বৃটিশ আমলে যখন গঙ্গার ধারের শহরতলিতে চটকল ও অন্যান্য কলকারখানা গড়ে উঠলো তখন বাঙালি শ্রমিক হতে রাজি হয়নি। মধ্যবিত্ত শ্রেণি একচেটিয়া ভাবে অফিসে বাবু শ্রেণির কাজ করেছে। কিন্তু নিম্নবর্গের মানুষজন কারখানায় কাজ করতে আসেনি। এই সমস্ত কাজ একচেটিয়া ভাবে বিহার থেকে আসা মানুষের দখলে চলে যায়। এদের সঙ্গে আসে বিহারের দলিত শ্রেণির মানুষ। সাফাইওয়ালার কাজে এরা একচেটিয়া। এরাও গত শতাধিক বছরে এদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে উঠেছে। যুগ পরিবর্তনের ফলে যতই কর্মসংকোচন হোকনা কেন অফিস আদালত কল কারখানায় সাফাইওয়ালার কাজ বাঁধা। তবে আগের সে সুদিন আর নেই, পাকা চাকরির বদলে এখন চাকরি হয় দৈনিক মজুরীর ভিত্তিতে। এদের পুরুষরা কল কারখানা, শপিং মল, নার্সিং হোম, ফ্ল্যাটবাড়ি, পুরসভায় কাজ করে, আর স্ত্রীলোকেরা গৃহ সহায়িকা। এদের খুব কাছ থেকে দেখে আমি বুঝেছি যে এদের দুঃখ দূর হবার নয়। এরা শুধু আজকের জন্যই বাঁচে।
এদেরই একজন লছমী হাড়ি আমার গৃহ সহায়িকা।এরা বাড়ির সকলে কাজ করলেও অভাব এদের নিত্য সঙ্গী।কারণ এদের বেতন কম, ব্যয় অনিয়ন্ত্রিত আর পুরুষমানুষের নেশা। ফলে ঋণ এদের পিছু ছাড়েনা । এরা আগু পিছু নাভেবে শাইলকদের কাছে দশ হাজার টাকা ঋণ নিয়েকুড়ি মাসে কুড়ি হাজার টাকা শোধ করে । একটা ঋণ শোধ করতে আরেকটা ঋণ নেয় । শেষে ঋণের কিস্তিদেওয়া অসম্ভব হয়ে উঠলেশাইলকরা ওদের সুদ দিয়ে চলতে বলে । ওরা তাতেই খুশি । এর ফলে ওদের ঋণ যে কোনদিন শোধ হবে নাসে হিসাব ওরা করেনা ।
এদের দেখে আমি ব্যথিত হই, পরামর্শ দিই, বাঁচাতে চেষ্টা করি নিশ্চিত ধংসের হাত থেকে। লোকের বাড়ি এঁটো বাসন ধুয়ে রোজগার করা টাকা সুদখোর মহাজনরা নিয়ে নেবে, আমার মাথা গরম হয়ে যায়।ঋণ যখন না নিলেই নয় তখন আমিব্যাঙ্কের ঋণ ব্যবস্থা করে দিয়েছি যাতে দশ হাজার টাকা নিয়ে কুড়ি মাসে কুড়ি হাজারের বদলে বারো মাসে বারো হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু এদের দুর্দশা ঘোচে না, বাড়ি শুদ্ধ লোক কাজ করে তবু। মাসের প্রথমে রোজগারের একটা মোটা অংশ সুদ দিতে চলে যায়।সংসার চালাতে বা চিকিৎসা করার জন্যে ঋণ, তার একটা মানে বোঝা যায়। কিন্তু ডাক্তার দেখাবার আগে ওঝা ডেকে তার পেছনে পাঁচশো টাকা খরচ করা, বাড়িতে সন্তান জন্মালে গঙ্গায় একটা জীবন্ত পাঁঠা ভাসিয়ে দেওয়া, অথবা হঠাৎ কে যেন বলেছে ক্লাস এইট এর সার্টিফিকেট জোগাড় করে কাকে যেন দশ হাজার টাকা দিলেই পুরসভায় ছেলেদের চাকরি বাঁধা- এই সবেই ওরা ধ্বংস। আমি হাজার বার বারণ করলাম এই ভাবে চাকরি হয়না,এসব জালিয়াতি চক্র। আমি বেশি বারণ করতে পারলাম না শেষে বলবে আমার জন্যে চাকরি হল না। কোন একটা স্কুলের ক্লার্ককে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হল সার্টিফিকেট বার করে দেবার জন্যে। জাল সার্টিফিকেট একটা এল, কিন্তু তারপর চাকরি করে দেবার লোক আর পাওয়া গেল না। এই ভাবে ওদের জীবন কাটে।আমার চোখের সামনে ঘটনা গুলো ঘটে বলে আমার অসহ্য লাগে।
লছমী আমার বাড়ি ছাড়াওআরও কয়েকজনের বাড়ি কাজ করে। আমি ওর গল্প শুনবনা ভাবি কিন্তু আমার কানে এসে যায়। ওরএকটি ছেলে ও একটি মেয়ে । ছেলে বাবুয়া, একটু বড় হতেই ইস্কুল ছেড়ে দিল, তারপর এক সময়ে ওর কাজ জুটে গেল। দুটো ফ্ল্যাটবাড়িতে সকালে ঝাড়ু দেওয়া আর ময়লা ফেলা । তারপর একটা নারসিং হোমে। ফ্ল্যাট বাড়ির লোকের ফাই ফরমাস খেটে কিছু বাড়তি টাকা। ও এখন মোটামুটি রাজা।
একদিন মায়ের খোঁজে ও আমাদের বাড়ি এসেছিল, ওর মাথার চুলের ছাঁট দেখে জিজ্ঞেস করলাম, “দারুণ চুল কেটেছিস রে । কত টাকা নিল?” ও মাথা নীচু করে বলল, ‘একশ টাকা’। ‘বাঃ দারুন লাগছে তোকে।‘ আমি তিরিশ টাকায় চুল কাটাই শুনে মাথা নীচু করে বসে রইল। আমি ওকে এসব বললাম বটে কিন্তু মনে মনে ভাবলাম ,ওরা ছেলে মানুষ, রোজগার করছে, একটু শখ তো মেটাবেই।
চলছিল ভালোই, আমি সুযোগ পেলে ওদের একটু উপদেশ দিই ব্যাঙ্কের খাতা করতে। এখন নানারকম সরকারী স্কীম হয়েছে,সেগুলো যদি ওরা কিছু পায়। ব্যাঙ্কের খাতা খুলে মাসে পঁচিশ টাকা করে জমা দিলে সরকার দেবে আরও পঁচিশ টাকা। তাতে শেষ বয়সে অনেক টাকা হবে, তার ওপর দুলক্ষ টাকা জীবন বীমা। কিন্তু সেটা হবার নয়। মাসের প্রথমে যদি বা দুএকশ টাকা খাতায় জমা পরে শেষ মাসে আমার মুড়িয়ে তুলে নেয়। এরা সারাদিন পরিশ্রম করে, সমস্ত টাকা খরচ করে ফেলে। বাড়তি খরচের ধাক্কা এলেই মহাজন, ধার, সুদ আরও ধার আরও সুদ। এই গেল গল্পের পটভূমিকা , এরপর ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত এগিয়ে চলল।
বাবুয়ার বিয়ের ঠিক হয়ে গেল । আমি বললাম, “হ্যাঁরে এত তাড়াতাড়ি কেন বিয়ে দিচ্ছিস? ছেলেটা এই রোজগার করতে শুরু করেছে। কিছুদিন আনন্দ করুক, টাকা পয়সা জমাক। তারপর না হয় –”। লছমীর উত্তর রেডি, “মেয়ে খুব ভাল, আর মেয়ের বাবা খুব করে ধরেছে”। আমি পাল্টা বললাম, “তা ছেলের বিয়ে দিবি টাকা কোথায় পাবি? মেয়ের বাবা কি তোর সব খরচ দেবে?” লছমীর এক কথায় উত্তর, “লোন করে নেব”। আমি রেগে গিয়ে বলি, “লোন তো করবি কিন্তু শোধ কী করে করবি?”ওর মুখে কোনো উত্তর নেই, মনে মনে হয়তো ভাবছিল আরেকটা লোন করে এটা শোধ করে দেবে।
একদিন লছমী এসে হাউমাউ করতে করতে বলল, বাবুয়া ফোন কিনবে বলছে। সিনেমাওয়ালা ফোন। আমি অনেক কষ্টে রাগ সামলে ছেলেকে আমার কাছে পাঠাতে বললাম।একদিন ও এল মায়ের সঙ্গে।
‘মামা তুমি একে একটু বোঝাও, ও আঠার হাজার টাকার ফোন কিনবে’।
আমি বাবুয়াকে অনেক বোঝালাম, “হ্যাঁরে তুই এত দামী ফোন কেন কিনবি? এই দেখ আমারটা সাত হাজার টাকা দাম । এতে কথা বলা, ফটো তোলা, মেসেজ পাঠানো, গান শোনা, সিনেমা দেখা সব কাজ হয় । তোর আর কী চাই? খবরদার টাকা গুলো নষ্ট করিস না । আমার কথা শোন”। ও মাথা নীচু করে বসে রইল।
কিছুদিন পরে খবর পেলাম ও কিনে ফেলেছে সিনেমাওয়ালা ফোন। কিছু টাকা দিয়েছে, বাকীটা কিস্তি। ফোনের দোকান কিস্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ভাই বোন একসঙ্গে বসে সিনেমা দেখছে। কদিন বাদে বিয়ে, বাবলা ভাবী বৌএর সঙ্গে কথা বলছে।
ঠিকই ছিল সব। কিন্তু এদের গল্প হঠাৎ এক দুর্ভাগ্যজনক বাঁক নিল। লছমীএকদিন খবর দিল বাবলা বেশিরকম অসুস্থ, ওকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।কথা বলে জানলাম, কিছুদিন ধরেই পেটে ব্যাথা। দোকান থেকে বলে এটা ওটা ওষুধ কিনে খাচ্ছিল। শেষে রক্ত পড়া শুরু হয়। যে নার্সিং হোমে কাজ করছিল সেখানে ডাক্তারবাবুরা ভর্তি করে নিয়েছেন। কয়েকদিন পরে খবর পেলাম ডাক্তারবাবুরা কোলকাতার হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেছে। ও মেডিকেল কলেজে ভর্তি, এর কয়েক দিনের মধ্যেই সব শেষ। খবর পেয়ে দেখতে গেলাম, বারো ঘরের এক উঠোনে শোয়ানো আছে ছেলেটা, পুরো বস্তিবাসী বিলাপ করছে। কদিন পরেই ছেলেটার বিয়ে হবার কথা ছিল।
জীবনের দায় বিষম। শোক ঝেড়ে উঠে দাঁড়াতেই হয়। ওরা আবার কাজে যোগ দিল। আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম সরকার যে গরীব মানুষদের ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলতে বলেছিল, সেসব কি বাবুয়া করেছিল? লছমী কিছুই জানেনা। আমি আর জিজ্ঞেস করিনা, নিস্ফল বিলাপ শুনতে আমার ভাল লাগেনা।
কদিন পরে লছমী এসে একটা ব্যাঙ্কের পাশ বই আমার হাতে দিয়ে বলল, এই নাও বাবুয়ার ব্যাঙ্কের খাতা। এখান থেকেই লোন নিয়েছিল। ব্যালেন্স দেখলাম পঁচিশ টাকা। মাঝে মাঝে যে টাকা জমা করার কথা কিছুই করেনি। লোনের কথাও কিছু লেখা নেই পাস বইতে।লছমী বলল, দুটো কিস্তি নাকি দেওয়া হয়েছে। বাকি কিস্তি এখন দিতে হবে। আমি মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে ওকে বইটা ফেরত দিতেই বলে, “তুমি একটু ব্যাঙ্কে গিয়ে খোঁজ কর”। মরা ছেলেটা বা তার মাকে বকাবকি করে আর কী লাভ! ব্যাঙ্কে গেলাম একদিন, জানা গেল ঐ অ্যাকাউন্ট থেকে কোন লোন নেওয়া হয়নি।
কদিন বাদে লছমী এসে জানাল, ফোনের দোকান থেকেই নাকি লোনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সেখানেই বাকি কিস্তি গুলো দিতে হবে। আমার জানা ছিল ওদের অনেক ঋণ। তার ওপর ছেলেটা গেল, ওর চিকিৎসা আর মারা যাবার পর পুজো পাঠ ইত্যাদিতে আরও ঋণ হয়েছে। সব মিলিয়ে ওদের অনেক বোঝা। আমি এইসব ভেবে ওকে একটা অসৎ পরামর্শ দেবার কথা ভাবলাম।
“শোন, তুই চুপচাপ বসে থাক। কোথা থেকে বাবুয়া ফোন কিনেছিল, কোথা থেকে লোন নিয়েছিলতুই তো এসব জানিস না। তোকে ধার শোধ করতে হবে না। ওরা আসুক তোর বাড়িতে তখন দেখা যাবে। তুই বলবি, ও ওপরে চলে গেছে, যাও ওপর থেকে ওকে ধরে নিয়ে এস।“
“আমার ডর লাগছে।অ্যায়সা করনা ঠিক হোগা?” যখন একটু গভীর কথা বলে তখন লছমী বাংলা বলে না, হিন্দী বলে।
“কাহে নেহি ঠিক হোগা? তুই নীরব মোদি, বিজয় মাল্যর গল্প জানিস?” লছমী হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। “ শোন, এরা ব্যাঙ্ক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছে। ওরা তিমিঙ্গিল, তিমি মাছ গিলে হজম করে ফেলে। সরকার এদের বিরুদ্ধে কিচ্ছু বলছে না। তোর এই সামান্য টাকা……।
“মামা, অ্যায়সা করনে সে বেইমানি হোগা”।
আমি জোর দিয়ে বললাম, “কিচ্ছু বেইমানি হবে না। তুই চুপচাপ বসে থাক। যদি ওরা না ছাড়ে তখন ওদের বলবি তোর ক্ষমতা নেই শোধ করার। দরকার হলে ফোনটা ফেরৎ দিলেই হবে”। এই সব বলে ওকে তখনকার মত ঠান্ডা করলাম। ও বাড়ি চলে গেল, কিন্তু আমার যুক্তিতে ও সন্তুষ্ট হয়েছে বলে মনে হোলনা। কিন্তু তারপর ওই বিষয়ে আর আমার সঙ্গে কথা হয়নি।
কিছুদিন পরে আমি একদিন লছমীকে জিজ্ঞেস করলাম ফোনের কিস্তির কথা,ফোনের দোকান থেকে লোক এসেছিল কিনা। ওর জবাব শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ওরা আমার পরামর্শ নেয়নি। ও বলল, বা্বুয়া চলা গিয়া। লেকিন অ্যায়সা করনেসে উপরমে ও বদনামী লেকে যায়েগা।বাবুয়াবহেন কে সাথ ওহি ফোনমে একসাথ ফিলিম দেখতে থে। উসকো নিশানি তো একঠো রাখনা চাহিয়ে। হমলোগ ফোনকা কিস্তি সব মিটা দেঙ্গে।
আমি নির্বাক হয়ে শুনলাম।
[বানানবিধি/মতামত লেখকের নিজস্ব]
Tags: গল্প, ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, হজম শক্তি
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।