারী হয়ে আসে ।

“ তুই কেন খুনি হবি হিয়া ? খুনি তো হবে ঐ ডাক্তার বাবু যিনি বাচ্চাটাকে খালাস করাবে । পাপ হলে ওরই হবে , তোর নয় । “  লতা এভাবেই হিয়াকে বোঝাতে চায় ।

হিয়া একটু চুপ করে থেকে ব ,”  মা, আমিই তো ডাক্তার বাবুকে কাজটা করার জন্য আনুমতি দেব । তাহলে তার দোষটা হবে কেন ? তাছাড়া এই কাজটা তার পেশার সাথে যুক্ত । তাই পাপটা পুরো আমারই হবে । তাছাড়া তোমাদের একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দেই , তাহল দোষ যদি হয়ে থাকে তা আমারই হয়েছে । যে আসছে তার নয় । তাই  আমি যে অন্যায়টা একবার করেছি তা আর দ্বিতীয় বার করতে পারব না মা । আমাকে করতে বল না  ।“

মিন্টু এতক্ষণ ধরে বোনের জ্ঞানের কথাগুলো শুনছিল । এবার আর ধৈর্য রাখতে না পেরে সটান হিয়ার চুল ধরে এক চড় কষায় । হিয়া কোন মতে তল পেটটা দুহাতে আগলে রেখে আঙিনায় আছড়ে পড়ে । মিন্টু মনে মনে বলে, গরিবের সম্বল হল তার মান সম্মান । হিয়া সেটুকুও মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে । তবু মুখে সেই একই কথা –‘ ক্ষতি পূরণ দিয়ে কি ধর্ষণ বন্ধ করা যায় ! এতে তো ধর্ষকের কোন ক্ষতি হয় না ! তাই যে আসছে তাকে বাঁচিয়ে রেখেই আমার লড়াই শুরু হবে  ।‘

হিয়ার মুখের কথাকে কেউ কেউ সমর্থন করল বটে তবে অনেকেই আবার বলল ,  “মেয়েটা এটা ঠিক করল না । ওর বড় গুমোর হয়েছে ।“

শহরে যেমন ঘরের কথা ঘরের মধ্যেই রয়ে যায় ,গ্রামে ঠিক তার উলটো । গ্রামের যে কোন কথা হাওয়ার পিঠে চড়ে পুকুর ঘাট,মাঠ-পাথার পার হয়ে ছুটতে থাকে শহরের দিকে । তাই শহরের বাবুদের কানে অজ গাঁয়ের কথা পৌছাতে খুব একটা দেরি হল না । আর অমনি তাদের চাপে গ্রেপ্তার হয় ধর্ষক মধু সর্দার । আর এই খবরে হিয়ার জেদটা আরো প্রবলভাবে  ওকে জাপ্টে ধরে । হিয়া নবাগত অতিথির জন্য প্রহর গোনে । মনে মনে নিজেকে আরো তৈরি করতে থাকে ।

 

আট

 

ছেলে-মেয়েকে খেতে দিয়ে অনেক্ষণ ধরেই লতা ভাবছিল সে ওদের কথাটা বলবে কিনা । শেষে হিয়ার পাতে দুটো ভাত দিয়ে বলেই ফেলল,” আজ রাস্তায় পূব পাড়ার পচার মায়ের সাথে দেখা । ও নাকি আমাদের বাড়িতেই আসছিল ।“

মিন্টু হাত চাটতে চাটতে বল্‌,” জিজ্ঞাসা করলে না কেন আসছিল ?”

“হ্যাঁ, তা জানতে চাওয়ায় সে বলল –প্রধানের বউ নাকি বলেছে যে তার ছেলে যে অন্যায় করেছে তার সাজাও সে পেয়েছে । ওরা চাইছে হিয়া ওদের বাড়ির বউ হোক । বিয়ের সব খরচ ওদের। তবে তার আগে আমরা যেন কেসটা তুলে নেই ।এটা বলার জন্যই সে আমাদের বাড়ি আসছিল ।

মিন্টু থালা উঁচু করে টক ডালটা সুরুৎ করে মুখের মধ্যে টেনে নিয়ে বল্‌, “ দেখ মা, অনেক ঘটনাই তো ঘটলো । আমাদের মুখও পুড়ল । তাই যার ব্যাপার তার মতটাই আসল । তবে প্রস্তাবটা আমার কিন্তু মন্দ লাগেনি ।

লতা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল,”  কিরে হিয়া ,যা বললাম তা শুনলি তো ?”

“ হ্যাঁ ।“ হিয়া যে এর বেশি কিছু বলবে না তা লতা জানে ।

“ তাহলে তোর মতটা বল । ওদের তো জানাতে হবে ।“ লতা উৎসাহ নিয়ে বলে ।

হিয়ার খাওয়া হয়ে গেছে । ও এঁটো থালায় আঁকি-বুকি কাটছিল ।ইদানীং হিয়ার এসব ব্যাপার নিয়ে কারোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। তবু অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলল ,” তুমি যা বললে তা যদি সঠিক হয় তাহলে ওরা আগে কেসটা তুলতে বলছে কেন ! তারপর তো বিয়ে নাও করতে পারে । অথবা আমার উপর অত্যাচার করে আমাকে পুড়িয়েও মারতে পারে । ওরা পারেনা এমন কোন কাজ নেই মা । যাদের কথায় থানা চলে, তাদের অসাধ্য কিছু নেই । তাছাড়া এখনও আমার বিয়ের বয়স হয়নি । আর একটা কথা শুনে রাখ মা ,আমি রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করব,তবু একজন ধর্ষককে বিয়ে করতে পারব না । এটাই আমার শেষ কথা ।“

মন্টু বোনের কথা শুনে বলে ,” এরপর তোর দশা কি হবে তা কি একবারও ভেবে দেখেছিস ? আবেগে আর যাই হোক পেট কিন্তু ভরবে না । আর আমাদের মতো গরিবদের পেটে দুবেলা দু’মুঠো ভাত দিতে গেলে ঐ কুত্তাদের কাছেই যেতে হবে । এটা একবার ভেবে দেখিস ।“

“ আমার দু’মুঠো ভাত আমি ঠিক জোগাড় করে নেব । তবুও ওদের ঘরে যাব না ।“ হিয়ার গলায় যেন একটা তেজ ঝরে পড়ে ।

“সে তো তুই নিজের কথা বললি । কিন্তু তুই তো আর একা থাকবি না । তখন কী হবে ? তাই বলি মাথা থেকে বরং ভূতটাকে তাড়া । ব্যাপারটা আরো ভাব । তারপর সিদ্ধান্ত নে । তুই সাপের লেজে পা দিয়েছিস । সে আমাদের কাউকে ছাড়বে না । শুনলাম প্রধান আমার নাম একশো দিনের কাজ থেকে একেবারে বাদ দিয়ে দিয়েছে । ওরা যখন তোকে ঘরের বউ করতে চাইছে, তখন আর আপত্তি করিস না । তোর যা ক্ষতি হওয়ার তা তো হয়েই গেছে । এখন ওরা আমাদের ভাতে মারতে চাইছে ।“ মিন্টুর গলায় একরাশ ক্ষোভ ঝরে পড়ে ।

মিন্টুর কথা শেষ হতেই হিয়া তাড়াতাড়ি উঠে যায় । মুখ ধুয়ে কূপির টিমটিমে আলোয় ও আবার ছাতা সেলাই নিয়ে বসে । এতদিনে হিয়া বুঝে গেছে যে, ছাতা শুধু মাথাই বাঁচায় না , দু’ মুঠো ভাতেরও সংস্থান করে ।

হিয়ার মনে এত জোর,এত সাহস কোথা থেকে আসে তা ভেবে অনেকেই অবাক হয় ! যার সামনে-পিছে কোন লোকবল নেই তার এমন লড়াকু চরিত্রটাকে তাই অনেকেই প্রশংসা করে ।আবার অনেকে বলে-‘এটা হিয়ার বড় বাড়াবাড়ি হছে । ওর বোঝা উচিত বাস্তবটা বড় নির্মম । বড় কঠিন ! ও একা লড়াইটাকে কতদূর নিয়ে যেতে পারবে ! তখন ওর এই জেদ থাকবে তো !’

পুকুর ঘাটে তেঁতুল দিয়ে পুজোর বাসন মাজতে মাজতে ভেবলির মা পদ্মা বলছিল ,” জানিস রুচি , ভেবলির বাবা বলছিল যে মহাভারতেও নাকি কুমারী মেয়ের বাচ্চা হওয়ার কথা আছে । তাও আবার একটা মেয়ে না, দুটো মেয়ের !ভাবতে পারিস ব্যাপারটা !”

রুচি অবাক হয়ে বলে ,” তাই নাকি গো দিদি ! ওদের নাম কি গো ?”

“ঐ যে একটা হল রানী সত্যবতী । যার কুমারী অবস্থায় একটা ছেলে হয়েছিল । সেই ছেলের নাম হল ব্যাসদেব । আর সেই নাকি মহাভারত লিখেছিল । আর একজন হল পান্ডুর বউ কুন্তি ।ওরও কুমারী আবস্থায় যে ছেলে হয়েছিল তার নাম ছিল কর্ণ । তাই ভেবলির বাবা বলছিল যে, হিয়ার ছেলে হওয়ায় সারা গ্রামে এত হৈ-চৈ এর কারণ কী ! এতে তো আর মহাভারত অশুদ্ধ হয়নি । তবে তোকে একটা কথা বলি রুচি , জানিস হিয়ার জন্য আমার খুব খারাপ লাগেরে । ও তো আমার ভেবলির সাথেই পড়ত ।ক্লাসে প্রথম ছিল । তাই আমি ভেবলির জন্যও ওর বাবাকে ছেলে খুঁজতে বলেছি । দিনকাল ভাল না রে রুচি- দিনকাল ভাল না । সময় থাকতে থাকতেই বিয়ে দিয়ে দেব ।“

এ কথা শুনে চাপা গলায় রুচি বলে ,” জান দিদি , কাল রাতে কাবুলের বাবা ঘরে ফিরে বলল হিয়া নাকি ওর বাচ্চাটাকে নিয়ে একাই থানায় গিয়েছিল । ওকে যে গ্রামের পুকুরটা ব্যবহার করতে দেওয়া হচ্ছে না সেটাই নালিশ করতে । কিন্তু থানার বড় বাবু নাকি হিয়ার নালিশ নেয় নি । বলেছে এই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে । কোখায় ওকে ভরসা দেবে তা নয়, বলছে পালিয়ে যেতে ! আর শুনলাম ওর দাদাটাও নাকি চাইছে হিয়া যেন আর এ বাড়িতে না থাকে । কারণ ওর উপরে নাকি চাপ আসছে !”

 

নয়

 

সারা আঙিনায় ঘন জোছনাটা শুয়ে রয়েছে । হিয়ার দৃষ্টি বিদ্ধ করছে ওর শরীর ! তবু জোছনাটা অকাতরে ওর দুধ সাদা আলো বিলিয়ে চলেছে সারা আঙিনা জুড়ে ! আর সেই জোছনার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হিয়া ভাবে-স্কুলের দিদিমনিরা কি এখনও ওর কথা বলে ? নাকি সব ঘটনা শোনার পর ওরাও মুখ ঘুরিয়ে নেয় ! তাহলে ওরাও কি আর পাঁচ জনের মতোই ভাবে হিয়া একটা নষ্ট মেয়ে !

দাওয়ায় বসে এমন ভরা জোছনায় হিয়া গ্রামের বকুল তলাটা স্পষ্ট দেখতে পায় । গাছের চারদিকে কে যেন ফুলের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে । আর ওর সম বয়সি বন্ধুরা হুড়মুড় করে ফ্রকের কোঁচড় ভরে ফুল কুড়িয়ে নিচ্ছে । তারপর ওরা স্বর্ণ লতা দিয়ে ছোট-বড় মালা গেঁথে ফেলবে । কোনটা পরবে হাতের কব্জিতে বা বাজুতে অথবা কোনটা গলায় । ওদের শরীর থেকে সুন্দর একটা মিষ্টি গন্ধ বেরিয়ে চারদিক ম-ম করবে ।

হিয়া একবার বুক ভরে শ্বাস নেয় । আর সাথে সাথে বকুলের মিষ্টি গন্ধে ওর সারা শরীরটা থর থর করে কেঁপে ওঠে ।

পাশে শোয়ানো বাচ্চাটা সামান্য নড়ে উঠতেই হিয়া একবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখে । দাদার কথাটা মনে পড়ে । ও বলেছিল বাচ্চাটাকে কোন অনাথ আশ্রমে দিয়ে দিতে।  অথবা যাদের কোন সন্তান নেই তাদের । হিয়া মুখের উপর না বলে দিয়েছে । সমস্ত কলঙ্ক যখন ও নিজের মাথায় তুলে নিয়েছে তখন এই শিশুটিকে মানুষ করার দায়ও তার । এতো কোন গাছের ফল নয় যে কাউকে তা বিলিয়ে দেবে !

হিয়া দাওয়ার খুঁটিতে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে । এতদিন যে ভাবেই হোক চলে যাচ্ছিল । কিন্তু দিন দিন তা বড় কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে । আবার বেঁচে থাকাটাও ভীষণ জরুরি । শুধু নিজের জন্য নয়, ঐ বাচ্চাটার জন্যও । কাজেই লড়াইটা এসময় ছেড়ে দিলে চলবে না । শত্রু পক্ষ যে এখনও ওকে মারতে চাইছে তা হিয়া প্রতি পদে পদে বুঝতে পারছে । তাই দারোগা বাবু যেদিন ওকে এই গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেতে বলেছিল সেদিন তার কথা বিশ্বাস হয়নি। অথচ এখন তাই ঘটছে ! বাচ্চাটা সামান্য কাঁদলেই গ্রামের লোকেরা বলছে –‘ঐ দেখ,আবার বেজন্মাটা কাঁদছে ।‘ এ সব শুনতে শুনতে হিয়ার কান এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে । সে আর এখন কাঁদে না ! বরং ওর চোখ দুটো জ্বলে ওঠে !

আজ হিয়া ওর এক টুকরো সংসারটাকে কাপড়ের পুঁটলিতে বেঁধে মাথায় তুলে নেয় । নিজের জন্ম ভিটাকে প্রণাম করে ছেলেকে কাঁখে নিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ায় । সে এই সমাজকে পদদলিত করে কোন এক অজানা সমাজের উদ্দেশে পা বাড়ায় ! যেখানে কোন বিদ্বেষ নেই,সমাজের কোন ভ্রুকুটি বা কোন দলীয় অনুশাসন তাকে সব সময় তাড়া করবে না !কিন্তু এমন কোন জায়গা আছে কি ? হিয়ার তা জানা নেই ।

হিয়া জানেনা সে কোথায় চলেছে । এখন পথই তার ভরসা । ভরা জোছনায় হাঁটতে হাঁটতে হিয়া দেখতে পায় ওর সামনে চলেছে দুজন নারী , যারা খুব স্পষ্ট নয় । অথচ প্রতিটি পদক্ষেপেই মিশে রয়েছে এক গর্বিত মায়ের পদধ্বনি ! যারা কুমারী মা হয়েও লজ্জামানা ছিলেন না । বরং তারা ছিলেন পুত্র গর্বে গর্বিতা । হিয়া তাঁদের চিনতে পেরে অস্ফুট স্বরে ডাকে- ‘মহর্ষী সত্যবতী , কুন্তী , তোমরা দুজনে কোথায় চলেছ !’

ওরা বারেক থমকে দাঁড়ায় । কিন্তু হিয়ার কথার কোন উত্তর না দিয়ে শুধু মুচকি হেসে পেছনের দিকে ইংগিত করে আবার হাঁটতে থাকেন । হিয়া বুঝতে না পেরে পেছনে তাকায় । আর সাথে সাথে বিস্মিত হয়ে দেখে  যে তার মা কনকলতা দাস তার নিজের ছেঁড়া সংসারটাকে মাথায় করে দ্রুত পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে  ! এই শ্বাপদসংকুল দেশে সে একা একা মেয়েকে ছাড়েই বা কীভাবে ! হাজার হোক সেও তো এক নারী ! একজন মা !

 

[বানানবিধি/মতামত লেখকের নিজস্ব]   

 

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ