বহুকালের পুরোনো রেল স্টেশন। ব্রিটিশ আমলে রেলপত্তনের গোড়ার যুগেরই স্টেশনটি। স্বাধীনতার পর রুরকি, ভিলাই, আসানসোল-দুর্গাপুরে যখন ইস্পাত প্রকল্পটি হয়েছিল, আমাদের এই বেলাডুবিতেও সে সময় স্টিল প্ল্যান্ট হয়েছিল। তখন বেলাডুবি পর্যন্ত নতুন রেলপথ সংযোজিত হওয়ায় ওই পুরনো রেল স্টেশনটি হয়ে উঠল – কামড়ুম জংশন। আমাদের তল্লাটে ওই কামড়ুম শহরটি বড় সড় মহকুমা শহর ছিল তখন, বেশ জমজমাট। নামীদামি মানুষজন থাকতেন কামড়ুম শহরে।
তবে আমি কখোনো কামড়ুমে যাইনি। এখন তো আর কেউ ট্রেনে ওঠে না ওই কামড়ুম জংশন স্টেশনটি থেকে। ট্রেন থেকে কেউ নামেও না। আমাদের বেলাডুবি বা ব্রাঞ্চ লাইনে সুখপুরে যাওয়া-আসার ট্রেনগুলি কামড়ুম জংশনে এখনও থামে। তবে কেউ ওঠে-নামে না। এখন জনহীন পরিত্যক্ত, মরা একটি শহর কামড়ুম। অরণ্য, মহারণ্য গ্রাস করে নিয়েছে বহুকাল ওই কামড়ুম শহরটিকে। ট্রেন থামলে গাছ গাছালির ভেতর দিয়ে ওই শহরটির বাড়ি ঘরদোরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। লুথেরান গির্জার চূড়াটি দেখায় যায় গাছ গাছালির ফাঁকে।
ওই কামড়ুম শহর থেকে নিজেদের অস্টিন গাড়িতে এসে আমাদের বেলাডুবির সেন্ট জোসেফে’স স্কুলে পড়ত শীলা, আমার সঙ্গেই। টিফিন বক্স খুলে প্যানকেক দু’ভাগ করে এক খণ্ড আমাকে দিত শীলা,ক্রিম বিস্কুট খাওয়াতো। সেই আমাকে পড়তে দিয়েছিল ‘আঙ্কেল টমস কেবিন’, ‘নিকোলাস নিকোলবি’। তখন ওই সিক্স-সেভেন ক্লাসে সৌরভ, হেনা, সুপ্রতিম, নওরোজরা আমাদের জুটিটি গিয়ে খোঁচা দিত, হাসাহাসি করত। অনেক পরে, বড়বেলায় অনেকবার ভেবেছি, যদি না মহা অঘটন ঘটে যেত ওই কামড়ুমে, হয়ত শীলা গোমসই হত আমার প্রথম প্রেমিকা,হতে পারত এমন ঘটনা,যে লুথেরান চার্চে শঙ্খ সাদা ঝালর দেওয়া ভূলম্বিত গাউন পরা শীলার সঙ্গে বিয়েই হয়ে যেত আমার। এসব কথা ব্যথিত তরুণ বয়সে কত না ভেবেছি।
এই বয়সেও আমার শীলার কথা মনে পড়ে। ভাবি, সে-ও অমন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল কি করে!
হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া – কথাটা হরবখত ব্যবহার হয়। ‘লোকটা অমন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল কি করে।’ ‘আমার মোবাইলটা কি হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে?’ কামড়ুমের চাড়াইল মাঠে ওই রকম হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিলেন এস এন এস। এস এন এস হচ্ছেন নকশালপন্থী নেতা সত্যনারায়ণ সিং, পুলিশের তাড়া খেয়ে তিনি কামড়ুমের ওই মাটিতে হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিলেন। এ নিয়ে বেলাডুবিতে হই হই পড়ে গিয়েছিল আমাদের ছোটবেলায়। বেলাডুবির শ্রমিক মহল্লায় আত্মগোপন করেছিলেন নকশালপন্থী দলের ওই উচ্চপদস্থ নেতা সত্যনারায়ণ। পুলিশ তাড়া করলে বেলাডুবি রেল স্টেশনে ছুটে এসে তিনি একটি চলন্ত ট্রেনে উঠে পড়েন, তারপর কামড়ুম জংশনে নেমে চাড়াইল মাঠের ভেতর দিয়ে দৌড়ে পালান তিনি। নকশালপন্থী দলে তিনিই শীর্ষস্থানীয় একমাত্র নেতা, যাঁকে পুলিশ কখনও ধরতে পারেনি। সংবাদপত্রে এমনটাই পড়েছিলাম ওই সিক্স-সেভেনে পড়ার সময়।
আমাদের ওই বয়সে খুব নামডাক ছিল ফুটবলার বিকাশ পোড়েলের। বিএনআর দলের ফুটবলার বিকাশ থাকতেন কামড়ুমে। ওঁর খেলা আমরা দেখেছি। বেলাডুবির স্পোর্টিং ক্লাবের সঙ্গে কামড়ুম স্টারর্সের খেলা হয়েছিল বেলাডুবি আর এম এস মাঠে। সেই ম্যাচে বিকাশের জোড়া গোলের একটি রেফারি অফ সাইডের দরুণ বাতিল করে দিলেও ১-০ গোলে জিতেছিল কামড়ুম স্টারস। আমরা স্কুল বালকেরা দল বেঁধে সেই ম্যাচে বিকাশের খেলা দেখতে গিয়েছিলাম।
আর থাকতেন সাধনা সেন, কামড়ুমে। বাংলা ছায়াছবিতে তখন অসিত কুমার-সাধনা জুটির সে কি জনপ্রিয়তা। এখন লোকে তাঁদের কথা ভুলে গেলেও সেকালে ‘মনের কথা’, ‘সুখের সংসার’, ‘একটুকু আশা’ এসব ছবির জনপ্রিয় অভিনেত্রী ছিলেন সাধনা সেন। বেলাডুবির প্রতিমা সিনেমা হলে মনের কথা ছবিটি যখন এল, মনে পড়ে মস্ত মস্ত পোস্টার, হোর্ডিংয়ে অসিত কুমার-সাধনা সেনের ছবির দিকে আঙুল তুলে লোকজন একে অপরকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলতেন, ‘ওই দেখ, ওই দেখ, সাধনা সেন, কামড়ুমে থাকে’।
ওই ফুটবলার বিকাশ পোড়েল, অভিনেত্রী সাধনা সেন, কামড়ুমে স্রেফ একটি রাতের ভয়াবহ অঘটনে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন। গড়ের মাঠ ভুলে গিয়েছে বিকাশকে। টলিউডের মনে নেই সাধনা সেনকে।
২.
কি ঘটেছিল কামড়ুমে? মহকুমা শহরটির বেবাক মানুষজন ওইভাবে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল কী করে? এই ঘোর অঘটন, ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটেছিল আমাদের বালক বয়সে, যখন আমরা নাইন-টেনে পড়ি। গোটা ব্যাপারটাই সেকালে দ্রুত ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল বলে, আমরা বালকের দল বড়দের মুখ যেটুকু শুনেছিলাম, সেটুকুই জানি। সংবাদপত্রগুলি পরদিন ‘ভয়ঙ্কর ঘটনা, বহু হতাহত’ – এ জাতীয় খবর দিলেও, দিন দুয়েকের পর থেকে কামড়ুমের এক টুকরো খবরও অজ্ঞাত কারণে কোনও কাগজে দেওয়া হয়নি। সে আমলে ছিল না টিভি, মোবাইল ফোন। এক একটি শহরে ল্যান্ড ফোনও ছিল তখন আঙুলে গোনা। গুজব অবশ্য রটেছিল খুবই।
বলাবলি হয়েছিল, রাত গভীরে বিকট বিকট বিস্ফোরণের শব্দ সহ কামড়ুমের বিভিন্ন অঞ্চলে মাটি ফুঁড়ে ফোয়ারার মত ছড়িয়ে পড়েছিল নীল বর্ণের ঘন তরল। ওই নীল তরলের ঢেউ নালা-নর্দমা উপচে ঢেউয়ের মত বইতে থাকে কামড়ুমের হাইরোডে, সড়কগুলিতে, অলিতে গলিতে। পাণীয় জল সরবরাহ ব্যবস্থায় ঢুকে পড়ে নীল তরল স্রোত। সেই নীল তরলের ছোঁয়া গায়ে লাগতেই মানুষজন নীল বর্ণ হয়ে গিয়ে হাত-পা ছুঁড়ে মারা যায়। পালাতে গিয়ে নীল ঢেউয়ে ভেসে ভেসে মারা যায় তারা। রটেছিল কামড়ুমে ভুগর্ভে বিজ্ঞানীদের গোপন গবেষণা কেন্দ্রে ওই বিস্ফোরণ ঘটেছিল।
কেন, কী রাসায়নিক তৈরি হচ্ছিল কেউ জানে না।কেউ কেউ বলেছিল কাঁদানে গ্যাসকে আরও ঝাঁঝালো করার পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছিল সেখানে।
কামড়ুম থানাটির কী অবস্থা হয়েছিল, কারও জানা নেই। তবে বাসুদেবপুর থানা থেকে পুলিশ বাহিনী এসেছিল।ওসি সহ বাসুদেবপুর থানার পুলিশের কয়েকজন পুলিশকর্মী কামড়ুমে ঢোকার পর আর ফিরে আসেন নি। এরপর পুলিশের বাকি বাহিনী কামড়ুম ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে। ভোরে বেলাডুবি থেকে দমকলের বেশ কয়েকটি গাড়ি মস্ত মস্ত ল্যাডার ও হোসপাইপ নিয়ে কামড়ুমে গিয়ে রেল লাইনের এপার থেকে শহরের পাড়াগুলি তাক করে জলের ফোয়ারা ছোঁড়ে। আশ্চর্যের বিষয় ওই নীল ঘনস্রোত কামড়ুমের চৌহদ্দি পেরিয়ে আশপাশের অঞ্চলে ঢোকেনি। সাতকানিয়া,বলসর,বাঘাটি গ্রামগুলি বেঁচে যায়। বড়দের মুখে আমরা এসব কথা শুনেছি।
পরদিন রটে গেল কামড়ুমের নালা-নর্দমার ওই ঘননীল স্রোত থেকে রাশি রাশি পোকা কামড়ুমের পাড়ায় পাড়ায় উড়ছে। ছুঁচের মতো পোকা, তাঁদের ডানা দুটি নীলবর্ণ। ঝাঁকেঝাঁকে সেই পোকা যাকেই হুল ফোটাচ্ছে,সেই ছটফট করে মরছে। মৃতদের শরীর হয়ে যাচ্ছে নীল। বেলাডুবিতে অনেকে বলতে লাগল,পোকা নয়, ঝাঁক ঝাঁক ছুঁচের মতো ওই গুলি, তেজস্ক্রিয় রশ্মি। হবেও বা। শোনা গেল, বহু মানুষ কামড়ুম থেকে পালাবার সময় ওই পোকার কামড়ে বা তেজস্ক্রিয় ছুঁচের হামলায় মারা গিয়েছে। শীলারা কি ওইসব রশ্মি এড়িয়ে পালাতে পেরেছিল? শীলা, ওর বাবা-মা, ভাই টমটম? এত যুগ পরেও এসব ভেবে আমার মন ছল ছল করে।
তদন্ত কমিশন হয়েছিল। মামলা মোকদ্দমাও। কারও কোনও বিচার হয়নি। শাস্তি হয়নি কারও। ক্রমে দিন গড়াল, মাস গড়াল, বছরগুলিও গড়িয়ে গেল। কামড়ুমের অঘটনের বিষয়টিও ভুলে গেল সবাই। আমাদের বেলাডুবি, এই তল্লাটের মুলুটি, বাসদেবপুর এখন জমজমাট। কত লোকজন দোকান বাজার, সুপার মার্কেট, মল। শুধু কামড়ুম অরণ্যে ঢাকা এক মরা শহরের ধ্বংসস্তূপ। জনমানবহীন। তবে কামড়ুম জংশনটিতে স্টেশন মাস্টার, রেল কর্মীরা, রেল পুলিশের কর্মীরা আছেন। তারা স্টেশন সংলগ্ন কোয়ার্টারে থাকেন। তাঁরা কেউ জংশন স্টেশন চত্বরের বাইরে যান না। দোকান বাজার করেন তাঁরা পরের স্টেশন বাসুদেবপুরে। আমরা কামড়ুমের আশপাশের জনসাধারণ সর্বদাই এই রেলপথটিতে যাতায়াত করি। ট্রেন কামড়ুম স্টেশনে থামলে, ঝোপঝাড়পূর্ণ পরিত্যক্ত জনপদটি দৃশ্যমান হয়। বুক উঁচু ঘাসে পরিপূর্ণ চাড়াইল মাঠটি দেখা যায়। মাঠের প্রান্তে গাছগাছালির ফাঁকে লুথেরান গির্জাটির চূড়া দেখা যায়। গির্জার উত্তরে গাছগাছালির ফাঁকে দেখা যায় খ্রিস্টান পাড়ার ভগ্নপ্রায় বাড়িগুলি। ওই একটি বাড়িতে শীলারা থাকত।
৩.
আয়নার ভিতর দিয়ে চলে যাব ভবানীপুর – কবিতায় এই লাইন লিখেছিল ভাস্কর। কলকাতায় কলেজে পড়ার সময় ভাস্কর ছিল আমার সহপাঠী। কবি মনোময় আচার্যের ‘মায়ামুকুর’ কাব্যগ্রন্থটি আমাকে পড়তে দিয়েছিল ভাস্কর। সেকালে প্রয়াত এই কবি মনোময় আচার্যকে কিংবদন্তির কবি বলত ভাস্কর আর তার সমবয়সী তরুণ কবিরা। ভাস্করের সূত্রে তাঁদের কারও কারও সঙ্গে আমার আলাপও হয়েছিল। এই কবি মনোময় কামডুনে থাকতেন। আমাকে জানিয়েছিল ভাস্কর। কামড়ুমের ওই নীল ঢেউয়ের রাতটিতে মিলিয়ে গিয়েছিলেন মনোময়। মনোময়ের ওই মৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে সজল হয়ে উঠেছিলেন ভাস্করের বন্ধু তুষার রায়, বরানগরের পুটুদার চায়ের দোকানে আমাদের আড্ডায়।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পার করে দু-একটি ছোট সংস্থায় কাজ করার পর আমি একটি বহুজাতিক ওষুধ সংস্থার সেলস ম্যানেজার পদ থেকে অবসর নিয়ে বেলাডুবিতে রয়েছি। পৈত্রিক বাড়িটি বিক্রি করে শহরের একটি ফাঁকা জায়গায় দ্বিতল একটি গৃহ নির্মাণ করেছি। আমার স্ত্রী পারমিতা বেলাডুবির কাছেই বাসুদেবপুরে স্কুলে পড়াত। অবসর নিয়েছে সেও। আমাদের ছেলে অনুত্তম, ওর ডাক নাম বিল্টু, বেলাডুবির স্টিল প্ল্যান্টে ইঞ্জিনিয়ার। গত বছর ছেলের বিয়ে দিয়েছি। পুত্রবধূ পূর্বা আমার এক ডাক্তার বন্ধুর মেয়ে। বালিকা বয়স থেকে পূর্বা আমার ভারী আদরের, এখন সে আমার শাসনকর্ত্রী।
কর্মসূত্রে আমি বাংলার জেলাগুলিতে ঘুরেছি, গিয়েছি বহির্বঙ্গেও। একবার জামশেদপুর থেকে বেলাডুবিতে ফিরেছি, কয়েকদিন ছুটি কাটাতে, সেটা ১৯৮৬ সালের এপ্রিল। সন্ধ্যায় হঠাৎ টিভিতে দেখলাম, সোভিয়েত রাশিয়ার চেরনোবিলে পরমাণু কেন্দ্রে বিস্ফোরণে বহু মানুষ হতাহত হয়েছে। তখনও সোভিয়েত ভাঙেনি। মিখাইল গোরবাচভের আমল। গোটা বিশ্বেই হই হই পড়ে গেল। মোট কতজন মারা গেছেন, তা সোভিয়েত সরকার জানাল না। তবে চেরনোবিল শহরটি পরিত্যক্ত হল। বিবিসি-সিএনএন-এ বিশ্বের মহা মহা বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করলেন তেজস্ক্রিয়তার দরুন চেরনোবিলে আগামী ৩০০ বছর মানুষ পশুপাখি, গাছপালার প্রাণ ধারণের উপযুক্ত আহবাওয়া থাকবে না। সংবাদপত্র, টিভি, রেডিওয় এসব খবর রটল যখন আমাদের বেলাডুবিতে এই তল্লাটে আবার বলাবলি শুরু হল কামড়ুমের ওই ভয়ঙ্কর রাতটির কথা। বয়স্ক মানুষজন বলতে লাগলেন সেসব কথা, তাদের সঙ্গে আমরাও।
তারপর আবার মানুষজন ভুলে গেল কামড়ুমের ওই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার বিষয়টি।
এসব কথাও কত আগের কথা। পঁয়ত্রিশ, ছত্রিশ বছর আগের। এই সেদিন এবছর এই ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি আমার বয়স ৭০ স্পর্শ করছে বলে আগের রাতে বিল্টু একটা বার্থ ডে কেক নিয়ে এল। ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটা ছুঁতেই সেই কেক কেটে আমি পারমিতার মুখে একটুকরো, এরপর পূর্বার মুখে, বিল্টুর মুখে তুলে দিলাম। পূর্বা সেই কেকের চকোলেট আমার মুখে মাখিয়ে দিয়ে হই হই তুলল। মোবাইলে এসব ছবি, সেলফি ইত্যাদি তোলা হল। সেদিন রাত্তিরে ঘুমিয়ে পড়ার আগে মনে মনে ভাবলাম, আগামীকাল আমার ৭০ বছরের জন্মদিনটিতে আমি সকালে উঠেই কামড়ুম শহরটি ঘুরে আসব। কোনও দিন যাইনি ওই শহরে। এবার যাবই।
৪.
জন্মদিনের সকালটিতে ঘুম ভেঙেই আমার মনে পড়ল আজ আমাকে যেতে হবে কামড়ুমে। চা খেতে খেতে খবরের কাগজটি পড়লাম রোজকার মত। এরপর জন্মদিন,তাই এক বাটি পায়েস দিল পারমিতা। গত রাতেই সে রেঁধে রেখেছিল। ফ্রিজের ঠান্ডা পায়েস তারিয়ে তারিয়ে খেলাম। এরপর স্নান সারলাম, বরাবরের অভ্যাস আমার সকালেই স্নান সেরে নেওয়া। পুত্রবধূ জন্মদিনে দিয়েছে নতুন শার্ট। সেই শার্টটি পরে কাঁধে ঝোলাটি নিয়ে রোজ যেমন বের হই, সে রকম টই টই করতে আমি বেরিয়ে পড়লাম। বাড়ির কাউকে কিচ্ছুটি বললাম না। পূর্বা বেরিয়ে বলল, ‘তাড়াতাড়ি ফিরো, আজ তোমার জন্মদিন, বেলা দুপুর করো না কিন্তু …’
বেলাডুবি রেল স্টেশনের নিচে প্রদীপের চায়ের দোকান। চা খেলাম, সিগারেটও। ডাউন ট্রেনটি আসার ঘোষণা হতেই দু নম্বর প্লাটফর্মে উঠে ওই ট্রেনটি ধরলাম। বাসদেবপুর, মলাটি পেরিয়ে কামড়ুম জংশন আসতেই নামার সময় গেটের কাছে দাঁড়ানো দু-চার জন যাত্রী হাই হাই করে উঠলেন, নামবেন না, নামবেন না। ওদের কথায় কান না দিয়ে তড়াক করে নেমে পড়লাম। দূরে রেল পুলিশের দুজন কর্মী বসেছিলেন। তাঁরা উঠে দাঁড়িয়ে মৎ যাইয়ে মৎ যাইয়ে বলে কয়েক পা এগিয়ে এলেন, কিন্তু আমি প্লাটফর্মের প্রান্তে নেমে রেলইয়ার্ড পেরিয়ে চাড়াইলের মাঠের দিকে এগোতে, প্লাটফর্ম ছেড়ে তাঁরা আর এগোলেন না।
ঘাসের জঙ্গল ঠেলতে ঠেলতে আমি দূরে গাছ গাছালিতে ঢাকা লুথেরান গির্জার চূড়াটি লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতে লাগলাম। মাঠের ভিতর এদিক সেদিক দেখলাম কাঠকুঠো স্তূপ করে রাখা। সাদা ধবধব করছে সেই স্তূপগুলি। কাছে গিয়ে বুঝলাম গরু ছাগলের কংকাল জড়ো করা। তার ওপর ঘাস গজিয়ে গিয়েছে। ঝোপে ঝাড়ে ল্যান্টানা কামারার গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের ওপর নীল রঙের প্রজাপতির ঝাঁক উড়ছিল। আচমকা দেখলাম পূর্বা জন্মদিন উপলক্ষে যে শার্টটি আমাকে দিয়েছে তা,সমুদ্রনীল। প্যান্ট যেটি পরেছি সেটিও নতুন, কালচে নীল। উর্দ্ধে আকাশেও মনে হল আজ অধিক নীল। ভয় ভয় করতে লাগল আমার। পরক্ষণেই যুক্তিবাদী মন বলল, ধুস এসব কাকতালীয়। নালা নর্দমায় কোনও নীল তরল দেখলম না।
লুথেরান গির্জার গেটটি দিয়ে ঢোকা গেল না। সেটি লতাপাতায় ঢেকে গিয়েছে। তবে ভগ্নাদশাগ্রস্ত ওই গির্জার ভাঙা পাঁচিলের ইঁটের পাঁজা পেরিয়ে. গির্জার দরজার সামনে পৌঁছে গেলাম। বহু বর্ষায় গির্জার দরজার পাল্লা দুটির ও নীচের অংশ ক্ষয়ে গিয়েছিল। ঠেলতেই পিচবোর্ডের চেয়েও পলকা হয়ে যাওয়া দরজা ভেঙে পড়ল। ফাঁক ফোঁকর দিয়ে আসা রোদে দেখলাম গির্জার ভেতরটা আলোয় ভরে আছে। শিশু যিশুকে কোলে নেওয়া শ্বেত পাথরের মা মেরীর মাতৃমূর্তিটি অটুট রয়েছে। সবুজ কাঁচ দিয়ে আলো আসছিল। দেখলাম ওপরের ডোমের ধসে পড়া অংশ থেকে বটের শিকড় ঝুড়ি ওই শ্বেত পাথরের মূর্তির ওপর ঝালরের মত দুলছে। গির্জা থেকে পেরিয়ে আমি এরপর গাছপালা ঠেলে খ্রিস্টান পাড়ায় ঢুকে পড়ি। প্রতিটি সড়কই আমার লাগছিল বনপথ। তবে ফুলে ফুলে ঢাকা নয়, পথে স্থানে স্থানে আমাকে পার হতে হয় মানুষ ও পথ কুকুরের প্রায় শিলীভূত হয়ে যাওয়া হাড়গোড়ের স্তূপ। বহু ঝোপঝাড় পার হতে হয় আমাকে। অবশেষে আমি খুঁজে পাই সেই ‘গোমস কুটির’। শীলাদের বাড়ির গেটের সামনে প্রবেশ পথের থামে শ্বেতপাথরের ফলকটি রুমাল ঘরে ঘসে তবেই আমি এই অট্টালিকাটির এই নাম দেখতে পাই। এই প্রবেশ পথটি দিয়েও গৃহ অভ্যন্তরে ঢোকা সম্ভব হয় না। ভাঙা পাঁচিলের ইঁটের স্তূপ পেরিয়ে ভাঙা দরজা দিয়ে আমি এবাড়ির বৈঠকখানাটিতে ঢুকতে পারি। দেওয়ালে ধূলি ধূসরিত কয়েকটি ছবি ঝুলছিল। কাঁধের ঝুলি থেকে বার করা জলের বোতলের জল ঢেলে রুমালে ঘসে আমি ছবিগুলি পরিস্কার করি। পেয়ে যাই একটি ছবি, যাতে সাইকেলের হাতল ধরে দাঁড়িয়ে আছে শীলা,পাশে হাসিমুখে ভাই টমটম। দেখলাম কী বাহারি মস্ত ঘেরের টুপি পরে আছে শীলা। দেখে এই বয়সেও আমার থুতনি নেড়ে দিতে ইচ্ছে করল শীলার। দিলামও। ছবির শীলা যেন কপট ক্রোধে তেমনই বলল, য়ু নট্টি বয়।
ছবিগুলি পরিস্কার করে, টাঙাতে টাঙাতে অনেক সময় লেগে গেল। ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠার সাহস হল না আমার। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে দেখে বাড়িতে পারমিতাকে ফোন করে দেরি হবে জানাতে গিয়ে দেখলাম, মোবাইলটি অচল হয়ে গেছে, স্ক্রিন কালো হয়ে গিয়েছে।
শীলাদের বাগানের পিছন দিকে পুকুরধার দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। দেখলাম, ভাঙা গ্যারেজে কয়েক টুকরো লোহার খণ্ড পড়ে আছে। অস্টিন গাড়িটি। তবে চাকাগুলি দিব্যি আছে। পুকুর ধারে একটি গাছে তিনটি মাছরাঙা দেখলাম, নীল।
এরপরও আমি কামড়ুমের পথে পথে ঘুরলাম। বাচস্পতি পাড়ার একটি ধ্বংস হয়ে যাওয়া গৃহের গেটে পথের ফলকে লেখা ‘মায়ামুকুর’। বুঝলাম এই সেই কবি মনোময় আচার্যের বাড়ি। এই বাড়ির ধসে পড়া লাইব্রেরি ঘরটিতে ছত্রখান আলমারির চতুর্দিকে বেশ কিছু বই ছড়ানো ছিল। উইয়ে ধরা বইয়ের স্তূপ থেকে বেছে বেছে আমি ততো নষ্ট হয়নি এমন দুটি বই নিয়েছি, কবি, মনোময় আচার্যের ‘দিনন্ত ও সূর্যাস্ত’ কাব্যগ্রন্থটির দুটি কপি। এই বই দুটি আমি কবি সম্মেলন ও নতুন গল্পপত্রের সম্পাদকদ্বয় শ্যামল কান্তি ও শংকর চক্রবর্তীকে দেব। দুজনেই আমার খুবই স্নেহভাজন।
জন্মদিনটিতে এই কামড়ুম ভ্রমণে আমি বৃক্ষ সকল থেকে ঝুলন্ত বহু স্বর্ণলতার স্পর্শসুখ যেমন পেয়েছি, বটের শিকড়ও ঝুড়িগুলি বাধাদানের বড় চাপড়ও মেরেছে। ধারালো ঘাসে আমার হাত পা ছড়ে গিয়েছে। কাঁটায় কাঁটায় কতো না ক্ষতবিক্ষত হয়েছি। জানুয়ারির শেষেও ঘামে নেয়ে গিয়েছি। নোনতা ঘাম গড়িয়ে কাটা ছেঁড়ার ক্ষতে পরে জ্বালা জ্বালা করেছে। ভালোবাসার জ্বালা?
ঘুরে ঘুরে ফের কামড়ুম স্টেশনে ফিরতি ট্রেনের জন্য আসতেই ফের একবার ওই দুই রেলপুলিশ কর্মীর মুখোমুখি হওয়া। এবার কিন্তু তাঁরা আমাকে খাতির যত্ন করতে থাকলেন। ‘আপ লোট আয়া সাব। লোট আয়া।’ খাতির করে তাঁরাই আমাকে ট্রেনে উঠিয়ে দেন। বেলাডুবিতে পৌঁছোই বিকেল বিকেল। স্টেশনে নেমেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রিকশ চাপি। রিকশ বাড়ির গেটে পৌঁছতেই দেখলাম, সামনের বাগানে একটি যুবক গোলাপ গাছের গোড়া খোঁচাচ্ছে খুরপি দিয়ে।
– কে ওই ছেলেটি। যুবকটিকে খুব চেনা চেনা লাগলো। খুব চেনা, তাও মনে করতে পারছি না। গলার ভেতর একটা গোল্লা দলা পাকিয়ে উঠলো আমার। একটা অস্বস্তি। ততক্ষণে খুরপি হাতে সে উঠে দাঁড়িয়েছে। আমাকে দেখেই যুবকটি বলে – এত দেরি করলে পাপা।
তৎক্ষণাৎ আমার শরীরে ঝপ করে কি যেন একটা ঘটে গেল। আমি যেন বাতাসের একটা ভাঁজের থেকে বেরিয়ে আবার ঝপ করে পৃথিবীতে ফিরলাম। আমি ওকে চিনতেও পারলাম, আরে এতো সেন্ট, সলমন, ওর মা, ওকে এই নাম দিয়েছে। মায়ের মত ফর্সাও হয়েছে সেন্ট। বেলাডুবি কলেজে সে ফিজিক্স পড়ায়। রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক করে এসেছে সে। আমার জন্মদিন, তাই সেন্ট হয়ত আজ কলেজে ডুব দিয়েছে বা তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে।
বারান্দায় আমার ইজি চেয়ারটিতে বসে বই পড়ছিল আমার পুত্রবধূ ডরোথি। আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে চোখ পাকিয়ে বলল. সেই দেরি করে ফিরলে পাপাই, বলেছিলাম না, জন্মদিন তাড়াতাড়ি ফিরো। ডরোথি শীলার বান্ধবীর মেয়ে।
শীলা। হ্যাঁ, ঘরের ভেতর থেকে আমার বউ শীলা বেরিয়ে এলো। এই বয়সে, এখনও তার গাল দুটি লাল, দেখে বোঝা যায় তরুণী বয়সে সে কী রূপসীই না ছিল। হ্যাঁ কামডুমের লুথেরান গির্জাতেই আমাদের বিয়ে হয়েছিল। শীলার মা-বাবা বিশেষত শীলার বাবা স্যামুয়েল গোমেস আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিলেন, কামড়ুমের খ্রিস্টান পাড়ার মানুষজনও কেউই আপত্তি তোলেননি। বরং খুশিও হয়েছিলেন অনেকেই। তবে বেলাডুবিতে আমাদের পাড়া প্রতিবেশীদের ভেতর বেশ ছিছিক্কার উঠেছিল। গুঞ্জন উঠেছিল, বামুনের ছেলে বিয়ে করছে অ্যাংলো খিরিস্তান ঘরের বেহায়া মেয়েকে। গুঞ্জন উচিয়ে কলরবের চেষ্টাও করেছিলেন কেউ কেউ। তবে আমাদের তরুণ স্মৃতি সংঘের বন্ধুরা দাবড়ে তাদের ঠান্ডা করেছিল। কামডুমের লুথেনরান চার্চে আমাদের বিয়ে দিয়েছিলেন রেভারেল মাইকেল বিশ্বাস। হ্যাঁ, শীলা পরেছিল মস্ত ঘেরের দুধ সাদা ভূমিতে লুটিয়ে পড়া ঝালর দেওয়া সেই গাউন। কী সুন্দরই লাগছিল না তাকে?
আমার জন্মদিন উপলক্ষে আগের রাতে শীলাই বানিয়েছিল মস্ত সাইজের চকোলেট দেওয়া বার্থ ডে কেক। সেই কেকের অর্ধেকটা প্যাকেট করে আমার জনমদিনটিতে সকালে আমি গিয়েছিলাম কামড়ুমে আমার শ্যালক শীলার ভাই টমটম, শালা বউ পামেলা আর তাদের ছেলে, ছেলের বউ তার ছোট্ট নাতনিটিকে দিতে। কয়েক বছর আগে পর পর আমার শ্বশুর-শাশুড়ি দু’জনেই মারা গেছেন। তবুও প্রতি বছরই শীলাকে সঙ্গে নিয়ে, কখনও একা একাও আমি কামড়ুমে যাই। কামড়ুমে কবি মনোময় আচার্যের কাছেও যেতাম, তিনি গত বছর মারা গেছেন। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে তিনি সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। তখন আমি তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম। সাহিত্য একাডেমি পাওয়া তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘দিগন্ত ও সূর্যাস্ত’ বইটির দু কপি তিনি আমাকে দিয়েছিলেন শংকর চক্রবর্তী ও শ্যামল কান্তি দাশকে দেওয়ার জন্য। আমি তাদের সে বই দিয়ে দিয়েছি।
কামড়ুমের সেই ফুটবলার বিকাশ পোড়েল বিএনআর থেকে পরে গিয়েছিলেন মোহনবাগানে। চুনি গোস্বামী, জার্নেল সিংয়ের সঙ্গে যখন খেলতেন খুব নাম ডাক হয়েছিল তার। আমাদের থেকে বয়সে তিনি ছিলেন ঢের বড়। বোধ করি তিনি আর নেই। অভিনেত্রী সাধনা দেবী পরে বোম্বাই চলে গিয়েছিলেন। ষাট-সত্তর দশকে বেশ কিছু হিন্দি ছবিতে সহনায়িকার ভূমিকায় আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন বোম্বেতেই তার প্রয়াণের খবর খবরের কাগজে বের হয়েছিল।
কামড়ুম আমাদের তল্লাটের বড়সড় জমজমাট শহর। স্টেডিয়াম আছে, মাল্টিপ্লেক্স আছে, কত মল। কাছাকাছি এরকম বড় শহর, ওই জামশেদপুর।
তাহলে ওই মহা দুর্ঘটনা? বিষাক্ত নীল স্রোত? অত মৃত্যু? অত নিখোঁজ? তাছাড়া পারমিতা? বিল্টু? পূর্বা?
সব বানিয়ে বলা। লেখকেরা এমন তো কতো কিছুই বানিয়ে বলে।
[বানানবিধি/মতামত লেখকের নিজস্ব]
Tags: কামড়ুম জংশন*, গল্প, মৃদুল দাশগুপ্ত
email:galpersamay@gmail.com
Tridibesh Bandyopadhyay on January 25, 2022
মনে রাখার মতো একটি গল্প, কামডুম জংশন*।
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।