01 Oct

মেয়েলি সাজ

লিখেছেন:প্রদীপ কুমার দাস


-হ্যালো, ডাক্তারবাবু বলছেন?

– হাঁ, বলছি।

– একবার আমাদের বাড়িতে আসতে হবে এখুনি।

-কেন কি হয়েছে?

-আমার  বৌমা হঠাৎ খুব অসুস্হ হয়ে পড়েছে। হাত-পা ছেড়ে দিয়েছে। খুব ঘামছে আর বলছে বুকের ভেতরটা কেমন করছে। কেউ যেন চেপে ধরেছে। আপনি ডাক্তারবাবু প্লিজ একবার আসুন এখুনি।

– দেখুন চেম্বারে কয়েকজন রোগী আছেন এখনও। ওদেরকে দেখে আসছি।

– একটু তাড়াতাড়ি করবেন। খুব অসহায় বোধ করছি।

ড. রমেন সেন। জনপ্রিয় চিকিৎসক। ডাক্তারি পেশার সঙ্গে সঙ্গে বহুবিধ সমাজসেবামূলক কাজেও নিজেকে জড়িয়ে রাখেন। এলাকার লোকজন খুব ভালবাসেন ও শ্রদ্ধা করেন। মাঝবয়সী। সুপুরুষ। মোটা ফ্রেমের চশমায় ভারিক্কি ডাক্তার বলে মনে হয়। তবে বেশ মিশুকে ডাক্তারবাবু। ফুটবল, ক্রিকেট, সাঁতার প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে স্বেচ্ছায় রক্তদান ও স্বাস্হ্যশিবির সব জায়গায় উনাকে আমন্ত্রণ জানালে চলে আসেন। এছাড়া আর একটি বড় গুণ হল বাড়িতে কল দিলে নিজের চেম্বার শেষ করে এ্যাটেন্ড করেন। এখানকার নব্য তরুণ চিকিৎসকদের কাছ থেকে সেই সৌজন্যতা হারিয়ে যেতে বসেছে।তাঁরা  নিজেদেরকে সব সময় কেউকেটা ভাবেন। রোগী অপারক হলেও  হোমকল এ্যাটেন্ড করেন না। ফোন করলে ফোন ধরেন না। এমতাবস্হায় বৌমার ওইরকম শরীর খারাপ দেখে খুবই ঘাবড়ে গেছেন মিসেস রত্নাবলী ঘোষ। উনার স্বামী একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবহারজীবী। মক্কেলের ভীড় সব সময় লেগে থাকে চেম্বারে। বয়স হয়ে গেছে, তবুও কাজের চাপের খামতি নেই। লোকে বলে ডাক্তার আর উকিলের কোন অবসর হয় না।একমাত্র অবসর চিতায় উঠলে।

বছর চারেক হল রত্নাবলী ঘোষ বেশ ধূমধাম করে তাঁর একমাত্র ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন। বৌমা শিক্ষিত। মার্জিত। আহামরী সুন্দরী না হলেও সুশ্রী। বিনীত। আজকালকার মেয়েদের মতো আলপটকা কিংবা দুর্বিনত নয়। স্পষ্টবাদী। যেটা সত্য বলে মনে হয় তার কাছে স্পষ্ট বলে দিতে কোন সংকোচ, দ্বিধা বোধ করে না। বাপের বাড়ি বর্ধমানের কেতুগ্রামে। আধা শহর আধা গ্রাম্য পরিবেশ থেকে লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়েছে। বাপের বাড়ি বেশ অবস্হাপন্ন। একমাত্র মেয়ে। সুপ্তি হালদার। উচ্চশিক্ষায় সম্মানের সঙ্গে উত্তীর্ণ  হওয়ার সাথে সাথে সাংসারিক কাজকর্মেও দক্ষ। এহেন কাজের ও গুণী মেয়েকে বৌ করে ঘরে তুলতে দেরি করেন নি রত্নাবলী ঘোষ ও তাঁর স্বামী অভিজিৎ ঘোষ। বিয়ের বছর দুই পরে ছেলে-বৌমার কোল আলো করে এক কন্যা সন্তান আসে। নাম রাখেন পায়েল। পায়েলকে নিয়ে বেশ আনন্দের সঙ্গে দিন কাটাছিলেন ঘোষ দম্পতি। হঠাৎ করে কি যে হল ঘোষ দম্পতির সংসারে নেমে এল কালো মেঘের ছায়া। ছেলে সৌরভ ঘোষ আইটি সেকটরে কাজ করে। কাজের সূত্রে  বিদেশে যেতে হয় প্রায়শই। বিয়ের প্রথম দু-তিন বছরে সেরকম কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার লক্ষ্য করেন নি ঘোষ দম্পতি। বরঞ্চ ওদের পারষ্পরিক বোঝাপড়া দেখে কিছুটা ঈর্ষান্বিত হতেন। যদিও নিজেদের দাম্পত্য জীবনে সে ধরণের কোন চিড় হয় নি আজও পর্যন্ত। তবে মাঝে একবার দুষ্ট মহিলাকে নিয়ে স্বামী অভিজিৎ ঘোষ খুবই বিপাকে পড়েছিলেন। তাঁকে শীলতাহানির কেসে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। নিজে আইনজীবী হয়েও বহুকষ্টে সেই কেস থেকে নিস্তার পেয়েছিলেন। ওই সময়টা খুবই দুঃস্বপ্নের মধ্যে কাটাতে হয়েছিল। এছাড়া বেশির ভাগ সময়ই আনন্দে কেটে যেত। ভ্রমণের নেশা ছিল ঘোষ দম্পতির।  সুযোগ পেলে বেরিয়ে পড়তেন দেশ ভ্রমণে। দেশ ভ্রমণের কত যে ফটো রয়েছে তাদের পারিবারিক এ্যালবামে। কখনো সখনো সময় পেলে এ্যালবামের পাতাগুলো উলটিয়ে উলটিয়ে মধুর স্মৃতি রোমন্হন করতেন ঘোষ গিন্নী।

কলিং বেলের আওয়াজে সম্বিত ফিরে পান রত্নাবলী ঘোষ। নিশ্চয়ই ডাক্তারবাবু এসেছেন। তড়িঘড়ি করে দোতলা থেকে একতলায় নেমে আসেন। দরজা খুলে ডাক্তারবাবুকে সাদর সম্ভাষণ জানান- আসুন ডাক্তারবাবু।

– কেমন আছেন বৌমা? খুব একটা ভাল বুঝছি না। আপনি দোতলায় চলুন। দোতলায় কোণের ঘরের বৌমা রয়েছেন বিছানায় শুয়ে।

– পায়ে পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠলেন দোতলার ঘরে। উঠতে উঠতে বুঝতে পারলেন রমেন সেন তাঁর বয়স বাড়ছে। বুকের মধ্যে কিছুটা চাপ ভাব আর একটু হাঁফভাব লাগছে। তবে বয়স যে খুব বেশি তাও নয়। ষাট এর কাছাকাছি। ছোটবেলায় রীতিমত ব্যায়াম করতেন। তাই এখনো লড়ে যাচ্ছেন। ভাবেন আর কতদিন লড়তে পারবেন জানেন না। তবে লোকের ভালবাসার টানে নিজের কষ্টটাকে আর বড় করে দেখেন না। ডাক্তারি পরীক্ষা পাশ করার পরে তাঁর এক সাত্তিক জ্যাঠামশাই তাকে মারা যাওয়ার আগে আশীর্বাদ করেছিলেন এই মন্ত্র দিয়ে যে ‘ শিবজ্ঞানে জীব সেবাই’ তোমার একমাত্র মন্ত্র। সেই মন্ত্র নিয়ে ষাটটা বছর পার করে দিলেন। যখন থামতে হবে থেমে যাবেন।

– দোতলায় পৌঁছে ধীর পদক্ষেপে মিসেস রত্নাবলী ঘোষের পেছন পেছন বৌমার ঘরে ঢুকে পড়লেন। এক নজরে দেখে নিলেন বৌমাকে। শুয়ে রয়েছেন খাটের ওপর। মুখটা ওপাশে ফেরা। তবে শোওয়ার মধ্যে যে কোন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তার কোন লক্ষণ তিনি দেখলেন না। আমাদের গলা শুনে পাশ ফিরে আমাদের মুখোমখি হলেন।

– কি হয়েছে বৌমা? কেমন আছো এখন?

– শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বুকের মাঝখানটায় কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। বুকটা ধড়পড় করছে।

– ঠিক আছে, দুশ্চিন্তা করো না, আমি দেখে নিচ্ছি। নাড়ির গতি, রক্তের চাপ, বুকে পিঠে স্টেথো বসিয়ে ভাল করে পরীক্ষা করলেন।

সুপ্তি জানালো, দেখুন ডাক্তারবাবু, আমার পা দুটো এক্কেবারে অসাড় হয়ে গেছে। আমি দাঁড়াতে পারছি না। দুই পায়ে কোন বল নেই। আমার কি হল, বলেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।

মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, কেঁদো না বৌমা, আমি দেখছি। ভাল করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে খারাপ কিছুই পেলেন না। মনে হল কোন কারণে মানসিক আঘাত পেয়েছে।কাউন্সেলিং করা দরকার। কথা বলতে বলতে একটু কষ্ট করে উঠে বসতে বললাম। উঠে বসলো। আবার কিছু কথা হলো। বললাম ধীরে ধীরে দাঁড়াও। ‘পারবো না ডাক্তারকাকু’।

– বেশ তো আমি তোমায় সাহায্য করছি। তুমি আমার হাতটা ধরে দাঁড়াবার চেষ্টা করো। ভয় নেই পড়ে যাবে না। আমি ধরে রয়েছি। কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। ওর হাতদুটো ধরে আস্তে আস্তে দাঁড় করালাম। ধরে ধরে কিছুটা হাঁটালাম। বুঝতে পারলাম রোগটা দেহে নয় মনেতে। সময় লাগবে মনের অতল গহ্বর থেকে সোনামানিক্য কুড়িয়ে আনতে।

– ঠিক আছে তুমি শুয়ে থাকো। আজকের দিনটা তুমি খাটে বসে খেয়ে নিও। ডাইনিং -এ যাওয়ার দরকার নেই। বাথরুমে যাওয়ার দরকার পড়লে তোমার স্বামীকে ডেকে নিও।

– সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল সৌরভকে ডাকার দরকার নেই। প্রয়োজন হলে শাশুড়ী মাকে ডেকে নেবো।

-বুঝলাম স্বামী সৌরভকে এড়াতে চাইছে। যেটা ভাবছিলাম সেটাই ঠিক বলে মনে হল।

আজকালকার নতুন দম্পতিদের ক্ষেত্রে পারষ্পরিক বোঝাপড়ার খুবই অভাব।সেই কারণে বিয়েটা অনেক ক্ষেত্রে টিকছে না। মিউচ্যুয়াল সেপারেশন নিয়ে নিচ্ছে। আইটি সেক্টরে তো এই ঘটনার বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। ইয়ং ছেলে-মেয়েদের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে কাজের নেশায় পাগল করে দিচ্ছে কতিপয় উচ্চাকাঙ্খী কর্পোরেট দুনিয়ার ওপরওয়ালারা, কাজের নেশায় ভুলে যাচ্ছে ঘর-সংসার, আত্মীয়-স্বজন এমন কি সহধর্মীনীকে। সহধর্মীনী উপেক্ষিত থাকছে দিনের পর দিন। মাস গেলে ব্যাংকের একাউন্ট ফুলে ফেঁপে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু জীবনটা যে মরুদ্যান হয়ে উঠছে। মরুদ্যানে যদি গাছ-গাছালি, ফুল-ফল না থাকে তবে সে মরুদ্যানটা টিকবে কি করে? রবি ঠাকুরের কথায়:

‘ জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো/সকল মাধুরী শুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো/ কর্ম যখন প্রবল আকার গরজি উঠিয়া ঢাকে চারি ধার/ হৃদয়প্রান্তে।হে জীবননাথ, শান্ত চরণে এসো”।

প্রথম প্রথম গৃহবধুরা মেনে নেয় সব কিছু মুখ বুজে। কিন্তু জীবনের তো অন্য কিছু চাওয়া পাওয়া আছে। সেগুলো পূরণ না হলে  সম্পর্কটা টিকবে কি করে? শনিবার, রবিবার ছুটির দিন হলেও পতিদেবতাই বসে থাকে ল্যাপটপ আর এ্যানড্রয়েড ফোন নিয়ে। খাবার নিয়ে এসে মুখের কাছে ধরে দিলেও চোখ চেয়ে প্রিয়ার মুখটা দেখার ফুরসৎ থাকে না। ‘হ্যা, রেখে যাও পরে আমি খেয়ে নেব।   রাতের  রাতের বেলাতেও আমার শুতে দেরি হবে তুমি খেয়ে শুয়ে পড়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করার দরকার নেই ‘। – তখন  অভিমানে  চোখে জল এসে মনে পড়ে যায় রবিঠাকুরের সেই গানটি, ‘জীবনের  পরম  লগন কোরো না হেলা কোরো না হেলা হে গরবিনী’।  এ রকম চিত্রটা আজকাল কমবেশি দেখা যাচ্ছে অনেক পরিবারে। স্বামী স্ত্রী দুজনেই যদি আইটি সেক্টরে কাজ করে তবে তো সোনায় সোহাগা ! দুটো সমান্তরাল রেললাইন চলতে থাকে কখন কোথায় তাঁদের সংযোগ হবে কেউ জানে না  তবে এক একটা জংশনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন বাড়ির লোকজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবেরা।

ঘোষ দম্পত্তির তবুও পয় আছে ছেলে বউমাকে নিয়ে।  বিয়ের বছর দুয়েকের মধ্যে ঘর আলো করে এসেছে ছোট্ট নাতনি পায়েল।   দেখতে দেখতে তাঁর বয়স দু বছরে দাঁড়িয়েছে। দুপায়ে নূপুর পরে যখন ছুটে বেড়ায় ভারি সুন্দর লাগে ঘোষ দম্পতির।  এইরকম একটা লিভিং ব্রিজ  থাকা স্বত্তেও ছেলে বউমার মধ্যে কীভাবে ফাটল চলে এল বুঝতে পারেন না ডাক্তার রমেন সেন। এটা বুঝতে গেলে চাই দুজনকে কাউন্সেলিং করার। কোথায় জটটা পাকিয়ে  আছে সেটা বের করতে হবে।

আসার সময়  রত্না   ঘোষকে   বলে এলেন দুই একদিনের মধ্যে বউমা একটু সুস্থ হলে আমার চেম্বারে নিয়ে আসবেন আর ছেলেকেও একটু পাঠাবেন আমার চেম্বারে ।

–  একদিন রাতের দিকে চেম্বারে এল সৌরভ। দু একটা রোগী ছিল বললাম, ‘একটু অপেক্ষা করো দু একজন রোগী আছে ওনাদের দেখে তোমার সঙ্গে কথা বলছি’।

মাথা নেড়ে ও চেম্বারের বাইরে চলে গেল। যথারীতি রোগী দেখা শেষ করে সৌরভকে ডেকে নিলাম চেম্বারে।

সৌরভ ঢুকতেই বসতে বললাম।   সামনের চেয়ারে আমার পাশে এসে বসল। সাদামাটা চেহারা গায়ের রং খুব ফর্সা নয় কিছুটা চাপা। লম্বায় পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি। দোহারা চেহারা  লাজুক প্রকৃতির। চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে না। মাথা নিচু করে নেয় কথা বলার সময়।

বুঝতে পারলাম কিছুটা ইনফিরিয়র কমপ্লেক্সে ভোগে।  আত্মবিশ্বাসের অভাব রয়েছে।

-আচ্ছা  সৌরভ, তোমাদের   মধ্যে কি কোনো ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে এর মধ্যে?

-না সেরকম কিছু নয় ।

-তবে সুপ্তির মানসিক আপসেটের কারণ কী?  তোমাদের তো দাম্পত্য জীবনের চার চারটে বছর কেটে গেছে। তোমাদের মধ্যে লিভিং ব্রিজ হিসেবে পায়েল এসেছে সেও খুব ভালো মেয়ে ।

-আমি  একটু কাজের মধ্যে থাকি ওকে সব সময় সঙ্গ দিতে পারি না। হয়তো এটাই কারণ।

-তুমি যে কাজে ব্যস্ত থাকো সেটা তো বিয়ের পর থেকে সুপ্তি নিজেকে সেইভাবে তৈরি করে নিয়েছে। তাই বলে বছর চারেক বাদে ওর মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ার কারণটা কিছুতেই মেলাতে পারছি না।

-তোমাদের   মধ্যে কি কোনও তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ ঘটেছে যেটা জেনে ও খুবই আপসেট?

-না না সেরকম কিছু নয়। তবে

একটু ইতস্তত করছে দেখে বুঝলাম নিশ্চয়ই কিছু ব্যাপার আছে। কিছুটা সময় নিয়ে বলল সৌরভ, ‘ছোটবেলা থেকে আমি ছেলে হলেও মেয়ে সাজতে খুব ভালো লাগত, মেয়েদের মতো জামাকাপড় পরা, হাতে চুড়ি পরা, মেয়েদের মতো চুল আঁচড়ানো,  চোখে কাজল দেয়া, ঠোঁটে লিপস্টিক লাগানো ইত্যাদি খুবই ভালো লাগত’।

একবার আমার মা এসব দেখে আমাকে বলেছিলেন, ‘তুই তো ছেলে, মেয়ে সাজতে ভালো লাগে কেন? ওসব করবি না।

মায়ের বকুনির ভয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে ওইরকম ড্রেস করতাম আর গোপনে ঘন্টার পর ঘন্টা আরশির সামনে দাঁড়িয়ে দেখতাম নিজেকে ওইভাবে। থাকতে থাকতে  কোথায় যেন হারিয়ে যেতাম তখন খেয়ালই থাকত না আমি মেয়ে মানুষ নই, আমি এখনও বায়োলোজিক্যালি পুরুষ মানুষ। তবে ওইরকম মেয়েদের সাজপোশাকে আমার যে কী ভালো লাগত সেটা ভাষায় বলা সম্ভব নয়। কেমন যেন নেশার মতো পেয়ে বসত, তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রস ড্রেসিং করা কমিয়ে দিয়েছিলাম। তবে ড্রেস মেটিরিয়ালগুলো আলমারির লকারের মধ্যে রেখে দিয়েছিলাম। কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে সুপ্তি ওইগুলো দেখে ফেলে তারপর থেকে ক্রমাগত  সন্দেহ আর বাক্যবাণের তীব্র কষাঘাতে জর্জরিত করতে থাকে।

ও হয়তো ভেবে নিয়েছিল আমি ড্রেস মেটিরিয়ালগুলো অন্য কোনো মেয়ের জন্য কিনে রেখেছি। ওকে বারংবার বোঝাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছি।

ও যখন জানতে পারল আমার মেয়ে সাজতে ভালো লাগে তারপর থেকে ওর প্রায় পাগল পাগল অবস্থা। কিছুতেই আর আমাকে পুরুষ হিসাবে মেনে নিতে পারছে না। কাছে গিয়ে  আদর করতে গেলে খেপে যাচ্ছে। এক কথায় ওর কাছে আমার পুরুষ অস্তিত্ব এখন প্রায় নেই বললেই চলে। এ জন্যই মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছে।

কয়েক দিন পরে সুপ্তি এল চেম্বারে। ওর সেই বাঁধাধরা কষ্টের কথা শোনাতে লাগল, রাতে ঘুম আসে না, বুক ধড়পড় করে, হাঁটতে চলতে গেলে হাঁফ ধরে,  হাত- পা কাঁপে, হাতের আঙুলগুলো ঠিকমতো মুড়তে পারে না, মুড়তে গেলে অসহ্য ব্যথা লাগে।

বুঝলাম সবই মানসিক অসুখের উপসর্গ।

-সৌরভকে  নিয়ে তোমার অসুবিধাটা কোথায়? তুমি নাকি ওকে একদম কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছো না? সৌরভ তোমার স্বামী, খুবই আপনজন। ওকে তো তোমার কষ্টের কথা শেয়ার করতে পারো।

-ওকে কী বলব বলুন তো অফিস আর বাড়ি,বাড়ি ফিরে বসে যায় ল্যাপটপ নিয়ে। তখন কাউকে ঢুকতে দেয় না। ঘরে আমার অবস্থা তখন ‘ আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল,  শুধাইল না কেহ’। এমনকী ছোট্ট মেয়েটাকে পাঠালে বকে ঝকে বের করে দেয়। কী যে করে সারাক্ষণ ল্যাপটপ নিয়ে ওই জানে।

-ওর প্রতি তোমার বিশ্বাস আছে কি না?

আছে বলেই তো ও ল্যাপটপ কোনো দিন দেখার চেষ্টা করিনি। হয়তো অফিসের কোনো গোপন তথ্য যাতে কেউ  জানতে না পারে  সেজন্যও হয়তো কাউকে দেখার অনুমতি দেয় না।

-তা হলে সমস্যাটা কোথায় দাঁড়াচ্ছে?

-এই ভেবে তো আমিও নিশ্চিন্তে ছিলাম। কিন্তু একদিন ভুল ভাঙল হঠাৎ করে ওর আলমারির লকারে ডালাটা খুলে দেখতে পেলাম মেয়েদের  সাজের হরেক রকম জিনিস।

কী নেই আমি তো অবাক! ও যে সাজের জিনিস কিনে এনেছে, কই একবার তো আমাকে বলেনি?

তাও লকারের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে কেন?

-তুমি জিজ্ঞাসা করোনি?

মিষ্টি হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল,’ এগুলো তোমার জন্য এনেছি, পরে দেব বলে’। এরপরই মজা করে রবিঠাকুরের গানটা শুনিয়ে বলেছিল,’ প্রিয়ে,  তোমার ঢেঁকি হলে যেতাম বেঁচে/ রাঙ্গা চরণতলে নেচে নেচে /টিপটিপিয়ে  যেতেম মারা,  মাথা খুঁড়ে হতেম সারা/ কানের কাছে কচকচিয়ে  মনটি তোমার নিতেম যেঁচে’। কথাগুলো শুনে কিছুটা বিশ্বাস কিছুটা অবিশ্বাস নিয়ে চলে এসেছিলাম ওর ঘর থেকে। তবে একটা চিন্তা কুরে কুরে খেত অন্য কোনও মহিলার জন্য আনে নি তো?

এই চিন্তায় মাথা গরম হয়ে যেত। মজার ব্যাপার হলো আমি একদিন ওর লকার থেকে সাজের জিনিসগুলো বের করে আনতে গিয়ে প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হই। বললাম, ‘ আমার জন্য  এনেছ যখন আমি ওগুলো নিয়ে ব্যবহার করি’।

নানান কথার মারপ্যাঁচে ওই জিনিসগুলো কিন্তু আমায় দেয়নি সৌরভ। সেদিন থেকে ওর প্রতি আমার কিছুটা হলেও অবিশ্বাস জন্মেছিল।

তার পরে একদিন আচমকা ওর ঘরে ঢুকে ল্যাপটপ খোলা দেখে থমকে দাঁড়াই।  ও তখন বোধহয় টয়লেটে গিয়েছিল।  মিনিমাইজ করা ছিল। আমি ম্যাক্সিমাইজ করতেই চমকে উঠি  :’এ কী দেখছি!  ও এতক্ষণ নীল ছবি দেখছিল?  তা হলে কি দরজা বন্ধ করে ও এসব দেখে?  বাড়ির কাউকে কি সেজন্য অ্যালাউ করে না?

-দেখুন ডাক্তারবাবু একজন বিবাহিত স্ত্রী হিসেবে আমি সেদিন খুবই অপমানিত হয়েছিলাম।  তাই যখন ওর মুখোমুখি হয়ে সব প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছিলাম,  সেদিন  ও সরাসরি সারেন্ডার করে।

তখনই জানতে পারি ছোটবেলা থেকে ও টান্সভেসসিস্ট  ফেটিজমে  আসক্ত ছিল।  সেই আসক্তি বড় হয়ে এমন কি বিবাহিত জীবনযাপন করে  কমাতে পারে নি। সেজন্যে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজেকে সুন্দরী নারীর বেশে সেজে একরকম দৈহিক ও মানসিক আনন্দ অনুভব করত। সেই আনন্দের চূড়ান্ত মাত্রার প্রতিফলন ঘটে  নীল ছবি দেখে।

-ঠিকই বলেছ সুক্তি তুমি। এটা হলো একধরনের আত্মরতির সুখানুভব। এটা একধরনের মানসিক বিকৃতি। ছোটবেলা থেকে যার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে। এই  এই অবস্থায় সুন্দরী স্ত্রী পাশে থাকলেও তার স্পর্শানুভূতিতে সে তৃপ্ত হতে পারে না। তাই যৌন সুখানুভূতি খোঁজার জন্যই নিজেই নিজের মধ্যেই মেতে থাকতে চায়। এটা একধরনের যৌন বিচ্যুতি।  এ ধরনের ঘটনা সমাজে খুব একটা বেশি দেখা না গেলেও,  কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরকমটা হয় অন্তত চিকিৎসাশাস্ত্রে তাই বলে ।

তুমি চিন্তা করো না ধৈর্য ধরে থাকো। যেহেতু এ রোগের শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত শিকড় তুলে ফেলতে  বেশ সময় লাগবে। কাউন্সেলিং করে শিকড় কাটতে হবে। তবে রাগারাগি  আর কথা কাটাকাটি করে কোনো লাভ হবে না। তোমাকে শান্ত মনে সবগুলো অ্যানালিসিস করে একটার পর একটা পদক্ষেপ নিতে হবে ।

-আচ্ছা ডাক্তারবাবু বিয়ের প্রথমের দিকে তো আমাদের মধ্যে ভালই মেলামেশা ছিল।

-দেখো সৌরভ বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ছেলে। এই ধরনের ছেলেরা সাধারণত বিয়ে-শাদিতে মত দিতে চায় না। নানা অজুহাতে এড়িয়ে যেতে চায়। বাবা মায়ের চাপে সে বাধ্য হয়েছিল বিবাহ বন্ধনে জড়াতে। কিন্তু ও জানত এই বন্ধনে সে বেশিদিন জড়িয়ে থাকতে পারবে না। তাই ভেবে নিয়েছিল যে একটা সন্তান এলে তাঁর রয়্যাল পার্টনার সন্তানকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে, সে মুক্ত হয়ে যাবে।    পূর্বের জীবনে ফিরতে আর কোনো বাধা থাকবে না। তাই ধীরে ধীরে তোমার কাছ থেকে সরে এসেছে। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে কেননা আত্মরতিতে যে তাঁর পরম যৌন সুখানুভূতি।  ওই মানসিক বিচ্যুতির  মোড় ঘোরাতে সময় লাগবে।

এ কাজে সবচেয়ে বেশি সাহায্য লাগবে তোমার ।

-ঠিক আছে এখন আমায় কী করতে হবে বলুন?

যেমন সংসার করছ তেমনই সংসার করবে।স্বামী শ্বশুর শাশুড়ি সকলকে সমানভাবে দেখবে।মেয়ের প্রতি নজর দেবে। ভেবে নেমে কিছুই হয়নি। মাঝের এই সময়টা একটা দুঃসময়  ছাড়া আর কিছুই নয়।

সৌরভও চেষ্টা করবে তোমার সঙ্গে আগের জীবনে ফিরে যেতে। সেটুকু সময় তুমি ওকে দাও।

সেই সময় দিতে প্রস্তুত সুপ্তি। রবিঠাকুরের কথায় সেও মনে মনে ভাবে ” সবার মাঝারে তোমারে স্বীকার করিব হে/ সবার মাঝারে তোমারে হৃদয়ে বহিব হে”।

 

[বানানবিধি/মতামত লেখকের নিজস্ব]  

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ