হাতেখড়ি – ১
পুরোহিত মশাই নতুন শ্লেটের ওপর সাদা চকটা রেখে কালো শ্লেটটা ধরে একবার সরস্বতী ঠাকুরের পায়ে ঠেকিয়ে নিজের মাথায় ঠেকালেন আর তারপর ঠেকালেন পাশে বসা হলুদ শাড়ি পরা বাচ্চা মেয়েটার মাথায়, তারপর বললেন – ‘কি নাম মা তোমার?’
উত্তর এল – ‘ছুচিসমিতা।’
-‘বাব্বা, নামের বাহার তো খুব!’ বলে ঠোঁট ওলটালেন আপন খেয়ালে। তারপর ‘দেখি’ বলে বাচ্চাটার কচি আঙুলের ফাঁকে চকটা গুঁজে নিজের হাত দিয়ে বাচ্চাটার হাত ধরে বাচ্চাটার কপালে ঠেকিয়ে হাতটা শ্লেটের ওপর ঠেকালেন আর লেখালেন – ‘অ’ আর তারপর একটু থেমে ঠিক তার নীচের লাইনে – ‘জয় মা সরস্বতী।’ পুরোহিত মশাইয়ের হাত ধরেই এসব করে ফেলল ছোট্ট শুচিস্মিতা।
এরপর পুরোহিত মশাই বললেন, – ‘এবার হাত জোড় করে ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে বল, জয় মা সরস্বতী, আমায় বিদ্যা দাও, বুদ্ধি দাও মা।’
পুরোহিতের কথা শুনে বাচ্চাটা হাত জোড়া করতে করতে বলল, – ‘আমার মা তো!’
বৃদ্ধ পুরোহিত অবাক হয়ে বললেন, কোথায় তোমার মা? বাচ্চা মেয়েটা দূরের দিকে হাতের ইশারা করতেই আটপৌরে ডুরে শাড়ি পরা এক বছর ত্রিশের মহিলা এগিয়ে এলেন। ক্ষণিকের দৃষ্টি বুলিয়ে বৃদ্ধ বললেন, -‘খুব ভাল দিনে মেয়ের হাতেখড়ি দিলে মা। তোমার মেয়ের নামটাও তো খুব সুন্দর — ‘শুচিস্মিতা’, কে দিল গো এত সুন্দর নাম?’
-‘আমি যে বাড়িতে রান্নার কাজ করি সেই বাড়ির বড়মা। জন্ম থেকেই ওকে খুব ভালবাসে।’
একটু থেমে ঠাকুরমশাই বললেন, ‘আজকাল তো কেউ আর সরস্বতীপুজোর দিনে হাতেখড়ি করায় না। খুব ভাল করলে মা।’
-‘হ্যাঁ, বড়মাই বলল, ‘আজকেই হাতেখড়ি দে। আজ হাতেখড়ি করলে পড়াশোনা শিখবে।’ আসলে আমি তো পড়াশোনা শিখতে পারিনি, তাই ভাবলাম যদি মেয়েটার একটু হয়।’
অভয় দিয়ে পুরোহিত বললেন, ‘এই বুড়োর কথায় ভরসা রাখ মা, দেখবে তোমার এই মেয়েই একদিন তোমার নাম উজ্জ্বল করবে। তারপর একটু থেমে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তা মা, তোমার নাম কি?’
-‘সরস্বতী, ঠাকুরমশাই।’
হাতেখড়ি – ২
ডোরবেলটা বাজতেই চায়ের কাপটা হাত থেকে টেবিলে নামিয়ে খবরের কাগজ থেকে চোখ সরাতে বাধ্য হলেন বৃদ্ধ অধ্যাপক অমৃতেশ ভাদুড়ী। একটু পরেই স্নান-খাওয়া সেরে কলেজ যাওয়ার তাড়া। লকডাউনের পর আজই প্রথম অফলাইন ক্লাস নেবেন। ফলে বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে?’
দরজার ওপার থেকে অনেকগুলো শিশুকণ্ঠের উত্তর এল, ‘আমরা’।
-‘আমরা কারা?’
-‘সরস্বতীপুজোর চাঁদাটার জন্যে এসেছিলাম।’
বিরক্ত অমৃতেশবাবু উত্তর করলেন, ‘পরে এসো।’
ওপার থেকে সমস্বরে উত্তর এল, ‘দাদু দরজাটা একবার খুলুন। আমরা পড়েই এসেছি।’
বাথরুম থেকে স্ত্রীর কণ্ঠ ভেসে এল, ‘বাচ্চাগুলো কালও এসেছিল। ওদের ফিরিয়ো না গো আর। ওদেরই পুজো তো!’
স্ত্রীর কথা আর বাইরের ‘পড়ে এসেছি’ শব্দাঘাতে এত ব্যস্ততার মধ্যেও দরজাটা খুলতে গেলেন প্রবীণ মানুষ অমৃতেশবাবু। দরজা খুলেই অবাক হলেন তিনি। কারোর বয়সই দশের বেশি নয়। একজনের বছর বারোর কাছাকাছি হবে বোধহয়। প্রত্যেকের হাতে পায়েই খড়ি ওঠা, চামড়ার ওপর ধুলোর আস্তরণ। হাতে দোকানের কেনা বিলবই।
দজা খুলতেই রোগা মতন একটা কালোছেলে চটজলদি বলে উঠল, ‘দাদু নিজের নাম, স্কুলের নাম আর সরস্বতী বানান বলব? মুখস্থ করে এসেছি। বলব?’
এতদিনের অধ্যাপক জীবনে ভাল ছাত্রের বেকায়দা প্রশ্নেও এতটা ঘাবড়াননি অমৃতেশ, যতটা আজ ঘাবড়ালেন। একটু সামলে বললেন। ‘আমি কী জিজ্ঞাসা করেছি নাকি তোদের?’
ছেলেটা মুহূর্তে উত্তর করল, ‘না, সবাই চাঁদা দেওয়ার আগে ওগুলো জানতে চায় তো! শুধু সরস্বতীপুজোর চাঁদা চাওয়া বাচ্চা দেখলেই বানান জিজ্ঞাসা করে দেখবেন। দুর্গা-কালি-জগদ্ধাত্রী, শেতলা পুজোর চাঁদা তোলা কাকুদের করে না কিন্তু। সসস্বতীপুজোর আগে পরীক্ষা নিতে কে বলেছে কে জানে!’
উত্তর শুনে মনে মনে হেসেই ফেললেন অমৃতেশ। বললেন, ‘ লেখ, পঞ্চাশ টাকা।’
পাকা ছেলেটা অবাক হয়েই বলল, ‘এটা তো জানি না! কাল আসব? বাড়ি থেকে মুখস্থ করে আসব কথা দিচ্ছি।’
উত্তর শুনে হাসতে হাসতে অধ্যাপকমশাই পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার নোটটা হাতে নিয়ে বললেন, ‘চাঁদার খাতায় টাকা লেখার ঘরে পাঁচ আর শুন্য লিখতে বলেছি। বানান নয়।
-‘এত টাকা কেন দিচ্ছ তুমি?অন্য বানান জিজ্ঞেস করবে? না অন্য পড়া?’ একটা ফর্সা মতন সুন্দর ছেলে জিজ্ঞাসা করল।
আরও জোরে হাসতে হাসতে অধ্যাপকমশাই বললেন, – ‘ ওরে, নারে বাবা, কোনো পড়া আমি নেব না। তোদের আমার ভাল লেগেছে, তাই দিচ্ছি।’
ওদের মধ্যের বড়ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করল, ‘আপনাদের বাড়িতে বাচ্চা কেউ নেই, না?’
এমন তীরবেঁধা প্রশ্নে প্রায় তোতলা হয়ে গেলেন দুঁদে নিঃসন্তান অধ্যাপকমশাই। তবুও রাগ না করেই পুরোটা বুঝতে প্রশ্ন ছুঁড়লেন। ‘কেন বল তো?’
ছেলেটা সরল মনেই বলে উঠল, ‘না যাদের বাড়ির বাচ্চারা বাইরে থাকে তারা আবার একটু বেশি দেয় আমাদের বাচ্চা মনে করে। আমরা নিই না।’
-‘কেন?’ অনেকটা সামলেছেন নিজেকে অধ্যাপক।
-‘এটা আমরা সবাই সঙ্ঘের পুজো। কারোর একার নয় না, না?’
বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা অধ্যাপকমশাইয়ের। তবু অসহায় কণ্ঠে বললেন, ‘কেউ বলে দিয়েছে?’
লম্বা ছেলেটা বলল, ‘আমার মা। কারো একার না, সবার পুজো করতে হবে।’
-‘তাহলে নিবি না?’ অমৃতেশের শেষ জিজ্ঞাসা।
-‘না’।
ছেলেটার এই না শব্দের জোরে কিভাবে যেন হাতের নোটটা পকেটে ঢুকে একটা দশটাকার নোট টেনে আনল আঙ্গুলগুলো নিজের অজান্তে। বিলটাও কখন হাতে চলে এল খেয়াল করেননি। উদাস দৃষ্টিতে দরজাটা ধরে তাকিয়ে ছিলেন ওদের চলে যাবার পথের দিকে। স্ত্রীর কণ্ঠে সম্বিত ফিরল, ‘কী হল?’
অমৃতেশ এলায়িত কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘হাতেখড়ি’।
-‘কার গো’? স্ত্রী উদ্বিগ্ন কণ্ঠের প্রশ্ন।
-‘আমার কথার আর আমার ভাবনার।’
[বানানবিধি/মতামত লেখকের নিজস্ব]
Tags: গল্প, দেবাশিস মজুমদার, হাতেখড়ি
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।