নবীন বরণ উৎসব চলছে। নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের ফ্রেসারস ওয়েলকাম দিচ্ছেন সিনিয়র দাদারা। আমাদের এক হৃষ্টপুষ্ট বন্ধুর হাতে এক সিনিয়র দাদা গোলাপ ফুলের সঙ্গে ধরিয়ে দিলেন পেল্লাই সাইজের একটি কাতলা মাছ। সেইসঙ্গে ঘোষণা করলেন আজ থেকে ওর নাম দেওয়া হল ‘কাতলা’। কাতলাই বটে। চেহারার সঙ্গে একদম মানানসই। সারা অনুষ্ঠান জুড়ে বয়ে গেল হাসির রোল। বন্ধুটির তখন চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্হা। এরপরে খাওয়া-দাওয়া, গান-গল্প, কবিতা, হৈ চৈ সেরে যখন অনুষ্ঠান শেষ হতে চলেছে, ঠিক সেই সময়ে কোথা থেকে এক সিনিয়র দাদা এসে আমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে কিছুটা দূরে কলেজ মর্গের পাশে এনে সরাসরি ডিসেকশন হলের মধ্যে ঢুকে পড়ে এক্কেবারে ডিসেকশন টেবিলের উপর বসিয়ে দিলেন। তখন ডিসেকশন হলে টেবিলগুলোর উপর বেশ কয়েকটি লাস কাটা -ছেঁড়া করছিলেন সিনিয়র দাদা-দিদিরা। আমি তো বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। টেবিলে অতগুলো লাশ বা মড়া দেখে। একজন সিনিয়র দিদি আমাকে উদ্ধারের কাজে এগিয়ে এলেন। ‘আয় নেমে আয়, ভয় পাস না। ক্লাশ শুরু হলে সব ডাক্তারি ছাত্র-ছাত্রীদের এই ডিসেকশন হলে আসতে হবে শব ব্যবচ্ছেদ করার জন্যে’। তোর তো ভালই হল,মনটা তৈরী হয়ে গেল’। আমাদেরও প্রথম প্রথম কেমন গা গুলিয়ে উঠতো খাওয়ার সময়ে। রাতে ঘুমানোর সময়ে ওই লাশগুলোর ছবি মনের মধ্যে ভেসে আসতো। প্রথমের দিকে ঠিকমত ঘুমাতে পারতাম না। ‘ ‘এখন ঠিক হয়ে গেছে’, সব জলভাত মনে হয়।
এরপরে একটা মৃদু ভৎসর্না করলেন সিনিয়র দাদাটাকে। ‘ওকে নিয়ে একটু মজা করলাম আর কি! বলেই আমাকে টেবিল থেকে নামিয়ে টেনে নিয়ে চললেন সোজা কলেজ ক্যানটিনে। জোর করে সেদিন অনেক খাবার খাইয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, এ্যানাটমি, ফিজিয়লজি কোন কোন বই পড়তে হবে, কতটা পড়তে হবে এসব খুঁটিনাটি জানিয়ে আমাকে বিদায় দিয়েছিলেন। এরপর থেকে কলেজে কোন অসুবিধেয় পড়লে ওই দাদাটার স্মরণাপ্ন্ন হতাম। দাদাও সাধ্যমত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন।
এনাটমি ক্লাশ শুরু হয়েছে। থিয়োরিটিক্যাল এর সঙ্গে প্র্যাকটিক্যাল চালু হয়েছে। প্রতিদিন নিয়ম করে ডিসেকশন হলে যেতে হয়। গায়ে সাদা এ্যাপ্রণ। হাতে গ্লাভস পরে আমাদের শিক্ষকরা প্রথমে দেখিয়ে দিতেন। এরপরে টাস্ক দিতেন। সেইমত আমাদের ডিসেকশন হলে সাদা এ্যাপ্রণ পরে প্রথম প্রথম হাতে গ্লাভস পরলেও পরের দিকে খালি হাতেই আমরা ডেডবডির কাটা-ছেঁড়া করতাম। খাওয়ার সময়ে ডাইনিং হলে এসে হাত ভাল করে দু-তিনবার সাবান দিয়ে ধুয়েও মনটা খুঁতখুঁত করতো। তাও খেয়ে নিতাম। পরের দিকে অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল।
ডিসেকশন হলে যখন আমরা কাটা-ছেঁড়া করতাম, তখন এককোণে একটা বেঞ্চিতে শুয়ে থাকতন অভিরামদা। অভিরাম হেলা। হাসপাতালে ডোমের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। আমরা ডিসেকশন হল থেকে বেরিয়ে গেলে সমস্ত টেবিলের উপর রাখা শবদেহগুলো সুন্দর করে ফরমালিন সহযোগে রক্ষণাবেক্ষের দায়িত্ব ছিল অভিরামদার উপর। এছাড়া কবে মর্গ থেকে কোন ডেডবডিটা ডিসেকশন হলে আনা হবে এসব তদারকি করতেন। বলাবাহুল্য এসব ডেডবডিগুলো ছিল বেওয়ারিস। অর্থাৎ কেউ রেলে কাটা, কেউ গাড়িতে চাপাপড়া, কোন ভবঘুরে পথেই মারা গেছে কিংবা হাসপাতালে থাকাকালীন মারা গেছেন যার কোন দাবিদার নেই। আমরা যে সময়ে ডিসেকশন করছিলাম সেই সময়ে উল্টৌডাঙার কাছাকাছি দার্জিলিং মেল লোকাল ট্রেনকে ধাক্কা মারাও প্রচুর লোক মারা গিয়েছিল। দুর্ঘটনায় অঙ্গ-প্রতঙ্গ সব ভীবৎস আকার নিয়েছিল। সেইসব বডি আমাদের এনআর এস হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছিল। তাদের অনেকেরই কোন দাবিদার ছিল না বলে বেওয়ারিস ঘোষণা করা হয়েছিল। ডিসেকশন হলে সেইসব কয়েকটা ডেডবডি দেখে আমাদের অনেকেরই রাতের ঘুম চলে গিয়েছিল বেশ কিছুদিন।
আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে বেশ সময় লেগেছিল। ইতিমধ্যে ঘোষণা হল আমাদের পরীক্ষা নেওয়া হবে। থিয়োরীর সঙ্গে প্র্যাকটিকাল হবে। তাই দুই বন্ধু মিলে ঠিক হলো রাতের বেলায় সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমরা দুইজনে ডিসেকশন হলে গিয়ে প্রাকটিকালটা ঝালিয়ে নেবো। কিছু উৎকোচ দিয়ে অভিরামদাকে হাত করে নিয়েছিলাম। রাতের বেলায় সবাই ঘুমিয়ে পড়লে ডিসেকশন হল খুলে দেবেন। আমরা যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি কাজ সেরে ফিরে আসবো হোস্টেলে। যেদিন ঠিক হয়েছে তার দুদিন আগে বন্ধুটি বললো তাকে একবার বাড়িতে যেতে হবে জুরুরী ডাক এসেছে। তবে পরের দিনই ফিরে আসবে।
নির্দিষ্ট দিনে বন্ধুটার দেখা মিললো না জেনে আমিই ঠিক করলাম একাই যাবো। রাতের বেলায় ডিসেকশন বক্স হাতে নিয়ে একাই চললাম এ্যানাটমি হলের ডিসেকশন রুমের দিকে। হলের মুখে দেখলাম বন্ধুটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। মুখটা শুকনো। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। চোখের কোটরটা বসে গেছে। ‘কি রে তুই?’ কখন এলি?
‘এই তো কিছুক্ষণ আগে’। সোজা হলে চলে এসেছি। হোস্টেলে যাওয়ার সময় পাই নি।
বেশ তো? চল ভিতরে ঢুকি।
দেখলাম বেঞ্চিতে যথারীতি চাদর মুড়িয়ে শুয়ে রয়েছেন অভিরামদা।’ ও অভিরামদা, ডিসেকশন হলটা খুলে দাও, আমরা এসে গেছি’। চাদরে ঢাকা মুখ না খুলে একটু নাকি স্বরে বলে উঠলো, ‘যাঁও নাঁ ভেতরেঁ, দরজাঁ খোলাঁ আছেঁ’। প্রথমটা তাঁর কথার গুরুত্ব না দিয়ে আমরা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম’। ভাবলাম আজ বুঝি জলের মাত্রাটা বাড়িয়ে দিয়েছে অভিরামদা। এমনি তো সারাদিনের বেশির ভাগ সময়ই সুরাপানে মত্ত থাকে, আজ হয়তো উপরি পাওয়ায় চড়িয়েছে বেশি করে।
নিওনের আলোয় হলঘরটা ঝকমক করছে। টেবিলে টেবিলে সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে ডেডবডিগুলো। কোনটায় একটা পা, কোনটায় একটা হাত, কোনটায় বা পেটের অংশ, শুধুমাত্র বুকের অংশ আবার কোন টেবিলে শুধুমাত্র মন্ডুটা। সাধারণ লোকে দেখলে ভয়ে আঁতকে উঠবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ডাক্তারি ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিদিন একই জিনিস দেখতে দেখতে অভ্যস্হ হয়ে পড়ে। মনে তেমন কোন বিকার দেখা যায় না। এরমধ্যে কিছু ছাত্র-ছাত্রী যে পাওয়া যায় না এমনটা নয় যাদের মধ্যে ছুঁচিবাই স্বভাব থেকেই যায়। হাত ধুয়ে চলেছে তো চলেছে। এছাড়া যখন তখন হাত ধোওয়ার মানসিকতা তাকে আচ্ছন্ন করে যাকে ডাক্তারি শাস্ত্রে বলা হয় ওসিডি বা অবসেসিভ কমপালসিপ ডিসওর্ডার।
আমি ও বন্ধুটা চটপট একটা নির্দিষ্ট টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কাজ শুরু করে দিলাম। মাঝে মাঝে আড়চোখে বন্ধুটার কাজ দেখে কিছুটা চমকে যাচ্ছিলাম। যখন ও ছুরি ও স্ক্যালপেল নিয়ে কাটা-ছেঁড়া করতে যাচ্ছে দেখি ওর হাতের আঙ্গুলগুলো হঠাৎ করে অস্বাভাবিক লম্বা হয়ে যাচ্ছে। তখন ওদিকে মাথা না ঘামিয়ে যখন আমি একমনে ডিসেকশনের কাজ করে চলেছি হঠাৎ যেন কে আমার গায়ে হাত দিল। কি ঠান্ডা শীতল পরশ! চমকে পেছন ফিরে কাউকে দেখতে না পেয়ে মনের ভুল ভেবে আবার কাজে মন দেবো ভাবছি, সেই সময় পাশের টেবিলে যেখানে বন্ধুটা কাজ করছিল, ওকে দেখতে না পেয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করছি, হঠাৎই দেখি অভিরামদা টলতে টলতে এগিয়ে আসছে। উনাকে বন্ধুটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবো ভাবছি ঠিক সেই সময়ে অভিরামদাকে আর কোথাও দেখতে পেলাম না। কি ব্যাপার! আমার দিকেই তো আসছিলেন অভিরামদা। হঠাৎ কর্পুরের মতন কোথায় উবে গেলেন? বন্ধুটা বা কোথায় গেল? এই সময়ে আবার পিঠে সেই হীমশীতল হাতের স্পর্শ!। চমকে পেছন ফিরতেই দেখি অভিরামদা দাঁড়িয়ে আছে। ‘তোমায় খুজছি, বন্ধুটাকে কোথাও দেখতে পেলে’? বলতে বলতে বন্ধুটা হঠাৎ আমার সামনে এসে খিল খিল করে হাসতে আরম্ভ করে দিল। ওর হাসিটা কেমন যেন মনে হল অস্বাভাবিক ধরণের। ‘ এত হাসির কি আছে? তুই বা কোথায় ডুব দিয়েছিলিস?
ওর উত্তর শোনার আগে অভিরামদা বলে উঠলেন, ‘বাবুসোনা আর এই ঘরে থেকো না, এখুনি বেরিয়ে যাও’। ‘কেন স্যারেরা কি জেনে গেছে যে কেউ হলে ডিসেকশন করছে?
আমার কথা শেষ হওয়ার আগে হঠাৎ করে আমার ছুরি, স্ক্যালপেল, ডিসেকশন বক্সটা কে যেন ছোঁ মেরে কেড়ে নিল। দেখি ওগুলো বাতাসে ভাসছে। একটু ভেতরে ভেতরে নার্ভাস হয়ে পড়ছি। কুলকুল করে ঘামছি।
আমার বন্ধুটা হঠাৎ তার দেহের দুগুণ আকারে লম্বা হয়ে সামনে এসে ক্ষণা ক্ষণা কন্ঠে বলে উঠলো, ‘ কিঁ রেঁ অন্যদেরঁ চোখেঁ ধুলোঁ দিয়েঁ ডিসেকশনঁ করছিসঁ নম্বরঁ বেশিঁ পাবিঁ বলেঁ?
আমি বললাম, ‘সেজন্যে তো তুইও এসেছিস আমার সঙ্গে’।
‘আমি আবার কোথায় এলাম’?
‘কেন এই তো সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিস!’
আরে এই আমি সেই আমি নই। আমি তো বাড়ি গিয়ে হঠাৎ করে অজানা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পটল তুলেছি।তোরা খবর পাবি শিগগীর’।
কি আবোল -তাবোল বকছিস?
দেখি সামনে দাঁড়িয়ে অভিরামদা। উনাকে দেখে বললাম, ‘ অভিরামদা, দেখো দেখি তোমার সামনে দিয়ে আমরা দুই বন্ধু ঢুকলাম ডিসেকশন হলে। আর ও বলছে এখন হলে নেই? বলতে বলতে হটাৎ দেখি অভিরামদার শরীরটা বিরাট লম্বা হয়ে ডিসেকশন হলে ছাদ বরাবর মাথা ঠেকে যাওয়ার উপক্রম। ওই শরীর দেখে আর মাথা ঠিক রাখা গেল না। ভয়ে কাঁপতে লাগলাম। হাত-পায়ে খিল ধরার উপক্রম। সেই সময়ে শুনতে পেলাম অভিরামদা আর বন্ধুটা বিকট স্বরে হাসাহাসি করছে। সেইসঙ্গে আমার স্ক্যালপেট, ছুরি সব হাওয়ায় উড়ছে। আর ডিসেকশন হলের টেবিলে রাখা খন্ডিত ডেডবডির অংশগুলো কাটা হাত, কাটা পা, কাটা মন্ডু, কাটা ধড়গুলো সব শূণ্যে ভাসছে। আর মর্গের সব ভীবৎস কদাকার ট্রেন এ্যাক্সিডেন্টে মৃত বডিগুলো সব সামনে এসে খিলখিল করে হাঁসছে। এসব দেখে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। এরপরে জ্ঞান ফিরে দেখি হাসপাতালের স্টুডেন্ট ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছি। আমার রুমের বন্ধুরা আমায় না পেয়ে খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে ডিসেকশন হলের মধ্যে আলো জ্বলতে দেখে অভিরামদার খোঁজ শুরু করে। ওর কোয়ার্টারসে গিয়ে জানতে পারে সেদিনই অত্যধিক সুরাপানের জন্যে হৃৎরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। বডি হাসপাতাল থেকে বাড়িতে এনেছেন আত্মীয়েরা শবদাহের জন্যে। বন্ধুরা এরপরে ডিসেকশন হলে আমাকে অজ্ঞান অবস্হায় পড়ে থাকতে দেখে ধরাধরি করে এনে স্টুডেন্ট ওয়ার্ডে ভর্তি করে দেয়। তারপরের ঘটনা আরও চমকপ্রদ। যে বন্ধুটা আমার সঙ্গে ডিসেকশন হলে গিয়েছিল তার বাড়ির লোকেরা কলেজের প্রিন্সিপাল স্যারকে জানিয়েছেন হঠাৎ করে অজানা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনা।
সবটা জেনে শুধুই চুপ করে থাকলাম। কেননা ওইদিনের সেই ভীবৎস ঘটনার স্বাক্ষী তো আমি নিজেই। আর কাউকে শেয়ার করার সাহস পেলাম না। এরপরে সুস্হ হয়ে ডিসেকশন হলে গেছি। একা যাই নি। বন্ধুদের সঙ্গে গিয়েছি। কিন্তু দিনের আলোয় কাজ সেরে চলে এসেছি। যতক্ষণ থাকতাম হলে সব সময় কেমন একটা গা ছমছমেভাব ও আড়স্টতা আমাকে গ্রাস করে থাকতো।
[বানানবিধি/মতামত লেখকের নিজস্ব]
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।